#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১৪]
– রাহনাফ, আপনি ঠিক কার কথা বলছেন! কাকে বিয়ে করার কথা বলছেন আপনি?
কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে রাহনাফকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো মেহের। মেহেরের ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নে রাহনাফ সামনের দিকে তাকিয়ে মৌনতা অবলম্বন করে কিছুক্ষণ। ছোট্ট করে একটা শ্বাস ত্যাগ করে মেহেরের দিকে তাকিয়ে মৌনতা ভেঙে রাহনাফ বলে উঠে,
– রাহির কথা বলছি আমি। রাহির সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার কথা চলছে। আপনি প্লিজ একবার হ্যাঁ বলে দিন লেখিকা সাহেবা। আমি শুধু আপনাকে চাই, আপনার হাত ধরে পাশাপাশি চলতে চাই বাকিটা জিবন। হুড খোলা রিক্সায় পাশাপাশি বসে গল্পের ফোয়ারা চালিয়ে অনেক দূর যেতে চাই। আপনার শীতল হাতে আমার উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেতেই কেপে উঠবেন আপনি আর আমি আদুরে আপনাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিবো। প্লিজ লেখিকা সাহেবা আমায় ফিরিয়ে দিবেন না।
রাহনাফের কথাশুনে আপনাআপনি মেহেরের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। অবাক চোখে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এই ছেলেটা তো প্রেমের রচনা বলছে। এটা শুধু মাত্র স্বপ্ন তাছাড়া বাস্তবে এসব হয় নাকি। অধোর কামড়িয়ে লম্বা শ্বাস টেনে মেহের বলে উঠে,
– আপনি রাহিকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায় রাহনাফ। আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।
– কেন পারবেন না আপনি। প্লিজ লেখিকা সাহেবা আমায় ফিরিয়ে দিবেন না তাহলে আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবো। আপনাকে দেখলে আমার হাজার বছর বাচার ইচ্ছে জাগে। আমার মুখের হাসি দেখলে আমি লড়াই করার সাহস পাই। আপনার পাশাপাশি যখন থাকি তখন মনে হয় আমি পৃথীবির সবচেয়ে সুখী মানব।
– আপনি ভুল পথে হাটছেন মিস্টার রাহনাফ। এখনো সময় আছে সঠিক পথে পা বাড়ান। কথাটা বলেই মেহের রাহনাফকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। অমনি রাহনাফ মেহেরের হাত ধরে আবার আগের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়। অতঃপর বলে,
– কি সমস্যা আপনার। আমাকে মেনে নিতে আপনার প্রবলেম কোথায়??
– প্রবলেম। মৃদু হাসে মেহের। আপনি নিজেই মস্ত বড় একটা প্রবলেম। রাহি আপনাকে ভালোবাসে আর সৈয়দ নওশাদ রাহির সাথে আপনাকে বিয়ে দেওয়ার জন্যে আপনার পিছনে লাক্ষাদিক টাকা ইনভেস্টমেন্ট করতে চাইছেন। আর আপনি কিনা রাহিকে বিয়ে করবে না। আপনাকে আমি কোনদিনও বিয়ে করবো না। হাত ছাড়ুন আমার। শেষ কথাটা চেঁচিয়ে বলে মেহের।
মেহেরের কথা মনে হয় রাহনাফের কর্ণপাত হলো না। সে করুন চোখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
-চলুন লেখিকা আমরা বিয়ে করে নেই। পরে আন্টিকে আমি বুঝিয়ে বলবো।
রাহনাফের কথা শুনে মেহেরের প্রচণ্ড রাগ হয়। সে রাগে কটমট করে রাহনাফের থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত রাহনাফের শক্তির সাথে পেরে উঠেনা। তাই সে রাহনাফের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। এতেও রাহনাফ কোন প্রতিক্রিয়া করে না। সে আগের চেয়ে আরো শক্ত মুঠি করে নেয়। মেহেরে চোখের দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বলে উঠে,
– একবার শুধু এই হাত ধরে রাখার অনুমতি দেন লেখিকা দেখবেন শত ঝড় আসলেও এই হাত ছাড়বো না আমি। একবার বিশ্বাস করেই দেখুন আমায় লেখিকা, আপনার বিশ্বাস আজিবন অটুট রাখার দায়িত্ব আমার।
– অনুমতি ব্যতীত হাত ধরাটা কি ঠিক। আপনার থেকে এটা আশা করিনি আমি। আমার হাত ছাড়ুন আশেপাশে সবাই আমাদের দেখছে।
