মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর। পর্ব-১১

0
3171

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১১]

১৯,
আজ সকাল থেকে রান্নার কাজে খুব আছেন সৈয়দা মাহবুবা। স্কুলেও যাওয়া হয়নি তার। সকল থেকে এপর্যন্ত শুধু রান্না করছেন তিনি। মেহের ব্যাস্ত ঘর ঘুছাতে। মৌ- কে আজ পাত্র পক্ষ দেখতে আসছে। হ্যাঁ আলিহান ওর তার বন্ধুরা দেখতে আসছে মৌ-কে। সৈয়দা মাহবুবার জ্বর কিছুটা কমে এলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মৌ-য়ের বিয়ে আগে দেওয়ার। মেহেরকে পরে বুঝিয়ে বিয়েতে রাজি করাবেন তিনি। মৌ-কে ওর পছন্দের কথা জিগ্যেস করতেই মৌ আলিহানের কথা জানায় সৈয়দা মাহবুবাকে। সৈয়দা মাহবুবা তার দুই মেয়ের সাথে বন্ধুসূলভ তাই হয়তো মৌ তার পছন্দের কথা তাকে জানাতে দ্বিধাবোধ করে নি। সৈয়দা মাহবুবা মৌ-য়ের পছন্দকে সামর্থ্য জানিয়ে তাদের সাথে দেখা করতে চান। মৌ শাওয়ার নিয়ে নিজের রুমে জানালায় হেলান দিয়ে বসে আছে। তার মনের মধ্যে বয়ে চলেছে অজানা ঝড়। আচ্ছা সৈয়দা মাহবুবার পছন্দ হবে তো আলিহানকে। নাকি সে আলিহানকে রিজেক্ট করে দিবে। যদি সৈয়দা মাহবুবা আলিহানকে অপছন্দ করে তাহলে কি হবে! মৌ-কি পারবে আলিহানকে ছেড়ে অন্যকাউকে বিয়ে করতে। না এটা সম্ভব না কখনো। জানালায় খিলে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে থাকে দূরের ওই রাস্তায়। এখান দিয়েই আসবে আলিহান।

– মৌ, তুই এখনো রেডি হোস নি। কিছুক্ষণের মধ্যে পাত্রপক্ষ চলে আসবে। রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল মেহের।

মেহেরের কথার কোন জবাব দিলো না মৌ। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকটায়। মৌ-য়ের থেকে কোন জবাব না পেয়ে মেহের ধীর পায়ে মৌ-য়ের পাশে দাঁড়ায়। মৌ-কে এমন গম্ভীর হয়ে ভাবতে দেখে মেহের মৌ-য়ের কাধে হাত রেখে বলে,

– এত মনযোগ দিয়ে কি ভাবছিস মৌ?

কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে দৃষ্টি নামিয়ে সামনে তাকায় মৌ। মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু সূরে বলে,

– মেহু তুই?

– তোর কি হয়েছে বলতো মৌ। সকাল থেকে দেখছি কেমন মন মরা হয়ে বসে আছিস। তোর কি কোন কারনে মন খারাপ।

মেহের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মৌ। বিছানায় এসে বসতে বসতে বলে,

– নারে, ভাল্লাগছেনা।

– সেটাই তো জানতে চাই। কেন ভালো লাগছে না তোর? তোর পছন্দের মানুষটাই তো তোকে দেখতে আসছে তাহলে ভালো লাগছে না কেন? মেহের মৌ-য়ের পাশে বসতে বসতে বলল। মেহের কথা শুনে মৌ ওর দিকে করুন চোখে তাকালো। অতঃপর বলল,

– আন্টি আলিহানকে পছন্দ করবে তো, মেহু। অভিযোগের সূরে কথাটা বলল মৌ। মৌ-য়ের কথা শুনে খিল খিল করে হেসে দেয় মেহের।

– এইজন্য এমন গাল ফুলিয়ে বসে আছিস। মেহের মৌ-কে জড়িয়ে ধরে আর বলে,শান্ত হো। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। মৌ মেহেরকে জড়িয়ে ধরে বলে,

– আমার খুব ভয় হচ্ছে মেহু। আসলে নিজের পছন্দের মানুষ দেখতে আসছে তো তাই এত টেনশন হচ্ছে। আন্টি যদি আলিহানকে পছন্দ না করে।

মেহের মৌকে ছেড়ে ওর গালে হাত রেখে বলে,

– ধুর পাগলী, কেন এত চিন্তা করছিস। সব ঠিকঠাকই হবে। তুই এখন রেডি হয়ে নে। আমি যাই মা-কে একটু হেল্প করি। মেহেরের কথার সম্মতি স্বরুপ মাথা নাড়ায় মৌ। অতঃপর মেহের চলে যায় আর মৌ রুমে বসে রেডি হতে থাকে

