মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৩১

0
1083

মেঘে ঢাকা চাঁদ (পর্ব ৩১)
সায়লা সুলতানা লাকী

“কি ভাবছিস?”
“কিছু না।”
“বলতে চাচ্ছিস না। ভালো, বলিস না। তবে আমার একটা কথা শুনে রাখ। অতি আবেগে কোন ডিসিশন নিবি না। অতি আবেগ আর অতি রাগ দু’টোই খুব বিপদজনক। এরই মধ্যে মানুষ যত ডিসিশন নেয় অধিকাংশই ভুল হয়। আর জীবন বড় কঠিন। এখানে কোন ভুলের জায়গা নেই। ভুল করলে মাসুল তাকে গুনতেই হয়। দেখছিস না লিখন কেমন করে গুনছে? ভুল কাউকেই ক্ষমা করে না।” নানি বেশ শান্তভাবেই কথাগুলো বললেন।

“রুশ প্রচন্ড রকমের এক ঘোরের মধ্যে আছে। ও ভুল করছে, ওকে ফেরাতে হবে।যাতে ও…. ”
“করতে দে, তুই ওকে কিছু বলবি না।”
“কি বলছো নানি তুমি? ও আমার ভাই, ওর অনেক কষ্ট পাবে। দেখো আমি কষ্ট সহ্য করতে করতে সহজকেও সহজ দেখতে ভুলে গেছি । ও এতটা শক্ নিতে পারবে না।”
“তখন ওকে সামলে নেওয়ার জন্য তুই আছিস, আমি আছি। কিন্তু এখন যদি তুই কিছু বলিস তবে ও তোকে এখন থেকেই নেগেটিভ ধরে নিবে মনে মনে। কোন কিছু না পেলে ভাববে তোর জন্যই ও বঞ্চিত হচ্ছে। তখন ও তোর সামনে থেকেও থাকবে বহু দূর। রুশ তখন আব্বু আপু সব হারাবে নিজের বিশ্বাস থেকে। এটা হতে দিস না। তুই এখন চুপ থাক। যা হচ্ছে হতে দে, ও নিজেই বাস্তবতা বুঝুক, চিনুক, জানুক।”

“নানি আমি যে আম্মুকে কথা দিয়েছি আমি রুশকে কোন কষ্ট পেতে দিবো না। আমি ওকে কীভাবে এমন পরিস্থিতিতে ছেড়ে দিতে পারি?”

“তুই রেশমাকে কথা দিয়েছিস বলেই এখন ওকে ছাড় দিবি যাতে ও তোর থেকে দূরে না যায়। যেনো কোথাও থেকে কষ্ট পেয়ে আবার তোর কাছেই ফিরে আসে সেই কষ্ট দূর করতে। জীবন বড় কঠিনরে নানুমনি। হিসাব না কষে দু পা চলতে গেলেই ফলাফলে বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা থাকে।”

“নানি আমার খুব কষ্ট লাগছে। কেন আমাদের জীবনটা এমন হল?”
” সবাই আল্লাহর ইচ্ছা, তাকেই ডাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোদের জন্য ভালো কিছু রেখেছেন।”
“নানি জানো আমার মনে একটা গার্ড ফিলিং হচ্ছে, আব্বু মনে মনে তার বৌকে নিয়ে এখানে এসে থাকার চেষ্টা করছে।”
“ছি লাবু! এতটা খারাপ ভাবিস কীভাবে তোর বাপকে। দেখছিস না ও রুশকে নিয়ে কতটা টেনশনে আছে। রুশ ক্লিয়ার বলে দিয়েছে, ওর মা একজন আর সে মরে গেছে। আর কোন মা ওর নাই। আর ওর আব্বুর নতুনবৌকে ও কোনোদিনও দেখতে চায় না। লিখন সামনে বসে সবটা শুনেছে। ও এমন কাজ কোনোদিনও করবে না। মেয়ে হয়ে বাপকে এতটা নীচ ভাবিস না। নিজেকে সংযত কর।” বলে নানি উঠে রুশের কাছে চলে গেলেন।
লাবন্য চুপচাপ বসে রইল আর নানির বলে যাওয়া কথাগুলো আবার মনের মধ্যে ঝালাই দিতে লাগলো আসলটা কি তা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল।

