মেঘের পরে রংধনু পর্ব-৩

0
1929

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_৩
লিখা: Sidratul Muntaz

বর্তমানে ইলহান দাঁড়িয়ে আছে একটা বিলাসবহুল ভবনের সামনে। ভেজা হলুদ শার্ট তার ঘর্মাক্ত শরীরে একদম শিটিয়ে আছে। ইলহানের বিরক্তির মাত্রাও আপাতত চরমে। উত্তরার পাঁচ নং সেক্টরে সে সাইকেল নিয়ে এসেছিল পিজ্জা ডেলিভারি দিতে। তাদের পেইজ রুলসে স্পষ্ট লেখা আছে ডেলিভারিম্যান বাসার নিচে দাঁড়াবে। সিঁড়ি ভেঙে উপরে আসতে পারবে না। কাস্টমারকে নিচে এসে ফুড রিসিভ করতে হবে। অথচ এই মহিলা কাস্টমার প্রচন্ড ঘাড়ত্যাড়া। উনি বলে দিয়েছেন,” হয় উপরে এসে পিজ্জা দিয়ে যান। নয়তো পিজ্জা নিয়ে ফেরত চলে যান। গার্ডের কাছে বিল দিয়ে দিচ্ছি।” এসব কথা শুনলে মাথা ঠিক থাকে না। ইলহান জোরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে নিজেকে ঠান্ডা করলো। মনে মনে বললো,” কাম ডাউন ইলহান। তোকে শান্ত থাকতে হবে। তুই এখন শুধুই একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী। তোর নিজের ইচ্ছার কোনো দাম নেই। কাস্টমার যা বলবে সেটাই করতে হবে।” ইলহান পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিল। বেশিক্ষণ রোদে থাকলে ওর গায়ের রঙ সম্পূর্ণ গোলাপী হয়ে যায়। এখনও তাই হয়েছে। ইলহান ফোনের ক্যামেরায় নিজের চেহারাটা একবার দেখে বললো,” হরিবল!”
ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে ভবনের ভেতরে ঢুকলো সে। দাঁড়োয়ান ওকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। এমনভাবে চেয়ে রইল যেনো ইলহান কোনো এলিয়েন। ইলহান বললো,
” পাঁচতলায় যাবো। ডেলিভারি আছে।”
দাঁড়োয়ান বললেন,” কার ডেলিভারি?”
ইলহান পিজ্জাটা দেখিয়ে বললো,” পিজ্জা ডেলিভারি!”
দাঁড়োয়ান মশাই এতোক্ষণে লক্ষ্য করলেন ইলহানের হাতের দিকে। তারপর লজ্জিত গলায় বললেন,” ও আইচ্ছা। এইবার বুঝছি। যান।”
ইলহান ঠোঁট উঁচু করে একটা বিরক্তির শব্দ করলো,
” উফফ!”
বেশিরভাগ মানুষ ইলহানকে দেখলে কমপক্ষে পাঁচসেকেন্ড হা করে থাকে। বিষয়টা অনেক বেশি অস্বস্তিজনক। এভাবে চলতে থাকলে ডেলিভারি বয়ের চাকরিটাও ছেড়ে দিতে হবে। ইলহান লিফটে করে পাঁচতলায় পৌঁছে গেল। কলিংবেল চাপতেই দরজা খুললো একটা শ্যামবর্ণের রোগা-পাতলা সুন্দরী মেয়ে। মেয়েটির হাতে কফির মগ ছিল। ইলহানকে দেখামাত্রই সে খুকখুক করে কেশে হাত থেকে কফির মগটা ফেলে দিল। কাঁচের মগ ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেল। কিছুটা কফি ছিটকে ইলহানের মুখেও পড়লো। ইলহান মনে মনে মেয়েটাকে একটা গালি দিয়ে ফেললো। তারপর বামহাত দিয়ে ট্রাউজারের পকেট থেকে টিস্যু বের করে মুখ মুছল। মেয়েটা খুব অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,
” স্যরি, স্যরি, এক্সট্রিমলি স্যরি।”
ইলহান একটা বিনয়ী হাসি দিয়ে বললো,” ইটস ওকে ম্যাম। আপনার পিজ্জা।”
মেয়েটা বললো,” হ্যাঁ নিচ্ছি।”
একথা বলেই মেয়েটা নিচু হয়ে মেঝে থেকে কফি মগের টুকরোগুলো তুলতে লাগলো। ইলহান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটা আঁড়চোখে ইলহানকে দেখতে নিয়ে হাত পর্যন্ত কেটে ফেললো। কি ঝামেলা! মেয়েটা বললো,
” আবারও স্যরি।”
ইলহানের বলতে ইচ্ছে করলো,” হাত আপনি কেটেছেন। তাহলে আমাকে স্যরি বলছেন কেনো?”
কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে সে প্রশ্ন করলো না। শুধু একটু হাসলো। মেয়েটা বললো,” আপনাকে দু’মিনিট দাঁড়াতে হবে।”
ইলহান খুব সুন্দর করে বললো,” ওকে, আই এম ওয়েটিং।”
মেয়েটা দৌড়ে চলে গেল। কয়েক মিনিট পরেই আবার ফিরে এলো হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে৷ তারপর বললো,
” আরে আপনি এখনও দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? বসুন না!”
” না, আমি বসবো না। আপনি যদি একটু কাইন্ডলি পেমেন্টটা করে দিতেন তাহলে আমি চলে যেতাম।”
” কেনো চলে যাবেন?”
ইলহান হেসে বললো,
” মানে? তাহলে কি যাবো না?”
এবার মেয়েটা লজ্জায় হেসে ফেললো,
” ও হ্যাঁ। নিশ্চয়ই যাবেন। মানে কফি খেয়ে গেলে ভালো হতো। এতো কষ্ট করে এসেছেন। অন্তত এক কাপ কফি তো খেতেই পারেন। ”
ইলহান মনে মনে খুব হাসলো। ডেলিভারিম্যানকে ঘরে ডেকে কেউ কফি অফার করে এইটা সে প্রথমবার দেখছে। ইলহান বললো,
” না ম্যাম, আমার হাতে সময় নেই। আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে৷ তাই একটু তাড়াতাড়ি করলে আমার জন্য ভালো হয়।”
” ঠিকাছে, একটু ওয়েট করুন। এই সুমনা, সুমনা..”
ওই পাশ থেকে আওয়াজ এলো,” জ্বী আপা?”
মেয়েটা ইলহানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললো,” আলমারির ড্রয়ারে দেখ আমার পার্সটা আছে। নিয়ে আয় তো।”
” এক্ষণি আনতাসি আপা।”
মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে বললো,” আনছে।”
ইলহান প্রচুর অস্বস্তিবোধ করা সত্ত্বেও মেয়েটির সাথে তাল মিলিয়ে হাসলো। মেয়েটা বললো,
” আচ্ছা আপনি থাকেন কোথায়?”
” নাবিস্কো।”
” এতোদূর থেকে আসেন? কষ্ট হয় না?”
” কষ্ট তো সবাইকেই করতে হয় ম্যাম। নাহলে টাকা আসবে কোথ থেকে?”
” ও হ্যাঁ তাইতো। রাইট। একদম ঠিক বলেছেন।”
” জ্বী।”
মেয়েটা এক আঙুলে কপাল চুলকাতে চুলকাতে বললো,” আচ্ছা আপনার কন্টাক্ট নাম্বারটা কিভাবে পেতে পারি? মানে আবার যদি কখনও পিজ্জা দরকার হয়..”
ইলহান বললো,” একটু আগে যে নাম্বারে কথা হলো সেটাই আমার কন্টাক্ট নাম্বার।”
” পারসোনাল?”
” নো ম্যাম, অফিসিয়াল। ”
” ও। আচ্ছা অফিসিয়ালটা নিশ্চয়ই সবসময় একটিভ থাকবে না। আপনার পারসোনাল নাম্বারটা কি দেওয়া যাবে?”
ইলহান মনে মনে আবারও একটা গালি দিল। কিন্তু মুখে বললো,
” আমাদের টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস অন-টাইম সার্ভিস ম্যাম। সবসময় পাওয়া যাবে।”
” ও, সবসময় কি ফোন আপনিই ধরবেন নাকি..”
