#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_১৮
লিখা: Sidratul Muntaz
হাসপাতালের নার্স হয়তো অর্ণভকে শায়িখ সাহেবের বাড়ির লোক ভেবেছেন। তাই একটা ফাইলসহ প্রেস্ক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
” ঔষধগুলো নিচে থেকে কিনে আনুন। একটা ইঞ্জেকশনও আছে। ভালো করে দেখে আনবেন।”
ব্যস্ত নার্স কথাটুকু বলেই হনহন করে কোথায় যেনো চলে গেলেন। এদিকে অর্ণভের কাছে বেশি টাকাও নেই। এখানে কমপক্ষে তিনহাজার টাকার ঔষধ তো থাকবেই। অর্ণভের পকেটে বড়জোর সাতশো বা আটশো আছে। এই টাকায় সে এতো ঔষধ কিভাবে কিনবে? উফফ, অরিন যদি এই বুড়োটাকে বিয়ে করে তাহলে তো সারাজীবন ঔষধ কিনতে কিনতেই জীবন শেষ হয়ে যাবে। কত রকমের ঔষধ লাগে বুড়োর। এই ঔষধ খেতে খেতে বুড়োটা একদিন দুম করে মরে না যায়। তখন অরিনের কি হবে? অল্প বয়সে বিধবা? না, না, আদরের বোনের এমন করুণ পরিণতি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এইভাবে তো অর্ণভ চিন্তাও করেনি৷ আর যাইহোক, বুড়োর কাছে অর্ণভ তার বোনকে কিছুতেই বিয়ে দিবে না। অর্ণভ আবারও বিথিকে একটা ফোন করলো।
” হ্যালো বিথি।”
” বল দোস্ত? ”
” আচ্ছা, তোর হাসব্যান্ডের মাসে কয়টাকার ঔষধ লাগে রে?”
” ঔষধ? কেনো? তুই কি আমার হাসব্যান্ডকে ঔষধ কিনে দিবি?”
” যদি সঠিক পরামর্শ দিতে পারিস তাহলে অবশ্যই কিনে দিবো।”
” কি পরামর্শ লাগবে?”
” যে বুড়োকে অরিন বিয়ে করার জান্য লাফাচ্ছে তার এক সপ্তাহের ঔষধের দামই দুই-তিনহাজার টাকা। এতো ঔষধ খেলে বেটা বাঁচবে কয়দিন? ফট করে তো একদিন মরে যাবে। তখন অরিনের কি হবে? আমার বোনটা কি সারাজীবন বিধবা হয়ে থাকবে?”
” বিধবা থাকবে কেনো? বুড়ো মরলে ওকে আবার অন্য জায়গায় বিয়ে দিবি। তাছাড়া একদিক দিয়ে লাভও আছে। বুড়োর টাকা-পয়সা থাকলে তো অরিনই সব পাবে।”
” শুধু টাকা-পয়সার জন্য একটা বুড়োর কাছে বোনকে বলি দিবো?”
” বলি দেওয়ার কথা আসছে কেনো? বুড়ো বলে কি সে মানুষ না? শুধু মেশিন ঠিক থাকলেই আর কোনো সমস্যা নেই।”
” মেশিন মানে?”
” আরে বুঝিসনি? যেটা দিয়ে বংশবৃদ্ধি হয়।”
” উফফ, শিট। তোদের মেয়ে-মানুষের লজ্জা শরম এতো কম?”
অর্ণভ যথেষ্ট অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বিথি প্রসঙ্গ বদলাতে বললো,
” জন্ম, মৃত্য, বিয়ে সব তো আল্লাহর হাতে। আমাদের কি এ বিষয়ে কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে? তুই এতো চিন্তা কেনো করছিস?”
” তাই বলে চিন্তা করবো না? পৃথিবীর সবকিছুই তো আল্লাহর হাতে। সেজন্য কি আমরা নিশ্চিন্তে বসে থাকি? কোনোকিছু চেষ্টা করি না?”
” তুই তাহলে এখন কি চাইছিস?”