সারাদিনে আর লিখন আসল না, রাত বারোটার দিকে বাসায় ফিরল। লাবন্য ধরে নিয়েছিলো আসবে না তাই নিজেই রেডি হয়েছিলো রুশের সাথে থাকার জন্য। কিন্তু রুশ বারবার বলছিলো যে ওর আব্বু আসবে তবে আসতে একটু লেট হবে। হলও তাই, এসেই ড্রেস চেঞ্জ করে বুয়াকে ডেকে খাবার চাইলো। লাবন্য আরও অবাক হল। কারন আগেও লিখন যেখানে যাই করতো রাতের খাবারটা বাসায় এসেই খেতো। আর তার পাশে ওর মা সেজেগুজে বসে থাকতো।গুটুর গুটুর গল্প করত আর খেতো । লাবন্য তখন মুগ্ধ হয়ে আব্বু আম্মুর ভালোবাসার চর্চা করতো হিমেলের সাথে ফোনালাপের মাধ্যমে।
আজ সেসবই সুখ স্মৃতি হয়ে আছে, নাকি এক অমানবিক ভালোবাসার প্রতারনার সাক্ষী হয়ে আছে তা শুধু সময়ই বলে দিতে পারে ওকে।

রুশের পায়ের প্লাস্টার খোলা পর্যন্ত প্রতিদিনই লিখন রাতে চলে আসতো বাসায়। সকালে আবার চলে যেত। পায়ের প্লাস্টার খোলার পরের দিন আর লিখন রাতে আসল না। লাবন্য ভাবলো রুশের হয়তো মনটা অনেক খারাপ থাকবে কিন্তু না রুশকে দেখা গেল নরমাল। পরে জানতে পারল ওর আব্বুই নাকি ওকে বুঝিয়েছে যে সে এখন নিয়মিত আসতে পারবে না, তবে মাঝে মাঝেই এসে ছেলের সাথে থাকবে। আর তাতেই রুশ মেনে নিয়েছে। ওর কথা হচ্ছে “আব্বু আসবেতো।” এতেই মনে হল ও খুশি। লাবন্যও তাই এই বিষয়টা নিয়ে ঘাটলো না।

আবার সেই আগের নিয়মেই চলতে লাগল লাবন্য রুশের জীবন। সকালে নানির সাথে বের হয় নানি রুশকে নিয়ে স্কুলে নেমে যায় আর লাবন্য চলে যায় ওর ইউনিভার্সিটিতে। লিখন নিজেই স্কুলে গিয়ে কমপ্লেন করেছিল সেদিনকার বিষয়টা নিয়ে। তাই স্কুল কমিটিও একটু নড়েচড়ে বসে ছিল। রুশকে যেন কেউ ওর আব্বু আম্মু নিয়ে মানে ওর প্রাইভেট লাইফ নিয়ে কিছু না বলে তা সব স্টুডেন্টদের বুঝিয়ে দিয়েছিলো।

