#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [০৯]
– আমার ধারণা ভুল নয় বলতে কি বুঝাতে চাইছেন আপনি, মিস্টার রাহনাফ।
– আমার বেড়ে হয়ে উঠাটা এই আশ্রমেই।
– মানে!!
মেহেরের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে রাহনাফ ওর দিকে ঘুরে বসে। অতঃপর বলতে থাকে,
– আমি অনাথ। হ্যাঁ লেখিকা সাহেবা এটাই সত্যি। আমার বয়স যখন ছয় বছর তখন ব্রেন স্টোকে আমার বাবা মারা যায়। বাবার মৃত্যর পর দাদার বাড়িতে ঠায় হয়নি আমার আর আমার মায়ের। তারপর একবছর আমি আর আমার মা দুইজনেই নানার বাড়িতে থাকতাম। একবছর যেতে না যেতেই মামা মামিদের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন চলে আসলো। আমাকে আর আমার মাকে তারা বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে না। নানাটাও ছিলো বৃদ্ধ। কামাই রোজগার কিছুই ছিলোনা তার। তাই ছেলে আর ছেলের বউয়ের কথার কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি। তারপর নানা সিদ্ধান্ত নেয় তারা আমার মায়ের আবার বিয়ে দিবে। মা প্রথমে আপত্তি করলেও পরে সেটা মেনে নেয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো আমাকে নিয়ে। কারন আমার মায়ের যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সে আমাকে মেনে নিবে না। আর নানার ও সামর্থ্য নেই যে সে আমার ভরণ পোষনের দায়িত্ব নিবে। একরকম বাধ্য হয়েই আমার মা আমাকে এই আশ্রামে রেখে যায়। সেই সাত বছর বয়স থেকে আমি এই আশ্রমে থাকি। এই আশ্রমে আমার কৈশোরকাল কেটেছে। আশ্রমের প্রতিটা ঘর আমার চেনা। এই আশ্রমের বৃদ্ধাদের আমি দাদা দাদি তাকি। বাচ্চাগুলো আমার ভাই বোন। হ্যাঁ এখানে সবাই আমার পরিবার। এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সে আমাকে পড়াশুনা করার সুযোগ করে দেয়। এসএসসি পরিক্ষার পর আমাকে আশ্রম ছেড়ে চলে যেতে হয়। তবে এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠিতার সাহায্যে আমি পলিটেকনিক্যালে ভর্তি হতে পারি। তারপর থেকেই নিজের খরচ নিজেই বহন করি। সকালে টিউশন আর রাতে টিউশন এই ভাবেই নিজের পড়াশুনো চালিয়ে যাই। পলিটেকনিক্যালে পড়ার সময় আলিহানের সাথে পরিচয় আমার। তারপর বন্ধুত্ব। আলিহান ও অনেক সাহায্য করেছে আমায়।
– এখন কি করছেন? দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করলো মেহের।
– আগের মতোই চলছে। তবে সাথে কোচিংটা যুক্ত হয়েছে। মৃদু হেসে জবাব দেয় রাহনাফ।
– আপনার পড়াশুনা কি শেষ? মেহের প্রশ্নে শুনে কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে রাহনাফ। অতঃপর বলো,
– নাহ। শুধুমাত্র ডিপ্লোমা শেষ। অর্থের অভবে এখনো বিএসসি করা হয়নি।
– ওহ। ছোট্টকরে শ্বাস ত্যাগ করে মেহের। তারপর সে রাহনাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেখান থেকে আসে। পিছনে পরে থাকে রাহনাফ। আচমকা মেহেরের মুখে বিষন্মতার ছাপ কেন? আর মেহের এভাবে চলেই বা গেল কেন? আচ্ছা রাহনাফের কোন কথায় কি কষ্ট পেয়েছে মেহের, ভাবতে থাকে রাহনাফ।
বাসায় ফিরে সেদিন রাতে মেহের একটা গল্প লিখে পত্রিকা পেজে জমা দেয়। পরের দিন ভোরে সেই গল্পটা নবচেতনা পত্রিকাতে প্রকাশ পায়। সেদিন মেহেরের গল্প সারাদেশ লোক পড়ে, পড়েনি শুধু রাহনাফ।
১৬,