” এই বুড়োর সাথে আমি অরিনকে বিয়ে দিবো না।”
” ঠিকাছে, যদি অরিনকে বুঝিয়ে মানাতে পারিস তাহলে বিয়ে দিস না। সমস্যা নেই তো।”
” এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। ও কি মানবে? ওই বুড়োর ভূত ওর মাথা থেকে নামানোর আইডিয়া জানতেই তোকে ফোন করেছি।”
” এক কাজ কর। বুড়োটাকেই মেরে ফেল। ঝামেলা শেষ। ”
” ছি, ছি, আমি মানুষ খুন করবো? তোর এতো জঘন্য মনে হলো আমাকে? একটা টিকটিকি মারতে গেলেও তো আমার হাত কাঁপে।”
বিথি হাসতে হাসতে বললো,” মজা করে বললাম। তুই সিরিয়াস হচ্ছিস কেনো? আচ্ছা অরিনের ফোন নাম্বারটা দে। আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো।”
” ওর রিসেন্ট নাম্বারটা আপাতত বন্ধ আছে। আমি তোকে পরে নাম্বার পাঠিয়ে দিবো। কিন্তু একটা কথা বলি দোস্ত, প্রয়োজনে আমি অরিনকে পায়ে শিকল পড়িয়ে ঘরে বসিয়ে রাখবো। তাও কিছুতেই ওই বুড়োর কাছে যেতে দিবো না।”
” পায়ে শিকল পড়িয়ে কয়দিন আটকে রাখবি?”
” যতদিন ওই আধমরা বুড়ো না মরছে ততদিন। আরও ভয়ানক ব্যাপার কি জানিস? ওই বুড়োর বউ পর্যন্ত এই বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে। তুই ভাবতে পারছিস? আমাকে বলে কি-না খুব শীঘ্রই অরিনকে নিজের সংসারে নিয়ে যেতে চায়। মানুষ কি পরিমাণ সিক হলে এই ধরণের কথা বলতে পারে? আবার তার ছ্যাঁচড়া ছেলেটাও কিন্তু অরিনের পেছনে রোমিও হয়ে ঘুরছে। বাপ-ছেলের মধ্যে তো এই নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ লেগে গেছে। সেই যুদ্ধের রেশ ধরে বুড়ো এখন হসপিটালে ভর্তি। আচ্ছা, আমি কি আমার বোনকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবো না যুদ্ধক্ষেত্রে? বলতো?”
” তুই আমাকে এইসব কি শুনাচ্ছিস দোস্ত? আমার তো রীতিমতো মাথা ঘুরছে। আচ্ছা, আমি আগে মাথায় পানি ঢেলে আসি তারপর তোর সঙ্গে কথা বলবো।”
” হ্যালো, হ্যালো।”
বিথী ফোন রেখে দিয়েছে। সত্যিই কি মাথায় পানি ঢালতে গেল? অর্ণভের নিজেরও মাথায় পানি ঢালা দরকার। মাথাটা মাত্রাতিরিক্ত গরম হয়ে আছে। অর্ণভ পেছনে ঘুরতেই দেখলো বাদামী রঙের কূর্তি গায়ে শ্যানিন বড় বড় চোখ মেলে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঠিক অর্ণভের মুখ বরাবর। রাগে তার শরীর পুরোদমে কাঁপছে। এই অগ্নিমূর্তি দেখে অর্ণভের গলা শুকিয়ে গেল। শ্যানিন খাবল মেরে অর্ণভের হাত থেকে ফাইলটা নিতে নিতে তেজী কণ্ঠে বললো,
” আমার বাবা বুড়ো? আমার মা সিক? ভাইয়া ছ্যাঁচড়া রোমিও? আমাদের পরিবারটা আপনার যুদ্ধক্ষেত্র মনে হয়? আপনি চাইছেন আমার বাবা মরে যাক? শুধু মাত্র কয়টা ঔষধ কিনতে হবে বলে এতো বদনাম? ছি! কোনো দরকার নেই আপনার ঔষধের। আমি নিজেই গিয়ে বাবার জন্য ঔষধ আনতে পারি। আপনার টাকায় থু।”
শ্যানিন এই কথাগুলো বলতে বলতে গটগট করে হেঁটে গেল। ওর চোখে জল পর্যন্ত চলে এসেছে। এই মেয়ে কি শুনেছে, কতটুকু বুঝেছে আল্লাহ মা’বুদ জানেন। অরিনকে আবার বলে দিবে না তো? তাহলে যে সর্বনাশ! তখন তো অরিন অর্ণভকেই শত্রু ভাববে। অর্ণভ কিছু বুঝাতে গেলেও আর শুনবে না। উফফ, কি মুশকিল! অর্ণভ শ্যানিনের পেছন পেছন গেল। শ্যানিন লিফটে উঠেই দরজা বন্ধ করে দিতে নিচ্ছিল। অর্ণভ দুই হাতে দরজার বন্ধ হয়ে যাওয়া আটকালো। তারপর দ্রুত লিফটে ঢুকলো। শ্যানিন বড় বড় চোখে তাকালো। অর্ণভ নরম গলায় বললো,
” কেমন আছো শ্যানিন?”
