মেঘের পরে রংধনু পর্ব-১৩

0
1115

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_১৩
লিখা: Sidratul Muntaz

সকাল থেকেই রান্নাঘরটা বিরিয়ানির গন্ধে মো মো করছে। আজ অরিনদের বাড়িতে একটা বিশেষ দিন। অরিন ইচ্ছে করেই অর্ণভের এলার্ম বন্ধ করে রেখেছিল যেনো সে অফিসে যেতে না পারে। সচরাচর অর্ণভ অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সকাল আটটায়। এখন বাজে সাড়ে নয়টা। অর্ণভের ঘুম এখনও ভাঙেনি। নৌশিন আর অরিন সকাল থেকে কাজ করছে। অর্ণভের জন্মদিনের কেক প্রায় তৈরী। এরই মধ্যে বাসন্তী খালা হাজির হলেন। সাথে আনলেন আরেকটা বিশাল বড় কেক, অনেক রকমের মিষ্টি আর হাজার খানেক উপহার। ড্রাইভার গাড়ি থেকে শুধু একটার পর একটা প্যাকেট নামাচ্ছেন। নৌশিন আর অরিন সবচেয়ে বেশি অবাক হলো নিশিতাকে নামতে দেখে। নিশিতা আজকে মিষ্টি রঙের শাড়ি পড়েছে। চুল একপাশে আঁচড়ে পেছনে ছেড়ে রেখেছে। মুখে মেকাপ দিয়ে দারুণভাবে সেজেছে। এই বেশে তাকে চমৎকার দেখাচ্ছে। ঠিক যেনো লজ্জাবতী বাঙালি নারী। বিশেষ দিন ছাড়া নিশিতা কখনও শাড়ি পড়ে না। অরিন মনে করার চেষ্টা করলো। আজকে কি কোনো বিশেষ দিন? অর্ণভের জন্মদিন তো নিশিতার কাছে বিশেষ দিন হতে পারে না। তাহলে? সুমনাও গাড়ি থেকে নামছে। সে একটুও সাজেনি। শুধু একটা সবুজ সেলোয়ার কামিজ পড়েছে। মেয়েটাকে এভাবেই অপূর্ব দেখাচ্ছে। কোমল চেহারার ফরসা, রূপবতী একটা মেয়ে। সুমনার চেহারার দিকে একবার তাকালে যে কেউ মায়ায় পড়ে যাবে। অরিন তো প্রথম দেখেই সুমনাকে ভাবী হিসেবে কবুল করে নিয়েছিল। কিন্তু কে জানতো? নিয়তির পরিহাসে এই মেয়েটাই একদিন তার খালার বাড়ির চাকরানী হয়ে যাবে! দিন-রাত তাদের ফাই-ফরমাশ খাটবে! জগতের নিয়ম বড়ই অদ্ভুত। হালিমা আর অরিনের মামী রাখি সুলতানা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছেন। হঠাৎ এতো আয়োজনের কারণ তাঁরা কেউই বুঝতে পারছেন না। বাসন্তী কখনও এতো বে-হিসাবি কাজ করেন না। সাতাইশ বছরের ছেলের জন্মদিনে কেক, মিষ্টি এনে হুলুস্থুল করে ফেলেছেন। এসবের কি আদৌ কোনো দরকার ছিল? অথচ কিছুদিন আগেই অরিনের ছোটবোন মিহরীমার জন্মদিন গেল। তখন তো এতো আয়োজন হয়নি। তাহলে আজ কেনো? হালিমা কেকের প্যাকেট খুলেই চমকে উঠলেন। কেকে অর্ণভের নাম লেখা নেই। তার বদলে লেখা,’ হ্যাপি বার্থডে মাই ডিএইচ।” এই ডিএইচের অর্থটা কি? রাখি জিজ্ঞেস করতেই বাসন্তী বললেন,
” আরে দাঁড়াও তোমরা। আগে অর্ণভটা আসুক। আমাদের বার্থডে বয় কোথায়?”
