মেঘের পরে রংধনু পর্ব-৩২

0
844

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_৩২
লিখা: Sidratul Muntaz

” কি অবস্থা ইলহান?”
ইলহান অর্ণভকে দেখে শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইলো।
” ভাইয়া, আসুন।”
” অসুবিধা নেই। তুমি শুয়ে থাকো। শরীরের অবস্থা কেমন?”
” এখন তো ভালোই আছি৷ শুধু ডান পায়ের ব্যথাটাই কমছে না।”
” এখনও ব্যথা কমেনি? বলো কি? লিগামেন্ট- ফিগামেন্ট ছিঁড়ে গেল না তো আবার?”
” আল্লাহর রহমতে সেরকম কিছু হয়নি। ডাক্তার বলেছেন দুইদিন বেডরেস্টে থাকলেই সব ব্যথা সেরে যাবে। হাঁটতে-চলতেও আর অসুবিধা থাকবে না।”
” ও আচ্ছা। যাক ভালোয় ভালোয় সুস্থ হয়ে গেছো এতেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।”
ইলহান কোমল হাসি দিল।
” জ্বী ভাইয়া, আপনি বসুন।”
অর্ণভ আরাম করে বেডের পাশের টুলটিতে বসতে বসতে বললো,” আচ্ছা ইলহান, আমাকে একটা কথা বলো। তোমার কাছে অনেক দিন ধরেই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করবো ভাবছিলাম। এক্সিডেন্টের মাঝে তো ভুলেই গেছি৷ এখন মনে পড়লো বলে জানতে চাইছি। তুমি কি কখনও কোনো শপিংমলে রিসিপশনিস্টের পোস্টের জন্য এপ্লাই করেছিলে?”
” হ্যাঁ। জেন্টালম্যান আউটলেটে। কেনো ভাইয়া?”
” না এমনি৷ কার কাছে যেনো শুনেছিলাম ব্যাপারটা। তখনি মাথায় প্রশ্ন আসলো যে শায়িখ সাহেব মানে বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে হয়ে তোমার এমন চাকরি করার কি দরকার ? মানে কৌতুহল জেগেছিল আর কি।”
” আসলে ভাইয়া এর পেছনে একটা দারুণ উদ্দেশ্য ছিল। কারণটা আমি আপনাকে অন্য একদিন ভেঙে বলি?”
” আমি আসলে সেজন্য বলিনি। কাজ তো কাজই। আমার মতে ফ্যাসিনেশন থেকে তুমি যেকোনো পেশায় জড়াতে পারো। টাকা-পয়সা কোনো ফ্যাক্ট না৷ আত্মতুষ্টিটাই আসল। আর সকল সৎ পেশাই সম্মানের। কিন্তু আমি তোমাকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করছি একটা আলাদা কারণে।”
” কি কারণ ভাইয়া?”
অর্ণভ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রুমে বসেও ঘামছে। জিহ্বা দিয়ে বারংবার ঠোঁট ভিজিয়ে নিতে লাগলো অপ্রস্তুতিতে। সে আসলে নিশিতার ব্যাপারটা খোলাখুলি ইলহানকে বলতে পারছে না। আবার সরাসরি ইলহানকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। এদিকে মহা ঝামেলা বেঁধেছে নিশিতাকে নিয়ে। নিশিতা আর বাসন্তী খালা ইন্ডিয়া থেকে সিঙ্গাপুর চলে গেছেন একদম ইউসুফ আঙ্কেলের কাছে। হঠাৎ সিঙ্গাপুর যাওয়ার উদ্দেশ্য হলো নিশিতার প্রেম নিয়ে ধরা খাওয়া। বাসন্তী খালার কাছে নিশিতা ধরা পড়ে গেছে। সে যে ডেলিভারিবয়ের সাথে প্রেম করছে আর সেই ডেলিভারিবয়ের বর্তমান পেশা রিসেপশনিস্ট বয় এইটা নিশিতার মা-বাবা জেনে গেছেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ের পাত্র হিসেবে এমন জামাই তাঁরা প্রত্যাশা করেননি এটাই স্বাভাবিক। তাই ইউসুফ আর বাসন্তী জোর করে নিশিতাকে অর্ণভের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য