মেঘের পরে রংধনু পর্ব-১৪

0
1199

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_১৪
লিখা: Sidratul Muntaz

ফ্যানের ঘূর্ণনটাও এখন বিরক্তিকর লাগছে অরিনের কাছে। তার শরীরের রগে রগে অদ্ভুত এক অস্থিরতা ঢুকে পড়েছে। ভয়ংকর এক অনুভূতি হচ্ছে। শ্যানিনের কণ্ঠস্বর মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অরিন একই কথা বার-বার শুনতে পাচ্ছে।
‘ তোর মতো বেস্টফ্রেন্ড থাকা অভিশাপ। তুই একটা পাষাণ৷ ভাইয়া তো চলেই গেছে, বাবাও মরে যাচ্ছে। তুই ভালো থাকিস এবার।’
সত্যিই কি অরিন এমন চেয়েছিল? তার জন্য একটা পরিবার ভেসে যাক এটা তো সে কোনোদিন চায়নি। শ্যানিনের বাবা যদি সত্যিই মারা যান? অরিন কি তাহলে খুনী হয়ে যাবে? উফফ, কি হচ্ছে এসব তার সাথে? অরিনের এমন অসহ্য আগে কখনও লাগেনি। সে কিচ্ছু ভাবতে পারছে না। মিহরীমা মোবাইল হাতে পেয়েই কান্না থামিয়ে দিয়েছে।সে এখন ইউটিউব বের করে গান দেখতে বসেছে। মেয়েটা ঠিকমতো দুই শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। কিন্তু ইউটিউব খুলে ডাউনলোড অপশন থেকে কিভাবে গান বের করতে হয় সেটা ভালোই পারে। অরিন মিহরীমাকে বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়ালো। অস্থিরভাবে ঘরময় পায়চারী করতে লাগলো। নিজেকে খুব বড় অপরাধী মনে হচ্ছে তার। ঠিক এই সময় অর্ণভ, নৌশিন আর নিশিতা চলে আসলো। ওরা ঘরের দরজা আটকে খুব প্রস্তুতি নিয়ে বিছানায় গোল হয়ে বসে গেল। ওদের ভাব-সাব দেখে মনে হচ্ছে খুব জরুরী আলাপ করতে এসেছে। অরিন প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। নিশিতা বললো,
” অরিন, এদিকে বোস। আমাদের কথা শোন।”
অরিনের চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো,” আমার এখন কিচ্ছু শুনতে ইচ্ছে করছে না। দোহাই লাগে তোমরা এই ঘর থেকে বের হয়ে যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”
অরিন জানে না তার কেনো এতো কষ্ট লাগছে? মনে হচ্ছে তার বুকভরে কেউ বিষাক্ত গ্যাস ঢুকিয়ে দিয়েছে। অরিন শ্বাস নিতে গিয়েও ক্লান্ত হয়ে পড়ছে! নৌশিন বললো,
” অরিন, তুই কি আমাদের সাথে যাবি?”
” কোথায়?”
” অর্ণভ ভাইয়া নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া করেছে। বিয়ের পর সুমনাকে নিয়ে থাকার জন্য। ”
অর্ণভ কড়া গলায় বললো,” ওই, ভাবী বল।”
” স্যরি, সুমনা ভাবী।”
নিশিতা মুখে পেচকী কেটে বললো,” আমারও কি এখন সুমনাকে ভাবী ডাকতে হবে?”
অর্ণভ নিচের ঠোঁট কামড়ে কঠিন চোখে বললো,” অবশ্যই।”
” ইউউ! প্লিজ, প্লিজ, এইটা আমি পারবো না। ”
” তুই পারবি না মানে? তোর ঘাঁড় পারবে। নাহলে কিন্তু তোর ওই ডেলিভারিবয় খোঁজার কিচ্ছায় আমি নেই।”
নিশিতার মুখের অবস্থা দেখে মনে হলো যেনো কেউ ওর মুখে কেঁচো ঢুকিয়ে দিচ্ছে। অরিন বললো,
” এর মধ্যে তুমি ফ্ল্যাটও ভাড়া করে ফেললে ভাইয়া? এতো তাড়া কিসের?”