অরিন বললো,” তোমার বার্থডে বয় এখনও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে খালা। যাও, ডেকে নিয়ে এসো।”
অর্ণভ সঙ্গে সঙ্গেই পর্দা সরিয়ে ড্রয়িংরুমে আসলো। ওর মুখে ব্রাশ। সাদা পেস্ট ঠোঁটের চারপাশে লেগে আছে। এই অবস্থাতেই অরিনকে উদ্দেশ্য করে সে বললো,
” আমি নাক ডাকি? আমাকে কবে নাক ডাকতে দেখেছিস তুই?”
সবাই অর্ণভকে দেখে একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠলো,” হ্যাপি বার্থডে!”
অর্ণভ কারো দিকে তাকালো না। ওর দৃষ্টি আগেই আটকে গেছে নিশিতার পেছনে দাঁড়ানো সুমনাতে! মেয়েটাকে একদম সবুজ ফুলগাছের মতো দেখাচ্ছে। বাসন্তী অর্ণভের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিশিতার দিকে তাকালেন। ভাবলেন অর্ণভ হয়তো নিশিতাকেই দেখছে। মনে মনে খুশিতে গদগদ হলেন তিনি। তারপর উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন,
” এইযে, আমার নবাবপুত্তুর! তোর জন্যই কিন্তু অপেক্ষা করছি। তুই আসার পর আমি একটা বিশেষ ঘোষণা দিবো। এই ঘোষণা শুনলে তোর মনে হবে আজকের জন্মদিনটাই তোর জীবনের শ্রেষ্ঠ জন্মদিন। তাই জলদি দু’মিনিটে মুখ ধুঁয়ে আয়। যা।”
অর্ণভ নিজেকে সামলে মুখ ধুতে চলে গেল। নৌশিন ফিসফিস করে বললো,
” তোর কি মনে হয় অরিন? ফুপু কি বিশেষ ঘোষণা দেওয়ার কথা বলছে?”
অরিনের আপাতত দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হৃাস পেয়েছে। সে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। সেদিন যে খালা তাকে অর্ণভ আর নিশিতার বিয়ের বিষয়ে বলেছিলেন সেটা তো অরিন একদম ভুলে গেছে। ইলহানের পাগলামি, নৌশিনের অসুস্থতা, আরও নানান ঝামেলায় সে এই ব্যাপারে অর্ণভের সাথে কথাই বলতে পারেনি। আজকে বাসন্তী খালা নিশ্চিত বিয়ের ঘোষণাই দিবেন। ভাইয়া হঠাৎ এসব শুনে নৌশিনের মতো অজ্ঞান হয়ে যাবে না তো? অর্ণভ আসার পর বাসন্তী সবাইকে ড্রয়িংরুমে জড়ো করলেন। অর্ণভ আর নিশিতাকে একদম মাঝখানে পাশাপাশি বসালেন। তারপর ঠান্ডা গলায় বললেন,
” আমি আত্মীয়তার বন্ধন আরও গাঢ় করার জন্য একটা ইম্পোর্ট্যান্ট ডিসিশন নিয়েছি। আমার সিদ্ধান্তে সবাই খুশি হবে এই আশা রাখছি। বিশেষ করে যাদের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তারা কিন্তু আগে থেকেই খুশি হয়ে বসে আছে৷ তাই অন্য কারো এই বিষয়ে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই।”
হালিমা বললেন,” আচ্ছা। এইবার কথাটা বলে ফেল আপা।”
বাসন্তী মুখের সামনে হাত নিয়ে একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। অরিন ভয়ে তটস্থ হয়ে মাথায় হাত চেপে ধরে বসে রইল। মনে হচ্ছে এখনি বজ্রপাত হবে। বাসন্তী বললেন,
” আমি এই দু’টোর বিয়ে দিবো বলে ঠিক করেছি।”
অরিন চোখ-মুখ খিচে নিল। কিন্তু কারো কোনো সাড়া-শব্দ নেই। অরিন মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো সবার মুখ আগের মতোই হাসি হাসি, স্বাভাবিক। রাখি বললেন,
” কাদের কথা বলছেন বাসন্তী আপা?”
