#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_১৫
লিখা: Sidratul Muntaz
“আমাকে কি পিষে ফেলতে চাইছেন? শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলবেন?”
ইলহান অরিনকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ইলহানের মুখে স্নিগ্ধ খুশির রেশ ফুটে উঠেছে। চোখ দু’টো চকচক করছে। সে অরিনের হাত দু’টো নিজের হাতে নিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। অতঃপর হাঁটু গেড়ে বসে অরিনের চোখে দৃষ্টি স্থির রেগে পরিতৃপ্ত গলায় বললো,
” ভালোবাসি অরি, আমার বিনাশীনি! অনেক, অনেক ভালোবাসি।”
ইলহান পরম আবেশ নিয়ে চোখ বন্ধ করে অরিনের দুইহাতের উল্টোপিঠে দুইবার করে চুমু দিল। অরিন ধরে আসা কণ্ঠে বললো,
” আমি বিনাশীনি? কি বিনাশ করেছি আপনার?”
ইলহান চোখ তুলে তাকিয়ে স্থিরচিত্তে অরিনের হাতটা নিজের বুকের বামপাশে ছুঁইয়ে শীতল কণ্ঠে জবাব দিল,” হৃদয়!”
অরিন অজান্তেই কেঁপে উঠলো। ইলহানের হাত থেকে নিজের হাত ছাঁড়িয়ে নিল। তারপর পেছন ফিরে চোখের জল আড়াল করার চেষ্টা করলো। অরিনের অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এই অনুভূতির নাম ভালোবাসা না। তবে এই প্রথম ইলহানের জন্য তার সর্বানাশা এক মায়াময় অনুভূতি হচ্ছে৷ যেই অনুভূতি ভেতর থেকে দারুণভাবে গ্রাস করে ফেলছে তাকে। খুব নিমেষে, স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রখর ভাবে! আচ্ছা, কারো প্রতি মায়া থেকে কি ভালোবাসার জন্ম হতে পারে? ইলহান উঠে দাঁড়িয়ে বললো,” কাঁদছো কেনো অরিন? দেখো আমি একদম ঠিকাছি। শুধু কয়েকদিনের জন্য ছন্নছাড়া হতে ইচ্ছে করেছিল। দেখতে চেয়েছিলাম, আমার অনুপস্থিতিতে কেউ কতটুকু উদগ্রীব হতে পারে। বলতে খারাপ লাগলেও এইটা সত্যি যে তোমাকে কাঁদতে দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। আমার হারিয়ে যাওয়া তোমাকে এতোটাই অস্থির করে তুলেছে যে তুমি পাগলের মতো এতোদূর পর্যন্ত ছুটে এসেছো। তাও নাকের পানি চোখের পানি একাকার করে কাঁদতে কাঁদতে। অরিন, ভালোবাসা না থাকলে এটা কখনও সম্ভব না। এখনও কি তুমি অস্বীকার করবে অরিন? এখনও কি তুমি বলবে যে তুমি আমাকে ভালোবাসো না? বললেও আমি কিন্তু আর তোমার কথা বিশ্বাস করছি না।”
ইলহান কৌশলপূর্ণ হাসি দিল। ইশশ, কত আকাঙ্খা ওর চোখে-মুখে! অরিনের ভীষণ মায়া লাগছে। অন্যসময় হলে সে কঠিন মুখ করে ঠিকই বলে দিতো,
” আপনার জন্য নয়। আমি এইখানে এসেছি আত্ম অপরাধ মোচন করতে। আপনার বাবাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি হয়তো মৃত্যু পথযাত্রী। সারাজীবন যেনো নিজের কাছে নিজেকে দোষী হয়ে থাকতে না হয় তাই আমি আপনাকে খুঁজতে এসেছি। নয়তো আপনার মতো হাজারটা ইলহান হারিয়ে গেলেও অরিনের কিচ্ছু যায়-আসে না!”
অরিন এই কথা বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। কিছু একটা আটকে দিচ্ছে তাকে। অরিন কেনো শক্ত হতে পারছে না? তার এই দূর্বলতার কারণ কি শুধুই অপরাধবোধ? নাকি অন্যকিছু? ইলহান অরিনের কাছে এসে ওর দুই কাঁধ চেপে ধরলো। ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর চোখের জল মুছে দিল। তারপর নিজেই অরিনের ঠোঁটের দুই কার্নিশে আঙুল রেখে ঠোঁটটা প্রসারিত করে বললো,
” আর কান্না না, এখন থেকে শুধু হাসবে। হাসলে তোমাকে মায়াপরী লাগে।”
ইলহান এই কথা বলেই অরিনের কপালে চুমু দিল। অরিন একটুও বারণ করতে পারলো না। শুধু ভাঙা গলায় বললো,
” কাউকে কিছু না জানিয়ে এভাবে লাপাত্তা হওয়া আপনার উচিৎ হয়নি। অন্তত বাড়ির লোকের কথা চিন্তা করতে পারতেন। তারা আপনার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিল।”
” আর তুমি?”
