মেঘের পরে রংধনু পর্ব-৮বোনাস

0
1262

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_৮(বোনাস)
লিখা: Sidratul Muntaz

নুসাইবা অরিনের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। অরিনের কাশি থামলে শায়িখ বললেন,
” এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখন তো প্রায় রাত দেড়টা বেজে গেছে। আজকে বলতে আমি সকালের কথা বুঝিয়েছি। তুমি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করো। বিয়েটা হলে কারো কোনো ক্ষতি হবে না। বরং আমার ছেলেটার জন্য ভালো হবে। আমরা কিন্তু শুধু তোমাদের কাবিন করিয়ে রাখার কথা ভেবেছি। দু’জন আলাদা বাসাতেই থাকলে। এখনি তোমাকে আমাদের বাসায় চলে আসতে হবে না। ইলহান অস্ট্রেলিয়া যাক, গ্র্যাজুয়েশন শেষ করুক, ফিউচারের জন্য প্রিপেয়ার হোক। তারপর তোমরা সংসার শুরু করো। সমস্যা নেই তো।”
অরিন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,” সমস্যা নেই মানে?”
শায়িখ সাহেব হেসে বললেন,” তুমি কি রাগ করছো মা? চাইলে তোমার মা-বাবাকেও ডেকে নিতে পারো। আমিই ডাকছি। তাঁরা যদি বলে বিয়ে আগামীকাল হবে তাহলে তাই হবে। কিন্তু হতেই হবে।”
অরিনের ইচ্ছে করছে সামনে থাকা সেন্টার টেবিল লাথি মেরে ভেঙে ফেলতে। তার সামনে বসে থাকা মানুষটি যদি বাবার বয়সী না হতেন তাহলে অরিন এটাই করতো। তিনি নিজেকে কি ভেবেছেন? তাঁর ছেলে প্রিন্স চার্মিং? তাকে বিয়ে করার জন্য অরিন কপাল চাপড়াচ্ছে? আশ্চর্য! এতো কথার মাঝে একবারও তো তিনি জানতে চাইলেন না অরিনের এই বিয়েতে মত আছে কিনা। কার্যত উনি এটাও জানতে চাননি যে অরিন তাঁর ছেলেকে পছন্দ করে কিনা। একটা মেয়ের বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে মেয়েটির মতামত ছাড়াই তাকে সরাসরি নিজের ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া কি কোনো বিবেকবান মানুষের কাজ হতে পারে? শায়িখ বললেন,
” তুমি চাইলে ইলহানের সাথে আলাদা করে কথাও বলে নিতে পারো। ইলহান বেডরুমেই আছে। যেতে পারো।”
অরিন নিজেকে সামলানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করে নরম কণ্ঠে বললো,
” আঙ্কেল, আমি আগে শ্যানিনের সাথে একটু কথা বলতে চাই।”
” হ্যাঁ অবশ্যই। যাও শ্যানিন। অরিনকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। আর তোমার মায়ের বিয়ের যে গয়না-শাড়ি আছে সব ওকে দেখাও। যদি ওর পছন্দ হয় তাহলে ওগুলোই পড়বে। নাহলে নতুন কিনে আনবো। কোনো সমস্যা নেই।”
অরিন শ্যানিনের হাত ধরে একটানে নিয়ে যেতে লাগলো। শায়িখ সাহেবকে সে ভালো ভেবেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাদের চৌদ্দ গুষ্টি বদের হাড্ডি। ছি!
শ্যানিনের রুমে এসে অরিন হাতের ব্যাগ ছুঁড়ে মারলো। শ্যানিন বললো,
” কাম ডাউন অরিন। আমি তোকে বলছি..”
শ্যানিনকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে অরিন ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বললো,” তুই শুধু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে। আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাই না। আজকে যদি আমার জায়গায় তুই থাকতি। যদি আমি তোকে মাঝরাতে বাসায় ডেকে নিতাম আর আমার মা-বাবা তোকে ভাইয়ার সাথে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিতেন তাও তোর মা-বাবার অনুপস্থিতিতে, তাহলে কি আন্টি-আঙ্কেল সেটা মানতেন? সেই বিয়েটা মানতেন? বল আমাকে!”