তারপর কেটে যায় তিনটা দিন। এই তিন দিনে মাত্র একবার দেখা হয়েছে মেহের আর রাহনাফের। তবুও সেটা মৌ আর আলিহানের দেখা করা নিয়ে। আজ মার্চ মাসের দ্বিতীয় দিন। কাল মেহেরের ডিবেট প্রতিযোগীতা “আমরাই সেরা” অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হবে টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে। মেহের রেডি হচ্ছে আজ সে আবার সেই চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোম যাবে। সেদিনের বৃদ্ধার কথা তার খুব মনে পরে। বৃদ্ধার সেই ছলছল চাওনি ভুলতে পারছে না মেহের। মেহের আজ বোরখা পরেই সেখানে যাবে।সকাল থেকে মৌ-য়ের মাথা ব্যাথা তাই সে আজ কোথাও যাবে না। মেহেরের রেডি হওয়া শেষে সে এবং তার মা সৈয়দা মাহবুবা দুজনে মিলে বেড়িয়ে যায়। কিছুদূর যেতেই তাদের পথ আলাদা হয়ে যায়। সৈয়দা মাহবুবা তার স্কুলের পথে চলে যায় আর মেহের যায় চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোমের দিকে।
রিক্সায় পাশাপাশি বসে কলেজের দিকে অগ্রসর হচ্ছে রাহি আর রাহনাফ। মেয়েদের সাথে রিক্সায় বসলে এই এক সমস্যায় পরতে হয়। পুরো রাস্তা বকবক করতে করতে মাথা ব্যাথা করিয়ে দেয়। রাহি পাগলের মতো একা একা বকবক করে যাচ্ছে আর রাহনাফ রিক্সার এক পাশে চুপটি করে বসে আছে। বেশ বিরক্ত লাগছে তার। সাথে মাথাটাও ব্যাথা করছে তার। শুধুমাত্র সৈয়দ নওশাদের কথা রাখতে রাহির সাথে আজ ওকে একই রিক্সায় যেতে হচ্ছে। সৈয়দ নওশাদের কথা ফেলতে পারে না রাহনাফ। তারই সুযোগ নিচ্ছে রাহি। হঠাৎ রাহনাফের চোখ যায় একটা অটোর দিকে। যেখানে বসে আছে মেহের। মেহেরকে দেখেই যেন রাহনাফের মাথাব্যথা নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। সে তাকিয়ে থাকে সেই অটোর দিকে। অটোটা যখন ওদের রিক্সা ক্রস করে চলে যায় তখন রাহনাফ বলে উঠে,
– চাচা রিক্সা থামান? রাহনাফের কথামত রিক্সাওয়ালা তার রিক্সা থামিয়ে দেয়। রাহনাফ রিক্সা থেকে নেমে যাবে তখন রাহি রাহনাফের হাত ধরে বলে,
– কোথায় যাচ্ছো তুমি?
– কোথাও যাচ্ছি না। তুমি কলেজে যাও আমি আসছি। রাহির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় রাহনাফ তারপর সে রিক্সা থেকে নেমে যায়। রাহির মন খারাপ হয় যায়। সে বিষন্ন মন নিয়ে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের পানে। কিন্তু রাহনাফ, তার ভাবনাতে বিরাজ করছে মেহের। চলে যায় রিক্সা। রাহনাফ সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে রিক্সার জন্যে। রিক্সা পেলে সে পিছু করবে মেহেরের।
১৭,
ওল্ডএজ হোমের বাহিরে এসে অপেক্ষা করছেন একজন বৃদ্ধা। বয়সের ভারে শরীর তার নুইয়ে পরেছে। শরীরে চামড়ায় ভাজ পরেছে একাধিক। চোখে স্পষ্ট দেখতে পেলেও কানে একটু কমই শুনে। একটু গুজে হাটেন তিনি। অধিক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন তিনি। প্রতি মাসের শুরুতে তার ছেলে এসে তাকে ফলমূল ঔষুদ আরো নানান দ্রব্যাদি দিয়ে যায়। কাল তার ছেলে আসেনি আজ নিশ্চয় আসবে। ছেলেকে দেখতে পাবে, তাকে দু-হাতে ছুতে পারবে, আনন্দের যেন শেষ নেই আজ তার। বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগে বৃদ্ধাটি। কিছুসময় পর দেখা মেলে তার ছেলের। হাতে একখান ব্যাগ নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে বৃদ্ধার ছেলে। ছেলেকে দেখে চোখদুটো পানি ভরে উঠলো