” নিশিতা আর অর্ণভ। মেইড ফর ইচ আদার। ”
বাসন্তী এই কথা বলে উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে দিলেন ওদের দিকে।
অরিন তাকিয়ে দেখলো নিশিতা আর অর্ণভ লাজুক মুখে হাসছে। সবার মুখেই হাসি। হালিমা তো আনন্দে বাসন্তীকে দু’টো মিষ্টি একসঙ্গে খাইয়ে দিলেন। বিস্ময় শুধু নৌশিনের চেহারায়। নৌশিন বললো,
” আচ্ছা ফুপু, তুমি কেকের মধ্যে ডিএইচ কেনো লিখেছো? এইটার মানে তো বললে না।”
বাসন্তী বললেন,” ডিএইচ মানে মাই ডটার’স হাসব্যান্ড।”
” ফুপু, ওইটাকে সন-ইন-ল বলে। ডটার্স হাসব্যান্ড বলে না।”
অর্ণভ আর নিশিতা একসঙ্গে হাত ধরে হেসে উঠলো। অরিন ওদের ঘনিষ্ঠটা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার মানে খালা যেটা সন্দেহ করেছিল সেটাই ঠিক? ও মাই গড! অরিন নিজেকে মনে মনে গালি দিল,” গাধী,গাধী,গাধী! তোর সামনেই এরা ডুবে ডুবে জল খেল আর তুই কিচ্ছু বুঝলি না।” বাসন্তী অসহায় মুখ করে নৌশিনকে উত্তর দিলেন,” আসলে লেখার সময় সন-ইন-ল ওয়ার্ডটা মাথায় আসছিল না। আচ্ছা থাক বাদ দে। একই তো মিনিং। নেক্সট টাইম ঠিক করে নিবো।”
জন্মদিনের উৎসব ভাবটা যেনো নিমেষেই কেটে গেছে। বাড়িতে এখন বিয়ের উৎসব লেগেছে। অর্ণভ-নিশিতার বিয়ে!

বাবার প্রেশার মাপতে গিয়ে মাথায় বাজ পড়লো শ্যানিনের। প্রেশার অতিরিক্ত বেড়ে গেছে! ইদানীং বাবার প্রেশার নরমাল করাই যাচ্ছে না। শুধু বেড়েই চলেছে। বাবা দিন কে দিন অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কিন্তু শ্যানিন তো যথেষ্ট খেয়াল রাখে তার বাবার। নিজে তদারকি করে বুয়াকে দিয়ে বাবার জন্য কম লবণের তরকারি রান্না করায়, গরুমাংস একদম খেতে দেয় না, সিদ্ধ চিকেন খাওয়ায়, নিয়ম করে বাবাকে সকাল-সন্ধ্যা হাঁটতে পাঠায়। বাবা যেনো লিফটে না উঠে সিঁড়ি ব্যবহার করে সেজন্য শ্যানিন নিজেও লিফটে উঠা বন্ধ করে দিয়েছে। এতো সাবধানে থাকার পরেও কেনো বাবাকে সুস্থ করা যাচ্ছে না? শ্যানিন বিষয়টা নিয়ে খুবই বিচলিত। এর মধ্যে আরেকটা ঝামেলা হয়েছে। তিনদিন ধরে ইলহান বাড়ি আসছে না। মোবাইলও বন্ধ। কোনো খোঁজ নেই। অরিন যেদিন তাদেরবাড়ি এসেছিল সেদিন মাঝরাতে ইলহান গাড়ি নিয়ে ওকে পৌঁছে দিতে গেল, ফিরলো সকালে। তার হাত ফেটে রক্ত পড়ছিল, চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থা ছিল, মাথার চুল এলোমেলো, গায়ে ধুলাবালি। সে ফিরে এসেই বাবার সাথে রাগারাগি শুরু করলো। তার প্রথম প্রশ্ন ছিল,
” তুমি অরিনকে কি বলেছো বাবা? ও কেনো এতো রেগে গেল?”
