মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-১৩

0
3102

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১৩]

২২,
বাসের সিটে পাশাপাশি বসে আছে মেহের আর রাহনাফ। মেহের কলেজে যাচ্ছে আর রাহনাফ কোথায় যাচ্ছে সেটা নিজেও জানেনা সে। মেহেরকে বাসে উঠতে দেখে সেও বাসে উঠে মেহেরের পাশে বসেছে। চারদিন পর আজ কলেজে যাচ্ছে মেহের। তাই ওকে খুব বেশী চিন্তিত দেখাচ্ছে। মৌ আর আলিহানের বিয়ে হয়েছে চারদিন হলো। সেদিন সকলের মুখ বন্ধ করার জন্যে আলিহান মৌ কে বিয়ে করে নেয়। তাছাড়া আলিহানের ইচ্ছে ছিলো সে ডাক ঢোল পিটিয়ে বিয়ে করবে। ওই মহিলাদের জন্যে সেটাও আর হলো না। সেদিন বাসায় কাজী ডেকে কোন রকমে বিয়েটা করে নেয়। মৌ-য়ের বিয়ের পর আলিহান ওদের সাথেই থাকতে শুরু করে দিয়েছে। এই কয়দিন মেহেরের কলেজে যাওয়া হয়নি। কাল রাতে কলেজ থেকে প্রিন্সিপ্যাল কল না করলে হয়তো আজও তার কলেজে যাওয়া হতো না। প্রিন্সিপ্যাল হঠাৎ কেন ওকে ডাকলো! বাসে বসে ভাবছে আর হাতের নোখ কামড়াচ্ছে। ওর পাশেই বসে রাহনাফ মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে দেখে যাচ্ছে।

– ম্যাডাম ভাড়াটা?

গাড়ির হেল্পপারের কথা শুনে চমকে উঠে সামনে তাকায় মেহের। তারপর সে হেল্পপারকে ভাড়া দিয়ে রাহনাফের দিকে তাকায়। রাহনাফ তার দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। হেল্পপার ওকে জিগ্যেস করে,

– আপনি কোথায় যাবেন স্যার?

হেল্পপারের প্রশ্ন উপেক্ষা করে রাহনাফ মেহেরের দিকে ঘুরে বসে। মেহেরের মুখের দিকে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নেশালো কন্ঠে বলে উঠে,

– কোথায় যাব জানিনা! শুধু এভাবে চলতে চাই, সারাজীবন?

রাহনাফের মুখে এমন অদ্ভুত কথা শুনে মেহের তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে রাহনাফের দিকে জিগ্যেসু দৃষ্টিতে তাকাতেই রাহনাফ বলে উঠে,

– টিকিট কাটবো লেখিকা সাহেবা ?

– মানে! কি বলতে চাইছেন আপনি মিস্টার রাহনাফ।

মেহেরের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের কোন জবাব দেয়না রাহনাফ। সে মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অতঃপর বলে,

– আমি দেশের বাহিরে চলে যাচ্ছি মেহের। রাহনাফের কথা শুনে মেহের মৃদু হেসে রাহনাফকে অভিনন্দন জানায়। রাহনাফ আবার প্রশ্ন করে,

– আমি চলে গেলে আমায় মিছ করবেন না লেখিকা সাহেবা।

– একটু।

– অপেক্ষা করবেন আমার জন্যে?

– কেন?

– ভালোবাসি আপনাকে লেখিকা সাহেবা। খুব বেশী ভালোবাসি।

রাহনাফের কথা শেষ হতে না হতেই বাস থেমে যায়। সামনে তাকাতেই দেখতে পায় গাড়ি কলেজের গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মেহের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইলে রাহনাফ ওর পথ আটকিয়ে বলে,

– আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি আমি!