” আরে, খালু বিদেশ থেকে ফিরলেই তো বাসন্তী খালা বিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়ো শুরু করবে। হাতে বেশি সময় কি আছে? আগে থেকে সব রেডি করে না রাখলে পরে তো ঝামেলা হবে। নতুন বউ নিয়ে তো আর রাস্তায় থাকতে পারবো না। আর তোর হিটলার বাপও কি আমাকে ঘরে টিকতে দিবে?”
” আমার বাবা কি তোমার বাবা নয়? শুধু আমার বাপ কেনো বলছো?”
অর্ণভ নিশিতার দিকে তাকিয়ে বললো,” শোন, আমার বেতন তো আর লাখটাকা না। তাই খুব ছোট্ট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। একরুম মাত্র। পাশের রুমে অন্য মানুষ থাকবে। তুই কি বলিস?”
” অন্যমানুষ থাকবে কেনো? আমি নিজেই তো আমার ডেলিভারিবয়কে নিয়ে তোমাদের পাশের ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে পারি। সবাই একসঙ্গে থাকলাম। মাঝে মাঝে নৌশিন আর অরিন আমাদের নতুন সংসারে বেড়াতে আসবে। ভালো হবে না?”
নৌশিন গালে হাত রেখে বললো,” আচ্ছা নিশু আপু, তোমার ডেলিভারিবয়কে দেখতে কেমন? চেহারার একটু বর্ণনা দাও তো।”
নিশিতা চোখ রাঙানো দৃষ্টিতে বললো,” তোর এতো আগ্রহ কেনো রে? তখন থেকে বার-বার এক কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিস। আরেকবার এই প্রশ্ন করলে ঠাস করে একটা চড় খাবি।”
নৌশিনের মুখ চুপসে গেল। তার ডেলিভারিবয়ের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু কেনো যেনো তার মনে হচ্ছে ইলহানের সাথে অরিনের বিয়েটা খুব শীঘ্রই হবে। আবার এটাও মনে হচ্ছে যে ইলহানই নিশিতার ডেলিভারিবয়। যদি সত্যিই এমন হয়, তখন এই দুই বোনের মধ্যে কঠিন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে। নৌশিনের আবার যা মনে হয় বেশিরভাগ সময় তাই ঘটে। যেমন, সেদিন সে ফজরের নামায পড়ার পর মনে হচ্ছিল ঘর থেকে বের হলেই ডেলিভারিম্যানের সঙ্গে দেখা হবে। সত্যি তাই হলো। কিন্তু সেই দেখা হওয়াটা যে এতো ভয়ানক আর অনাকাঙ্ক্ষিত হবে সেটা নৌশিন চিন্তা করেনি। নিশিতা বললো,
” এই অরিন, এবার তুই ঝটপট একটা বুদ্ধি বের করতো। ডেলিভারিবয়কে কিভাবে খুঁজে বের করবো?”
অরিন বিরস মুখে বললো,” একটা কাজ করতে পারো। সেই পেইজ থেকেই আবার পিজ্জা অর্ডার করো। স্পেশাল রিকোয়েস্ট করে বলবে, আগেরবার যে এসেছিল তাকে দিয়েই যেনো পার্সেল পাঠানো হয়৷ তাহলে এক্সট্রা টিপ দিবে। এরপর যখন ওই চাল্লু আসবে, আমরা বেঁধে রেখে তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করবো।”
” চাল্লু মানে?”
” তোমার ডেলিভারিবয়।”
নৌশিন হাতে তালি বাজিয়ে বললো,” ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া! তাহলে অর্ণভ ভাইয়ার বার্থডে আর নিশুআপুর ম্যারেজডে একই দিনে হবে। ওয়াও, খরচও কম লাগবে আবার ডাবল সেলিব্রেশনও হবে!”