শ্যানিন, নুসাইবা ইলহানকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলো যে তারা অরিনকে তেমন কিছুই বলেননি। কিন্তু ইলহান বিশ্বাস করলো না। তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। একদম এক কাপড়ে বের হয়েছিল। গাড়ি পর্যন্ত নেয়নি। সেদিনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইলহানের কোনো খোঁজ নেই। শায়িখ সাহেব ছেলের চিন্তা করতে করতেই আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নুসাইবা নিজেও সারাদিন দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। কারো মনে শান্তি নেই। আজকে সকাল থেকে শায়িখ সাহেব অসুস্থ হয়ে বিছানাতেই শুয়ে আছেন। এখন সকাল এগারোটা বাজে। শ্যানিন তাঁর ঘরে এসেছে আধঘণ্টা হবে। এর মধ্যে তিনি প্রায় বিশবার বলে ফেলেছেন ইলহানকে ফোন দেওয়ার কথা। শ্যানিন শুধু বলেছে,
” দিচ্ছি।” কিন্তু একবারও ফোন দেয়নি। সে জানে ভাইয়ার মোবাইল বন্ধ। তাকে ফোন করে লাভ নেই। কিন্তু এই বিষয়ে বাবাকে জানালে তিনি আরও অস্থির হয়ে উঠবেন। এমনিই বাবার প্রেশার দেখে শ্যানিনের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শায়িখ সাহেব আদুরে গলায় বললেন,
” মা, আমার খুব ঠান্ডা কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। তুই একটা জুস বানাতে পারিস না? স্ট্রবেরি ফ্লেভারের? ওইটা খাবো।”
শ্যানিন মনে মনে একটু হাসলো। সে জানে বাবার জুস খেতে ইচ্ছে করছে না। তিনি জুসের বাহানায় শ্যানিনকে এই ঘর থেকে বের করতে চাইছেন। শ্যানিন চলে গেলেই তিনি মোবাইল নিয়ে বসবেন। ইলহানকে ফোন করবেন। আসলে তিনি নিজের মুখেই বলেছেন ইলহান নিজে থেকে বাড়ি ফিরলে ফিরবে নাহলে নেই। কিন্তু তিনি আগ বাড়িয়ে ফোন করবেন না। অথচ তিনদিন হয়ে গেল। ইলহানের কোনো খোঁজ নেই। তাই শায়িখ সাহেব ঘাবড়ে গেছেন। হার মেনে নিজেই ইলহানকে ফোন করতে চাইছেন। কিন্তু শ্যানিনের সামনে এই কাজটা করতে তিনি লজ্জা পাচ্ছেন। শ্যানিন বাবার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে বললো,
” জুসে চিনি বেশি হবে নাকি কম?”
” তোর যেমন ইচ্ছা।”
শ্যানিন দরজার বাহিরে চলে গেল। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। বাবা মোবাইল হাতে নিয়েছেন। হয়তো ইলহানের নাম্বার ডায়াল করছেন। শ্যানিন চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেল। তার খুব খারাপ লাগছে। যেদিন থেকে ইলহান ভাইয়া বাড়ি ছেড়েছে, সেদিন থেকে একবারও শ্যানিন বাবার মুখে হাসি দেখেনি।
শায়িখ সাহেব খুব বিরক্ত হয়ে ফোন নামিয়ে রাখলেন। তিনি বুকে শক্ত চাপ অনুভব করছেন। ছেলেটার মোবাইল এখনও বন্ধ। ছেলেটা কোথায় গেল? বাড়ি ছাড়ার আগে ইলহান চিৎকার করে একটা কথা বলেছিল,” তুমি আমার সুখ কেনো সহ্য করতে পারো না বাবা?” ওর কণ্ঠে তীব্র অভিমানের ঝাঁঝ ছিল। শায়িখ সাহেব তখন উচ্চ আওয়াজে ধমক দিয়ে বলেছিলেন,” কি যা-তা বলছো? আমি তোমার সুখ সহ্য করতে পারি না মানে?”
