মেঘের পরে রংধনু পর্ব-১৭

0
1187

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_১৭
লিখা: Sidratul Muntaz

হাতের লিপস্টিকটার দিকে একনজরে তাকিয়ে রইল সুমনা। কি ছোট্ট আর নগন্য একটা জিনিস। অথচ এর দাম নাকি চারহাজার টাকা। লিপস্টিকের গায়ে দাম লেখা নেই। সুমনা দাম জানতে পেরেছে লিপস্টিকের সাথে মোড়ানো চিঠি পড়ে। আজ সুমনা যখন অর্ণভদের বাড়িতে গেছিল, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে অর্ণভ আচমকা ওর হাতে একটা প্যাকেট গুজে দিল। সুমনা আতঙ্কে অস্থির হয়ে দ্রুত সেই প্যাকেট ওরনার আড়ালে গুটিয়ে নিল। এমন কাজ অর্ণভ প্রায়ই করে। তাই সুমনা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে ভয়ও লাগে। যদি কেউ দেখে নেয়। চিঠিতে অর্ণভ লিখেছে,
” এইযে সবুজ গাছ, আজকে সবুজ জামা পড়েছিস কেনো রে? আমার সবুজ রঙ পছন্দ তাই? এর মানে আমার জন্মদিনের কথা তোর মনে ছিল। তাহলে উপহার আনিসনি কেনো? সবাই তো জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমার জন্য কত কিছু আনলো। মিহরীমা পর্যন্ত আমাকে উপহার দিয়েছে। কি দিয়েছে জানিস? সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার কোলে হিসু করে দিয়েছে৷ এটা কি উপহার নয়? যেখানে আমার তিনবছরের বাচ্চা বোনটাও আমাকে উপহার দেয় সেখানে তোর এতো দেমাগ কিসের? না, তোকে আমি আমার কোলে হিসু করতে বলছি না। এইটা তোর কাজ নয়। তোর কাজের হিসেবটা অন্যরকম। তাছাড়া তোর থেকে উপহার আদায়ের সিস্টেমও আমার জানা আছে। আর ভুল যখন করেছিস শাস্তি তো একটা পেতেই হবে। খামের ভেতরে আরেকটা প্যাকেটে টকটকে গোলাপী শেডের একটা লিপস্টিক আছে তোর জন্য৷ ওইটা সবুজ জামার সাথে পড়বি। তাহলে মনে হবে, সবুজ গাছের মধ্যে গোলাপ ফুটে আছে। উফফ! লিপস্টিকটার দাম জানিস কত? চারহাজার টাকা। এতো দামী উপহার তোকে কেনো দিচ্ছি? তোকে তো শাস্তি দেওয়ার কথা ছিল। তোর এতোবড় সাহস আমার জন্মদিনে উপহার আনতে ভুলে যাস। আবার সবুজ পোশাক পড়ে ড্যাংড্যাং করে ঘুরে আমার মাথা খারাপ করে দিস৷ এতো এতো অপরাধের জন্য শাস্তি তো তোর প্রাপ্যই। তাই এই লিপস্টিক পড়ে তুই আমাকে চুমু খাবি। তাহলেই আমার পয়সা উসুল হবে। তোকে শাস্তিও দেওয়া হবে আবার জন্মদিনের উপহারও আদায় হবে। এক ঢিলে কয় পাখি মারলাম বলতো? কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তুই তো আবার এইটটিন মাইনাস। তোর আঠারো বছর হতে কয়দিন বাকি যেনো? আচ্ছা থাক, সরাসরি চুমু খেতে হবে না। খামের ভেতর আমার একটা রুমাল আছে। তুই বরং আপাতত ওই রুমালেই চুমুটা দিয়ে দে। সময় করে এসে একদিন আমি আমার চুমুওয়ালা রুমালটা নিয়ে যাবো। ততদিনে সাতাশটা চুমু জমিয়ে ফেলতে পারবি না?”
সুমনা চিঠি পড়ে হেসে ফেললো। খাম থেকে রুমালটা বের করতেই দেখলো লাল সুতো দিয়ে ইংরেজি অক্ষরে লেখা আই লভ ইউ সুমনা। সুমনার চোখের পাতা ভেদ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে কেনো এতো ভাগ্যবতী? সত্যিই কি এতোবড় কপাল নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল সে? এমন দুঃসাহসিক কল্পনা তো তার স্বপ্নেও করার কথা ছিল না। জীবনে কখনও সুমনা চারহাজার টাকার পোশাক পড়েছে কি-না সন্দেহ। সেইখানে চারহাজার টাকার লিপস্টিক তো তার জন্য নিতান্তই দিবাস্বপ্ন হওয়ার কথা। কিন্তু অর্ণভ ভাই নামক মানুষটা যেনো সুমনার সকল দিবাস্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব নিয়েছেন। করুণাময় তাকে স্বর্গীয় দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন সুমনার অন্ধকারাচ্ছন্ন উৎকট দূর্গন্ধময় জীবনটাকে ফুলের সৌরভে মোহমান্বতি করতে। এইযে সুমনা এখন মহলের মতো বিশাল বাড়িতে আছে, দামী পোশাক পড়ছে, খাবার খাচ্ছে, স্বাভাবিক মানুষের মতো একটা সুস্থ জীবন পেয়েছে। এগুলো কিন্তু তার ভাগ্যে থাকার কথা ছিল না।