শ্যানিন আরও জোরে চোখ রাঙানি দিল। অর্ণভ অসহায় মুখে বললো,
” আচ্ছা স্যরি। বিশ্বাস করো, আমার ফ্রেন্ডের সাথে ফান করে ওইসব বলেছি। তুমি বুঝতে পারোনি। আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি। ”
শ্যানিন গর্জন করে উঠলো।
” এইটা ফান? আমার হসপিটালে শয্যাশায়ী বাবার মৃত্যুকামনা করেছেন আপনি। এই বিষয়টা ফান মনে হচ্ছে আপনার?”
অর্ণভ চুপ করে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা দারুণ ক্ষেপেছে। শ্যানিন হাত ভাজ করে বললো,
” অরিনকে এসব কথা আমি অবশ্যই বলবো। তার বিশুদ্ধ ভাইয়ের মেন্টালিটি কত শুদ্ধ, কত সুন্দর চিন্তা-ভাবনা করে! আমার বাবার মৃত্যু পর্যন্ত চায়! তাও সামান্য ঔষধ লাগবে বলে। ছি!”
অর্ণভের আত্মা অর্ধেক শুকিয়ে গেল।
” অরিনকে আবার এসব জানানোর কি দরকার? নিজে ভুল বুঝে অরিনকেও ভুল বুঝাতে চাও?”
” আমি ঠিকই বুঝেছি।”
লিফট থেমে গেছে। শ্যানিন সামনে হাঁটতে লাগলো। অর্ণভ এবারও ওর পিছু নিয়ে মিনতির স্বরে বললো,
” দেখো শ্যানিন, রাগ করো না। আমি সত্যিই আমার ফ্রেন্ডের সাথে মজা করছিলাম। তাছাড়া তোমার বাবার সাথে তো আমার সম্পর্কটাই এমন। মজার সম্পর্ক! তাই না?”
” আমার বাবার সাথে আপনার মজার সম্পর্ক হয় কি করে? মানে কি করে?”
অর্ণভ মুখ শুকনো করে বললো,” পাবলিক প্লেসে এইভাবে চিৎকার কেনো করছো অযথা? আমরা তো ঠান্ডা মাথায় বসেও কথা বলতে পারি।”
শ্যানিন আরও আক্রোশ নিয়ে বললো,
” আমাদের পরিবার খুব খারাপ তো? এইখানে অরিনকে বিয়ে দিতে হবে না। আপনি আপনার বোনকে জাদুঘরে তুলে রাখুন। নিজেও জাদুঘরে চলে যান। আমার ভাই ছ্যাঁচড়া, আমি চিৎকার করি অযথা, আমার মা সিক, বাবা আধমরা বুড়ো। আর আপনাদের পরিবারের সবাই সাধু সন্ন্যাসী। তাহলে আপনারা লোকালয়ে কেনো থাকেন? সাধারণ মানুষের মাঝে তো আপনাদের থাকার কথা না। মরুভূমির দেশে চলে যান।”
শ্যানিন তার কথা শেষ করে ফার্মেসীতে ঢুকে গেল। অর্ণভ হতাশ হয়ে বাহিরের একটা বেঞ্চিতে বসলো। কি থেকে যে কি হচ্ছে, তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।পরিস্থিতি অনবরত জটিল হয়ে যাচ্ছে৷ এখন শ্যানিন গিয়ে অরিনকে কি ভংচং বুঝাবে আল্লাহ জানেন।অর্ণভের পাশে বসেই নাসির বললো,
” বড়ভাই লাইটার আছে?”