কিন্তু মনে মনে তিনি ঠিকই স্নেহময় কণ্ঠে বলেছেন,” তোর সুখের জন্য আমি নিজের জীবনটাও বাজি রাখতে পারি রে বাবা!” শায়িখ সাহেব বুকের একপাশ চেপে ধরলেন। খুব ব্যথা করছে। অসহ্য রকমের ব্যথা! তাঁর খুব ইচ্ছে করছে ইলহানকে একটু দেখতে। ইলহান যদি তাঁর কাছে এসে তাঁর মাথাটা কোলে নিয়ে চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলতো,” বাবা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা। তাহলে তিনি শান্তিতে একটু ঘুমোতে পারতেন। ছেলের কোলে মাথা রেখে গভীর আয়েসে চোখ বন্ধ করার চেয়ে সুখের মুহুর্ত তাঁর কাছে দ্বিতীয়টি নেই। শায়িখ সাহেব চোখ বন্ধ করলেন। তেইশ বছর পূর্বের সোনালী অতীতগুলো তিনি দেখতে পাচ্ছেন। কত ঝলমলে অতীত! ইলহানকে একটা নীল তোয়ালে মোড়ানো অবস্থায় শায়িখের কোলে দেওয়া হলো। বাচ্চাটার সৌন্দর্য্য চাঁদকেও হার মানাবে। তিনি কখনও এতো সুন্দর শিশু দেখেননি। এতিমখানায় এমন হীরকের খন্ড কোথ থেকে এলো? লাল রক্তিম ঠোঁটের অধিকারী এই অসাধারণ শিশুটির জায়গা এতিমখানা হতে পারে না। এই হীরক খন্ডকে শায়িখ কিছুতেই ফেলে রেখে যেতে পারেন না। সেই ক্ষমতা তাঁর নেই। তিনি স্ত্রী নুসাইবাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় হানিমুন করতে এসেছিলেন। আজকে আবার শায়িখের বাবার মৃত্যুবার্ষিকীও ছিল। তাই তিনি ঠিক করেছেন এতিমখানার বাচ্চাদের নিয়ে ভোজের আয়োজন করবেন। তিনি আর তাঁর স্ত্রী বাচ্চাদের নিজহাতে বেড়ে খাওয়াবেন। শায়িখের বাবার আত্মার জন্য দোয়া করবেন। কিন্তু এতিমখানায় আসার পর একটা বিস্ময়কর ঘটনার সম্মুখীন হলেন তাঁরা। ডাস্টবিনে নাকি চাঁদের সন্ধান পাওয়া গেছে! মানে একটি অবর্ণনীয় সুন্দর বাচ্চাকে ডাস্টবিনে কুঁড়িয়ে পাওয়া গেছে। বাচ্চাটির খবর পত্রিকায় ছাঁপানোর পর থেকেই একের পর এক দম্পতি আসতে লাগলো বাচ্চাটিকে দেখতে। এতিমখানায় উপচে পড়া ভীর জমতে শুরু করলো। মিডিয়ার যত ফটোগ্রাফার, ক্যামেরাম্যান সবাই ছুটে আসলো। বাচ্চাটার সাথে একটা ছবি তোলার জন্য সকলে মরিয়া হয়ে উঠলো। যে-ই বাচ্চাটিকে দেখতো সে-ই অবাক হয়ে যেতো। এতো বিস্ময়কর সুন্দর! শায়িখ সাহেব বাচ্চাটিকে দত্তক নেওয়ার জন্য এতিমখানার কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে চাইলেন। কিন্তু তাঁরা জানালো, এই বাচ্চাকে নেওয়ার জন্য হাজার হাজার দম্পতি অপেক্ষায় ছিল। সবাইকে তো আর একটা বাচ্চা ভাগ করে দেওয়া যাবে না। তাই লটারির মাধ্যমে নির্বাচন করা হলো। অস্ট্রেলিয়ার একজন ধনী ব্যক্তি, নাম মি. ইভলিন বাচ্চাটিকে লটারির মাধ্যমে জিতে নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কোনো স্ত্রী নেই। তিনি বিবাহিত নাকি