রাজি করাতে চাইছেন। আর নিশিতা দুইদিন ধরে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ রেখে সারাদিন একরুমে দরজা আটকে বসে থাকছে। যতদিন তার মা-বাবা তার ডেলিভারিবয় ওরফে রিসেপশনিস্ট বয়কে মেনে না নিচ্ছে ততদিন সে স্বাভাবিক হতে পারবে না। অর্ণভ এইসব কিছু আজকেই জানতে পেরেছে। বাসন্তী খালা অর্ণভকে ফোন করে প্রায় তিনঘণ্টা কেঁদেছেন আর এইসব গোঁজামিলের গল্প শুনিয়েছেন। নিশিতা নাকি ছেলেটি সম্পর্কে কোনো তথ্যই দিতে পারছে না। ছেলেটিকে নিজচোখে দেখেছেও মাত্র একবারই৷ বাসন্তী খালার কথা হলো, এইরকম একটা অদেখা- অজানা ছেলের জন্য তাঁর মেয়েটা কেনো না খেয়ে দম আটকে মরে যেতে চাইবে? এইটা কি ঠিক? আবার তাঁরাও কোনো খোঁজ-খবর ছাড়া সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি ছেলের সাথে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করতে পারছেন না। অর্ণভ এখন এই গোঁজামিলপূর্ণ ঘটনার সমাধান করতেই ইলহানের কাছে ছুটে এসেছে। সে শুধু ইলহানকে জিজ্ঞেস করতে চাইছে, সিভিতে যেই ফোন নাম্বার ছিল সেইটা কার? অর্ণভ বললো,
” আচ্ছা ইলহান, যদি কিছু মনে না করো একটা ছোট্ট প্রশ্ন করবো।”
ইলহান জীভ কেটে বললো,” কি বলেন ভাইয়া? আমি আবার কি মনে করবো? আপনি যা ইচ্ছা প্রশ্ন করেন।”
” তুমি কি চাকরিটা পেয়েছিলে?”
” উমম… সেটা এখনও আমি জানি না ভাইয়া। আসলে চাকরিটার এখন আমার আর কোনো প্রয়োজন নেই। যদি পেয়েও যাই তাহলে আমি আমার একটা ফ্রেন্ডকে বলে রেখেছি সে নিজেই যেনো চাকরিটা নিয়ে নেয়। নাসিরকে চেনেন না ভাইয়া? বাবা যখন সিএমএইচ এ ভর্তি ছিল তখন আমার একটা ফ্রেন্ড আমার সাথে হসপিটালে এসেছিল। ওর দাঁড়ির গোছা অনেকটা ছাগলের মতো।”
” মনে আছে। ওইরকম দাঁড়ির জন্যই তো ওকে আমি রামছাগল বলে ডাকি।”
ইলহান খুব জোরে হেসে দিল। অর্ণভ বললো,” তাহলে কি এখন রিসেপশনিস্টের চাকরিটা নাসিরই করছে?”
” আমি আসলেই এই সম্পর্কে একদমই কিছু জানি না। নাসিরের সাথে আমার কথা হয়নি। তবে সিভি জমা দেওয়ার সময় আমি নাসিরের নাম্বারটা দিয়েছিলাম তো, তাই ওরা যোগাযোগ করলে নাসিরের সাথেই করবে। আমি জানতেও পারবো না সেটা। হয়তো নাসির নিজেই চাকরিটা করছে। নট শিউর৷ আচ্ছা আমি কি ওকে একটা ফোন করে শিউর হয়ে নিবো?”
অর্ণভ চোখে-মুখে কাঠিন্য ভাব আনলো। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো, ” দরকার নেই। তুমি শুধু ওকে ফোন করে হসপিটালে আসতে বলবে। তারপর ওর রামছাগলের মতো দাঁড়িতে আমি সিগারেট দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিবো।”
ইলহান বিস্মিত হয়ে বললো,” কেনো ভাইয়া?”

অরিন ইমারজেন্সী রুমের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে লজ্জায় কাঁপছে। নুসাইবা ওয়েটিংরুম থেকে বের হতেই সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ডাকলো,
” আন্টি।”
নুসাইবা পেছন ফিরে অরিনের মুখ দেখেই হেসে উঠলেন।
” আরে অরিন, আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছো? কিছু বলবে মা?”