নাসিরের হাতে সিগারেট। সে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে লাইটার চাইছে। অর্ণভ ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চায়ের দোকানে করতে না পারা কাজটা এখন করে বসলো। নাসিরের নাক বরাবর একটা শক্ত ঘুষি মেরে দিল। নাসির কয়েক মুহুর্তের জন্য চোখে-মুখে অন্ধকার দেখলো। অর্ণভের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার অসহায় মস্তিষ্ক বুঝতেই পারছে না তাকে কেনো মারা হয়েছে। নাসিরের নাক থেকে কয়েক ফোটা রক্ত বেরিয়ে এলো। সেই রক্ত দেখে নাসির আরও ভড়কে গেল। আরও বেশি ভয় পাওয়া দৃষ্টি নিয়ে অর্ণভের দিকে তাকালো। শ্যানিন এই অবস্থা দেখে বজ্র কণ্ঠে বললো,
” আপনার সমস্যা কি? নাসির ভাইকে কেনো মারলেন? ভাইয়ার বন্ধু বলে আপনি তাকেও মারবেন?”
অর্ণভ গম্ভীর স্বরে বললো,
” কারো বন্ধু হওয়ার জন্য আমি ওকে মারিনি। রামছাগলের মতো দাঁত কেলিয়ে লাইটার চাওয়ার জন্য মেরেছি।”
নাসির সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে সিগারেট ফেলে বললো,” আমি আর জীবনে কোনোদিন সিগারেট খাওয়ার জন্য কারো কাছে লাইটার চাইবো না। আমি আর জীবনে সিগারেটই খাবো না।”
শ্যানিন বললো,
” নাসির ভাই, আপনি এই মানুষটার কাছে লাইটার চেয়েছেন? আমার কাছে চাইতেন। আমি আপনাকে কিনে এনে দিতাম।”
এরপর অর্ণভের দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বললো,” আর আপনি লাইটার চাওয়ার জন্য কাউকে ঘুষি দিয়ে রক্ত বের করে ফেলতে পারেন না। মাস্তানির একটা লিমিট থাকা উচিৎ। সামান্য লাইটার চাওয়ার জন্য যদি আপনি উনাকে ঘুষি মারতে পারেন তাহলে একটু আগে আপনি যেটা করেছেন তার জন্য আমার উচিৎ এই ইঞ্জেকশনের সূচ দিয়ে আপনার চোখ গেলে দেওয়া। আমি কি সেটা করেছি?”
অর্ণভ ইঞ্জেকশনের দিকে তাকালো। তার রীতিমতো ভয় লাগছে। এই মেয়ে যেই চীজ। সত্যি সত্যি অর্ণভের চোখ গেলে দিতে পারে। দুইবছর আগে কি করেছিল সেটা আজও মনে আছে অর্ণভের।
সেদিন শুক্রবার ছিল। অর্ণভ এইদিনে সবসময় বাসায় থাকে। কিন্তু সেদিন একটু বের হয়েছিল এলাকার দোকানে বসে চা খেতে। অর্ণভের কিছু বন্ধুও এসেছিল। সবাই আড্ডা দিচ্ছিল একসাথে। হঠাৎ শ্যানিন কোথ থেকে একটা পিস্তল নিয়ে এসে অর্ণভের মাথায় তাক করে বললো,
” এখনি চলুন কাজী অফিস। নাহলে আই উইল শ্যুট ইউ।”
অর্ণভ অজান্তেই দুইহাত উপরে তুলে আসামির মতো সারেন্ডার করলো। চায়ের দোকানে মানুষ জমে গেছে। সবাই কৌতুহল নিয়ে দেখছে ওদের কান্ড। অর্ণভ ঢোক গিলে বললো,
” এসব কি শ্যানিন?”