– পাগল হয়ে গেছেন আপনি মিস্টার রাহনাফ। ডক্টর দেখান। গাড়ি থেকে নেমে যায় মেহের। রাহনাফ ও মেহেরের পিছু পিছু গাড়ি থেকে নেমে যায় আর মেহেরকে ডাকতে থাকে। পিছনে ফিরে তাকায় না মেহের। রাহনাফ পিছন থেকে চিৎকার করে বলে উঠে,

– ভালোবাসি লেখিকা সাহেবা আপনাকে। আপনি বাসুন আর নাই বাসুন আমি আপনাকে সারাজীবন ভালোবেসে যাব লেখিকা সাহেবা। আমি অপেক্ষা করবো আপনার জবাবের জন্যে! আর হ্যাঁ আমি কিন্তু আপনার মুখ থেকে হ্যাঁ টাই শুনতে চাই। বুকের বা পাশে হাত রেখে উপরের দিকে তাকিয়ে বলে,আপনি আমার মেঘলা আকাশে ভালোবাসা রোদ্দুর নিয়ে এসেছেন লেখিকা সাহেবা। আমার মনের আকাশের #মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর আপনি।
বুকের উপরে থাকা হাতের উপর ভালোবাসা পরম উষ্ণ ছুঁইয়ে দেয় রাহনাফ তারপর সেখন থেকে চলে যায়।

এদিকে রাহনাফ চলে যাওয়ার পর হাটু গেরে মাটিতে বসে পরে রাহি। সৈয়দ নওশাদ তার হাতটা শক্তকরে ধরে রেখেও তাকে পরে যাওয়া থেকে আটকাতে পারলেন না। গাটুগেরে মাটিতে বসে চিৎকার করে উঠলো রাহি। সৈয়দ নওশাদ করুন চোখে তাকিয়ে আছে তার মেয়ে রাহির দিকে। কিছুক্ষণ আগে রাহনাফ যখন চিৎকার করে মেহেরকে তার মনের কথা বলছিলো তখনি রাহি আর সৈয়দ নওশাদ চলে আসে আর রাহনাফের বলা কথাগুলো শুনে নেয়। সব শুনে সৈয়দ নওশাদ অবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এক অচেনা ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছেন তিনি। যে ঝড় এসে নিমিষেই সব কিছু চুরমার করে দিবে। সৈয়দ নওশাদ কি পারবে এই ঝড় সামলাতে? নানা চিন্তা বেকে বসেছে তার মাথায়। রাহি উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাতে চোখের পানি মুছে বলতে থাকে,

– বাবা আমার রাহনাফকে চাই। তুমি যে করেই হোক আমার রাহনাফকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। ওই দুটাকার মেয়ের জন্যে আমি আমার রাহনাফকে হাড়াতে চাইনা বাবা।

রাহির কথা বলা শেষ হয় সৈয়দ নওশাদের চিৎকারে। রাহির কথা শুনে সৈয়দ নওশাদ চিৎকার করে ওর উপর হাত উঠায়। রাহি অশ্রুসিক্ত নয়নে সে দিকে তাকায় আর বলে,

– বাবা তুমি,

সৈয়দ নওশাদ তার হাত মুঠি করে সেটা নামিয়ে নেয়।রাহির দিকে ক্রোধ নিক্ষেপ করতেই রাহি চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায়। সৈয়দ নওশাদ কলেজের দিকে এক পলক তাকিয়ে রাহির পিছন পিছন চলে আসে।

২৩,
ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই সৈয়দ নওশাদের স্ত্রীর ঝঝালো কণ্ঠস্বর শুনে থেমে যায়। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় তার স্ত্রী কোমড়ে শাড়ির আঁচলে গুজে অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সৈয়দ নওশাদ তার স্ত্রীর এমন রাগের কারন বুঝতে অসুবিধা হইলো না। তিনি এটাও বুঝতে পারলেন এবার তার উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে চলবে। এই ঝড় রোজকার বিষয় তাদের। সৈয়দ নওশাদ মাথা নিচু করে তার রুমে চলে যেতে চাইলে তার স্ত্রী এসে তার কলার চেপে ধরে বলতে থাকে,