শ্যানিন মাথা নিচু করে বললো,” আমি হলে মানতাম।”
” আচ্ছা, ভালো। তুই হলে মানতি। কিন্তু তোর বাবা-মা মানতেন? একদম সত্যি কথা বল।”
” না।”
এবার অরিন উচ্চস্বরে বললো,
” তাহলে উনারা কিভাবে ভাবলেন আমার মা-বাবার অনুপস্থিতিতে আমি বিয়ের জন্য রাজি হবো?”
” বাবা কিন্তু বলেছেন তুই চাইলে তোর মা-বাবাকেও ডাকতে পারিস।”
অরিন উপহাস মেশানো একটা হাসি দিয়ে হাত তালি বাজালো।
” ওয়াও, আনবিলিভেবল! ডাকতে পারি? মানে আমার বিয়েতে আমার মা-বাবাকে আমি ডাকবো? কি সুন্দর কথা! আচ্ছা তোরা কি ভাবিস নিজেদের? তোদের অঢেল টাকা আছে। সেই টাকা দিয়ে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবার কিনে নেওয়া যায়?”
” ছিঃ অরিন। এই কথা কখন বললাম?”
” আজকের ঘটনাতে আমার সেটাই মনে হচ্ছে। আঙ্কেল তো একবারও জানতে চাইলেন না আমি তাঁর ছেলেকে ভালোবাসি কিনা? উনি তো আমার মতামতের তোয়াক্কাই করলেন না। আচ্ছা আমি তোর ভাইকে কেনো বিয়ে করবো আমাকে একটা কারণ বল।”
” তুই কেনো বিয়ে করবি না তার একটা কারণ বল।”
” একটা না, হাজারটা কারণ আছে। তোর ভাই একটা সাইকো। তার আত্মসম্মানবোধের অভাব। সে ব্যক্তিত্বহীন। আর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আমি তাকে ভালোবাসি না।”
” এজন্যই তোর তাকে ব্যক্তিত্বহীন, আত্মসম্মানবোধহীন, সাইকো এসব মনে হয়। অরিন, সবার ভালোবাসার পদ্ধতিটা সেইম না। প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে ভালোবাসে। এই ভালোবাসার সংজ্ঞাটা একেকজনের কাছে একেকরকম। ইলহান ভাইয়া তোকে যেভাবে ভালোবাসে সেই ভালোবাসার নাম হচ্ছে পাগলামি ভালোবাসা। তার কাছে তুই মানে সবটা। বুঝতে পারছিস? সবটা। সে তোকে তার সবটা দিয়ে ভালোবাসে। তোর জন্য ভাইয়া কি কি করছে তা যদি জানিস তাহলে এখনি ভাইয়ার পা ধরে ক্ষমা চাইবি। আফসোস করবি এতোদিন অবহেলা করার জন্য। অবশ্য মুখে বললে তো তুই বিশ্বাস করবি না৷ তোকে প্রমাণ দেখাবো, আয়।”
” আমি কোনো প্রমাণ দেখতে চাই না। অনেককিছু দেখিয়েছিস আমাকে। এবার থাম। আমি আর নিতে পারছি না।”
” আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে দে অরিন।”
” যতটুকু বুঝেছি তাই যথেষ্ট। আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। ”
” তোকে বিয়ে করতে হবে না। তুই শুধু ভাইয়ার সাথে ভালো করে একটু কথা বল।”
” আমি সেজন্যই এসেছিলাম। সত্যি বলছি, তোর ভাইয়ের সাথে ভালো ব্যবহার করার জন্যই আমি এসেছিলাম। ভেবেছিলাম আজকে তাকে ভালো করে বুঝাবো। কিন্তু না, উনি ভালো ব্যবহারের যোগ্যতাই রাখেন না আসলে।”
” এইখানে ভাইয়ার কিন্তু কোনো দোষ নেই। ভাইয়ার অবস্থার কথা চিন্তা করে মা-বাবা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
অরিন বিছানা থেকে ব্যাগটা তুলে হড়বড় করে বের হয়ে যাচ্ছিল। শ্যানিন অরিনের হাত ধরে বললো,
” কোথায় যাচ্ছিস?”
” বাসায়।”
” ড্রয়িংরুমে মা-বাবা আছে। তাদের সামনে দিয়ে তুই চলে যাবি?”
” হ্যাঁ যাবো।”
” বেয়াদবি হবে অরিন।”
অরিন অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” আমারটা বেয়াদবি? আর তোরা যেটা করেছিস সেটাকে কি ভদ্রতা বলে?”
” তুই অনেক বেশি রেগে যাচ্ছিস। আচ্ছা, যেতে হলে যা। কিন্তু ভাইয়ার সাথে একবার অন্তত দেখা করে যা। প্লিজ!”
” ওহ, ভুলেই গেছিলাম৷ তাঁর সাথে দেখা করা তো সবচেয়ে বেশি জরুরী। চল।”
” শিউর তুই?”
” হ্যাঁ শিউর। চল।”