অরিন প্রশ্নটা এড়াঁনোর উদ্দেশ্যে বললো,” এখন কি আপনি বাড়ি ফিরে যেতে চান? নাকি এভাবেই ছন্নছাড়া হয়ে সারাজীবন মানুষকে পাগল করে বেড়াবেন বলে ঠিক করেছেন?”
ইলহান হেসে বললো,
” যাবো। কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে।”
” শর্ত মানে? বাড়ি ফেরার জন্য শর্ত?”
” শুধু তোমার জন্য শর্ত। শর্ত নাম্বার এক, সবসময় আমার ফোন ধরতে হবে। দিনে কমপক্ষে তিনঘণ্টা আমার সাথে মোবাইলে কথা বলতে হবে। কথা ম্যাসেজেও হতে পারে, কলেও হতে পারে। তোমার যেভাবে সুবিধা হয় সেভাবে বলবে। কিন্তু কথা বলতেই হবে। দুই, আমার যখন দেখা করতে মন চাইবে, আমি চলে আসবো। তোমাদের এলাকায় অথবা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবো। তুমি নিচে আসবে নয়তো বারান্দায়। কখনও নিষেধ করতে পারবে না। আর মোস্ট ইম্পোর্ট্যান্ট, সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন আমরা বাহিরে দেখা করবো। ডেইট তুমি জানাবে কিন্তু প্লেস আমি ঠিক করবো। তিন, আমার যখন ইচ্ছা হবে আমি জড়িয়ে ধরবো, কোলে নিবো, কিস করবো, এসব নিয়ে রাগ করতে পারবে না।”
” তিন নাম্বারটা একটু বেশি হয়ে গেল না?”
” চার, আমার সামনে সবসময় এমন গোমরা মুখে থাকা যাবে না। হাসতে হবে। আর কখনও মনখারাপ করে কথা বন্ধ রাখা চলবে না। বরং আরও বেশি করে কথা বলে সম্পূর্ণ মনখারাপ আমার উপর ঢেলে দিতে হবে। আমার কোনো ব্যবহারে কষ্ট পেলে সরাসরি আমাকেই বলবে। নিজের মধ্যে জমিয়ে রাখবে না। পাঁচ, সাদা জামায় তোমাকে দারুণ লাগে। বেশি বেশি সাদা রঙের জামা পড়বে।”
” আমরা কি রিলেশনে যাচ্ছি?”
” উহুম, সারাজীবন একসাথে চলার অঙ্গীকার করছি।”
অরিনের মনে হলো, সে মস্তবড় ভুল করেছে। এইখানে এভাবে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসার কোনো দরকার ছিল না। অরিনের উচিৎ ছিল নিজে না এসে শুধু ভাইয়াকে পাঠানো। সে ইলহানকে নিয়ে হসপিটালে চলে গেলেই হতো। অরিন কেনো আসলো? এখন যে ইলহান তাকে নিয়ে ভুল-ভাল স্বপ্ন দেখছে। অরিনের সাহস হচ্ছে না ইলহানের এই স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার। হঠাৎ করে ওর মনটা এতো নরম কি করে হয়ে গেলো? অরিন আগের মতো কাঠখোট্টা সাজার যথাসাধ্য চেষ্টা করে বললো,
” আমি আপনার সাথে কোনোপ্রকার সম্পর্ক করতে আগ্রহী নই।”
” তোমার চোখ দেখে তো সেটা মনে হচ্ছে না।”
অরিন হকচকিয়ে উঠলো। আসলেই কি তাই? অরিন কি তবে নিজের মনের কথা নিজেই বুঝতে পারছে না? নাকি ইলহান মিথ্যে বলছে? অরিন বললো,
” এতো কথা শুনতে চাইনি। আমি আপনার কোনো শর্ত ফর্ত মানতে পারবো না। আপনি আমার সাথে এখান থেকে চলুন আগে।”
” শর্ত না মানলে আমিও যাবো না।”
” ব্ল্যাকমেইল করছেন?”
” করছি। আমি বরং শর্তগুলো তোমাকে লিখে দেই। তুমি সময় নিয়ে ভেবে আমাকে জানাও। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। শুধু উত্তর হ্যাঁবোধক হলেই হবে।”
ইলহান একটা প্যাড আর একটা কলম নিয়ে টেবিলে বসলো। গোটা গোটা অক্ষরে শিরোনাম লিখলো, ‘শর্তনামা।’ অরিন তীক্ষ্ণ মেজাজী কণ্ঠে বললো,
” আপনার বাবা হসপিটালে ভর্তি। ছয়ঘন্টা ধরে লাইফ সাপোর্টে আছেন। তবুও কি আপনি যাবেন না?”