” তার আগে আপনি বলুন এসব কি? আপনি মানুষটা এমন কেনো? শুক্রবার আপনি বাসায় থাকেন বলে কত শখ করে আমি লাল শাড়ি, লাল চুড়ি পড়ে এসেছি। আপনি কি ভেবেছেন? আমি অরিনের কাছে এসেছি? ভুলেও না। আমি তো আপনার কাছে এসেছি। অথচ আপনি কি করলেন? আমার দিকে ভালো করে তাকালেন পর্যন্ত না। একবারও তো বললেন না, শ্যানিন তোমাকে সুন্দর লাগছে। আমি আসার পাঁচমিনিটের মাথায় বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। কেনো? চা খাওয়া কি এতো জরুরী? কি এমন আছে এই চায়ে? যা শ্যানিনের মধ্যে নেই?”
অর্ণভ লজ্জিত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকালো। মানুষ জন হাসছে। অর্ণভের বন্ধুরা শ্যানিনকে আগা-গোড়া দেখে একদম মুখস্ত করে নিচ্ছে। অর্ণভ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
” রাস্তা-ঘাটে এইসব কি শুরু করেছো? চলো আমরা বাসায় গিয়ে এই বিষয়ে কথা বলবো।”
” না আমি যাবো না। বাসায় নিয়ে আপনি আমাকে আবার ভুল-ভাল বুঝাবেন। আপনার লেকচার শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। আজকে একটা এসপার-ওসপার হবেই। হয় আপনি আমাকে নিয়ে কাজী অফিসে যাবেন নয়তো আমি এখানেই আত্মহত্যা করবো।”
শ্যানিন নিজের মাথায় পিস্তল ধরলো। অর্ণভ দ্রুত গলায় বললো,
” কি পাগলামি করছো শ্যানিন? বিয়ে যে করতে চাও, তোমার কি বিয়ের বয়স হয়েছে?”
শ্যানিন চোখ বন্ধ করে পিস্তলের ট্রিগার চেপে দিল। অর্ণভ আতঙ্কে জুবুথুবু হয়ে চোখ-মুখ খিচে জোরে একটা চিৎকার দিল। শ্যানিন রাস্তার মাঝেই লুটিয়ে পড়লো। কয়েক মুহুর্ত পিনপতন নীরবতায় কাটলো। তারপর অর্ণভ শ্যানিনকে কোলে তুলে চিৎকার দিতে দিতে বললো,
” ইমিডিয়েটলি হসপিটালে নিতে হবে। দোস্ত পাঁচমিনিটের মাথায় কি একটা এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা যায় না? ”
অর্ণভের এক বন্ধু রিশাদ বললো,” ভালো করে চেয়ে দ্যাখ। এম্বুলেন্স লাগবে না।”
অর্ণভ শ্যানিনের মুখের দিকে তাকাতেই দেখলো মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। অর্ণভের চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। শ্যানিন অর্ণভের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
” কোলে যখন নিয়েই ফেলেছেন তাহলে আর হসপিটাল কেনো? চলুন, কাজী অফিসে গিয়েই আসল কাজ করে আসি।”
শ্যানিন এক চোখ টিপল। অর্ণভ রাগে শ্যানিনকে কোল থেকে আছাড় মেরে ফেলে দিল। তারপর? কোমরে ভেঙে এক সপ্তাহের জন্য সত্যি সত্যি হসপিটালে থাকতে হয়েছিল। পরে জানা গেছে, শ্যানিন ওই পিস্তল অর্ণভের বড়মামার ওয়ারড্রোবের ড্রয়ার থেকে চুরি করেছিল। বড়মামা পুলিশ মানুষ। ঘরে পিস্তল রাখলে সবসময় বুলেট বের করে রাখেন। ভাগ্যিস সেদিন পিস্তলে বুলেট ছিল না। তাহলে কি যে সর্বনাশ হতো! এরপর থেকে বড়মামা আর বাসায় পিস্তল রাখেন না। অর্ণভের এখন মনে হচ্ছে ইঞ্জেকশনেও কোনো সূচ নেই। কারণ ইনটেক ইঞ্জেকশনের সাথে সবসময় সূচ থাকে না। শ্যানিন কি আবার মিথ্যে বলে অর্ণভকে ভয় দেখালো?