তার। পরনে থাকা থানের এক অংশ দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলেন তিনি। ছেলেটা তার কাছে চলে আসলো, বৃদ্ধা এবার আর তার চোখে জল আটকে রাখতে পারলেন না। শ্রাবণ ধারার মত করে বইতে শুরু করলো তার চোখের জল। ছেলেটা এসে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। এবার ছেলেটাও কাঁদছে। বাস্তবতা কতটা কঠিন। যে মা তাকে জন্ম দিয়েছে, আদর ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলেছে সে আজ থাকে বৃদ্ধাশ্রমে। ছেলের এত বড় বাড়িতে জায়গা হয়না মায়ের। প্রতিয়া মেয়ে যদি তার শ্বাশুড় শ্বাশুড়িকে নিজের বাবা মায়ের মতো ভালোবাসতো তাহলে বিশ্বে কোন বৃদ্ধাশ্রম থাকতো না।
রিক্সা থেকে নেমে আশ্রামে ভিতরে প্রবেশ করার সময় মেহেরের চোখ আটকে যায় সে বৃদ্ধার দিকে। কেউ একজন তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, কিন্তু কে সে। উল্টোদিকে থাকায় লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না মেহের। তাই সে ধীর পা তাদের দিকে এগোতো থাকে। মেহের বৃদ্ধার অনেকটা কাছাকাছি চলে আসছে তখনি লোকটা বৃদ্ধাকে ছেড়ে দু-হাতে আলতো করে তার চোখের পানি মুছে দেয়। লোকটার মুখ দেখা মাত্র মেহের দুপা পিছিয়ে যায়। অস্ফুটভাবে বলে,
– সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। এই বৃ্দ্ধার ছেলে সৈয়দ নওশাদ, তাহলে তো উনি,,,, আর মেহের কিনা এই বৃদ্ধার সাথে দেখা করার জন্যে এখানে এসেছে। নিজের উপর বেশ রাগ লাগছে না। রাগে হাতদুটি মুঠো করে নিলো মেহের। সৈয়দ নওশাদ তার মাকে ছেড়ে দিয়ে বুক পকেট থেকে স্মার্ট ফোন বের করে বলে,
– তুমি মেহের কে দেখতে চেয়েছিলে না মা। দেখো আমি আজ মেহেরের ছবি এনেছি। তারপর সে মোবাইলে মেহেরের ছবি তার মাকে দেখাতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। বৃদ্ধা তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে,
– সেদিন মেহের এসেছিলো আমি দেখেছি ওকে। দু হাতে ছুইয়ে দেখেছি। জানিস বাবা এখন আর আমার আফসোস নাই। আমি আমার প্রথম নাতনীকে ছুয়ে দেখতে পারছি। তাদের বলা কথা তিক্ত লাগছিলো মেহেরের তাই সে হাত দিয়ে কান বন্ধকরে নেয়। তারপর সে নিরবে প্রস্থান করে।
চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোমের বাহিরে আসতেই দেখা হয়ে যায় রাহনাফের সাথে। রাহনাফকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলো মেহের তখন রাহনাফ গিয়ে মেহেরের সামনে দাঁড়ায়। মেহের তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে রাহনাফের দিকে তাকায়। বিনিময়ে মৃদু হেসে রাহনাফ বলে উঠে,
– না আসলে হয়েছে কি? না মানে আসলে !
– কি মানে মানে করছেন বলুন তো। পথ আটকিয়ে দাঁড়িয়েছেন কেন? কড়া গলায় বলে মেহের।
– কোথায় যাচ্ছেন?
– পাতালপুরীতে, আপনি যাবেন আমার সাথে।
– শুধু পাতালপুরী কেন, আপনি আমাকে যম রাজ্যে নিয়ে যেতে চাইলেও আমি বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যাব। মনে মনে বলল রাহনাফ।
– এভাবে হা করে কি দেখছে? সামনে থেকে সরে দাঁড়ান।
– হ্যাঁ হ্যাঁ । রাহনাফ মেহেরের সামনে থেকে সরে যায়। মেহের তার ক্রোধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের উপর তারপর চলে যায়।
চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।