নিশিতা ঝারি দেওয়ার মতো করে বললো,” এই চুপ থাক! তোদের কি মনে হয়? যদি এই সুযোগ থাকতো তাহলে আমি এতোদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম? মিনিটে মিনিটে পিজ্জা অর্ডার করতাম। কিন্তু আসল সমস্যা হচ্ছে ওই ডেলিভারিবয় সেদিন থেকেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।”
” হোয়াট?”
” হুম।”
অর্ণভ ফুশ করে হেসে উঠে বললো,” ডেলিভারিবয়ের বুদ্ধি আছে বলতে হবে। আসলেই চাল্লু মাল।”
নিশিতা আঁড়চোখে তাকিয়ে বললো,” কি বলতে চাও তুমি? সে আমার ভয়ে চাকরি ছেড়েছে? কথায় কথায় আমাকে অপমান না করলে তোমার কি পেটের খাবার হজম হয় না?”
অরিন বললো,” আচ্ছা, তাহলে ওদের কাছ থেকে কোনো ইনফরমেশন নিতে পারবে না? যেমন- ছেলেটার নাম, ঠিকানা কিংবা ফোন নাম্বার?”
নিশিতা হতাশ কণ্ঠে বললো,” ওরা এসব কিছুই দিতে চায় না।”
” নাম ছাড়া, ছবি ছাড়া ঢাকা শহরে একটা মানুষকে খুঁজে বের করা কঠিন।”
” তবুও আমি ঠিক করেছি নাবিস্কো গিয়ে ওকে ভালোমতো খুঁজবো। অর্ণভ ভাই, তুমি যাবে আমার সাথে?”
” হ্যাঁ চল। আজকে বিকালেই যাই তাহলে। তুইও আমার নতুন ফ্ল্যাট দেখে আসলি আর নাবিস্কোও ঘোরা হয়ে গেল।”
নৌশিন বললো,” তাহলে কি আমি যাবো না?”
অর্ণভ বললো,” খোঁজাখোঁজির মধ্যে তোদের যাওয়ার দরকার নেই। তোকে আর অরিনকে আমি অন্য একদিন নিয়ে যাবো।”
” ঠিকাছে।”
অরিন ওদের আলোচনায় খুব একটা মনোযোগ দিতে পারলো না। তার হৃদয়ে বিষাক্ত কোনো পোকা কামড় দিয়ে রেখেছে। এই যন্ত্রণার পরিমাণ সীমাহীনপ্রায়। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অরিন নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিল। কোলাহল তার অসহ্য লাগছে। অপরাধবোধ তাকে ভেতর থেকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দিয়েছে! সে শুধু মনে মনে আল্লাহর কাছে একটা দোয়াই করে চলেছে। শায়িখ আঙ্কেল যেনো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়। অর্ণভ আর নিশিতা হাসি-খুশি ভাব নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে গেল। তাই দেখে বাসন্তী মনে মনে ভীষণ খুশি। বিয়ে ঠিক হতে না হতেই এই দু’টোর নব দম্পতির মতো আচরণ শুরু হয়ে গেছে। বাসন্তী যদি পারতেন তাহলে আজকেই ওদের ধরে বিয়ে করিয়ে দিতেন। কিন্তু তাঁর স্বামী জনাব ইউসুফ হক ব্যবসার কাজে সিঙ্গাপুর আটকে আছেন। সামনের মাসে তিনি দেশে আসবেন। বিয়ের আয়োজন তখনি শুরু হবে। কিন্তু তিনি আসার আগেও তো কিছু আয়োজন এগিয়ে রাখা যায়। বাসন্তী অনলাইন থেকে টুকটাক শপিং তো করতেই পারেন। গতকাল রাতেও তিনি একটা অনলাইন পেইজে একটা বিশাল ব্রাইডাল লেহেঙ্গা দেখেছেন। সেটা কিনে রাখলে কেমন হয়? এছাড়া টুক-টাক শপিং তো করাই যেতে পারে। তিনি কি সুমনাকে নিয়ে এখনি একবার শপিং এর জন্য বের হবেন? সুমনা যেটা পছন্দ করে অর্ণভের আবার সেটাই পছন্দ হয়। মেয়েটার রুচি ভালো।

সন্ধ্যায় অরিন আর থাকতে না পেরে মায়ের মোবাইল থেকে আবার শ্যানিনকে ফোন করলো। প্রথমবারে শ্যানিন ফোন ধরেনি। অরিন আরও তিন-চারবার ফোন করলো। শ্যানিন একবারও ফোন ধরলো না। অরিন দুশ্চিন্তায় টিকতেই পারছিল না। ওরা কোন হসপিটালে আছে সেটা জানা থাকলে অরিন এখনি ছুটে যেতো। আধঘণ্টা পর শ্যানিন নিজে থেকেই ফোন দিল। অস্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠে বললো,
” কিছু বলবি?”