ইলহান মৃদু হেসে বললো,
” যে ডিউটিতে থাকবে সে-ই ফোন ধরবে ম্যাম।”
” কিন্তু আমার যদি আপনাকে দরকার হয়?”
ইলহানের ইচ্ছে করলো ঘুরিয়ে একটা চড় মারে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে মুখে ভদ্রতার হাসি এনে বললো,
” আমাকে আপনার কেনো দরকার হবে ম্যাম?”
মেয়েটা হকচকিয়ে গেল। একহাতে মাথা চুলকে হাসার চেষ্টা করে বললো,
” এমনি বললাম আর কি। কিছু মনে করবেন না।”
ওই পাশ থেকে আওয়াজ এলো,” আপা, টাকার ব্যাগ তো পাইতাসি না।”
” তাহলে অন্যজায়গায় খুঁজে দ্যাখ। ওয়ারড্রোবের উপরে কিংবা ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে।”
” আচ্ছা আপা, খুঁজতাসি।”
ইলহান বললো,” একটু তাড়াতাড়ি করলে ভালো হয়। আমার আসলেই খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”
” তাড়াতাড়িই তো করছি। কিন্তু খুঁজে পাওয়া না গেলে আমার কি দোষ বলেন?”
ইলহান মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটা বললো,
” শুধু শুধু দাঁড়িয়ে আছেন। আপনাকে তো বললাম ভেতরে এসে বসেন। কফি খান।”
” না ম্যাম, আমি এভাবেই ঠিক আছি।”
মেয়েটা হঠাৎ তেতে উঠলো,” কি বারবার ম্যাম ম্যাম করছেন? আমার নাম নিশিতা।”
” আমি তো আপনার নাম জানি না ম্যাম।”
” এখন তো জানলেন। এখন আর ম্যাম ম্যাম করবেন না।”
ইলহান কিছু বলার আগেই সুমনা পার্স নিয়ে চলে এলো। নিশিতা বললো,” এতো জলদি পেয়ে গেলি?”
” আপা, এটা বিছানার উপরেই তো আছিলো। আপনি হুদাই এতো জায়গায় খুঁজতে কইলেন ক্যান?”
ইলহান এই কথা শুনে সরুচোখে নিশিতার দিকে তাকালো। নিশিতা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,” ও, বিছানার উপরেই ছিল বুঝি? আসলে আমার যে ইদানীং কি হয়েছে.. কিচ্ছু মনে থাকে না।”
সুমনা অবাক হয়ে ইলহানের দিকে তাকিয়ে বললো,” উনি কেডা আপা?”
” ডেলিভারি ম্যান।”
সুমনা কপালে হাত দিয়ে বললো,” মাশাল্লাহ। এত্তো সুন্দর ডেলিভারিম্যান? ভাইজান আপনি এরপর থেকা বাসাত্তেন বাইর হইলে মাথার একপাশে একটু কইরা কাজল লাগায় রাখবেন। নাইলে কিন্তু নজর লাগবো কইলাম।”
ইলহান ফিক করে হেসে দিল। নিশিতা চোখ বড় করে বললো,
” তোকে এতো জ্ঞান দিতে হবে না। যা এখান থেকে!”
সুমনা চলে গেল। নিশিতা জিজ্ঞেস করলো,
” আচ্ছা, বিল যেনো কত হয়েছে?”
” বারোশো নব্বই টাকা।”
নিশিতা ইলহানকে প্রথমে বারোশো টাকা দিল। নব্বই টাকা দিতে গিয়ে দেখলো ওর কাছে আর ভাঙতি নেই। তাই একহাজার নোট টাকা দিয়ে বললো,
” ভাঙতি হবে?”
” এতো টাকা তো আমার কাছেও ভাঙতি নেই।”
নিশিতা চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বললো,
” আচ্ছা তাহলে আপনি একটু বসুন। সুমনা নিচে থেকে গিয়ে ভাঙতি করে আনবে।”
” থাক লাগবে না ম্যাম। ভাঙতির দরকার নেই। আপনি রেখে দিন।”
” তা কি করে হয়? আপনি ডেলিভারি চার্জ নিবেন না?”