এরই মধ্যে একদিন সকালে বুয়া খালা বারান্দা থেকে দৌড়ে ফিরে এসে জানালো দোতলার মানুষরা বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। নিচে তাদের মালপত্র নামিয়ে পিকাপে তুলছে লোকজন। কথাটা শুনেই লাবন্য ফিক করে হেসে উঠল। ওর নানির দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল
“বেচারা একরাম মিয়াতো দেখি সত্যি সত্যিই বড় দৌড়ের উপর আছে। পরোপকারী মনোভাব তাকে বাসা ছাড়া পর্যন্ত টেনে নিল।”
“পুরোটা না জেনে বাজে বকিস কেন? একরাম সাহেবরা বাসা ছাড়ছে না। পাশের ছোট ইউনিটের ভাড়াটিয়ারা চলে গেল।”
“তাই নাকি! তা তুমি জানলে কীভাবে নানি?”
“একই বিল্ডিংএ থাকি, কম বেশি টুকটাক খবরতো রাখতেই হয়।”
“ওওওও আচ্ছা, যাক পাশের বাসার আন্টির মতো তোমারও তাহলে ভালোই সময় কাটে অন্যের খোজখবর রেখে।” বলে লাবন্য দুষ্টর মতে হিহিহি করে হেসে উঠল।
“একটা চড় দিব ফাজিল মেয়ে। আমার এত সময় বয়েই গেছে যে জনে জনে খবর রাখি! যা নিজের কাজে যা। ” বলে ধমক দিয়ে নানি নিজের রুমে চলে গেলেন। লাবন্য চুপচাপ বসে ভাবলো নানি থাকাতে জীবনে কিছু স্বস্তি ফিরেছে, এটাই মনে হয় অশেষ দয়া পরম করুনাময়ের।
ইদানিং হিমেল আর তেমন একটা আসে না। নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে কাজের প্রচুর চাপ পড়েছে। সবই খবর আসে নানির কাছ থেকে। যত ব্যস্ততাই থাক। রাতে একবার নানির সাথে তার কথা হয় প্রতিদিনই। এতে কেউ তার খবর নিচ্ছে না বলে যে কষ্টটা ছিলো তা অনেকটা লাঘব হয়েছে। মাঝে মধ্যে লাবন্যকে কল দেয় হিমেল তবে এখন আর সেই সুর খুঁজে পায় না লাবন্য ওর মনে। মনে হয় কোথায় যেনো তাল কেটে গেছে মনের বীনায়। নিজের পড়া নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতে চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে রুশকেও দেখতে হয়। রুশকে নিয়েই যেন বেশি টেনশন হয়। ও একটু বেশি ওর আব্বুর প্রতি ঝুকে গেছে। একটা মোবাইল কিনে দিতে চেয়েছিলো ওর আব্বু ওকে, লাবন্য বাঁধা দিয়েছে। বলেছে এখনি ওর মোবাইল ব্যবহার করার সময় হয়নি, এমনটাই ওদের আম্মু ওদের শিখিয়েছিলেন। কথাটা শুনে আর লিখন ছেলেকে মোবাইল কিনে দেয়নি। মাঝে মাঝে লাবন্যের মোবাইলটাই রুশ বোনকে না জানিয়ে ব্যবহার করে। ওর আব্বুকে মিসড কল দিলেই ওর আব্বু ফিরতি কল দেয়। তখন দুজন মিলে কথা বলে। এভাবেই চলছিলো দিনগুলো।
এরাই মধ্যে একদিন বুয়া খালা এসে খবর দিলো যে দাদিকে ও নিচে দেখছে বারান্দা থেকে। লাবন্যর বুকটা কেঁপে উঠল তা শুনে। আনমনে আবার বলে উঠল “দাদি এখানে আবার কি কারনে? আবার কি অঘটন ঘটতে যাচ্ছে এ বাসায়? ” আর কিছু চিন্তা করল না নিজের রুমে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইল ডোরবেল শোনার অপেক্ষায়। আসলে কি বলবে তাই ঠিক করছিলো। অনেকক্ষণ সময় পার হওয়ার পরও যখন কোন ডোরবেলের শব্দ পেলো না তখন কিছুটা অবাক হয়ে আবার ফিরে এল ডাইনিংএ।

“বুয়াখালা তুমি ঠিক দেখেছেতো? উনি দাদিই ছিলেন?”
“হুমম, মিথ্যা কমু ক্যা?”
“কিন্তু তারাতো এখনও বাসায় আসলো না। ঘটনাটা কি বলোতো? আবার নতুন কি ঝামেলা পাকাচ্ছে তারা?”
“তাসলিমা তুই যা, রান্না দেখ” বলে বুয়াকে সরিয়ে দিলেন নানি। এর পর বেশ শান্ত স্বরেই বললেন
“তারা তাদের বাসাতেই উঠেছেন। তোদের এখানে কেন আসবে?”
“মানে?”
“মানে, তারা দোতলার ওই ছোট্ট ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছেন। এখন থেকে এখানেই থাকবেন।”
“কি বলছো তুমি?”
“যা শুনছিস, রুশের কাছে থাকার জন্য এরচেয়ে আর ভালো কি পথ ছিল তোদের বাবার। মেয়ে সেয়ানা হলে এমনিতেই তখন বাবা মায়ের টেনশন বেড়ে যায়৷ এখন তোর মা নেই তাই বলতে পাড়িস ওর দায়িত্ব আর টেনশন দ্বিগুণ হয়েছে…. ”
“দাঁড়াও দাঁড়াও, নানি কি বলছো তুমি? বুঝে বলছোতো? আমার জন্য তার টেনশন হয়? আজবতো? তার জন্য আমি জীবনে কি কি ফেইস করেছি তা কি সে জানে? আমার দায়িত্ব নিবে সে? সেতো আরেক বিয়ে করে আমার সাড়ে সর্বনাশ করেছে। লোকজন এখন আমার পিঠপিছে তার কর্মকান্ডের জন্য মিটমিটিয়ে হাসে। বুঝছো কিছু?”

