#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_২০
লিখা: Sidratul Muntaz
অর্ণভ আর হালিমা অরিনের কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই একটা নার্স এলো অরিনের কাছে। সে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো,
” আপু ভালো আছেন?”
অরিন বিনয়ী কণ্ঠে জবাব দিল,
” জ্বী, সিস্টার। ভালো আছি।”
নার্সটা টেবিলের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
” কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আপু?”
” বলুন।”
” ওইযে, লম্বা করে খুব সুন্দর একটা ভাইয়া আছে না? ব্রাউন চুল, বিদেশী বিদেশী। উনি আপনার কে হয়?”
অরিন কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ আগে হলে নির্দ্বিধায় বলে দিতো, ফিয়্যান্সে। কিন্তু এখন তো বিয়েটাই ভেঙে গেছে। তাই ইলহানকে ফিয়্যান্সে বলে পরিচয় দেওয়ার কোনো মানে হয় না। নার্সটা খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইছে। অরিন অল্প হেসে বললো,
” আমার বেস্টফ্রেন্ডের ভাই। কেনো?”
” ডোন্ট মাইন্ড আপু, আমি আপনাদের কথা শুনেছি। আপনাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে এটা আমি জানি।”
অরিন ইতস্ততভাবে চুল কানে গুজে বললো,
” ও। ”
” আপু আপনি কিন্তু খুব লাকি। ভাইয়ার সাথে বিয়ে হলে আপনি অনেক হ্যাপি থাকবেন। সে আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আপনাদের জন্য আমার তরফ থেকে শুভকামনা।”
নার্স চলে যাচ্ছিল। অরিন বললো,
” এই শুনুন।”
” জ্বী আপু?” নার্স থেমে দাঁড়ালো।
” আপনি কিভাবে বুঝলেন যে সে আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে?”
” উনার কান্না দেখেই বুঝেছি। ছেলে মানুষ যে এতো কাঁদতে পারে উনাকে না দেখলে আমি জানতামই না। সারারাত উনি আপনার পাশে বসে ছিলেন। পাগলের মতো ছটফট করেছেন। আমি এইখানে যতবার এসেছি ততবার দেখেছি আপনি ঘুমিয়ে আছেন আর ভাইয়া পাহাড়া দিচ্ছেন, মশা তাড়াচ্ছেন, মাঝে মাঝে আপনার হাত নিয়ে চুমু দিচ্ছেন। উনার চোখে সারাক্ষণ পানি লেগে ছিল। আমার নিজের কাছেই খুব মায়া লাগছিল। একবার ভেবেছিলাম আপনাকে ঘুম থেকে তুলে দেখাবো। কিন্তু ডাক্তার যে বলেছে আপনার একটানা ঘুম জরুরী, তাই ভাইয়া কাউকে কেবিনে ঢুকতে দেননি। যাতে আপনার ঘুমের কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্য তিনি সারারাত দাঁড়রক্ষীর মতো জেগে ছিলেন। বিয়ের আগেই যার এই অবস্থা, এতো যত্ন! তাহলে চিন্তা করে দেখুন বিয়ের পর কি হতে চলেছে? আমার মনে হয় আমি এই প্রথম কারো প্রতি এমন গভীর ভালোবাসার উদাহরণ দেখলাম। আপনাদের বন্ধন সারাজীবন অটুট থাকুক। বেস্ট অফ লাক আপু।”
নার্স একটা উজ্জ্বল হাসি দিল। অরিন অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে পারলো না।
একটু পর অরিন কেবিন থেকে বের হয়ে দেখলো ইলহান সিঁড়ির পাশের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেনো ফোনে কথা বলছে। ইলহানের মুখে প্রফুল্ল হাসি। ওকে খুব প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। তবে ঘুম না হওয়ার কারণে চোখ দু’টো হালকা ফাঁপা লাগছে।গালের দুই পাশে টোল ভেসে উঠেছে। ইলহানের হাসিটা সত্যিই নজর কাড়ে। যখন সে জানতে পারবে বিয়েটা ভেঙে গেছে তখন এই অপূর্ব হাসির কি হবে? অরিন আরেকটু কাছে যেতেই শুনতে পেল ইলহান ফোনে বলছে,
” হা হা, অ্যাংকার! তুই না আসলে কিন্তু আমি বিয়েই করবো না। যত দেরি করবি তত বিয়ের ডেইট পেছানো হবে। তবুও তোকে থাকতেই হবে। আমার লাইফের বেস্ট এচিভমেন্টের দিন আমি তোর সাথে সেলিব্রেট করতে চাই ডিয়ার!”