আলিহান ও তার তিন বন্ধু এসেছে মৌ-কে দেখতে। এদের মধ্যে রাহনাফ ও এসেছে। সবাইকে বসার রুমে রেখে মেহের ওর মাকে ডাকতে চলে যায়। সৈয়দা মাহবুবা রান্না সেরে গোসল করতে গিয়েছেন মাত্র। প্রায় দশ মিনিট পর সৈয়দা মাহবুবা বসার রুমে আসেন। সৈয়দা মাহবুবাকে দেখে আলিহান দাঁড়িয়ে যায়। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সৈয়দা মাহবুবার দিকে। সৈয়দা মাহবুবা ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আলিহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– তুমি দাড়িয়ে গেলে কেন বাবা। বসো।

– ছোটমনি। অস্ফুটভাবে বলল আলিহান। তবে এটা সৈয়দা মাহবুবার কান পর্যন্ত ঠিকই পৌছালো। সৈয়দা মাহবুবা তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে বলে উঠলেন,

– কি- কি বললে তুমি।

সৈয়দা মাহবুবার ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না আলিহান। সে তার আসন ছেড়ে দ্রুত সৈয়দা মাহবুবার কাছ গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। দু-হাতে শক্তকরে সৈয়দা মাহবুবাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,

– ছোটমনি, তুমি আমাকে চিনতে পারছো না। আমি তোমার গুড্ডু। তুমি আমাকে চিনতে পারছো না। কোথায় হাড়িয়ে গেছিলো তুমি। জানো কত খুজেছি তোমাকে আমি। আলিহান সৈয়দা মাহবুবাকে ছেড়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আলিহানের পরিচয় শুনে সৈয়দা মাহবুবা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখদুটো তার অশ্রুতে ভরে গেছে। ছলছল করছে পানিতে। তিনি তার হাতদুটি আলিহানের গালে রেখে কান্নামিশ্রত সুরে বললেন,

– গুড্ডু। আমার গুড্ডু, কত বড় হয়েগেছিস তুই। ছোট মনির কথা মনে আছে তোর। সৈয়দা মাহবুবা আলিহানকে তার বুকে জড়িয়ে নিলেন।

পাশাপাশি বসে আছে আলিহান আর সৈয়দা মাহবুবা। ওদের পাশেই দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখ করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে মেহের। এখানে কি হচ্ছে কিছুই ডুকছে না তার ছোট্ট মাথায়। আর এই আলিহানই বা কে? তার মায়ের সাথে আলিহানের কি সম্পর্ক। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মেহেরের মাথায়। আলিহান তার মা-কে এভাবে জড়িয়ে রেখেছে কেন? নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে মেহের ওর মাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,

– মা, আলিহান ভাইকে তুমি কি করে চিনো। কই আগে তো কখনো তার সম্পর্কে আমাদের বলো নি।

মেহেরের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন কর্নোপাত হতেই আলিহান সৈয়দা মাহবুবার দিকে প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকায়। আলিহানের প্রশ্নের জবাব স্বরুপ সৈয়দা মাহবুবা মৃদু হেসল মাথা নাড়ায়। তারপর মেহেরের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে ডাকে। মেহের গিয়ে সৈয়দা মাহবুবার পাশে বসে তখন পাশ থেকে আলিহান মেহেরের চুল টেনে বলে,

– এটাতো পুরাই পিচ্চি। মেহের বিরক্তি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আলিহানের প্রতি। তারপর সে সৈয়দা মাহবুবার দিকে জিগ্যেসু দৃষ্টিতে তাকায়। সৈয়দা মাহবুবা লম্বা করে শ্বাস টেনে বলে,

– গুড্ডু তোর ভাই মেহু। তোর চাচাতো ভাই সে।

সৈয়দা মাহবুবার কথা শুনে চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে মেহের। অতঃপর সৈয়দা মাহবুবা আবার বলে,

– গুড্ডু হচ্ছে তোর বড় চাচার ছেলে। তোর বড় চাচা আর চাচি গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায় তারপর থেকে আমি যতদিন ছিলাম ওকে দেখাশোনা করেছি।

সৈয়দ মাহবুবার কথা শুনে উঠে দাঁড়ায় মেহের। দু-হাতে শক্ত করে উড়নাটা চেপে ধরে নিজেকে কঠিন পজিশনে নিয়ে যায়। অতঃপর বলে,