“সব কিছুতেই এত হাইপার হয়ে যাস কেন? একটু আস্তে ধীরে কথা বল। না আমি পালাচ্ছি না তুই কোথাও যাচ্ছিস।”
“নানি শোনো তার বিষয় আসলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। এটা তার কেমন ডিসিশন হল তাইতো বুঝলাম না। সে কি চায় আমরা দুইভাইবোন তাদের জ্বালায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাই? দূরে ছিলো তাইতো ভালো ছিলো। এদেরকে দেখতামও না জ্বলতামও না। রুশ যে বলেছে ও ওই মহিলাকে দেখতেও চায় না কোনোদিন তা কি সে বোঝে নাই?”

“লিখন এখন বিয়ে করছে, ওই মহিলাকে চাইলেও তোদের এখন দেখতে হবে না চাইলেও এখন দেখতে হবে। অহেতুক তাকে নিয়ে নতুন কোন ইস্যু তৈরি করে তোরা তোদের অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত হবি?”

“আমার মাথায় আসতেছে না নানি তুমি এসব কি বলছো? ও আল্লাহ তুমিই বলে দাও এখন আমি কি করবো? ” বলে কাঁদতে শুরু করল লাবন্য

“প্রথম প্রথম কাঁদবি, কষ্ট পাবি।ঘৃণা করবি। এভাবে চলবে কিছুদিন। তারপর আস্তে আস্তে সব সয়ে যাবে। আবার লিখন ওর দুই বাচ্চা নিয়ে আগের মতে সুখে শান্তিতে থাকবে। তোরাও তোদের বাবার আদর সেহাগে গা ভাসাবি। শুধু আমার রেশমাই হয়ে যাবে তাদের জীবন থেকে নিশ্চিহ্ন। এমনটাই হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এটাই স্বাভাবিক। ”
“প্লিজ নানি তুমি একটু চুপ থাকো, আমি আর নিতে পারছি না।” বলে লাবন্য অঝোরে কাঁদতে লাগল। ওর নানিও নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।

রাতে লিখন আসলো বাসায়, এই কয়দিনে লাবণ্য মোটামুটি ওর সামনে আসতো টুকটাক কথা বলতো অবশ্য সব কথাই হতো রুশকে নিয়ে। কিন্তু আজ ওর আব্বুকে বাসায় আসতে দেখে লাবন্য নিজের রুমে চলে গেল। লিখন বিষয়টা খেয়াল করল। কিন্তু কোন কিছু আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল না। রুশ তখন খেয়েদেয়ে ঘুমানোর জন্য রেডি হয়েছিল তখনই আসল লিখন। ওকে দেখে লাবন্যের নানিও কোন কথা বললেন না। নিজের রুম থেকেও বের হলেন না। লিখন বেশ কিছুক্ষণ রুশের রুমে বসে থেকে আবার চলে গেল। বুয়া দরজাটা আটকিয়ে দিতেই লাবন্য বের হল রুম থেকে। দেখল রুশ ঘুমিয়ে গেছে। বুয়াই একটু হাসি দিয়ে বলল
“ভাইজানে মনে হয় রুশ বাবারে ঘুম পাড়াইতে আইছিলো। পোলারে ঘুম পাড়াইয়া দিয়া আবার গেলোগা।”
লাবন্য কেন উত্তর না দিয়েই আবার নিজের রুমে চলে গেল।