ইলহানের লেখা থেমে গেল। সে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে ভ্রু কুচকে বললো,
” হোয়াট?”
” হুম। সিএমএইচে ভর্তি আঙ্কেল। শ্যানিন ফোন করে আমাকে এসব না জানালে আমি কখনোই এখানে আসতাম না। আঙ্কেল এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আপনি ওখানে গেলে হয়তো তাঁর সুস্থ হওয়ার আশঙ্কা একটু হলেও বাড়বে। আমি এজন্যই আপনাকে নিতে এসেছি। আমি চাই না, আমার জন্য কারো..”
অরিন তার কথা শেষ করতে পারলো না। ইলহান ঝড়ের বেগে বিছানা থেকে কালো জ্যাকেট নিয়ে সেটা পরতে পরতে বের হয়ে গেল। অরিন তাড়াহুড়ো করে বললো,
” শুনুন আমি আপনার সব শর্তে রাজি।”
ইলহান ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। অরিনের শেষ কথাটা কি সে শুনতে পেয়েছে?
অর্ণভ ধমক দিয়ে বলে উঠলো,” আপনি কি শুরু করেছেন ভাই? বলছি তো আমি চা খাবো না।”
” তাহলে সিনেমা দেখেন। ও চাচা, টিভির সাউন্ডটা একটু বাড়িয়ে দেন। ডায়লগ শোনা যাচ্ছে না।”
” আমি চায়ের দোকানে বসে সিনেমা দেখবো কেনো? ”
” তাহলে কি সিনেমাহলে গিয়ে দেখবেন?”
” আমার বোন যেখানে আছে আমি সেখানে যেতে চাইছি।”
” ওইখানে আরও বড় সিনেমা চলে। সেই সিনেমা দেখার চেয়ে ভালো আমি চা খাই আপনি দেখেন।”
নাসির বড় বড় করে চায়ে চুমুক দিতে লাগলো। একবার মুখ কুচকে বললো,” চা টা বেশি গরম।”
অর্ণভ ‘ধুত্তুরি’ বলে বেঞ্চে একটা লাথি মারলো। তার মেজাজ চায়ের থেকেও বেশি গরম হয়ে আছে। বেঞ্চ নড়ে উঠায় নাসিরের শার্টে কিছুটা চা ছিটকে পড়লো। সে মৃদু হেসে বললো,
” বড়ভাই কি রাগ করলেন?”
অর্ণভের হাত শক্ত হয়ে আসলো নাসিরের নাক বরাবর ঘুষি মারার জন্য। কিন্তু কাজটা সে করতে পারলো না। এর আগেই ইলহান চলে আসলো৷ সে খুব অস্থির হয়ে বললো,
” নাসির উঠ, এখনি আমাদের সিএমএইচ যেতে হবে।”
” ঘটনা কি?”
” আরে বেটা ঘটনা বলার টাইম নাই। চল আগে।”
ইলহান খুব জলদি নাসিরকে নিয়ে রিকশায় উঠে গেল। অর্ণভ একাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। একটু পর অরিন এসে বললো,
” ভাইয়া, ওরা কোথায় গেছে?”
” শুনলাম সিএমএইচ যাচ্ছে।”
” তাহলে চলো আমরাও যাই।”
” ওখানেই কি শ্যানিনের বাবা এডমিট?”
” হ্যাঁ ভাইয়া।”
” এরা শ্যানিনদের কি হয়?”
” একজন শ্যানিনের ভাই আরেকজন তার বন্ধু।”
অর্ণভ মনে মনে ভাবলো, এই সুন্দর ছেলে যদি শ্যানিনের ভাই হয় তাহলে তো সে শায়িখ সাহেবের ছেলেই হবে। আবার রামছাগলের মতো দাড়িওয়ালা ছেলেটা বললো সুন্দর দেখতে ছেলেটা নাকি অরিনের জন্য রোমিও। এদিকে অরিন আবার শায়িখ সাহেবের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অস্থির। মা-ও তো বললো শায়িখ সাহেব অরিনের জন্যই অসুস্থ হয়েছেন। অসুস্থ অবস্থায় তিনি আবার অরিনকে দেখতেও চেয়েছেন। সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে অর্ণভের কাছে। মানে একই মেয়ের জন্য বাপ অসুস্থ, ছেলে রোমিও। হায় হায়, শেষমেষ কি তাহলে এক মেয়েকে নিয়েই বাপ-ছেলের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যাবে? অরিন কি যুদ্ধ লাগাতে যাচ্ছে?
চলবে
(এসাইনমেন্টের চক্করে গল্প লিখতে পারছি না। অনেক কষ্ট!)