– আমার কোনদিন বাবাই ছিলো না তাহলে চাচা আসবে কোথা থেকে।

মেহেরের কথা শুনে সৈয়দা মাহবুবা কিছু না বললেও আলিহানের বন্ধুরা বেশ অবাক হয়। আলিহানও অবাক হয়েছে। তবে রাহনাফ একটু বেশীই অবাক হয়েছে, এইতো কিছুদিন আগে মেহের বলেছিল ওর বাবা মারা গেছে তাহলে আজ কেন বলছে ওর কোন দিন বাবা ছিলোই না। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মেহেরের মুখ পানে তাকিয়ে থাকে রাহনাফ। সে তার লেখিকা সাহেবাকে মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারে না। তার মাথায় যে কখন কি চলে কে জানে। রাহনাফ নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে বলে উঠলো,

– এ আপনি কি বলছেন লেখিকা সাহেবা। আপনার বাবা ছিলো না মানে?

– হ্যাঁ আমার বাবা কখনো ছিলো না, না এখন আছে আর না ভবিষ্যৎ এ কোন দিন থাকবে। আমার মা একজন সিঙ্গেল মাদার।

নিজেই একদমে কথা গুলো বলে চলে যায় মেহের। মৌ-য়ের সাথে তার কথা বলতে হবে। এই বিয়েটা যে করেই হোক ভাংতে হবে। কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না এই বিয়ে। না হলে যে পুরো অতীতটা ওদের সামনে চলে আসবে। মেহের ওর মাকে ভেঙে পরতে দেখতে পারবে না কখনো না। মেহের চলে যেতেই আলিহানের এক বন্ধু বলে উঠে,

– আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবো পত্রীকে কউ নিয়ে এসো।

মেহের চলেই যাচ্ছিলো তখন সৈয়দা মাহবুবা পিছন থেকে ওকে ডাক দিয়ে বলেন,

– মৌ-কে নিয়ে এসো।

মেহের করুন চখে সৈয়দা মাহবুবার মুখের দিকে তাকায়। সৈয়দা মাহবুবা তার মেয়ের চাওনি উপেক্ষা করেন। বাধ্যে মেহের মৌ-কে পাত্র পক্ষের সামনে নিয়ে আসে। দেখুক যত খুশি দেখে নিক। দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। এই বিয়ে মেহের হতে দিবে না। সে তার মা আর মৌ কে নিয়ে এই শহর ছেড়ে চলে যাবে।

বাঙালীর একটা রীতি আছে, পাত্রী দেখার সময় পাত্রীকে সম্মান স্বরুপ কিছু টাকা উপহার দেওয়া হয়। সেই রীতিটাই পালন করতে মেহের আলিহানের কাছে টাকা দাবি করে। প্রতিউত্তরে রাহনাফ বলে উঠে,

– আসলে আসার সময় আমরা কেও টাকা নিয়ে আসে নি। বিশ্বাস না হলে আপনি আমাদের পকেট চেক করতে পারেন লেখিকা সাহেবা।তবে আমার বিকাশে কিছু টাকা আছে! আপনি যদি আপনার বিকাশ নাম্বার দিতেন তাহলে আমি এখুনি সেন্ড মানি করে দিতাম।

রাহনাফের কথা শুনে মেহের সহ উপস্থিত সকলের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মেহের ড্যাবড্যাবিয়ে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে ভাবে,

– পাত্রী দেখতে এসে সেন্ড মানি করতে চায়, এটা কি মজা করছে নাকি সত্যিই ওনাদের কাছে টাকা নাই। বেপারটা ওর কাছে কেমন লাগছে। মেহের কোন কথা না বাড়িয়ে বলে,

– ঠিক আছে, টাকাটা আপনি পরে দিয়ে দিয়েন। সেন্ড মানি করার কোন প্রয়োজন নেই। তারপর সে মৌ-কে নিয়ে তার রুমে চলে যায়। মেহেরের এমন কান্ডে রাহনাফের মনটা ছোট হয়ে যায়। কত আশা নিয়ে নাম্বারটা চেয়েছিলো সে। ভাবছিলো এই সুযোগে সে মেহেরের নাম্বারা জেনে যাবে। কিন্তু সেটাও হলো না। মেহের তার সব আশায় পানি ঢেলে চলে গেলো। মেহের মৌ কে রুমে নিয়ে দরজাটা লক করে দেয়। মৌ শাড়ির ক্লিপ খুলতে খুলতে বলে,

– কি হয়েছে মেহু, একরম করছিস কেন?

– তুই এই বিয়ে করবি না মৌ।

মেহেরের কথা শুনে মৌ-য়ের হাত থেমে যায়। সে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহেরের দিকে। আর ভাবতে থাকে সবই তো ঠিক আছে তাহলে এই মেহুর আনার হলোটা কি??

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here