সকাল বেলা ঘটলো আসল বিপর্যয়। লাবন্যের ছোট ফুপু আসল ওদের বাসায়। এসেই গলা চড়িয়ে চিৎকার শুরু করল
“আমার মায়ের সংসারটারে নষ্ট করে দিলি তুই সেদিনকার এক পিচ্চি মাইয়া হয়ে। প্রথমে বুঝি নাই ঘটনা কি ঘটল? এখন স্পষ্টই বুঝতাছি এত সব ঘটনার পিছনে কার হাত আর কার বুদ্ধি কাজ করছে। আমার মায়ের ঘরটারে দখল করাই ছিলো আসল মতলব। ওরে লাবন্য তুই পোলাপান মানুষ তুই এইসব কুবুদ্ধির তালে পইড়া নিজের বাপ দাদিরে এত এত কষ্ট দিলি? আমার মা এই ঘর ছাইড়া এই শেষ জীবনে কত কত কষ্ট করল এইসব পাপের ভার তুই সহ্য করতে পারবি? আমার মা তার পোলার কামাই থাকতেও মাইয়ার ঘরে কি নাজেহাল হইয়া এই কয়দিন কাটাইলো। এই সবের হিসাব তোদের একদিন দিতে হইব। আল্লাহ কি মনে করছোস তোগো ছাইড়া দিবো?”
ফুপুর চিৎকার শুনে লাবন্যের মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে গেলো। ও ভুলেই গেল সামনে দাঁড়ানো মানুষটা ওর ফুপু। ও নিজেও প্রতিত্তোরে তার চেয়েও বেশি গলা চড়িয়ে বলে উঠল
আল্লাহ কি শুধু তোমাদের? এত বেশি ধর্মপরায়ণ ধার্মিক যখন তুমি, তখনতো তোমার এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহসই থাকার কথা না। সাক্ষাৎ নিজের জন্য জাহান্নামের আগুন চোখে দেখে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিজের কাপড় চোপড় নষ্ট করার কথা ছিলো। ভণ্ডামি করার আর জায়গা পাও না। আমার সাথে আসছো ভণ্ডামি করতে? জানো না আমি রেশমা না? আমি লাবন্য, লাবন্য। নামটা মনে রাখো। যে কি না নিজের আর ভাইয়ের স্বার্থে নিজের বাপকেও ছাড় দেয় নাই। আমার সাথে আসছো গলা বাজি করতে, জেনে যাও আমি তোমার চেয়েও বড় গলাবাজ। আর কোনোদিনও আমার সাথে গলাবাজি করার সাহস দেখাবা না। ”

“হুমম, সেই দিনকার মেয়ে তুই আমারে হুমকি দেস। শয়তানের পেট থেইক্যাতো একটা শয়তানই হইছোস? আমার ভাইয়ের বাড়ি জোরজবরদস্তি নিজেদের নামে লেখাইয়া নিয়া জমিদারের হালে পরের মায়েরে আনাইয়া বাদশাহী করতাছোস। আমি আসতে চাইছি যখন তখন তোর সহ্য হয় নাই। এখন রেশমার মায়েরে খাওয়াইতাছোস আমার ভাইয়ের কামাই………”
আর বলতে পারলো না। লিখন এসে এক ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলো। এত জোরে ধমক দিলো যে চার দেয়ালের বিল্ডিং কেঁপে উঠল। ওর ধমকে লাবন্য আর ওর ফুপু দুজনই স্তব্ধ হয়ে গেল।
“এই তুই উপরে আসছিস কেন? কার পারমিশনে তুই উপরে আসছিস? তোদেরতো উপরে আসার কথা না। তোরা আসবি নিচে। যেখানে তোদের মতো স্বার্থপর অপদার্থ সন্তান জন্মদানকারী এক মা থাকে। এখানে আসারতো তোদের কোন অধিকার নাই। এখানে শুধু আমি আসব। এখানে আমার সন্তানরা আছে। এখানেতো কোন স্বার্থপরের জায়গা নাই। কেন আসছিস এখানে জবাব দে। জবাব দে বলছি। ” শেষ কথাটা আরও জোরে চিৎকার দিয়ে বলল।

ভাইয়ের এমন আক্রমণে বোন কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। আকস্মিক এমন ভাবে ভাই এখানে আসবে তা ও ধারনা করতে পারে নাই। কি বলবে তা না ভেবেই বলে উঠল

“অত ছোট্ট চিপাচিপিতে মা থাকবে আর এখানে তোমার মরা বৌয়ের মা আলিসানে আসন পাতবে এইটা কেমন কথা ভাই?”