ইলহানের রুমের সামনে এসে আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিল শ্যানিন। ইলহান ভেতর থেকে ক্লান্ত গলায় বললো,
” কে?”
” ভাইয়া, আমি শ্যানিন। আসবো?”
” আয়।”
শ্যানিন অরিনকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। অরিন সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে তাকালো। ইলহান খালি গায়ে বিছানায় শুয়ে আছে। ছি! এই মানুষটার কি একটু লজ্জা নেই? তাঁর ঝকঝকে তকতকে শরীরটা সবাইকে দেখাতে হবে? দেখিয়ে বুঝাতে হবে আমি অনেক সুন্দর আমাকে বিয়ে করো! ইলহান দুই আঙুল দিয়ে মাথায় মালিশ করছে। তার চোখ বন্ধ। এই অবস্থাতেই বললো,
” বল শ্যানিন।”
” ভাইয়া, অরিনকে নিয়ে এসেছি।”
ইলহান এই কথা শুনে একলাফে উঠে বসলো। বিছানা হাতড়ে কফি কালার টি-শার্টটা নিয়ে দ্রুত পরতে পরতে উঠে দাঁড়ালো। শ্যানিন কিছু বলতে নিচ্ছিল। ইলহান তার আগেই হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে বললো,
” তুই যা।”
শ্যানিন অরিনের দিকে একবার ভীতদৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল। অরিন এবার ঘুরলো ইলহানের দিকে। ইলহান একটা তৃপ্তিময় মৃদু হাসি দিল। কতদিন পর! কতদিন পর এই নেশা ধরানো চেহারাটি দেখতে পাচ্ছে সে। এই রূপ দেখলেই তো ইলহানের বুকের কাঁপন থেমে যায়! পৃথিবী নিস্তব্ধ হয়ে যায়! তীব্রভাবে তৃষ্ণার্ত চোখ দুটি দিয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে মেয়েটির দিকে। সময় থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। আরও ইচ্ছে করে মেয়েটিকে অনন্তকাল ধরে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখতে। ইলহান বিবশ কণ্ঠে বললো,
” কেমন আছো অরিন?”
অরিনের মুখ দিয়ে খুব বাজে একটা গালি বের হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে নিজেকে সংবরণ করলো। ঠান্ডা গলায় বললো,
” আপনার সমস্যা কি? এসব কি শুরু করেছেন?”
ইলহান অরিনের কথাটা যেনো শুনতেই পায়নি। সে অরিনের দুই কাঁধে হাত রেখে বললো,
” একটু বসো, একটু দেখি!”
ইলহানের আকুতি মেশানো কণ্ঠ অরিনের কাছে বিষাক্ত। রাগে অরিনের শরীর শিরশির করছে। সে ইলহানের হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে বললো,
” আমি এখানে বসতে আসিনি। আপনার সাথে বোঝা-পরা করতে এসেছি।”
” আচ্ছা, তাহলে বসো। বসে বোঝা-পরা করো।”
” আগে আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আন্টি-আঙ্কেল আমাদের বিয়ে কেনো ঠিক করলেন?”
ইলহান হেসে বললো,” বাবা তাহলে তোমাকে সব বলে দিয়েছে?”
” হুম। অনেককিছু বলেছে। অনেককিছু বুঝিয়েছে। আমি এটা কল্পনাও করতে পারিনি।”
ইলহান অরিনের হাত ধরে বললো,” কেনো? আমাকে বিয়ে করবে না?”
অরিন হাত ছাড়িয়ে বললো,” কথায় কথায় আমাকে টাচ করা বন্ধ করুন। আপনি কি চান বলুন তো? আমার পেছনে এইভাবে কেনো পড়ে আছেন? আপনার লজ্জা লাগা উচিৎ। ”
” বিশ্বাস করো, লজ্জা নেই।”
” এতোদিন আপনাকে শুধু আত্মসম্মানহীন ভাবতাম। এখন মনে হচ্ছে আপনি মনুষ্যত্বহীন, অহংকারী, নিকৃষ্ট জানোয়ার! একটা মেয়েকে যখন ইচ্ছা কিডন্যাপ করবেন,দিনের পর দিন তার পেছনে লেগে থাকবেন, সে পাত্তা না দিলে বাসায় ধরে এনে বিয়ের প্রস্তাব দিবেন। কি পেয়েছেন? বিয়ের জন্য তাকে বাধ্য করবেন? আমার মতামতের কি কোনো দাম নেই? কখনও জিজ্ঞেস করেছেন আমি কি চাই? বলতে বলতে আমার মুখ ব্যথা হয়ে গেছে যে আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আর কয়ভাবে বললে আপনার কথা কানে যাবে?”
” আর বলোই না প্লিজ। আমি এই কথা শুনতে চাই না।”
” তার মানে আপনি যেটা চান সেটাই আমাকে শুনাতে হবে? আমার ইচ্ছার কোনো দাম থাকবে না? আমার জীবনটা অতিষ্ট বানিয়ে ফেলছেন। এর চেয়ে ভালো আমাকে মেরে ফেলুন। এটাকে ভালোবাসা বলে না। যদি আসলেই ভালোবাসতেন তাহলে আমাকে এইভাবে শাস্তি দিতে পারতেন না। আমার মতামতের গুরুত্ব আপনার কাছে থাকতো। কিন্তু সেই গুরুত্ব আপনার কাছে নেই। আর থাকবে কি করে? আপনি তো আমার মন পেতে চান না। শুধু জোর করে আমাকে বিয়ে করতে চান। মোটকথা আপনি শুধু আমাকে ভোগ করতে চান। তাই যদি হয় তাহলে এতো নাটক কিসের? নিন এখনি ভোগ করুন। মিটিয়ে ফেলুন খায়েশ। আমাকেও মুক্তি দিন।”
ইলহান ঠাটিয়ে চড় দিল অরিনের গালে।

চলবে

( হুদাই এক পর্ব আধা লেইক্ষা দিলাম। আবার আরেক পর্ব আধা লেইক্ষা দিলাম।🐸)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here