অরিন খুব ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করলো,” আঙ্কেল কেমন আছেন এখন?”
” বাবাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। জ্ঞান ফেরার পর কন্ডিশন জানা যাবে।”
অরিনের খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সে জোর করে কান্নাটা চেপে রেখেছে। শ্যানিনের সামনে কান্না প্রকাশ করতেও তার লজ্জা লাগছে। শ্যানিন বললো,
” অরিন, তুই কি বলতে পারবি ভাইয়া কোথায় আছে?”
” আমি কিভাবে জানবো?”
” জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই যদি বাবা ভাইয়াকে দেখতে পায়, তাহলে ডাক্তার বলেছে কোনো মিরাকল হতে পারে। তুই যদি ভাইয়ার খবর জেনে থাকিস তাহলে প্লিজ বলে দে। আমি জানি, ভাইয়া পৃথিবী উল্টে গেলেও তোর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করবে না। তার সাথে নিশ্চয়ই তোর কথা হয়েছে, তাই না? তুই কি তাকে বাবার অসুস্থতার খবরটা একবার জানিয়ে দিবি?”
শ্যানিন ফুপিয়ে কাঁদছে। অরিন গলায় দলা পাকানো কান্নাটা গিলে বললো,” তোরা কোন হসপিটালে আছিস?”
” সিএমএইচ।”
অরিন মোবাইল রেখে দিল। ইলহান কিভাবে তার সাথে যোগাযোগ করবে? সে তো নিজের সিমটাই ফেলে দিয়েছে। অরিন ফ্লোরে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। হালিমা অন্যঘর থেকে ছুটে আসলেন মেয়ের কান্না শুনে। মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে অবাক হয়ে নিজেও ফ্লোরে বসলেন। আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি হয়েছে মা? কাঁদছিস কেনো তুই?”
অরিন মায়ের দুই হাত জাপটে ধরে বললো,” মা, ভাইয়াকে এখনি বাসায় আসতে বলো। শ্যানিনের বাবা হসপিটালে ভর্তি। খুব অসুস্থ তিনি। আমি তাঁকে দেখতে যেতে চাই মা। ভাইয়া কি আমাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে পারবে?”