“মায়ের জন্য এত দরদ যখন তোর, তুই আজকেই এখনই তোর মাকে নিয়ে নিজের বাসায় যাবি। যা এক্ষন যা।বদমায়েশের দল। পরের ধনে পোদ্দারি করার খায়েশটা আর গেলো না যখন এখন যা মা নিয়ে নিজের কাছে রাখ।”

“তোমার কি হইছে ভাই? তুমি নিজের মায়ের কষ্ট দেখছো না, পরের মায়েরে সুখে রাখতাছে দিব্যি। এরজন্যই কি মা তোমারে জন্ম দিছে?”

“তাইতো মায়ের দেখভাল করতে পারোস না অক্ষম সন্তান তোরা, তোদের এই অক্ষমতা দেখার জন্যই কি মা তোদের মতো অসভ্যগুলোরে জন্ম দিছে?”

“বুঝছি তোমারে যাদুটোনা করছে রেশমার মা বইনে।”
এই কথা শুনেই লাবন্য অগ্নিমূর্তির ন্যয় রুপ ধরে তেড়ে আসল ফুপুর দিকে। তখনই লিখন লাবন্যকে জড়িয়ে ধরল। মেয়েকে বুকের মধ্যে ঝাপটে ধরে। বোনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। এরপর বলল

“তোদের জ্ঞান বুদ্ধি সব শেষ। এখন শুধু তোদের জন্য আমার করুনা হয়। রেশমার মৃত্যুর পর থেকে তোদের সবার রুপ একটু একটু করে দেখে দেখে এখন আমি ক্লান্ত। আমার এই সংসারের উপর যে তোদের এত বড় কুদৃষ্টি ছিলো তা যদি আগে ধরতে পারতাম তবে হয়তো মনের দিক থেকে অনেকটা স্বস্তি পেতে পারতাম নিজেকে সংশোধন করে, এতটা অনুশোচনায় ভুগতাম না রেশমার মৃত্যুর পর। একটা মানুষ পাই নাই আমি তোদের মাঝে যে কিনা নিঃস্বার্থভাবে আমার সন্তানদের দায়িত্ব নিবে। পাগল হয়ে এদিক সেদিক ঘুরছি। চোখের সামনে প্রাণচঞ্চল মেয়েটার ধীরে ধীরে ওর চঞ্চলতার মৃত্যু দেখেছি।ওর পড়াশোনা ওর ভবিষ্যৎ সব নিয়ে দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম কাটিয়েছি প্রতিটা মুহুর্ত। তোদের বুদ্ধিতে পরে আবার বিয়েও করেছি। আর তখনই দেখলাম আমার মেয়েটা তখনকার ডিপ্রেশনের লেভেল। তখন মনে হয়েছে সব শেষ, আমার সব শেষ। আমি পুরোপুরি শেষ। আমার চারপাশে কেউ নাই যে কি না আমার এমন বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে। আমার মেয়েটাকে একটু মেন্ট্রাল সাপোর্ট দিবে। আমার লাভকে ঘৃণার সাগরে ডুবতে বাঁধা দিয়ে আবার লাভ দিয়ে ওর মনকে ভরিয়ে দিবে। খুঁজতে খুঁজতে যখন আমি দিশাহারা তখন আল্লাহ ফেরেসতা রুপে এই মানুষটাকে আমার জীবনে এনে দিয়েছে। আমার এই এক জীবন তার জন্য কিছু না। আমার যদি আরও দশ জীবনও হয় তাও আমি তাকে দান করব তাও আমার জন্য কম হবে।”

লাবন্য ওর আব্বুর দুই হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছিলো না। হঠাৎ করেই ওর আব্বুর শেষ কথা গুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। কি বলছে আব্বু এসব? এর কি মানে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here