মেঘের পরে রংধনু পর্ব-২৫

0
954

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_২৫
লিখা: Sidratul Muntaz

শ্যানিনদের পরিবারের সাথে যে ইলহানের রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই এটা অরিন আগে থেকেই জানতো। শ্যানিন বলার আরও অনেক আগে। জোভান ভাইয়ের বিয়েতে যখন অ্যাংকারের সাথে অরিনের প্রথম সাক্ষাৎ হয় তখনি সে ইলহানের সব ইতিহাস জানতে পেরেছিল। ইলহানের পাঁচ-ছয়বছরের জন্য অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যটা শুধু লেখাপড়া ছিল না। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের আসল মা-বাবাকে খুঁজে বের করা। মায়ের খোঁজ না পেলেও বাবার খোঁজ ইলহান ঠিকই পেয়েছিল। ইলহানের বাবা অস্ট্রেলিয়ার একজন কুখ্যাত গ্যাংস্টার, মি. ইভলিন। যার নাম শুনলেও মানুষের হার্টবিট অস্বাভাবিক হয়ে যায়। খুবই অদ্ভুত একজন মানুষ তিনি৷ তার না আছে কোনো সংসার না আছে কোনো পরিবার। অত্যন্ত সার্থবাজ ধরণের লোক। তার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে দীর্ঘদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকা। এছাড়া সে আর কিছুই চায় না। ইলহানের মায়ের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল মি. ইভলিনের। ইলহানের মা ছিলেন তৎকালীন সময়ের অন্যতম সুন্দরী নারী, অলিভিয়া। যার রূপের উত্তাপে ইভলিনের ইস্পাতের মতো কঠিন হৃদয়টাও গলতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি অলিভিয়ার প্রেমে পাগল হয়ে গেলেন। তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় দুই বছর লিভিং করলেন। তারপর যখন ইলহান অলিভিয়ার পেটে আসলো, ইভলিন রাতারাতি সন্তানকে দুনিয়ায় আনতে অস্বীকার করলেন। তিনি চাননি পৃথিবীতে তাঁর কোনো বংশধর সৃষ্টি হোক। তাঁর মতো শক্তিশালী কেউ এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি জন্ম নিক। তাঁর মৃত্যুর পর তিনি দুনিয়ায় নিজের কোনো অস্তিত্ব রেখে যেতে চান না। তিনি ক্ষমতাবান। তিনি অদ্বিতীয়। চিরকাল এমন হয়েই থাকতে চান। কিন্তু মুর্খ ইভলিন হয়তো জানতেন না, দুনিয়ায় কেউ কখনও অদ্বিতীয় হতে পারে না। অদ্বিতীয় হওয়ার একমাত্র অধিকার শুধু আল্লাহর। ইভলিন চিরকুমার হয়ে সারাজীবন একাকী অতিবাহিত করার সিদ্ধান্ত এজন্যই নিয়েছিলেন যাতে তাঁর সমতুল্য কেউ এ দুনিয়ায় কোনোদিন পদার্পণ করতে না পারে। কিন্তু অলিভিয়া এইভাবে ইভলিনের সঙ্গে থাকতে রাজি হলো না। বার-বার তারা শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হবে আর যখন কোনো বাচ্চা আসার সম্ভাবনা দেখবে তখন তাকে হত্যা করবে। এরচেয়ে বড় জুলুম দুনিয়ায় আর কি হতে পারে? গ্যাংস্টার ইভলিন মানুষ খুন করতে করতে এমন পর্যায় চলে গেছিলেন যে নিজের নিরীহ সন্তানদের খুন করতে পর্যন্ত একবারও দ্বিধান্বিত হোননি। পরপর তিনবার অলিভিয়া তার পেটের সন্তান নষ্ট করেছিল ইভলিনের কথা শুনে। কিন্তু চতুর্থবার অলিভিয়ার বিবেক জাগ্রত হয়। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সে। কঠোরভাবে সিদ্ধান্ত নেয় সে আর একটাও নিষ্পাপ প্রাণ হত্যা করবে না। সে অবশ্যই তার সন্তানকে পৃথিবীতে আনবে। ইভলিনের সাথে থেকে এতোবড় পাপ কাজ সে আর কখনও করবে না। অলিভিয়া ইভলিনের থেকে অনেক দূরে পালিয়ে গেল। কিন্তু ইভলিনের হাত অনেক লম্বা। সে প্রয়োজনে অলিভিয়াকেও খুন করবে তাও তাঁর কোনো চিহ্নকে এই পৃথিবীতে টিকতে দিবে না। অলিভিয়ার সাথে হয়তো আল্লাহর রহমত ছিল। সে নয়টি মাস ধরে নিজেকে ইভলিনের থেকে লুকিয়ে-বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এর আগেও ইভলিন অসংখ্য নারীকে খুন করেছে তাঁর বাচ্চা পেটে ধরার অপরাধে। অলিভিয়াই প্রথম নারী যে ইভলিনের বাচ্চাকে দুনিয়ায় আনতে পেরেছিল। কিন্তু জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেনি। অলিভিয়া জানতেন তাকে মরতে হবেই। তাই ইলহানকে সে করুণাময়ের হেফাজতে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মনে-প্রাণে চাইতেন ইলহান যেনো বেঁচে থাকার কোনো মাধ্যম খুঁজে পায়। আর ইভলিন যাতে কখনও ইলহানের খোঁজ না পায়। কারণ যেই মুহুর্তে সে ইলহানের খোঁজ পাবে সেই মুহুর্তে সে স্বীয় সন্তান ইলহানকে হত্যা করবে! ইভলিন ইলহানের খোঁজ ঠিকই পেয়েছিল। কিন্তু তখন ইলহান ছিল এতিমখানার বাচ্চাদের মধ্যে আলোচিত এবং জনপ্রিয়। তার আসল পরিচয় কেউ জানতো না। কিন্তু তার সৌন্দর্য্যে সবাই মুগ্ধ ছিল। ইভলিন নিজেও প্রথমবার নিজের সন্তানকে দেখে অবাক হয়ে গেছিলেন। তিনি যদি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে থাকেন তাহলে তাঁর সন্তান নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ হবে। এটাও ইভলিন মেনে নিতে পারবেন না। ইলহানকে দেখতে রোজ বিভিন দেশ থেকে মানুষ আসতো। তাকে ডাস্টবিনে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়ার খবরটা ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় খবর। তাই ইলহানকে হত্যা করা ইভলিনের জন্য অসম্ভব কাজ। ইভলিন নিজেও একদিন এতিমখানায় গেলেন স্বচক্ষে ছেলেকে দেখতে। তার ছেলেকে কোন দম্পতির হাতে তুলে দেওয়া হবে সেটাও জেনে রাখতে চাইলেন। তারপর দেখা গেল, লটারির মাধ্যমে ইলহানের মা-বাবা নির্বাচিত হচ্ছে। ইভলিন ভাগ্য পরীক্ষা করতে নিজের নামও টোকেনে যুক্ত করলেন। তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসতেন। ইলহানকে দত্তক চাইতে আসা দম্পতির সংখ্যা তখন কয়েক লাখ। লাখ-লাখ মানুষের মধ্যে মি. ইভলিনের নাম উঠার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। এটা ভেবেই ইভলিন নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন মিরাকল হলো। ইভলিনের নামটাই লটারিতে উঠলো। আর তিনি পেয়ে গেলেন নিজের সন্তানকে লটারির মাধ্যমে। কিন্তু তাঁর এই নিঃসঙ্গতার জীবনে তিনি নিজের সন্তানকেই মিথ্যে পরিচয় দিয়ে নিজের কাছে রাখতে চান না। তিনি ভেবেছিলেন ইলহানকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবেন। সেদিন এতিমখানাতেই মি. ইভলিন ইলহানকে ফেলে চলে গেলেন এই বলে যে পরদিন এসে নিয়ে যাবেন। কিন্তু পরদিন তিনি দেখলেন শায়িখ হাসান নামের একজন ব্যক্তি তাঁর সন্তানকে তাঁর থেকেই কিনে নিতে চান। ইভলিনের যেনো কাঁধ থেকে বোঝা নামলো। তিনি এমন কিছুই চাইছিলেন। কিন্তু এইভাবে ইলহানকে দিয়ে দিলে মানুষ সন্দেহ করতে পারে। তাই তিনি শায়িখ হাসানকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করলেন। ইভলিনের কিডনী বিকল রোগ ধরা পড়েছিল। ইভলিন ঠিক করলেন যদি শায়িখ হাসানের সাথে তাঁর কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট করা সম্ভব হয় তবেই তিনি ইলহানকে তাঁর হাতে দিবেন। নতুবা দিবেন না। তাই তিনি শায়িখ সাহেবকে পরেরদিন অফিসে ডেকে পাঠালেন। শায়িখের কোষ পরীক্ষা, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে জানা গেল তিনি কিডনীদানে সম্পূর্ণ সক্ষম। ইভলিন সন্তুষ্ট হলেন এবং একটা কিডনীর বিনিময়ে ইলহানের দায়িত্ব শায়িখকে দিয়ে কাঁধের বোঝা হালকা করলেন। শায়িখ সাহেব আজও দেহে একটা কিডনী নিয়ে বেঁচে আছেন। তাঁর সেই কিডনীটাই হয়তো এখন বিকল হওয়ার পথে। তাই বলা যায় তিনি মৃত্যু পথযাত্রী। অরিনের খারাপ লাগে মানুষটার জন্য। এজন্যই শায়িখ সাহেব অরিন আর ইলহানের বিয়ে নিয়ে এতো তাড়াহুড়ো করছেন। এটাও অরিন জানে। কিন্তু শায়িখ সাহেবের শেষ ইচ্ছেটা অরিন পূরণ করতে পারবে না। খুবই আফসোসের বিষয়। যাইহোক, এই পৃথিবীর কেউ কি কখনও জানবে ইলহান আসলে কার ছেলে? যদি সেদিন শায়িখ সাহেব ইলহানকে ইভলিনের থেকে না আনতেন তাহলে হয়তো ইলহান বর্তমানে জীবিত থাকতো না। ইভলিন অনেক আগেই ইলহানকে মেরে ফেলতেন। কিন্তু ইভলিন এতো চেষ্টা করেও নিজের সন্তানের থেকে নিজেকে আড়াল রাখতে পারেননি। ঠিকই ইলহান চব্বিশ বছর পর তাঁর বাড়ির দরজায় এসে হানা দিল। বাবা ডাক তাঁকে শুনতেই হলো। কিন্তু ইলহান ভালোবেসে ইভলিনকে বাবা ডাকেনি। ঘৃণাভরা কণ্ঠে ডেকেছে। ধিক্কার জানিয়েছে। বাবা সম্বন্ধে এতোবড় সত্যি জানার পর ইলহান ভেতর থেকে কেমন যেনো গুমরে যেতে লাগলো। ওইসময় অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাংকারই ছিল ইলহানের একমাত্র সহচর। যে সর্বক্ষণ ইলহানের সঙ্গে থাকতো। ইলহানের ভাষ্যমতে অ্যাংকার তার জন্য যা করেছে তা কোনো ভাইও ভাইয়ের জন্য করবে না। ইলহানের যেই মুহুর্তে অ্যাংকারকে প্রয়োজন হতো, অ্যাংকার সবকিছু ফেলে ছুটে আসতো। দোস্ত,দোস্ত বলে জান ছেড়ে দিতো। এখনও তাই দেয়। কিন্তু ব্যাপারটা অরিনের কাছে হাস্যকর লাগে। ইলহান কি জানে? অ্যাংকার আসলে মনে মনে ইলহানের ধ্বংস চায়। ইলহান হয়েছে ঠিক তার বাবার মতো। কিন্তু বাবার মতো তারও পৃথিবী থেকে নিজের বংশধর মিটিয়ে ফেলার মতো কোনো অদ্ভুত ইচ্ছা নেই। সে শুধু সৌন্দর্য্য দিয়ে মেয়েদের ঘায়েল করে। অতঃপর ভোগ করে। তারপর উচ্ছিষ্টের মতো ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। ঠিক যেভাবে তার মা তাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল। এই কাজ করে ইলহান কি মায়ের থেকে প্রতিশোধ নেয়? কে জানে? কিন্তু এই কাজ করতে ইলহান ভীষণ ভালোবাসে। প্রত্যেকটা নতুন জায়গায় ইলহানের নতুন নতুন টার্গেট থাকে। জোভানের বিয়েতে ইলহানের টার্গেট ছিল অরিন। কিন্তু অ্যাংকার এটা মেনে নিতে পারেনি। কারণ অ্যাংকার নিজেই অরিনকে পছন্দ করেছিল। ইলহান অরিনের সাথে প্রতারণা করবে আর অ্যাংকার চেয়ে চেয়ে দেখবে এইটা তো হতে পারে না। তাই চার বছরের ফ্রেন্ডশীপ ভেঙে অ্যাংকার অরিনকে ইলহানের আসল রূপ জানিয়ে দিল। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে যেদিন অরিন প্রথমবার ইলহানের কপালে চুমু খাচ্ছিল সেদিনই অ্যাংকার নিশ্চিত হয়ে গেল ইলহানের পরিকল্পনা আশি শতাংশ সফল হয়ে গেছে। অরিন হয়তো আর এক-দু’দিনেই পটে যাবে। তারপর রুম ডেইট। মেয়ে বেশি ভদ্র বা সুশীল হলে বিয়ের মিথ্যে অভিনয়। যেটা ইলহান এখন করছে। কিন্তু অরিন তো ইলহানের আসল রূপ ভালো করেই জানে। তাই এই বিয়েটা সে কখনোই করবে না।

অরিনের দরজায় আবার টোকা পড়লো। মা ডাকছেন। স্টেজে যেতে হবে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। অরিন ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে দরজা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

অনবরত মোবাইল ফোন স্ক্রল করে নিশিতার ফোন নাম্বার বের করার চেষ্টা করছে অর্ণভ। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো নিশিতার নাম্বার মোবাইলে সংরক্ষিত থাকার পরেও সে নাম্বারটা খুঁজে পাচ্ছে না। হয়তো অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় চোখের পাওয়ার কমে গেছে অর্ণভের। সে আসলেই চোখে-মুখে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে। এদিকে তার ছোটবোনের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে আর সে ভাই হয়ে শান্ত থাকবে কি করে? কখনোই পারবে না। নিশিতার নাম্বার পেয়েই অর্ণভ ডায়াল করলো। কিন্তু নাম্বার বন্ধ। অর্ণভের এই মাত্র মনে পড়লো নিশিতা তো ইন্ডিয়ায়! ওহহো! এতো বড় বিপদের সময় কেনো এতো প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে? এতো জটিলতা কি করে সামলাবে অর্ণভ? নিশিতা বাংলাদেশে থাকলে একটা ভরসা ছিল। তাকে সরাসরি ইলহানের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে ইলহানকে হাতে-নাতে ধরা যেতো।অরিনটাও বেঁচে যেতো। অর্ণভের মনে হচ্ছে, সে অরিনকে এখন কিছু বিশ্বাস করাতে পারবে না। মা-বাবাও ইলহানের সম্পর্কে এতোবড় অভিযোগ মানবে না। কিন্তু সরাসরি প্রমাণ করলে পারলে কেউ আর অস্বীকার করতে পারতো না। তাছাড়া অর্ণভ নিজেই তো এখনও ইলহানকে অবিশ্বাস করতে পারছে না। এতো বিনয়ী স্বভাবের একটা ছেলের চরিত্র কিভাবে এতোটা নিম্ন হতে পারে! ইলহানের আচার-ব্যবহার কত সুন্দর! আজকে অর্ণভ যখন ওদের বাড়ি গেল, ইলহান কত আন্তরিকভাবে বড়ভাই, বড়ভাই করে ডাকলো। সালাম দিল। হ্যান্ডশেকের পর হাতটা বুকে ছুঁইয়ে বিনয়ী ভঙ্গিতে হাসলো। সেই হাসিতে তো বিন্দুমাত্র অশুদ্ধতা ছিল না। যার ব্যবহার এতো মার্জিত, যাকে দেখতে এতো সুন্দর, যার কথা-বার্তা হৃদয় ছুঁয়ে যায় তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহের চেষ্টা করতে গেলেও মাথায় অদ্ভুত যন্ত্রণা হয়। পৃথিবীর নিয়ম এতো নিষ্ঠুর হতে পারে না। অর্ণভ ম্যাসেঞ্জার এপ খুলে দেখলো নিশিতা অনলাইনেই আছে। অর্ণভ দেরি না করে সাথে সাথে নিশিতাকে ফোন দিল। গলা ভালোমতো ঝেড়ে নিয়ে বললো,
” হ্যালো, নিশিতা!”