” বিলের সাথেই ডেলিভারি চার্জ ইনক্লুডেড। সমস্যা নেই। নব্বই টাকা আমি আপনাকে ডিস্কাউন্ট দিলাম।”
ইলহান এই কথা বলে এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না। দ্রুত চলে গেলো। নিশিতা পেছন থেকে ডেকেই যাচ্ছিল,
” আরে, আরে, শুনুন না।”
ইলহান সোজা গেইটের বাহিরে চলে এলো। দেয়ালে একটা লাথি মেরে বললো,” অসহ্য।”
মেয়েটা পুরো ত্রিশমিনিট ওকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আজকালকের মেয়েদের কি কোনো সেল্ফ রেসপেক্ট নেই? ইলহান তো আকার-ইঙ্গিতে অসংখ্যবার বুঝিয়েছে যে সে মেয়েটার প্রতি ইন্টারেস্টেড না। তবুও মেয়েটা ত্যাড়ামি করেই যাচ্ছিল। এই ত্রিশমিনিটে ইলহান আরও দুইটা ডেলিভারি শেষ করতে পারতো। খুবই বিরক্ত লাগছে এখন৷ এই চাকরি সে আর করবে না। আজকে থেকেই ডেলিভারিম্যানের চাকরি সে বয়কট করলো। প্রয়োজনে ট্যাক্সি চালাবে, রিকশা চালাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু ডেলিভারিম্যান আর না। এর আগেও ইলহান এমন অস্বস্তিজনক অবস্থায় পড়েছিল। কিছুদিন আগের ঘটনা, সে একটা মেয়েকে প্রাইভেট টিউশনি পড়াতো। ম্যাথ আর ফিজিক্স পড়ানোর জন্য মাসে দশহাজার টাকা পেতো। প্রতিদিন দুইঘণ্টা করে পড়াতে হতো। মেয়েটা ছিল ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই মেয়েটির হাব-ভাব বদলে যেতে লাগলো। ইলহান আসার আগে সে লিপস্টিক দিয়ে,চোখে কাজল লাগিয়ে সেজে-গুজে বসে থাকতো। ইলহান যখন ওকে পড়া বুঝাতো, মেয়েটা ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকতো। আর মুচকি মুচকি হাসতো। বিভিন্ন বিব্রতকর প্রশ্ন করতো। ইলহান খুব কড়া টিচার হয়ে মেয়েটিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। কিন্তু বিশেষ লাভ হতো না। মেয়েটা ওকে একদম ভয় পেতো না। ইলহানের অস্বস্তির মাত্রা বাড়তে লাগলো। একদিন তো মেয়েটা সীমা অতিক্রম করে ফেললো। ইলহানের জন্য লাভ লেটার লিখে ফিজিক্স বইয়ে লুকিয়ে রাখলো। ইলহান সেদিন পড়াতে গিয়ে চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়েছিল। সে লাভ লেটারটা ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেললো। তারপর সঙ্গে সঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় দাঁড়িয়েই স্টুডেন্টের বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিল, সে আর পড়াতে আসবে না। তারপর থেকে ইলহান ঠিক করেছে জীবনেও আর মেয়ে স্টুডেন্ট পড়াবে না। কয়েকদিনের মধ্যে ইলহান একটা ছেলে স্টুডেন্ট পেয়ে গেল। কিন্তু সেখানে আরও বড় ঝামেলা। স্টুডেন্টের বড়বোন প্রতিদিন ইলহানকে নাস্তা দিতে আসতো। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইলহানের সামনে বসে থাকতো। যতক্ষণ ইলহান নাস্তা খেতো মেয়েটা ততক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো। আকার-ইঙ্গিতে বুঝাতে চাইতো সে ইলহানের প্রেমে পড়েছে। একদিন তো স্টুডেন্টের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাবও চলে আসলো। তারপর সাথে সাথে রিজেক্ট। ইলহান টিউশনিও বয়কট করলো। তারপর এই ডেলিভারি ম্যানের চাকরি নিল। ভেবেছিল ডেলিভারিম্যানকে নিশ্চয়ই কেউ বিয়ের প্রস্তাব দিতে আসবে না। কিন্তু এইখানে তো অবস্থা আরও ডেঞ্জারাস। ইলহান চাইলেই পারে সবকিছু ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া ফিরে যেতে। দিন-রাত খাটা-খাটনি করে পয়সা উপার্জনের কোনো প্রয়োজন নেই তার। কারণ ইলহানের বাবার যেই পরিমাণ টাকা আছে তাতে ওদের চৌদ্দ পুরুষ আরামে খেয়ে-দেয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ইলহান সেই আরামের জীবন ছেড়ে রাস্তায় নেমেছে। দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করছে। সবকিছুই অরিনের জন্য। যেনো সে পারমানেন্টলি অরিনকে ঘরে নিয়ে আসতে পারে। ইলহান যখন প্রথমবার তার বাবা শায়িখ সাহেবকে বললো সে বিয়ে কর‍তে চায় তখন তিনি এমন একটা রিয়েকশন দিলেন যেনো সপ্তম আসমান থেকে আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়েছেন। চক্ষু চড়কগাছ করে বললেন,
” তোমার বয়সটা যেনো কত?”
