#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১২]
সকাল সকাল রাহনাফকে নিজ বাড়িতে দেখে বেশ অবাক হয় রাহি, সাথে খুশিও হয় অনেক। সে একগাল হেসে রাহনাফের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
– রাহনাফ তুমি আমার বাড়িতে!
– স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছি, স্যার কোথায় আছেন? ব্যাস্ত ভঙ্গিতে জবাব দেয় রাহনাফ।
– বাবাতো তার রুমেই আছে। তুমি যাও আমি তোমাদের দুজনের জন্যে চা করে আনছি। খুশি মনে গান গাইতে গাইতে রান্নাঘরে চলে যায় রাহি। রাহনাফ পুরো ড্রয়িংরুম অবলোকন করে নিয়ে উপরে সৈয়দ নওশাদ আহমেদের রুমের দিকে পা বাড়ায়। কয়েক কদম সামনে এগোতেই দেখা হয়ে যায় রাহির মায়ের সাথে। রাহনাফ তাকে সালাম দিয়ে কোন রকমে তার থেকে চলে যায়। রাহির মা বিড়বিড় করতে করতে ড্রয়িংরুমে চলে আসে। একমাত্র মেয়েকে রান্নাঘরে দেখে অবাকের চরম শিখরে পৌঁছে যায় সে। মুখে হাত দিয়ে অবাক নয়নে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ধীর পায়ে মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। অতঃপর বলেন,
– বাড়িতে এতজন সার্ভেন্ট থাকতে তুমি কেন রান্নাঘরে?
– রাহনাফের এসেছে!
– দেখেছি। তুমি যাও গিয়ে রাহনাফের সাথে গল্প করো। চা-টা না হয় কমলা করে দিবে।
– নাহ। রাহনাফের জন্যে আমি নিজে হাত চা বানাতে চাই।
– কিন্তু রাহি তুমি তো চা বানাতে পারবে না।
– শিখে নিবো। তুমি আমাকে শিখিয়ে দাওনা মা। রাহির কথায় তার মা বিষম খেল কয়েকবার। সে কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে বলল,
– বেবী তুমি চা বানাও আমি দেখি রাহনাফ কি করছে। দ্রুত পা ফেলে রান্নাঘর থেকে চলে আসে রাহির মা। রাহি ইউটিউব এ চা বানানোর ভিডিও দেখে চা বানাতে থাকে
এদিকে রাহনাফ সৈয়দ নওশাদের রুমে আসলে সৈয়দ নওশাদ তার কাজ ছেড়ে রাহনাফকে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। গ্রিলে হাত রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে দুজনে। দক্ষিণা হওয়া এসে শীতল করে দিচ্ছে মন। রাহনাফের খুব করে জানতে ইচ্ছে কাছে তাকে কেন ডাকা হয়েছে। আবার মুখ ফুটে সৈয়দ নওশাদকে সে কিছু জিগ্যেস ও করতে পারছে না। দুজনের মধ্যে চলছে পিনপতন নিরবতা। প্রায় মিনিট দুয়েক পর সৈয়দ নওশাদ নিরবতা ভেঙে বলে উঠে,
– তোমার পড়াশুনার কি খবর রাহনাফ। বিএসসি করবে না নাকি?
সৈয়দ নওশাদের কথায় মৃদু হাসে রাহনাফ। সামর্থ্য জানা সত্তেও সে কেন এমন প্রশ্ন করছে সেটাই বুঝতে পারছে না সে। সৈয়দ নওশাদ তো জানেই অর্থের অভাবে রাহনাফের বিএসসি করাটা আটকে গিয়েছে তবুও কেন এ প্রশ্ন করছে সে
– আপনি তো সবটা জানেন স্যার, তাহলে কেন প্রশ্ন করছেন?
রাহনাফের কথা শুনে স্মিত হাসলো সৈয়দ নওশাদ। সে স্থির দৃষ্টি রাখলো রাহনাফের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ রাহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সৈয়দ নওশাদ বলে উঠলেন,
– যদি ইনভেস্ট আমি করে দেই।
সৈয়দ নওশাদের কথা শুনে রাহনাফের চক্ষুদ্বয় আপনাআপনি বড় হয়ে গেলো। সে অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে অতঃপর বলে,
– আপনি কেন শুধু শুধু আমার পিছনে ইনভেস্টমেন্ট করবেন।
– শুধু শুধু ইনভেস্ট করবো এটা কখন বললাম। বিনিময়ে তুমি আমায় কিছু দিবে।
মৃদু হাসলো রাহনাফ। অধরে হাসি ফুটিয়ে বলল,
– আপনাকে দেওয়ার মতো আমার কি আছে বলুন স্যার। কেন শুধু শুধু লজ্জা দিচ্ছেন আমায়।
– সেটা সময়মতো আমি চেয়ে নিবো। এখন বলো কোথায় গিয়ে বিএসসি কম্প্লিট করতে চাও। আমেরিকা অস্ট্রিয়া কানাডা জাপান। উঃহ আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, তোমার তো জাপানের ইউনির্সিটিতে থেকে বিএসসি করার স্বপ্ন ছিলো। আজই এপ্লাই করে ফেলো।
সৈয়দ নওশাদের কথা শুনে আবারও হাসলো রাহনাফ। এই মানুষটাকে ও ওর বাবার আসনে বসিয়েছে। আশ্রাম থেকে বেড়িয়ে আসার পর এই মানুষটাই তো ওকে লড়াই করে বাচার স্বপ্ন দেখিয়েছে। কলেজের ফি ভেতন দেওয়ার সময় এই মানুষটা নানা ভাবে তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় রাহনাফের বাবা বেঁচে থাকলে বোধহয় এভাবেই সাহায্য করতেন।
– আমি দেশের বাহিরে কোথাও যেতে চাইনা, স্যার। সবার সব স্বপ্ন কি সত্যি হয়, বলুন স্যার। আমি এখানেই থাকতে চাই এই শহরে তার কাছাকাছি।
রাহনাফ কথা বলা শেষ করে সৈয়দ নওশাদের দিতে তাকিয়ে দেখে সে ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাহনাফ তার মাথা নিচু করে ফেলল।অতঃপর সৈয়দ নওশাদ বলে উঠলেন,
– কোন স্পেশাল কেউ!
উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় রাহনাফ। রাহনাফের এমন লজ্জামখা মুখ দেখে সৈয়দ নওশাদ ধরেই নেন এই স্পেশাল মানুষটা রাহি। কারন রাহনাফকে তিনি রাহির সাথে বেশী মেলামেশা করতে দেখেন। অতঃপর সৈয়দ নওশাদ রাহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
– আগে নিজের ক্যারিয়ার ঠিক করে নাও। তাছাড়া সে তো তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে। বিএসসি কম্প্লিট করে দেশে ফিরে এসো তারপর আমি নিজে তোমাদের চারহাত এক করে দিবো।
– সেটা তো তুমি দিবেই বাবা, কিন্তু বিএসসি করার জন্যে দেশের বাহিরে কেন যেতে হবে। আমাদের দেশে এত বড় বড় ইউনির্সিটি থাকতে বাহিরের দেশগুলোতে কেন যাবে। দু-কাপ চা হাতে রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল রাহি। সৈয়দ নওশাদ রাহির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন অতঃপর বললেন,
– কয়েকদিনের ই ব্যাপার এতে তুমি অমত করো না। সৈয়দ নওশাদ আহমেদের বাড়ির জামাই হবে আর বিদেশ থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসবে না সে টা তো কখনো হয় না। শেষ ব্যাক্যটা মনে মনে বললেন তিনি।
রাহি রাহনাফ ও সৈয়দ নওশাদের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাড়িয়ে বলে,
– কতদিন লাগবে পড়াশুনা শেষ হতে?
রাহনাফ চায়ের কাপ থেকে মুখ সরিয়ে রাহির দিকে তাকায় কিছু বলার জন্যে কিন্তু তার আগেই সৈয়দ নওশাদ বলে উঠেন,
– তিন থেকে সারে দিন বছর।
মন খারাপ করে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় রাহি। রাহির চলে যাওয়ার পর রাহনাফ চায়ের কাপটা রেখে বলে উঠে,
– আপনি ঠিক কি করতে চাইছেন?