” অর্ণভ ভাইয়া, কেমন আছো?”
” আগে বল তুই কেমন আছিস? কোথায় উঠেছিস তোরা? হোটেলে?”
” হ্যাঁ, হোটেল ছাড়া আর কোথায় উঠবো? তোমাদের অবস্থা বলো। আজ না অরিনের গায়ে হলুদ ছিল? ছবি দিলে না কেনো? নাকি দিয়েছো? আমার আসলে নিউজফিডটা চেক করা হয়নি। মাত্র আমি শপিং থেকে ফিরেছি। এখন একটু শাওয়ার নেওয়ার কথা ভাবছিলাম আর তুমি ফোন করলে। জানো, তোমার আর অরিনের জন্য কিন্তু অনেক কিছু কিনেছি।”
” আচ্ছা এসব গল্প পরে হবে। আগে বল, বাসন্তী খালা কেমন আছে?”
” মা তো ভালোই আছে। ড্রয়িংরুমে বিয়াল্লিশ ইঞ্চির একটা এলইডি টিভি পেয়ে গেছে। এখন সারাক্ষণ শুধু টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখছে। আগে তো সুমনাকে নিয়ে টিভির সামনে বসতো আর বকবক করতো। এখন আমাকে পেয়েছে। একটু পর পর শুধু ডেকে মুভি সিন ব্যাখা করে। কি যে এক যন্ত্রণায় আছি! আচ্ছা শোনো অর্ণভ ভাইয়া, আমার না তোমার থেকে একটা হেল্প লাগবে। খুব ছোট্ট হেল্প।”
” আমি নিজেই তো তোকে হেল্পের জন্য ফোন করেছি।”
” তাই? এজন্যই তো বলি, হঠাৎ আমার কথা তোমার কেনো স্মরণ হলো? প্রয়োজন ছাড়া তো ভুলেও ফোন দাও না। আচ্ছা মা কি ভাববে বলো তো? দুইদিন পরে যার সাথে আমার বিয়ে সে কি-না আমায় সারাদিনে একবারও ফোন করে না? তার সাথে আমার দিনে একবারও কথা হয় না? মা তো সন্দেহ শুরু করবে। মাঝে মাঝে তো একটু ফোন দিতেই পারো তাই না?”
অর্ণভ একহাতে চোখ মালিশ করতে করতে বললো,” শোন নিশিতা, সুমনার কাছে আজকে একটা কথা শুনলাম। তুই কি সত্যিটা আমাকে বলবি?”
” কি কথা শুনেছো?”
” তোর সেই ডেলিভারি বয়ের খোঁজ নাকি পাওয়া গেছে? তোদের মধ্যে কি এখন রিলেশন চলে?”
ওই পাশ থেকে কয়েক মুহুর্ত কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। কিছুক্ষণ পর নিশিতা বললো,
” মেয়েটা তাহলে সব বলে দিয়েছে তোমাকে? বুঝি না এই মেয়ে এতো মুখ পাতলা কেনো? পেটে কি কোনো কথা থাকে না? আমি আরও ভাবলাম সবাইকে দেশে এসে সারপ্রাইজ দিবো।”
” তার মানে সুমনা যা বলেছে সব সত্যি?”
নিশিতা লাজুক কণ্ঠে বললো,” হুম।”
” নাম কি ছেলের?”