হালিমা স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। অরিন কেঁদেই চলেছে। এইভাবে তিনি মেয়েকে আগে কখনও কাঁদতে দেখেননি। হালিমা অরিনের হাত ছেড়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেই তো অরিন শ্যানিনদের বাসায় রাত্রীযাপন করতে গিয়েছিল। শ্যানিনের বাবা নাকি অসুস্থ অবস্থায় অরিনকে দেখতে চেয়েছেন। খটকা তো তখনি লেগেছিল হালিমার মনে। আর এখন অরিনের কান্না দেখে তিনি অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেলেন। কিন্তু এই কথা ভেবেই তার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে। তার কালো মেয়েটা শেষমেষ বাপের বয়সী এক বৃদ্ধের প্রেমে পড়লো? তাও আবার বেস্টফ্রেন্ডের বাপ? ছি, ছি, ছি! লোকসমাজে মুখ দেখানোর মতো আর জায়গা রইল না। অর্ণভ বাসায় ফিরতেই হালিমা কাঁদতে কাঁদতে অর্ণভকে সবকিছু জানালেন। অর্ণভ এসব শুনে থতমত খেয়ে গেল। মায়ের কথা সে সহজে বিশ্বাস করে না। অরিনের থেকে আসল ঘটনা জানতে হবে। অর্ণভ অরিনের ঘরে গিয়ে দেখলো তার বোন হাঁটুতে মুখ গুজে গুমরে গুমরে কাঁদছে। অর্ণভ মৃদু গলায় ডাকলো,
” অরিন, কি হয়েছে?”
অর্ণভের কণ্ঠ শুনে অরিন এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে গেল। দুইহাতে চোখ মুছে খুব ব্যস্ত হয়ে বললো,
” ভাইয়া, আমি তোমার সাথে একটা জায়গায় যেতে চাই। এখনি যেতে হবে। প্লিজ আমাকে নিয়ে চলো।”
অরিন কথাগুলো বলতে বলতে ওর হাত ব্যাগ গুছিয়ে নিতে লাগলো। অর্ণভ হতভম্ব হয়ে বললো,
” বান্ধুবির বাবা অসুস্থ বলে তুই এইভাবে মরাকান্না শুরু করেছিস? স্বামী মারা গেলেও তো মেয়েরা এতো কাঁদে না।”
অরিন মাথা নিচু করে ভালোমতো চোখ মুছল। অর্ণভ বললো,” আচ্ছা থাক, কাঁদিস না। আমার বান্ধুবি বিথীর কথা মনে আছে তোর? সেও নিজের থেকে বিশ বছরের সিনিয়র জামাই বিয়ে করেছিল। এসব আজ-কালকের যুগে কোনো ব্যাপার না। শ্যানিনের বাপের বয়স কত রে?”
অরিন নিস্তেজ গলায় বললো,” ভাইয়া, এসব তুমি কি বলছো?”
” আচ্ছা বাদ দে। আগে চল হসপিটালে যাই।”
” আমি হসপিটালে যাবো না।”
” তাহলে?”
” অন্য একটা জায়গায় যাবো।”
” কোথায়?”
” যেতে যেতে বলছি।”
অর্ণভ আর অরিন বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। অরিন মনে মনে যেটা ভেবে রেখেছিল সেটাই করলো। সেদিন রাতে ইলহান অরিনকে কিডন্যাপ করে যেই বাড়িতে নিয়ে গেছিল সেটা নাকি ইলহানের বন্ধুর বাড়ি। অরিনের মনে হচ্ছে, সেই বাড়িতে গেলেই ইলহানকে খুঁজে পাওয়া যাবে। অরিন ইলহানকে নিয়েই হসপিটালে যেতে চায়। কিন্তু যদি ইলহান সেখানে না থাকে? অরিন আপাতত নেগেটিভ চিন্তা-ভাবনা মাথায় আনতে চাইছে না। ইলহানকে সেখানে থাকতেই হবে। অবশ্যই থাকতে হবে। অরিনকে সেদিন চোখে পট্টি পড়িয়ে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। কিন্তু ফিরে আসার সময় ইলহান তাকে পৌঁছে দিয়েছে। তখন অরিনের চোখ খোলাই ছিল। তাই ওই বাড়ির ঠিকানা অরিনের ভালোমতো মনে আছে। অরিনের স্মৃতিশক্তি খুব ভালো। সে একবার কিছু দেখলে সহজেই মনে রাখতে পারে। নাসিরের বাড়ির সামনের অরিনদের ট্যাক্সি থামলো। অরিন পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। এখনও সে কাঁদছে। অর্ণভ ট্যাক্সি ভাড়া দিতে দিতে বললো,
” কোথায় এলাম আমরা?”