অবিবাহিত সেটাও অজ্ঞাত। তিনি বাচ্চাটিকে এতিমখানাতেই রেখে গেছেন। আজকে নিতে আসবেন। কিন্তু শায়িখ সাহেব যে ইতোমধ্যে হীরক খন্ডটির মায়ায় পড়ে গেছেন! তাঁর একটাই চিন্তা, এতো ছোট বাচ্চা মা ছাড়া থাকবে কিভাবে? মুখে এই কথা বললেও মনে মনে তিনি ভাবছিলেন, এই ছোট্ট রাজকুমারকে ছাড়া তিনি নিজে থাকবেন কিভাবে! এই বাচ্চাটির ভুবন ভোলানো হাসি যে তাঁর বুকে সূচের মতো আটকে গেছে। একটা অদ্ভুত সূক্ষ চাপ তিনি বুকের বামপাশে অনুভব করেছেন। এই চাপ ততক্ষণ কমে না, যতক্ষণ না তিনি বাচ্চাটিকে বুকে নেন। শায়িখ সাহেবের মনে হলো, এই হীরক খন্ডকে ছাড়া তিনি যেতে পারবেন না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মি. ইভলিন আসার পর তাঁর কাছেই এই বাচ্চাটিকে চাইবেন। বিনিময়ে মি. ইভলিনকে তিনি যে কোনো কিছু দিতে রাজি থাকবেন। মি. ইভলিন বিকালের দিকে এলেন। ততক্ষণ শায়িখ আর নুসাইবা এতিমখানাতেই অপেক্ষা করেছেন। নুসাইবা যত্ন করে বাচ্চাটিকে ফিডারে দুধ খাওয়ালেন। শায়িখের বুকে তখনও অদ্ভুতভাবে চিনচিনে ব্যথা করছিল। মি. ইভলিন নিজের সাথে আরও চার-পাঁচটি গাড়ি নিয়ে এসেছেন। বেশ ফরসা, লম্বা-চওড়া,সুদর্শন এক ভদ্রলোক৷ তবে চোখেমুখে ভয়ংকর গম্ভীর ভাব। যেনো এই মাত্র মানুষ খুন করে এসেছেন নয়তো এখনই কাউকে খুন করবেন৷ এমন একটা সাংঘাতিক চেহারার মানুষ মি. ইভলিন। সাদা শার্ট পরিহিত ভদ্রলোকের কাছে শায়িখ সাহেব বিনীতভাবে আর্জি জানালেন, বাচ্চাটিকে তিনি নিয়ে যেতে চান। মি. ইভলিন এই কথা শুনে একটুও রাগ করলেন না। স্বাভাবিক কণ্ঠে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন,
” আপনার HIV নেই তো?”
শায়িখ সাহেব একটু হকচকিয়ে বললেন,” না।”
মি.ইভলিন তখন পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে শায়িখ সাহেবকে দিয়ে বলেছেন আগামীকাল সকাল নয়টায় তার অফিসে চলে আসতে। অতঃপর তিনি আর কথা বাড়াননি। শিশু ইলহানকে নিয়ে চলে গেলেন। শায়িখ সাহেব হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর প্রচন্ড কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু পরদিন তিনি মি.ইভলিনের অফিসে গেলেন। মি. ইভলিন ডাক্তারকে দিয়ে তাঁর রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করালেন। টিস্যু পরীক্ষা করালেন। প্রায় ছয়-সাত ঘণ্টা পর তিনি জানালেন বাচ্চাটিকে শায়িখের হাতে তুলে দিবেন। কিন্তু বিনিময়ে শায়িখের একটা কিডনি তাঁকে দিতে হবে। শায়িখ সাহেবের তখন মনে হয়েছিল শুধু একটা কিডনি কেনো? তাঁর শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে গেলেও কোনো আপত্তি নেই। তবে শুধু চোখ দু’টো ছাড়া। কারণ এই চোখ দিয়ে তিনি তাঁর চাঁদের টুকরোকে দেখবেন।
