মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর। পর্ব-১০

0
3286

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১০]

মেহেরের চলে যাওয়ার পানে রাহনাফ তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অধরে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বলতে থাকে,

– জীবনটা অনেক সুন্দর হয় লেখিকা সাহেবা। যদি ভালোবাসায় এ জীবন পূর্ণতা পায়। যদি কেউ তোমার কষ্টটা ভাগ করে নিতে চায়, তাহলে তোমার জিবন সুন্দর লেখিকা । আর আমি তোমার কষ্ট গুলো নিতে চাই। আমার সকল আনন্দ তোমার মাঝে বিলিয়ে দিতে চাই লেখিকা সাহেবা।

বুকের উপর হাত ভাজ করে তাকিয়ে থাকিয়ে থাকে আকাশ পানে। শীতের শেষ প্রখর তাপ দিচ্ছে সূর্যিমামা। এতদিন যেন আকাশ মেঘে ঢাকা ছিলো আর আজ মেঘ কাটিয়ে উকি দিয়ে সূর্য। ঠিক যেন #মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর।
মোবাইলের রিংটোন এর শব্দে ঘোর কাটে রাহনাফের। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে নাম্বার দেখে নেয় রাহনাফ। মোবাইলের স্কিনে রাহি নামটা জ্বলজ্বল করছে। রাহনাফ কল রিসিভ করে বলল,

– আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব। রাহিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে মোবাইল পকেটে পুরে রাখে। তারপর সে হাটতে থাকে সামনের দিকে।

১৭,
আজ সকাল থেকেই মেহেরের মনটা বিষণ খারাপ। সময়ানুক্রমে মন খারাপটা আরো দৃঢ় হচ্ছে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে সে ছাদে চলে আসে। যদি ছাদের এই মনোরমা পরিবেশ দেখে তার মন খারাপটা দূর হয়ে যায়। সৈয়দ মাহবুবা ছোট্টথেকে বাগান পছন্দ করতেন। আগে বাড়ির আশেপাশে উঠোনে অনেক গাছ রোপন করেছেন তিনি। এই ভাড়া বাড়িতে আসার পর ছাদে গাছ লাগান তিনি। সকাল সন্ধা দুই বেলা গাছের পরিচর্যা করেন সে।
তার ছাদ বাগানে রয়েছে আপেল, আমলকী, লেবু বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ। ছাদের কোনো অংশে আবার লাগিয়েছেন পাথরকুচি, কালোমেঘা, তুলসী গাছসহ বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গাছ। সবজি ফল আর ফুলে ভরে গেছে পুরো ছাদ। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এটি ছাদ নাকি সবুজ ফসলের মাঠ। মেহের গিয়ে লেবু গাছের পাশে দাঁড়ায়। কচি লেবুর পাতার গন্ধ শুকে নেয় সে। না ভালো লাগছে না। আচ্ছা এই ঔষুদি গাছগুলা কি মেহেরের মন ভালো করে দিতে পারবে। হয়তো পারবে না। মেহের তো শরীরে কোন আঘাত পায়নি তাহলে ঔষুদ লাগিয়ে কি হবে। কাল রাত থেকে মেহেরের মা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পরেন। যার কারনে আজ মেহের ডিবেট প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পারে না মেহের এতেও মন খারাপ হয়নি মেহেরের। সব আগে তার মায়ের সুস্থতা বলে দাবি জানায় সে। সৈয়দ মাহবুবা মেহেরকে অনেকবার বলছে, সে যেন আঞ্চলিক ভাষার এই ডিবেট মিছ না করে। কিন্তু মেহের, সে তার অসুস্থ মা কে ছেড়ে কোথাও যাবে না। মায়ের সেবা আর মৌ-য়ের সাথে দুষ্টুমিতে ভালো কাটছিলো মেহেরের দুপুর।তার মধ্যে সৈয়দা মাহবুবা মেহের আর মৌ-কে ডেকে বলেন,