– আপনাদত তোমাকে জাপান পাঠানোর ব্যবস্থা করতে চাচ্ছি। আজই এপ্লাই করবে তুমি। রাহনাফ কিছু বলবে তখন সৈয়দ নওশাদ তার হাত উঠিয়ে রাহনাফকে থামিয়ে দেন।
২১,
সৈয়দা মাহবুবা বাচ্চাদের ক্লাস নিচ্ছিলেন এমনি সময় তার মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। ক্লাস নিচ্ছিলেন বিধায় তিনি কল রিসিভ করলেন না। শুধু মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কলটা কেটে যায়। সৈয়দা মাহবুবা আবারও বাচ্চাদের পড়ানোর মনোযোগ দেন, কিছুক্ষণ পর আবার কল বেজে উঠে। এবার সৈয়দা মাহবুবা নাম্বার না দেখে মোবাইলটা সুইচ অফ করে দেন। তারপর মনোযোগ দেন পড়ানোর কাজে। প্রায় পচিশ মিনিট পর তার ক্লাস নেওয়া শেষ হয়। ক্লাস থেকে বেড়িয়ে তিনি আগে মোবাইলটা অন করে নেয়। মেহের কল করেছে। খুব প্রয়োজন না হলে মেহের কল করে না। তাহলে এখন কেন কল করছে ও। ওদিকে সব ঠিকঠাক আছে তো। মেহেরের নাম্বারে ডায়াল করেন সৈয়দা মাহবুবা। কলটা রিং হতেই ওপাশ থেকে মেহের কল রিসিভ করে কর্কশ গলায় বলে উঠে,
– তোমাকে কতবার কল করেছি, কল রিসিভ কেন করছো না
– ক্লাস টাইম ছিলো তাই রিসিভ করিনি। কল কেন করেছো?
– আলিহান ভাই তার ব্যাগপত্র নিয়ে আমাদের বাসায় উঠেছে। বলে সে নাকি এখন আমাদের সাথে থাকবে। আলিহান ভাইকে ব্যাগপত্র নিয়ে বাসায় আসতে দেখে পাশের ফ্লাটের কয়েকজন আন্টি এসে নানা কথা বলছে। মৌ-কে নিয়ে খারাপ কথা বলছে। মা তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। কথাগুলো বলেই কল কেটে দেয় মেহের। সৈয়দা মাহবুবা দু-হাতে তার মুখ চেপে ধরেন। এ জিবনে বেঁচে থাকতে নিয়ে আরো কত সমস্যায় মুখোমুখি হতে হবে। তার জিবনটা তো এভাবে গেলো এখন কি তার মেয়েদুটোও শান্তি পাবে না নাকি। চোখদুটি পানিতে টলমল করে উঠলো। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে মোবাইলটা ব্যাগে পুরে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন।
বাড়িতে পা রাখা মাত্রই তিনি শুনতে পেলেন কিছু অশ্রাব্য ভাষা। কিছু মহিলা তাকে তুলে তার মেয়েদের অপমান করছে। মহিলারা সৈয়দা মাহবুবার সিঙ্গেল মা হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করছে। মেহেরের জন্ম পরিচয়ের কথা তুলছে। আজ মেহের প্রতিবাদ করতে পারছে না। কারন সে তার জন্মদাতার পরিচয় কাউকে বলবে না কাউকে না। তাই সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনে যাচ্ছে। আলিহান প্রতিবাদ করতে চাইলে তাকেও থামিয়ে দেয় মেহের। বলুক না লোকে যা খুশি বলুক। এদের তো এটাই কাজ সামনে দাঁড়িয়ে শান্তনা দিলেও চোখের আড়াল হলেও সমালোচনার মেলা বসে। আজ না হয় সামনাসামনি বলছে। তাতে কি! এসব মেহেরের অভ্যাস হয়ে গেছে।
– গুড্ডু তুই বিয়ের জন্যে প্রস্তুত তো?
সৈয়দা মাহবুবা বুকের উপর দু-হাত গুজে বললেন।
সৈয়দা মাহবুবার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে সকলের দৃষ্টি পরে তার দিকে। একজন মাধ্যবয়স্ক মহিলা বলে উঠেন,
– যেই বড় লোকের ছেলে দেখেছে উমনি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। এই বিয়ে কয়দিন টিকবে। পরে দেখা যাবে পেটে বাচ্চা নিয়ে এসে আবার বাপের বাড়ি ফিরে এসেছে । পরে হবে সিঙ্গেল মাদার। আর কত ডং দেখতে হবে।
সৈয়দা মাহবুবা মহিলার কথার কোন প্রতিবাদ না করে আলিহানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন,
– আজ এখুনি তুই মৌ-কে বিয়ে করবি।
সৈয়দা মাহবুবার কথা শুনে অন্য আরেক মহিলা বলে উঠেন,
– বড় লোকের ছেলে, মেয়েদের সাথে ফুর্তি করাই এদের কাজ। ফুর্তি করবে, মজা লুটবে তারপর ভাগবে, বিয়ে কোনদিন করবে না।
উক্ত মহিলাদের কথা শুনে সৈয়দা মাহবুবা সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আলিহানের দিকে। আলিহানের দৃষ্টি স্থির তার পাশে মাথা নিচু করে বসে থাকা মৌ-য়ের দিকে।
চলবে,,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।