অর্ণভ অরিনকে নিয়ে বাসায় ফেরার সময় নুসাইবা বললেন,
” অরিন থাকুক না আমাদের সাথে। তুমি চলে যাও। অরিনকে পরে ইলহান পৌঁছে দিবে।”
নুসাইবা কথাটা এক বিশেষ অর্থে বলেছেন। কিন্তু অর্ণভ সেই অর্থ বুঝতে না পেরে উল্টোটা বুঝলো। সে ভাবলো ভদ্রমহিলা বৃদ্ধের সেবা-শুশ্রূষার জন্য অরিনকে রেখে দিতে চাইছেন। বুড়ো তো আবার অরিনকে দেখলেই অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায়। নাহলে কি আর মাঝরাতে গাড়ি পাঠিয়ে বাসায় ডেকে নেয়? অর্ণভ রাগী কণ্ঠে বললো,
” অনেক রাত হয়ে গেছে। অরিনকে এখন বাসায় যেতে হবে। নাহলে মা চিন্তা করবে।”
” চিন্তার কি আছে? আচ্ছা তুমি আপাকে ফোন করে দাও আমি কথা বলে নিচ্ছি।”
অর্ণভ ত্যাড়া গলায় বললো,” কোনো দরকার নেই। অরিন আমার সাথেই যাবে। ”
নুসাইবা হেসে বললেন,” ঠিকাছে, তোমার ইচ্ছা। নিয়ে গেলে নিয়ে যাও। কিন্তু অরিন থাকতে চাইছিল তাই আমি বললাম।”
অর্ণভ অনেকটা ধমক দেওয়ার মতো বললো,” ওর ইচ্ছেতেই সব হবে নাকি?”
নুসাইবা বুঝতে পারলেন না ছেলেটা এইভাবে কথা কেনো বলছে। শ্যানিন অবশ্য বলেছিল অরিনের ভাই একটু রগচটা। এখন মনে হচ্ছে শুধু রগচটা না, খুব রক্ষণশীলও। নুসাইবা অরিনকে ডাকলেন অর্ণভের সাথে চলে যাওয়ার জন্য। অরিন এসে বললো,
” আমি এখানে থাকি ভাইয়া? প্লিজ।”
অর্ণভ খুব বিরক্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বুড়োটা দেখা যায় তার বোনের কচি মাথা একদম চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছে। সে মনে মনে ঠিক করলো, কাল মাকে নিয়ে আসবে হসপিটালে। মায়ের ধমক খেয়ে যদি অরিনের একটু শিক্ষা হয়। অর্ণভ চলে যাওয়ার সময় অরিনকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললো,
” এসব আজে-বাজে বিয়ের ভূত মাথা থেকে বের কর। তোর কি মনে হয়? এইরকম পাত্রের কাছে মা-বাবা তোকে বিয়ে দিতে রাজি হবে?”
” তুমিও তো মা-বাবার অমতে সুমনাকে বিয়ে করছো। তাহলে আমি করলে দোষ কোথায়?”
অর্ণভ বিস্মিত হয়ে গেল। অরিন দেখি মুখে মুখে ভালোই তর্ক শিখেছে। সব ওই বুড়োর ব্রেইনওয়াশের কুফল। অর্ণভ রাগে দাঁত খিচে বললো,
” তোর সাথে আমার তুলনা কিসের? আমি কি তোর মতো বুড়া মানুষ বিয়ে করতে যাচ্ছি?”
” বুড়া কেনো বলছো ভাইয়া? তোমার থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা বলে? জানি খুব অতিরিক্তই লম্বা। তাই বলে কি বুড়া হয়ে গেল? ”
” পাঁচ ইঞ্চি মানে?”
অর্ণভ হতভম্ব। তার বোন এতো নির্লজ্জ হয়ে গেছে? বড়ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কি জঘন্য কথাটাই না উচ্চারণ করলো। এখন বিথির বলা সেই কথাটাই কানে বাজছে,” শুধু মেশিন ঠিক থাকলেই আর কোনো সমস্যা নেই।” তার মানে অরিনও বিথির মতো চিন্তা করে! অর্ণভ “ছি, ছি” করতে করতে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেল। তার ছোট্টবোনটার যে এতো অধঃপতন হয়ে গেছে সে জানতো না। অথচ অর্ণভ বুঝলোই না অরিন আসলে ইলহান আর অর্ণভের উচ্চতার পার্থক্যের কথা বলছিল।
চলবে