ইলহান গম্ভীর গলায় বললো,” আগস্টে চব্বিশ হবে।”
” ওই বয়সে আমি বিয়ে কি সেটাই বুঝতাম না।”
” সিরিয়াসলি বাবা? তুমি এতো গাঁধা ছিলে?”
” গাঁধা থাকবো কেনো? তখন আমি লেখাপড়া করতাম। আমার সব চিন্তা ছিল ক্যারিয়ার নিয়ে।”
” ক্যারিয়ার তো বিয়ের মধ্যেই পড়ে। আর আমি যাকে বিয়ে করতে চাই সে আমার ক্যারিয়ারের জন্য অনেক ইম্পোর্ট্যান্ট। ও সাথে থাকলে আমি এভারেস্টও জয় করে ফেলতে পারবো। শী ইজ মাই অনলি ওয়ান ইন্সপিরিশন।”
তখন ইলহাকে শায়িখ সাহেব সেই ঐতিহাসিক প্রশ্নটি করে বসলেন,” বিয়ের পর বউকে খাওয়াবি কি?”
ইলহান বললো,” বাবা, আমি কোনো হাতি বিয়ে করছি না। মাত্র আঠারো বছরের রোগা-পাতলা পিচ্চি একটা মেয়ে। সে কি এমন খায়?”
” আঠারো বছর হয়েছে তুই নিশ্চিত?”
” হ্যাঁ। আমি নিজচোখে ওর বার্থ সার্টিফিকেট দেখেছি।”
” তাহলে তো ভালোই। কিন্তু তোমাকে যে এতোটাকা খরচ করে অস্ট্রেলিয়া পাঠালাম। তুমি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট না করেই চলে এলে। এখন বলছো বিয়ে করবে। এমনিই আমার ঘাড়ে চড়ে আছো। এখন বউ-সংসার নিয়ে একদম গেঁড়ে বসতে চাইছো?”
” ছেলেকে পালতে পারলে ছেলের বউ পালতে পারবে না? দুটোই তো তোমার জিনিস বাবা।”
শায়িখ সাহেব হেসে বললেন,
” এসব বলে আমাকে কনভিন্স করা যাবে না। তোমার বিদেশে পড়ালেখার জন্য এই পর্যন্ত যত খরচ করেছি সব আগে সুদে আসলে হিসাব সমেত ফিরিয়ে দাও। তারপর বিয়ের কথা চিন্তা করো।”
ইলহান ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিয়ে ফেললো। চট করে বললো,
” আমি যদি সত্যিই এটা করতে পারি তাহলে তুমি আমাকে বিয়ের অনুমতি দিবে?”