” নাম দিয়ে কি করবে? প্রবাদ আছে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়।’ মানে একটা ছোট্ট নাম কখনও মানুষের আসল পরিচয় বহন করতে পারে না। এর জন্য দরকার তার গুণাবলি। আমি তোমাকে তার গুণাবলি বলি। সে মানুষ হিসেবে অত্যন্ত সুইট। ঠিক আমি যেমন চাইতাম তেমন। এত্তো সুন্দর করে কথা বলে মানে ওর যেকোনো কথা শুনলেই মনে হয় আরে, আমি তো এই কথাটা শোনার জন্যই বসেছিলাম। ওর সাথে আমার সবকিছু মিলে যায়। ও আমাকে অনেক যত্ন করে জানো ভাইয়া? আর সবথেকে বড় কথা, এখন পর্যন্ত ও আমার একটা ছবিও দেখতে চায়নি। না দেখেই আমার প্রেমে পড়ে গেছে। আমি কিন্তু ওকে আমার নামটাও বলিনি। সেও নিজের নাম গোপন রেখেছে। কিন্তু আমরা দু’জন-দু’জনকে নিকনেম দিয়ে ডাকি। আমি ওকে কি নাম দিয়েছি জানো? ক্যাটবেরি! কারণ ও তো ক্যাটবেরির মতোই সুইট। দেখো তুমি কিন্তু আবার এটা নিয়ে পচানি দিও না। আমি কিন্তু ফোন রেখে দিবো তাহলে।”
” আচ্ছা এক মিনিট, আগে বুঝতে দে বিষয়টা। তুই ওর নাম-পরিচয় কিছু জানিস না?”
” না। এসব আর্টিফিসিয়াল জিনিস জেনেই বা কি হবে? আমি তো ওর মনটা চিনে গেছি। মানে আসল মানুষটাকেই চিনে গেছি। নাম-পরিচয় তো আমাদের তৈরী করা নকল জিনিস। আর মন, এটা তো আল্লাহ প্রদত্ত সৃষ্টি আসল জিনিস! ভাইয়া, ও যেমনই হোক। যদি কাঠমিস্ত্রী অথবা সুইপারের ছেলেও হয় তাও আমি ওকেই ভালোবাসবো। আমার বাবা বিরাট শিল্পপতি বলে যে আমাকেও শিল্পপতির ছেলেকেই পছন্দ করতে হবে এমন তো কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই। তাই না? তাছাড়া আমার মনে হয় নিজে বড়লোক হলে গরীব লাইফ পার্টনার চুজ করাই ভালো। নাহলে প্রকৃতিতে ব্যালেন্স হবে কিভাবে?”
” এইসব কথা কি তোর ওই ডেলিভারি ম্যান তোকে শিখিয়েছে?”
” একদম না। ও শেখাবে কেনো? আমি ক্লাস নাইন-টেনের বাচ্চা মেয়ে না যে বয়ফ্রেন্ডের শেখানো বুলি তোতাপাখির মতো আওড়াবো। আমি বলছি আমার ধারণার কথা। যেটা আমি সঠিক মনে করি।”
” তুই আমার সামনে থাকলে এখন চটকানা মেরে দাঁত ফেলে দিতাম। এতো ভাষণ কে শুনতে চেয়েছে তোর কাছে? যা বলছি ঠিক-ঠাক উত্তর দে। খবরদার কথা প্যাঁচাবি না।”
নিশিতা মিনমিন করে বললো,” তুমি সবসময় এমন করো কেনো? ভালো কথাও তোমার ভালো লাগে না।”
” আচ্ছা শোন, কোথায় পেয়েছিস এই ছেলেকে?”