অরিন জবাব না দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। চিকন গলির মাঝে ছোট্ট একটা দালান। সেই দালানের চারতলায় নাসিরের বাসা। অরিন নাসিরের নাম জানে না। কিন্তু দেখলে চিনতে পারবে। অরিন ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে একসাথে তিনবার কলিংবেল বাজালো। অর্ণভ বললো,
” আরে থাম, এতো অস্থির হচ্ছিস কেনো? ঘরে মানুষ থাকলে দরজা নিশ্চয়ই খুলবে।”
অরিনের হাত-পা কাঁপছে। নাসির দরজা খুলতেই অরিন ফট করে ভেতরে ঢুকে গেল। নাসির বললো,
” আরে ভাবী, আপনি এইখানে? ঘটনা কি?”
অর্ণভ নাসিরের মুখে ভাবী শব্দটা শুনে বেয়াক্কেলের মতো তাকিয়ে রইল। নাসির বললো,
” বড়ভাই, আসেন। ভেতরে আসেন।”
অর্ণভ কথা না বলেই ভেতরে ঢুকলো। দুই রুমের ফ্ল্যাট। একটা ড্রয়িং রুম অন্যটা বেডরুম। ড্রয়িংরুমে ফ্লোরে বিছানা পেতে নাসির বসে ছিল। বই-পত্র ছড়ানো-ছিটানো। অন্যরুমের দরজা বন্ধ। অরিন সেই বন্ধ দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো। নাসির বললো,
” ভাবী আপনি খবর পেলেন কিভাবে? একেই মনে হয় বলে হার্ট কানেকশন। আমার বন্ধু তো নাওয়া-খাওয়া সব ছেড়ে দিচ্ছিল। আপনি যদি আরেকটু দেরি করতেন তাহলে ওর লাশ পেতেন।”
অর্ণভ প্রচুর বিরক্ত হলো। তার বোনকে অনবরত একটা দাড়িওয়ালা রামছাগল ভাবী ডেকে যাচ্ছে। এসবের মানে কি? অর্ণভ বললো,
” এই, আপনি এতো বেশি কথা বলেন কেনো? চুপ থাকতে পারেন না?”
নাসির বললো,” বড়ভাই কি রাগ করলেন? ভাবীকে দেখে আসলে আমার মাথা কাজ করছে না। পাগল হয়ে গেছি খুশিতে। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে ভাবী আমার বাড়িতে এসেছে।”
নাসির একথা বলে খিকখিক করে হাসতে লাগলো। অর্ণভের ইচ্ছে করছে রাম ছাগলটাকে ঘুষি মেরে ভোতা বানিয়ে দিতে। হঠাৎ ইলহান দরজা খুললো আর অরিনকে দেখেই চমকে উঠলো। অরিন বললো,
” সমস্যা কি আপনার? ফোন বন্ধ কেনো? আপনি কি একটুও শান্তিতে থাকতে দিবেন না আমাকে?”
অরিন আর কিছু বলার আগেই ইলহান শক্ত করে অরিনকে জড়িয়ে ধরলো। ভাইয়ার সামনে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় অরিন লজ্জা আর অস্বস্তিতে মিইয়ে গেল একদম। অর্ণভ হা করে তাকিয়ে থেকে বললো,
” এইটা আবার কোন জাতের পাগল?”
নাসির হেসে বললো,” রোমিও জাতের পাগল। ভাই চলেন, আমরা বরং নিচ থেকে চা খেয়ে আসি। প্রাইভেসি মেইনটেইন করা জরুরী। ”
নাসির অর্ণভকে টানতে টানতে নিচে নিয়ে গেল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here