ওই পাশ থেকে কিছু বলা হলো। এরপর ইলহান বললো,
” অরিনই তো আমার জীবনের বেস্ট এচিভমেন্ট। ও সাথে থাকলে আমার আর কিচ্ছু লাগবে না৷ আর ফাইনালি ম্যাডাম বিয়েতে রাজি হয়েছে। এর চেয়ে বড় হ্যাপিনেস আর কি হতে পারে বল? এতোদিন আমার ঘ্যানঘ্যানানি শুনে বিরক্ত হয়েছিস না? এবার আমার খুশি দেখতে দেখতে বিরক্ত হবি।”
এবার ওই পাশের ব্যাক্তিটি কিছু বললো। ইলহান বললো,
” একটা বিষয় খেয়াল করেছিস অ্যাংকার? আমার জীবনে কিন্তু অরিনের ভূমিকাটা দুইরকম। প্রথমটা খুব যন্ত্রণাদায়ক, শ্বাস রুদ্ধকর, একদম মেরে ফেলার মতো অবস্থা করে। আর দ্বিতীয়টা হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখ, অমায়িক শান্তির। এইযে, এখন অরিন শুধু আমার। এই সুখের কথা যতবার ভাবছি ততবার আনন্দে আমার শরীর কাঁপছে। অথচ কয়েকদিন আগেও আমি কিচ্ছু ভাবতে পারছিলাম না। ঘুমাতে, খেতে, হাঁটতে, চলতে, উঠতে, বসতে মানে প্রত্যেকটা মুহুর্তে শুধু অরিন কল্পনায় চলে আসতো। ও আমাকে জ্বালিয়ে মারছিল। তুই তো সবই জানিস। ওর জন্য আমি কত কিছু করেছি। বাংলাদেশে পর্যন্ত ছুটে এসেছি। যেই দেশে আর কখনও ফিরবো না বলে শপথ করেছিলাম। অরিনের জন্য আমি সেই শপথের তোয়াক্কাও করিনি। অবশেষে সেই অরিন আমার হতে চলেছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, এই মুহুর্তে আমার চেয়ে সুখী মানুষ এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আজরাতে মনে হয় খুব শান্তির একটা ঘুম হবে। কিন্তু অরিন আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে। এইবার তো আমার পালা। আমিও ওকে প্রচুর জ্বালাবো দেখিস। আমার প্রত্যেক রাতের ঘুম হারাম করেছে ও। এইবার আমিও ওর প্রত্যেক রাতের ঘুম হারাম করবো। ইটস টাইম টু টেইক রিভেঞ্জ। ”
অরিন দ্রুত ওই জায়গা থেকে সরে এলো। তার এসব কথা শুনতে একদম ভালো লাগছে না। সে আর ইলহানের সামনেই যাবে না, ধূর! এই ছেলে শুধু মায়া লাগাতে জানে। আর অরিনও ক্রমাগত দূর্বল হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে তো সে মায়ের পায়ে ধরে বিয়ের জন্য মিনতি শুধু করবে। কিন্তু মা কি রাজি হবে? আচ্ছা, ইলহান একটু আগে অ্যাংকারকে বলছিল সে নাকি অরিনের জন্যই বাংলাদেশে এসেছে। এই ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। কারণ ইলহান বাংলাদেশে আসার আগে তো অরিন তাকে চিনতোই না। তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল ইলহানের কাজিনের বিয়েতে। তাহলে? সেই বিয়েতে মার্টিন অ্যাংকার নামের একটা ছেলে ছিল। সে ইলহানের বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু বিদেশী। ইলহানের ভাষ্যমতে অ্যাংকার অরিনকে আগে থেকেই চিনে। কিন্তু বিয়েতে যখন
অ্যাংকারের সাথে অরিনের দেখা হয়েছিল তখন তো অরিনের একবারও মনে হয়নি যে অ্যাংকার তাকে আগে থেকেই চিনতো! কোথায় যেনো একটা গন্ডগোল লাগছে। হালিমা দূর থেকে হাত উঁচু করে অরিনকে ডাকলেন,
” এই অরিন, এদিকে আয়। আমরা চলে যাচ্ছি।”
অরিন মাথা নিচু করে মায়ের কাছে গেল। অর্ণভ বললো,
” অনেক হয়েছে। এইবার বাসায় চল।”
অরিন নিম্ন কণ্ঠে বললো,” মা, তুমি কি বিয়ের বিষয়টা নিয়ে আরেকবার ভেবে দেখবে?”