” ও যেইখানে কাজ করতো না? পিজ্জাশপে? ওইখানে আমি প্রায়ই ফোন করে ইনফরমেশনের জন্য খোঁজ নিতাম। হঠাৎ একদিন একটা ভাইয়া আমাকে ওদের শপে যেতে বললো। ক্যাটবেরি সম্পর্কে নাকি জরুরী কিছু ইনফরমেশন জানতে পেরেছে। আমি কিন্তু ওকে ক্যাটবেরি বলেই সম্বোধন করছি। তুমি বুঝে নিও ঠিকাছে? তো ক্যাটবেরি সম্পর্কে ইনফরমেশন আছে এইটা জানার পর তো আমি নাচতে নাচতে ছুটে গেলাম। ভেবেছিলাম যদি একবার পেয়ে যাই সরাসরি তোমাদের সামনে এনে হাজির করবো। তোমরা তাক লেগে যাবে এত্তো সুন্দর ছেলেকে দেখে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ওর সাথে আমার দেখা হয়নি। কিন্তু যে ভাইয়াটা আমাকে আসতে বলেছিল সে-ই আমাকে ক্যাটবেরির ফোন নাম্বার দিল। নাম্বারটা সে কালেক্ট করেছিল সিভি থেকে। ক্যাটবেরির নাকি পিজ্জাশপের মালিকের সাথে টাকা-পয়সা নিয়ে কি একটা ঝামেলা হয়েছিল। তখন ক্যাটবেরি চাকরি ছাড়ার কয়েকদিন পর আবার পিজ্জাশপে এসেছিল। তখন ওর কাছে জেন্টালম্যান আউটলেটে রিসেপশনিস্টের চাকরিতে জমা দেওয়ার জন্য একটা সিভি ছিল। সেই সিভি ও সবাইকে যখন দেখাচ্ছিল তখন ভাইয়াটা একফাঁকে সিভি থেকে নাম্বার নোট করে রেখেছিল আমার জন্য। কারণ আমিই বলেছিলাম ক্যাটবেরি সম্পর্কে যেকোনো ইনফরমেশন দিতে পারলেই একহাজার টাকা দিবো। আর যদি ফোন নাম্বার কালেক্ট করে দিতে পারে তাহলে দশহাজার দিবো। কিন্তু ক্যাটবেরি ওর আসল ফোন নাম্বার কাউকে দেয় না। ফ্রেন্ডদেরকেও না। কারণ ওর ফ্রেন্ডরা নাকি ওর নাম্বার মেয়েদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে। এজন্য ওকে প্রত্যেক মাসে সিম চেঞ্জ করতে হয়। তাই সিম চেঞ্জ করার ঝামেলা থেকে বাঁচতে ও এখন নিজের নাম্বার গোপন রাখে। কিন্তু ওই ভাইয়াটা চালাকি করে সিভি থেকে ওর নাম্বার উঠিয়ে রেখেছিল আমাকে দেওয়ার জন্য। তারপর আমি যেদিন সেই পিজ্জাশপে গেলাম, সে আমাকে ফোন নাম্বারটা দিল আর আমি তার হাতে দশহাজার টাকা দিলাম। শেষ, মামলা ডিশমিশ! তারপর বাসায় এসে ঠান্ডা মাথায় রিলেক্স হয়ে ক্যাটবেরিকে ফোন করলাম। সে প্রথমবারে ধরলো না। দ্বিতীয়বার ধরলো। জানো, প্রথমে ওর কণ্ঠটা শুনে আমার চোখে জল চলে এসেছিল। এত্তো সুন্দর করে কেউ কথা বলতে পারে? ওকে আমি এখন পর্যন্ত আমার নাম বলিনি। হয়তো নাম বললে চিনে ফেলবে। কিন্তু আমি চাই ও আমাকে না চিনুক। আরে চেনার আগেই তো ও প্রেমে পড়ে গেছে। তাহলে চিনলে কি হবে বলো?”
অর্ণভ এতোক্ষণে বুঝতে পারলো। তার মানে সুমনা যা বলেছে সবই সত্যি। ইলহান হয়তো টাইমপাসের জন্য নিশিতার সাথে মজা নিচ্ছে। কিন্তু যে ছেলের দুই দিন পর বিয়ে সে অন্য একটা মেয়ের সাথে কিভাবে ফোনে প্রেম করে? একটা অচেনা-অজানা মেয়েকে বিয়ের মিথ্যে স্বপ্ন দেখানো কি ঠিক? এটাও তো রীতিমতো ক্রাইম। নাকি ইলহান নিশিতাকেও বিয়ে করতে চায়। হয়তো অরিনের পর ইলহানের দ্বিতীয় টার্গেট নিশিতা! অর্ণভ আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললো,
” তুই নাম্বারটা ম্যাসেজ করতে পারবি?”
” ক্যাটবেরির ফোন নাম্বার চাইছো? কেনো? তুমি কি করবে?”
” দরকার আছে। একটু ম্যাসেজ কর।”
” আচ্ছা লাইনে থাকো, ম্যাসেঞ্জারে স্ক্রিনশট দিচ্ছি।”
নিশিতা কয়েক মিনিট পর স্ক্রিনশট পাঠালো। কিন্তু এইটা ইলহানের ফোন নাম্বার না। ইলহানের সিম তো এয়ারটেল আর এইটা বাংলালিংক।
অর্ণভ বললো,” তোরা এখন নিশ্চয়ই ফোনে কথা বলতে পারিস না? তাহলে কিভাবে কথা বলিস? সোশ্যাল মিডিয়ায়?”