তার জীবনটা এতো সুন্দর হওয়ার কথা কখনোই ছিল না। সে তো জন্মেছিল অভিশাপ নিয়ে। সুমনার বাবা সিকান্দার একটা মানুষরূপী নিকৃষ্ট জানোয়ার। আঁধার রাতে সুমনার মাকে হত্যা করে খাটের নিচে লুকিয়ে পরদিন সকালে ছোট্ট সুমনাকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন পয়সাওয়ালা কিছু হায়েনাদের হাতে। সুমনা তখন একটুও অবাক হয়নি। শুধু নিরাধার দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল বাবা নামের মানুষটির দিকে। সুমনার জীবনে আদর, ভালোবাসা বলতে একমাত্র যিনি ছিলেন তিনি হচ্ছে মা। সেদিনরাতে নৃশংসভাবে মায়ের মৃত্যু দেখে পাথর বনে গিয়েছিল সে। জগতে এর চেয়েও বেশি নিদারুণ কষ্ট সহ্য করার শক্তি পনেরো বছর বয়সী সুমনার ছিল না। বাবা মাকে খুন করেছিলেন শুধুমাত্র টাকার জন্য। তার বাবার স্বভাবটাই এমন। তিনি দিন-রাত ঘরে শুয়ে বসে থাকবেন, ড্রাগস নিবেন। মারাত্মক রকম ড্রাগ এডিক্টেড ছিলেন। সেই ড্রাগসের টাকা যোগাড় করতে মায়ের উপর প্রচুর অত্যাচার করতেন। সুমনার মা রাবেয়া বেগম ছিলেন এলাকার বেশ নামকরা একজন বুয়া। তিনি যে বাড়িতে কাজ করতে যেতেন দুইদিনেই সেই বাড়ির মানুষ জন তাঁর ভক্ত হয়ে যেতো। বাড়ি বাড়ি কাজ করেই বেশ ভালো টাকা কামাতেন তিনি। সুন্দর কাজের জন্য বকশিশ পেতেন। একদিন কাজে না আসলে মানুষ বাসায় দেখতে পর্যন্ত চলে আসতো। বুয়ার প্রতি এতো যত্ন আগে কেউ কখনও করেনি৷ রাবেয়া ছিলেন সকলের ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু ভয়ংকর সেই অবিস্মরণীয় রাতে সেই মানুষটির জীবনের চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। সুমনার মা রাবেয়া সেদিন হুমকি দিয়ে সিকান্দারকে বলেছিলেন, ” আর কোনোদিন টাকার লাইগা আমার বা আমার মাইয়ার গায়ে হাত তুললে আমি তোমারে গরুর মতো জবাই কইরা রাস্তার কুত্তারে খাওয়ামু।”
ব্যস, সিকান্দারের মাথায় যেনো খুন চেপে গেল। তিনি রাবেয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করলেন। প্রথমে বাশ দিয়ে বারি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিলেন। তারপর বিশাল পাথর দিয়ে রাবেয়ার সমস্ত শরীর থেতলে থেতলে হত্যা করলেন৷ মায়ের এই অপ্রত্যাশিত মৃত্য নিজচোখে দেখে সুমনা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আর যখন তার জ্ঞান ফেরে, সে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়৷ তার মুখের শব্দ হারিয়ে গেছিল তখন। অনুভূতিরা যেনো আত্মহত্যা করেছিল৷ সুমনাকে বিক্রি করে সিকান্দার ড্রাগসের টাকা ঠিকই যোগাড় করে নিচ্ছিলেন। সুমনা তখন আল্লাহর কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা করলো। সেও যেনো তার মায়ের মতো পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারে। ভয়ংকর এই জীবন থেকে মুক্তি চাই তার। হায়েনাদের অত্যাচারে যেনো তার মৃত্যু হয়। কিন্তু দশজন হায়েনার ভীড়ে একজন মানুষও উপস্থিত ছিল সেদিন। সেই মানুষটির নাম অর্ণভ জোয়ার্দার। সেও একইভাবে টাকা দিয়ে সুমনাকে কিনে আনলো। কিন্তু ভোগের জন্য নয়, সর্বনাশা জীবন থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। প্রথম কিছুদিন সুমনা অর্ণভদের বাড়িতেই ছিল। তাকে নিয়ে ওই বাড়িতে অনেক ঝামেলা হচ্ছিল। অরিন ছাড়া কেউই সুমনার সাথে ভালো ব্যবহার করতো না। প্রায়ই অর্ণভ আর তার বাবার মধ্যে ঝগড়া হতো সুমনাকে নিয়ে। তারপর বাসন্তী তাকে এই বাড়িতে নিয়ে এলেন। সুমনা কখনও কল্পনাও করেনি তার জীবনটা এইভাবে পাল্টে যাবে।আর সবচেয়ে বড় অবাক তো সুমনা সেদিন হয়েছিল যেদিন জানতে পারলো অর্ণভ ভাই তাকে শুধু দয়া দেখিয়ে সেই হায়েনাদের হাত থেকে ফিরিয়ে আনেননি। বরং তিনি সুমনাকে ভালোবেসেছেন। এতো এতো এতো বেশি ভালোবেসেছেন যে পৃথিবীর সবকিছু বিসর্জন দিয়ে শুধু সুমনাকে নিয়ে বাঁচতে চাইছেন। সুমনা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চেহারাটা একবার দেখে মুচকি হেসে বললো,” তুই সত্যিই খুব ভাগ্যবতী রে সুমনা। কিন্তু এতো সুখ তোর এই পোড়া কপালে সইবে তো?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here