অর্ণভ উচ্চকণ্ঠে ধমক দিল।
” আরেকবার এই কথা বললে একটা চটকণা খাবি তুই। ফাজিল!”
অর্ণভের ধমক শুনে হালিমা নিজেই আঁতকে উঠলেন। আর অরিন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে মায়ের একহাত জড়িয়ে ধরলো। আশেপাশের মানুষ ওদের দিকে তাকাচ্ছে। কত অস্বস্তিকর পরিস্থিতি! অরিনের রাগে কান্না পাচ্ছে। অর্ণভ বললো,
” খুব বেশি বাড় বেড়েছে না তোর? এক্ষুণি বাসায় চল।”
অর্ণভ হাত টেনে ধরলো অরিনের। অরিন অভিমানী গলায় বললো,
” যাবো না।”
অর্ণভ আরও রেগে গেল।
“এইবার কিন্তু সত্যি-সত্যি আমার হাতে চড় খাবি। মা তোমার মেয়েকে বুঝাও৷ আমার মেজাজ খারাপ হলে কিন্তু আমি সবকিছু ভেঙে ফেলবো।”
হালিমা অর্ণভকে ঠান্ডা করার জন্য বললেন,” আচ্ছা, আচ্ছা যাবে৷ ও নিশ্চয়ই বাসায় যাবে। তুই নিচে গিয়ে ট্যাক্সি ডাক। আমি ওকে বুঝিয়ে নিয়ে আসছি।”
অর্ণভ হনহন করে বেরিয়ে গেল। প্রায় সবাই অরিনের মুখের দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। এতোগুলা মানুষের সামনে বকা খেয়ে অরিনের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। কান্না আসছে! ভাইয়া কেনো এমন করলো? সে তো কখনও এতো বাজে ব্যবহার করে না! চেচামেচি শুনে শ্যানিন ছুটে এসে বললো,
” আন্টি, অরিন, কি হয়েছে?”
হালিমা মনখারাপ করা দৃষ্টি নিয়ে শ্যানিনের দিকে তাকালেন। এই মেয়েটাকে তিনি খুবই পছন্দ করেন। তার অনেক আগে থেকেই ইচ্ছা, শ্যানিনকে বাড়ির বউ করবেন। শ্যানিন যে অর্ণভকে পছন্দ করে এটা হালিমা বেশ ভালো করেই জানেন। তিনি ভেবেছিলেন শ্যানিনের লেখাপড়া শেষ হলেই ওদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন। কিন্তু এখন অরিনকে নিয়ে এই বিয়ে সংক্রান্ত ঝামেলাটার জন্য সেই ইচ্ছা পূরণ হবার নয়। বেস্টফ্রেন্ডের বাপের কাছে আবার কেউ কিভাবে মেয়েকে বিয়ে দেয়? এও কি সম্ভব? হালিমা শায়িখ সাহেবকে কিছু বলতেও পারছেন না। কারণ অরিন নিজেই তো এই বিয়েতে রাজি। শায়িখ সাহেব দোষী হলে অরিনও দোষী। আর যদি অরিনের বিয়েটা হয়েও যায় তাও শ্যানিনের সাথে অর্ণভের বিয়ে সম্ভব না। কারণ তখন অর্ণভ হয়ে যাবে শ্যানিনের মামা। তাও আবার সৎ মামা। ছি, ছি ছি! আস্তাগফিরুল্লাহ! হালিমা শ্যানিনের কথার কোনো জবাব না দিয়েই অরিনকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলেন। বের হওয়ার সময় সিঁড়ির কাছে ইলহান ওদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। হালিমা ইলহানকে দেখে মনে মনে ভাবলেন, এতো সুন্দর বিবাহযোগ্য একটা ছেলে থাকতে বুড়োটা নিজের বিয়ের কথা কিভাবে চিন্তা করে? ছি!”
চলবে