অরিন মাথা নিচু করে মাথা নাড়লো। নুসাইবা আদুরে স্বরে বললেন,
” বলো।”
অরিনের কণ্ঠ থেমে থেমে আসছে৷ সে কিভাবে এই কথা উচ্চারণ করবে? নুসাইবা এখানে এসেছিলেন রাতে ইলহানের সেবার জন্য নিয়োজিত নার্সের সাথে কথা বলতে। কিন্তু অরিন চাইছে নার্সের জায়গায় রাতে সে নিজেই ইলহানের কেবিনে থাকবে। ইলহানকে ঔষধ খাওয়াবে, কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে দেখবে, সময়মতো ডাক্তারকে ওর অবস্থা জানাবে৷ মানে একজন নার্সের যতসব করণীয় অরিন তার সবকিছুই করবে। শ্যানিনের ভার্সিটিতে এক্সাম শুরু হয়েছে৷ তাই সে সুমনাকে নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। অরিনের মা-বাবাও আজ সকালে চলে গেছেন। বিকালে আবার আসবে বলেছেন। সন্ধ্যা হয়ে গেলে কেবিনে বাহিরের মানুষ প্রবেশের অনুমতি নেই। শুধু রোগীর সাথে সর্বোচ্চ একজন পরিবারের মানুষ থাকতে পারবে। নুসাইবা আজরাতে শায়িখ সাহেবের কেবিনে থাকবেন। তিনিও খুব অসুস্থ। তাই নুসাইবা বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। একসাথে বাপ-ছেলে অসুস্থ হয়ে গেল। দুইজনের খেয়াল রাখা তাঁর একার পক্ষে মুশকিল। তাই অরিন নিজে থেকেই দায়িত্বটা নিতে চাইছে। নার্সের ভরসায় সে ইলহানকে রাখতে পারবে না। অরিন অনেকক্ষণ ধরে চুপ আছে দেখে নুসাইবা কাছে এসে হাত দিয়ে অরিনের মুখ তুলে বললেন,
” আরে, কথা বলে না কেনো মেয়েটা? বলো কি হয়েছে?”
” আন্টি,আমি বলছিলাম যে আমি কি আজরাতে আপনার সাথে হসপিটালে থেকে যাবো? আসলে বাসায় গিয়ে আমার মন টিকবে না। তাছাড়া আমি আপনাকে হেল্পও করতে চাই। আপনি একা আর কয়দিক সামলাবেন বলুন?”
নুসাইবা অরিনের চোখের ভাষা পড়েই চট করে বুঝে ফেললেন আসল কাহিনী। তাই একটু ঠাট্টা করার জন্য বললেন,
” ও। তাই? আমাকে হেল্প করতে চাও? খুব লক্ষী মেয়ে তুমি। তাহলে আজরাতে তোমার আঙ্কেলের একটু খেয়াল রেখো। আমি ইলহানের কেবিনে থাকবো তো, তোমার আঙ্কেলকে দেখার মতো কেউ নেই। নার্সের ভরসায় তো আর ছাড়া যায় না। বয়স্ক মানুষ! তাই দায়িত্বটা তোমাকেই দিচ্ছি। বেশি কিছু না, এই কখন কি লাগে..ঔষধ,খাবার,পানি সব এগিয়ে দিবে। বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে ধরে-ধরে নিয়ে যাবে। আর বেশি সমস্যা হলে নার্সদের ডেকে নিও। ওরা তোমাকে হেল্প করবে। পারবে না?”
অরিনের মনের ভেতরটা টুশ করে ভেঙে গেল। কিন্তু মুখে কৃত্রিম হাসি বজায় রেখে সে বললো,
” জ্বী আন্টি। পারবো।”
” রাতে হয়তো ঘুমেরও অসুবিধা হবে। তুমি ভেবে বলো, সত্যি পারবে?”
অরিন জোরপূর্বক বললো,
” জ্বী আন্টি। আমি পারবো। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
নুসাইবা খুব জোরে হাসতে লাগলেন। অরিন অপ্রতিভ হয়ে গেল। নুসাইবা বললেন,
” সত্যি করে বলো তো অরিন, তুমি কি আসলেই আমাকে হেল্প করতে চাও নাকি ইলহানের কেবিনে থাকতে চাও? কোনটা?”
অরিন এতো লজ্জা পেল যে একদম সাথে সাথেই বলে উঠলো,” না আন্টি, সেরকম কিছুই না বিশ্বাস করুন।”
নুসাইবা হেসে অরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” রাতে তুমি ইলহানের কাছেই থেকো মা। আমি নিজেই এটা তোমাকে বলবো ভেবেছিলাম। যেই মেয়েটি আমার ছেলের এক্সিডেন্ট নিজ চোখে দেখে স্ট্রোক করে ফেলে, তার মৃত্যুর আশঙ্কায় পাগলের মতো কেঁদে জ্ঞান হারায়, নিজের জীবন ভুলে সারাক্ষণ শুধু আমার ছেলেটির সুস্থতার জন্য চোখের জল ফেলতে পারে এমনকি নামাযে বসেও হিঁচকি তুলে কাঁদতে পারে তার কাছে আর যাইহোক, আমার ছেলের নিরাপত্তা নিয়ে অন্তত কোনো সন্দেহ থাকা উচিৎ না। ইলহান তোমার কাছেই সবচেয়ে সুরক্ষিত থাকবে অরিন। এটা আমি বিশ্বাস করি। সারাজীবন এভাবেই ওর খেয়াল রেখো! আজ থেকে আমার চোখের মণির দায়িত্ব আমি তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম।”
অরিনের কেনো যেনো কান্না পেয়ে গেল। শুধু লজ্জায় কাঁদলো না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here