– মা-রে তোদের একটা কথা বলি শুন। আমার তো বয়স দিনদিন বেড়েই চলেছে। আজকাল শরীরটাও বেশী ভালো থাকে না। আজ ভালো থাকলে কালই মন্দ। কবে জানি পরপারে যাওয়ার ডাক এসে যায়।

– মা তুমি চুপ করবে। কেন এসব অলক্ষনে কথা বার্তা বলছো। এখন কোন কথা বলবে না তুমি। এতক্ষণ তো কোন কথাই বের হচ্ছিলো না মুখ দিয়ে। যেই জ্বরটা একটু কমেছে ওমনি শুরু করে দিয়েছো। মেহেরের কড়া শাসনে মৃদু হাসে সৈয়দা মাহবুবা। অতঃপর বলে,

– আমি তোদের দুজনের বিয়ে দিতে চাই। মেহু, মৌ তোদের যদি পছন্দের কেউ থাকে তবে সেটা আমাকে বলতে পারিস। আমি তাদের পরিবারের সাথে কথা বলবো।

সৈয়দা মাহবুবার মুখে বিয়ের কথা শুনে রেগে যায় মেহের। মেহের তো আগেই ঠিক করেছে সে বিয়ে করবে না। তাহলে তার মা বিয়ে দেওয়ার কথা কেন বলছে। মেহের চায়না তার মা বিয়ের পর যতটা কষ্ট পেয়েছে সেও কষ্টটা সে পাক। দুজন মানুষের পথ চলা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাক। মাঝপথ থেকে চলে যাক সে। তবে যে মেহের নিজেকে সামলাতে পারবে না। তার চেয়ে ভালো সে একাই সবটা পথ হাটবে। চায়না কারো সঙ্গ।

সৈয়দা মাহবুবা তার দুই মেয়ের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে তারা কি জবাব দেয় সেটা জানার জন্যে। মৌ চুপ করে থাকে কোন কথা বলে না। তবে মেহের সে চুপটি করে থাকার মেয়েই নয়। সে বলে উঠে,

– মা তুমিতো অসুস্থ তাহলে এখন এসব কথাবার্তা কেন বলছো বলতো। আর আমি তোামকে আগেও বলেছি মা, আমি বিয়ে করতে চাইনা। আমি বিয়ে করবো না। আমি তো তোমাকে দেখেছি নিজের জিবনের সাথে কতটা সংগ্রাম করেছো তুমি। পরিবার সমাজের সাথে লড়াই করে বাঁচছো তুমি। মা, তোমার মতো আমার এত ধৈর্য নাই। আমি পারবো না তোমার মতো জিবনের সাথে লড়াই করে বাচতে।

– তুই কেন আমার মতো লড়াই করবি বলতো মা। দেখবি তোর বর তোকে অনেক ভালোবাসবে।

সৈয়দা মাহবুবার এই কথাটা শুনে মেহেরের মন আরো বেশী খারাপ হয়ে যায়। হ্যাঁ তার বর তাকে ভালোবাসবে। এটাই স্বাভাবিক, কেননা তার গায়ে তো সাদা চামড়া। আর সুন্দর বউকে তো ভালোবাসবেই। মেহের সৈয়দা মাহবুবার দিকে করুন চোখে তাকায় অতঃপর বলে,

– সুন্দর বৌকে সবাই ভালোবাসে তাই না মা। কথাটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল মেহের।

মেহেরের কথার গভীরতা বুঝতে বাকি রইলো না সৈয়দা মাহবুবার। সে বড় করে শ্বাস ফেলে মেহেরের হাতদুটি ধরলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন,