প্রায় চব্বিশ বছর কেটে গেছে। শায়িখ সাহেব এখনও একটা কিডনি নিয়ে বেঁচে আছেন। এই কথা নুসাইবা ছাড়া আর কেউ জানে না। শায়িখ সাহেবের শেষ কিডনিটাও বিকল হওয়ার পথে। তিনি খুব বেশিদিন হয়তো পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারবেন না। তাঁর মৃত্যুর সময় যে ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। আজকে বা কালকের মধ্যেই তিনি দুম করে মরে যেতে পারেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে একমাত্র ছেলের নিষ্প্রাণ অবস্থা তাঁকে খুব যন্ত্রণা দিচ্ছিল। তাই তিনি ছেলের মুখে হাসি আনার জন্য হুট করে অরিনকে ডেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেললেন। এতে মেয়েটা যে এতো রেগে যাবে তা তিনি ভাবতেও পারেননি। তিনি তো ভেবেছিলেন অরিনও ইলহানকে পছন্দ করে। অথচ অরিন নাকি ইলহানকে সহ্যই করতে পারে না। শায়িখ সাহেবের কপাল খুবই খারাপ। ছেলেকে সুখী করতে গিয়ে দুঃখ দিয়ে ফেলেছেন। এখন হয়তো মৃত্যুর আগে একমাত্র প্রিয় ছেলের মুখটাও তিনি দেখতে পাবেন না! শ্যানিন স্ট্রবেরি জুস নিয়ে বাবার ঘরে ঢুকলো। বাবা একহাতে বুক চেপে ধরে বসে আছেন। নড়াচড়াও করতে পারছেন না। শ্যানিন বললো,
” নাও বাবা। তোমার জন্য বেশি করে চিনি আর বরফ কুচি দিয়ে জুস বানিয়েছি।”
শায়িখ সাহেব জুস হাতে নিলেন। শ্যানিন খানিক অস্থির হয়ে বললো,
” শরীর খারাপ করছে নাকি বাবা তোমার?”
শায়িখ সাহেব হঠাৎ হাত থেকে জুসটা ফেলে দিলেন। আর সাথে সাথে স্ট্রোক করলেন।

কিছুক্ষণ আগেও অরিন নিশ্চিত ছিল যে অর্ণভ আর নিশিতার বিয়েটা হচ্ছে। কিন্তু এইমাত্র সে যেটা শুনলো তাতে ইচ্ছে করছে এখনি এক গ্লাস সেভলন খেয়ে মরে যেতে। নিশিতা আর অর্ণভ অরিনের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বলছে, তারা নাকি কেউই এই বিয়েতে আগ্রহী না। অরিন জিজ্ঞেস করলো,
” তাহলে বড়দের সামনে কিছু বললে না কেনো তোমরা?”
নিশিতা বললো,” ঝামেলা করে লাভ কি? পরে যদি জোর করে বিয়ে দেয়? তার চেয়ে বরং এখন ভালো মেয়ের মতো রাজি হয়ে যাই। তারপর বিয়ের দুই-একদিন আগে সুযোগ বুঝে পালিয়ে যাবো।”
অরিন চক্ষু চড়কগাছ বানিয়ে বললো,” হোয়াট? কার সাথে পালাবে?”
অর্ণভ বললো,” আমি তো সুমনাকে নিয়ে পগার পা। সব রেডি আছে।”
অরিন নিশিতার দিকে তাকিয়ে বললো,” আর তুমি কি করবে?”
নিশিতা মৃদু হেসে বললো,” আমার ডেলিভারি ম্যান আছে না? শোন, বিয়ের আরও কমপক্ষে একমাস বাকি। এই একমাসের মধ্যেই আমাদের সেই ডেলিভারিম্যানকে খুঁজে বের করতে হবে।”
” তারপর?”
” তারপর আমি ডেলিভারিম্যানকে নিয়ে পালাবো!”
” আর সেই ছেলে যদি তোমাকে নিয়ে পালাতে রাজি না হয়?”