– তোমার সাহস হয় কি করে আমার মেয়ের উপর রাগ ঝাড়ার। রাহি যা চাইছে সেটাই দিবে তুমি। রাহনাফের সাথে রাহির বিয়ে দিবে, নাহলে ওই দু টাকার মেয়ে মেহেরকেই এই দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিবো।

– না। চমকে উঠে সৈয়দ নওশাদ আর বলে,

– আমি তোমার সব কথাই শুনবো তুমি মেহেরের কোন ক্ষতি করবে না। আচ্ছা আমি কি তোমাদের কোন ইচ্ছে অপুর্ণ রেখেছি কখনো।

সৈয়দ নওশাদের কলার ছেড়ে দেয় তার স্ত্রী। আর বলে,

– যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাহির সাথে রাহনাফের বিয়ের ব্যাবস্থা করো। আমি আমার মেয়ের চোখের পানি সহ্য করতে পারি না।

সৈয়দ নওশাদ কিছু বললেন না। মাথা নিচু করে কিছু ভাবতে ভাবতে তার রুমে চলে যায়।

সেদিন রাতেই সৈয়দ নওশাদ রাহনাফকে ডেকে তার সাথে রাহির বিয়ে দেওয়ার কথা বলে। রাহনাফ সরাসরি সৈয়দ নওশাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। সৈয়দ নওশাদ অনেক জোর করেও রাহনাফকে বিয়েতে রাজি করাতে পারে না। সৈয়দ নওশাদের পরিকল্পনা জেনে রাহনাফ পড়াশোনার জন্যে যে জাপানে যাওয়ার জন্যে এপ্লাই করছিলো সেটাও ক্যান্সেল করে দিতে চায় কিন্তু সৈয়দ নওশাদ এটাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। রাহিকে বিয়ে না করলেও নওশাদ জাপান যাবে। হ্যাঁ নওশাদ জাপান থেকে বিএসসির ডিগ্রী নিয়ে আসবে। রাহনাফ রাহিকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি এটা শুনে রাহির মা মেহেরের উপর প্রচণ্ড রেগে যায় আর মেহেরের ক্ষতি করার জন্যে উঠে পরে লেগে যায়।

এলমাকে পড়ানোর শেষে বাড়ি ফিরছিল মেহের। তখন রাহনাফ এসে মেহেরের পথ আটকিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। রাহনাফকে দেখেও না দেখার ভান করে মেহের চলে যেতে নিলে রাহনাফ আবার গিয়ে মেহেরের সামনে দাঁড়ায়। রাগে বিরক্ত হয়ে মেহের ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠে,

– সমস্যা কি আপনার? বারবার আমার পথ আটকিয়ে দাঁড়াচ্ছেন কেন?

– আমি কিন্তু আমার জবাবটা এখনো পাইনি লেখিকা সাহেবা।

– পাগল হয়ে গেছেন আপনি মিস্টার রাহনাফ। আমি কোনদিনও আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না। ইভেন কাউকেই নয়। আমি আমার মায়ের পাশে থাকতে চাই।

– আমাকে বিয়ে করে নিন দুজনেই আন্টির মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকবো।

– এটা সম্ভাব না, কেন বুঝতে পারছেন না আপনি। চলে যান আপনি?

– কেন সম্ভব নয়। আপনাকে ভালোবাসতে হবে না শুধু একটা সুযোগ করে দিন আমি যেন আপনাকে মন উজার করে ভালোবাসতে পারি। আপনার প্রতিটা খুশির কারন হতে পারি।

– ভালোবাসা, বিশ্বাস এই শব্দগুলোকেই বিশ্বাস করতে পাই আমি।

– আপনার সব ভয় দূর করে বিশ্বার এক নতুন বন্ধনে জড়াবো আপনাকে।

– আপনি কেন বুঝতে পারছেন না মিস্টার রাহনাফ।

– আপনিও তো আমার দিকটা বুঝতে পারছেন না লেখিকা সাহেবা। প্লিজ হ্যা বলে দিন না হলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। আমি পারবো না আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে।

চলবে,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here