– না মেহু। তোর ধারনাটা সঠিক নয়। সবাই বর্ণবাদী হয় না। একেক জন একেক রকমের হয়। আমার ভাগ্যে স্বামি শ্বাশুড় বাড়ির ভালোবাসা নেই তাই হয়তো আজ আমি একজন সিঙ্গেল মাদার। আমাদের দেশে এখন অনেক মানুষ আছে যাদের গায়ের রং কালো আর তারা স্বামি সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছে। কালো মেয়েদের সবাই অপছন্দ করে না। জানিস মেহু আমার দাদা কি বলতো, আমার দাদা বলতো, নদীর পানি ঘোলা ভালো আর জাতের মেয়ে কালো ভালো। ছোট বেলায় আমার গায়ের রং নিয়ে আমার প্রতিবেশী আত্নীয় স্বজনরা অনেক কটু কথা বলতো আর তাদের সকলের কথার প্রতিবাদ জানাতো আমার দাদা। কই আমার দাদা তো আমাকে অপছন্দ করেন নি। মেহু, সবার মন মানসিকতা এক হয় না।

সৈয়দা বেগমের কথায় কোন প্রতিক্রিয়া করে না মেহু। নিঃশব্দে সেখান থেকে প্রস্থান করে সে। তারপর সোজা চলে আসে ছাদে। বাগানের প্রতিটা গাছকে ছুঁইয়ে দেখছে সে। তখন তার চোখ যায় ওদের বাসা থেকে কিছুটা দূরে একটা ছোট্ট চায়ের দোকানের সামনে। যেখানে কিছু বাচ্চা ছেলেরে সাথে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে রাহনাফ। রাহনাফের এই দিকটা খুব ভালো লাগে মেহেরের। রাহনাফ বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে তাই হয়তো রোজ বিকালে স্কুলের মাঠে ওদের সাথে ক্রিকেট খেলে। আনমনে হেসে ফেলল মেহের। এতক্ষণের মন খারাপটা এবার বোধহয় চলেই গেলো।

১৮,
নিজের রুমে বসে অফিসের কাজ করছিলেন সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। অফিসের কাজ তিনি অফিসেই বেশী করেন। আজকাল তিনি বাসায় বেশী আসেন না বলেই চলে। সারাদিন রাত অফিসেই কাটিয়ে দেন। সারাদিন অফিস করে দিন শেষে ঘরে ফিরলে যদি একটু শান্তিই না পাওয়া যায় তাহলে কার ঘরে ফিরতে মন চায়। তাই সৈয়দ নওশাদ এখন বেশী সময় অফিসেই কাটায়। গত কাল দিনটা তার খুব সুন্দর কেটেছে। মায়ের সাথে সময় কাটিয়েছে, এক সাথে বসে দুজনে খাবার খেয়েছে। বসে বসে কালকের কথাই ভাবছিলো সৈয়দ নওশাদ এমনি সময় রাহি এসে তার দরজার লক করে বলে,

– বাবা আসবো??

ঘোর কেটে যায় সৈয়দ নওশাদের। সে ভিতর থেকে জবাব দেয়,

– এসো।

রাহি এসে সৈয়দ নওশাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– বাবা আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।

– হুম বলো।

– বাবা, আমি। আমি রাহনাফকে বিয়ে করতে চাই।

রাহির কথা শুনে মাথা তুলে সামনে তাকায় সে। অতঃপর বলে,

– কি বললে তুমি।

– তুমি ঠিকই শুনেছো বাবা, আমি রাহনাফকে বিয়ে করতে চাই। আমি জানি এতে তোমার কোন আপত্তি নাই। তুমিও তো রাহনাফকে পছন্দ করো তাইনা বাবা।

– হ্যাঁ। কিন্তু সেটা শুধু মাত্র একজন ছেলে হিসাবে, মেয়ের জামাই হিসাবে নয়।

– বাবা প্লিজ, প্লিজ বাবা না করো না। রাহনাফকে বিয়ে করার বয়না শুরু করে দেয় রাহি।

– ঠিক আছে। আমি রাহনাফের সাথে কথা বলবো। সৈয়দ নওশাদের কথা শুনে রাহি খুশি হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। সৈয়দ নওশাদ তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

– পাগলী একটা। তোর কোন চাওয়া আমি অপূর্ণ রেখেছি কখনো। এটাও রাখবো না। রাহনাফের সাথে তোর বিয়ে হবে।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here