শায়িখ সাহেব নির্দ্বিধায় বললেন,” অবশ্যই। কিন্তু আমার থেকে কোনো সাহায্য নেওয়া যাবে না। সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় উপার্জন করতে হবে।”
” ওকে ডান। আমাকে যাস্ট একবছর টাইম দাও বাবা। আমি তোমার সবটাকা সুদে-আসলে মিটিয়ে দিবো।”
” ঠিকাছে। দেখা যাক।”
সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে বাবা-ছেলের কঠিন চুক্তি। ইলহান সেই চুক্তিনামায় সই করেছে। শায়িখ সাহেবও করেছেন। এখন শুধু টাকা যোগাড়ের অপেক্ষা। ইলহান পাগলের মতো পরিশ্রম করছে। সে সারাদিন বাহিরে থাকে। তপ্ত রোদে পুড়ে যখন তার পিপাসা পায়, খুব ইচ্ছে করে কোল্ড ড্রিংক খেতে। হাজী বিরিয়ানির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বিরিয়ানির গন্ধে পেট মোচড় দিয়ে উঠে। ইলহান তাও খায় না। নিজের টাকার এক পয়সাও এদিক-ওদিক খরচ করে না সে। সব জমিয়ে রাখে। সে একবছরের আগেই বাবার সবটাকা পরিশোধ করতে চায়। যত জলদি টাকা পরিশোধ করবে তত জলদিই অরিনের সাথে তার বিয়ে হবে। এই বিষাদময় অপেক্ষার যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না ইলহানের। কবে পাবে সে অরিনকে?
ইলহান নাসিরকে একটা ফোন করলো। ডেলিভারি বয়ের চাকরি তো সে ছেড়ে দিবে। এখন তার নতুন চাকরি দরকার। নাসির হলো ইলহানের চাকরি খুঁজে দেওয়ার জলজ্যান্ত মেশিন। ইলহান যখন নাসিরকে ফোন করে আজকের ঘটনাগুলো বললো তখন নাসির হাসতে হাসতে বললো,
” ভাই, তোর জন্য মেনস অফিসের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন বয়েস স্কুল, বয়েস কলেজ। তেমন মেনস অফিস। মেয়ে আসার চান্স নাই।”
” ফাজলামি করিস না। ভালো কোনো আইডিয়া থাকলে দে।”
” একটা ভালো চাকরি আছে। শপিংমলের রিসেপশনিস্ট। করবি?”
” পাগল নাকি? শপিংমলে তো মেয়েদের আনা-গোণা আরও বেশি। তুই কি ইচ্ছে করে আমার সাথে মজা নিচ্ছিস?”
” আরে না ভাই, এইটা ছেলেদের শপিং সেন্টার। ব্র্যান্ডের নাম হচ্ছে জেন্টালম্যান। কোনো মেয়ে কলীগ নাই। সব ছেলে। কাস্টমাররাও ছেলে। আর মেয়েরা নিশ্চয়ই শার্ট-প্যান্ট কিনতে আসবে না?”
” কিনতেও পারে। ভাই, হাসব্যান্ড অথবা বয়ফ্রেন্ডের জন্য? ”
” ভাইরে! তুই এতোকিছু চিন্তা করলে তো কোনো চাকরিই করতে পারবি না। আজ-কাল পৃথিবীর এমন কোন জায়গা আছে যেখান মেয়ে মানুষ নাই? আচ্ছা তুই এক কাজ কর। একটা সেলুন দে। মেনস সেলুন। মানুষের চুল-দাড়ি ফালাবি, ফেসিয়াল করাবি, প্যাডিকিওর-ম্যানিকিওর করাবি। আর যেহেতু মেনস সেলুন, কোনো মেয়েও আসবে না। ভালো না?”
ইলহান হতাশ গলায় বললো,
” আচ্ছা, রিসেপশনের চাকরিটাই দ্যাখ। আমি করবো।”
” ঠিকাছে, আমি তোকে সন্ধ্যার মধ্যে আপডেট জানাবো। সিভি রেডি রাখিস।”
” ওকে।”
ইলহান যখন নাসিরের সাথে কথা বলে ফোনটা রাখলো তখনি খেয়াল করলো একটা মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ড্রেনে পড়ে যাচ্ছে। ইলহান মেয়েটিকে সাবধান করার আগেই মেয়েটা ধুপ্পুস করে ড্রেনে পড়ে গেল। ইলহান মনে মনে বললো,
” উচিৎ হয়েছে। মর শালি!”

চলবে ইনশাল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here