” হ্যাঁ। হোয়াটসঅ্যাপ আছে না?”
” সেখানেও কি একই নাম্বার?”
” হ্যাঁ। ওর তো একটাই নাম্বার। কিন্তু কেনো? তুমি হঠাৎ নাম্বার গবেষক হয়ে উঠলে কেনো?”
” কিছু না। আচ্ছা, আমি কি একবার তোর ক্যাটবেরির সাথে ফোন করে কথা বলতে পারি?”
” না ভাইয়া, প্লিজ! এই কাজটা অন্তত করো না। আমাদের মধ্যে একটা চুক্তিনামা আছে। আমরা কখনও বিয়ের আগে কারো নাম জানতে চাইবো না, দেখাও করবো না। আর পরিবারের কাউকে এই বিষয়ে জানাবো না। আগে বিয়ে হবে, তারপর সবাই সবটা জানবে।”
নিশিতার কথাগুলো অর্ণভকে রীতিমতো তাজ্জব করে দিচ্ছে। ইলহান এইভাবে নিশিতার ব্রেইনওয়াশ করে রেখেছে? আর নিশিতা তো এতো বোকা না। তাহলে ও কিভাবে এইসব মেনে নিচ্ছে? নাকি প্রেমে পড়লে সবাই বোকা হয়ে যায়? অর্ণভ নিজেও তো সুমনার প্রেমে বোকা হয়ে গেছে। যে আদরের ছোটবোনদের চেহারা একদিন না দেখলে তার অস্থির-অস্থির লাগে সেই প্রিয় ছোটবোনদের ছেড়ে, মা-বাবাকে ছেড়ে দূরে কোনো অপরিচিত জায়গায় সুমনাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছে সে। আদৌ কি অর্ণভ পারবে এই কাজ করতে? নিশিতা বললো,
” ভাইয়া, তুমি কিন্তু ওকে ফোন দিও না প্লিজ।”
” আচ্ছা, ফোন দিবো না৷ আমি বরং রাখি।”
” শোনো, শোনো। বলেছিলাম না তোমার একটা হেল্প লাগবে?”
” হ্যাঁ বল।”
” শোনো, ক্যাটবেরি তো হাইটে অনেক লম্বা। শুনেছি ও নাকি ছ’ফুট চার। ভাবতে পারছো তুমি? আজকে ওর জন্য শপিং করতে গিয়ে আমার পুরো নাজেহাল অবস্থা। এতো বড় বড় জিনিস খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এখন মা তো ভেবেছে আমি তোমার জন্য শপিং করছি। বিয়ের শেরোয়ানীর সাইজ দেখে মা তো অবাক! বলে এতো লম্বা পোশাক নাকি তুমি কিছুতেই পরবে না। কিন্তু আমি তো এইটা তোমার জন্য কিনিনি। কিনেছি ক্যাটবেরির জন্য। এখন তুমি কি একটু মাকে বুঝিয়ে বলবে যে তুমি বিয়ের দিন এই সাইজের শেরোয়ানীই পড়তে চাও? বলবে এগুলোই হলো তোমার আসল সাইজ। তাহলে মা একটু ঠান্ডা হবে।”
অর্ণভ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অরিন যেমন তার ছোটবোন তেমনি নিশিতাও তার ছোটবোন। দু’জনেরই বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন! অথচ এই দু’জনের কেউই জানে না যাকে নিয়ে তারা এতো স্বপ্ন দেখছে সে আসলে কতবড় প্রতারক! অর্ণভের দায়িত্ব হলো এই প্রতারকের ছোবল থেকে তার দুইবোনকেই রক্ষা করা। অর্ণভ নরম গলায় বললো,
” আচ্ছা, আমি খালাকে বলে দিবো৷ তুই চিন্তা করিস না।”
” থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া।”
অর্ণভ ফোন রেখে খুব গাঢ় একটা শ্বাস নিল। তার বুকের ব্যথা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

চলবে

( পাঠকগণ, কমেন্ট করে অনুভূতি জানাবেন না?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here