” হবে না কেনো? ও রাজি হবে সাথে ওর বাপও হবে।”
অর্ণভ বললো,” এক্সেক্টলি। রাজি না হলে কেলিয়ে রাজি করাবো। হাত-পা বেঁধে চব্বিশ ঘণ্টা ওয়াটার ট্রিটমেন্টে রাখবো। তারপর দেখবো রাজি না হয়ে কই যায় শালা।”
অরিন মনে মনে ভাবলো, ভালোই তো। তার ভাই-বোনরা সব পালিয়ে বিয়ে করছে। একজন কাজের মেয়ে নিয়ে পালাবে, অন্যজন ডেলিভারি বয়কে নিয়ে পালাবে। তাহলে অরিন কেনো বাদ থাকবে? সেও একটা রিকশাওয়ালা জুটিয়ে ভেগে যাক! দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ আসছে। অরিন দরজা খুলে দেখলো নৌশিন এসেছে। নৌশিনের কোলে মিহরীমা কান্নাকাটি করছে। অরিন আদর করে মিহরীমাকে নৌশিনের কাছ থেকে নিল। এই মেয়েটা ঘুম থেকে উঠে অরিনকে না দেখলেই কান্নাকাটি শুরু করে। মাকেও সে এতো পছন্দ করে না যতটা অরিনকে পছন্দ করে। অরিন ভেবে রেখেছে তার যার সাথেই বিয়ে হবে তাকে প্রথম শর্ত হিসেবে বলবে, অরিনের সাথে মিহরীমাকেও শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যেতে। নাহলে অরিনের বিয়ের পর এই ছোট্টবোনটা ওকে ছাড়া মরেই যাবে। অরিন মিহরীমার কান্না থামাতে মায়ের রুমে এসে বসলো। বিছানায় মায়ের মোবাইলটা পড়ে আছে। মোবাইলের স্ক্রিন জ্বলছে। কেউ ফোন করলো নাকি? অরিন মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো আসলেই ফোন এসেছে। নাম্বারটা পরিচিত। অরিন কল রিসিভ করতেই ওই পাশ থেকে একটা ভাঙা কণ্ঠ ভেসে আসলো,
” আসসালামু আলাইকুম, আন্টি। অরিন আছে?”
” আমিই অরিন।”
অরিন এই কথাটা বলার সাথে সাথেই অপর পাশের কণ্ঠ তীক্ষ্ণ ও রুক্ষ রূপ ধারণ করলো।
” সেলফিশ, তোর জন্য আজকে বাবার এই অবস্থা। তুই কি চাস? আমরা সবাই মরে যাই? আমাদের মেরে শান্তি হবি তুই?”
” আজব, আমি এটা কেনো চাইবো? তোর কি হয়েছে শ্যানিন? তুই কি কাঁদছিস?”
” আমার বাবা হসপিটালে ভর্তি। ভাইয়া তিনদিন ধরে নিখোঁজ। মা অনবরত কান্নাকাটি করছেন। এই অবস্থায় কি আমার খুশিতে নাচা উচিৎ?”
” আঙ্কেল হসপিটালে মানে? কিভাবে হলো এসব?”
” তোর জন্যই তো সব হয়েছে। তুই একটা পাষাণ। তোর মতো বেস্টফ্রেন্ড থাকা মানে অভিশাপ। বুঝেছিস?”
শ্যানিনের কান্নার শব্দে অরিনের মাথা ধরে যাচ্ছে। সে বিচলিত হয়ে বললো,
” শ্যানিন প্লিজ, আমাকে একটু খুলে বল। কি হয়েছে? ”
” ভাইয়া বাবার সাথে রাগারাগি করে বাসা থেকে বের হয়ে গেছিলো। কারণ বাবা নাকি তোকে খুব বাজে কথা বলেছেন। তোকে ডেকে এনে অপমান করেছেন। সত্যি করে বলতো, আমার বাবা কবে তোকে অপমান করলেন? তুই ভাইয়ার কাছে এতোবড় মিথ্যে বলতে পারলি? আজ তিনদিন ধরে ভাইয়ার ফোন সুইচড অফ। সে কোথায় আছে, কি খাচ্ছে, কিছুই আমরা জানি না। আর আজকে সকালে বাবা ভাইয়ার টেনশনে স্ট্রোক করেছেন। আমাদের ফ্যামিলির সবাই এখন হসপিটালে। এবার নিশ্চয়ই তুই খুশি? আর তোকে কেউ জ্বালাবে না। ভাইয়া তো চলেই গেছে, বাবাও মরে যাচ্ছে। তুই ভালো থাকিস এবার।”
শ্যানিন ফোন কেটে দিল। অদ্ভুত তো!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here