বিনা বাক্যে মেহেরের হাত ছেড়ে দেয় রাহনাফ। মেহের তার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে রাহনাফ যেখানটায় ধরেছিলো সেখানে লাল দাগ বসে গেছে। হাতের দিকে একপলক তাকিয়ে রাহনাফের দিকে তাকায় মেহের। তাখন খেয়াল করে রাহনাফের চোখে পানি টলমল করছে। মেহের থামকে যায় রাহনাফের চোখের পানি দেখে। সে তাকিয়েই থাকে রাহনাফের অক্ষির দিকে। দু-ফোটা অশ্রু রাহনাফের চোখের কোটর গড়িয়ে গাল বেয়ে মাটিতে পরে যায়। এই দৃশ্য দেখে মেহেরের বুকের বা পাশটায় চিনচিন করে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু কি এই ব্যাথার কারন জানা নাই মেহেরের। শুধু বুকের ভিতরের ব্যথাটাই অনুভব করছে সে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না মেহের। মাথা নিচু করে দু-হাতে উড়না খামচে ধরে সে। তারপর নিরবে সেখান থেকে প্রস্তান করে। রাহনাফ অশ্রুসিক্ত নয়নে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ না মেহের তার চোখের আড়াল হয়। মেয়ের চোখের আড়াল হতোই নিজের হাতটা উপরে তুলে নেয় রাহনাফ। মেহের যেখানে কামড় বসিয়ে দিয়েছে সেখানে মেহেরে দাতের দাগ বসে গেছে। স্মিত হাসে রাহনাফ আর দাগের ওই অংশটাতে নিজের অধোরে ছুইয়ে দেয়। দু-চোখের কোনে তার এখনো অশ্রুর ভীড়।
২৪,
বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে অন্দকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সৈয়দা মাহবুবা। শাড়ির আচল নিচে পরে ফ্লোরের সাথে লেপ্টে আছে। জানালা দিয়ে বাতাশ এসে তার আধপাকা চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে। বহুদিন পর নিজের চুলগুলো খোলা রেখেছেন। এর আগে কবে তিনি নিজের চুলে বাতাশের দোল খাইয়েছেন সেটা তার জানা নেই। আজ আকাশে চাদকে ঘিরে হাজার তারার মেলা বসেনি। চারিদিকে নিকশ কালো অন্দকার। দূর দূরান্তে শুধু বড় বড় দালানে জ্বলে থাকা লাইটের আলোয় জ্বলমল করে শহরটা।তবুও আলো আছে শহরের বুকে। অন্ধকার আকাশের মতোই তার মনটা আজ ভালো নেই। মনের আকাশে মেঘ জমেছ তার। লোকের এত কটু কথায় হাপিয়ে উঠেছেন তিনি। লড়াই করতে করতে ক্লান্ত তিনি। এর মধ্যেই আবার যদি প্রাক্তন স্বমী কল করে তাহলে পুরনো ঘা টা মনে হয় তাজা হয়ে উঠে। মনে ভিতরে পুষে রাখা রাগটা আবার মনে হয় জ্বলে উঠে। এমনটাই হয়েছে সৈয়দা মাহবুবার সাথে। বিকাল বেলা সৈয়দ নওশাদ কল করেছিলো তার নাম্বারে। কলটা রিসিভ করা হয়ে উঠেনি। সৈয়দ নওশাদ তার নাম্বার কোথায় পেলো সেটা ভাবতে ভাবতেই কল কেটে যায়। পরে আর কল করা হয়ে উঠে নি। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস নিলেন কয়েকবার। তারপর আনমনে বলে উঠলেন,
– দমকা হাওয়ায় ঘুরপাক খেয়ে,
ঘুটঘুটে অন্ধকারে শূন্যতায় পতিত আমি।
আদুরে মিষ্টি সুরে কেউ সমবেদনা জানায়নি,
ভালোবাসার আঁচলে বাঁধা হইনি তাই হয়তো
ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাস আমাকে ছাড়েনি। [শিখা]
– মা, এতরাতে তুমি এখানে! এখনো ঘুমাও নি যে?
মেহেরের কণ্ঠস্বর শুনে পিছনের দিকে ঘুরে তাকায় সৈয়দা মাহবুবা। মেহেরের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলে উঠেন,
– ঘুম আসছে না রে। তুই এখানে কি করছিস?
মেহের ওর পায়ের পাশে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আদিরে গলায় বলল,
– আমারও ঘুম আসছে না। আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দিবে মা ।
মেয়ের এমন বাচ্চামো দেখে মৃদু হাসলেন সৈয়দা মাহবুবা। তারপর সে তার মেয়েকে নিয়ে বিছানায় চলে গেলেন।
সৈয়দা মাহবুবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে মেহের। সৈয়দা মাহবুবা মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর কথা বলছেন। মেহের চুপচাপ তার মায়ের কথা শুনে যাচ্ছে। দু-চোখের পাতা মেলানোর সাহস পাচ্ছে না সে। এতক্ষণ নিজের রুমে ঘুমানোর জন্যে যতবার দু-চোখের পাতা এক করেছে তাতবারই রাহনাফের সেই অশ্রুসিক্ত নয়ন ভেসে উঠেছে তার চোখের সামনে। চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেনি মেহের। পরপর কয়েকবার চেষ্টা করার পরেও যখন এমনটা হয়েছে তখন সে বাধ্য হয়েই তার মায়ের রুমে চলে আসে। সৈয়দা মাহবুবা কথা বলার ফাকে যখন দেখলেন মেহের এখনো ঘুৃমায় নি তখনি তিনি মেহেরকে জিগ্যেস করেন,
– এখনো ঘুমাচ্ছিস না কেন? আর তোর চোখমুখ এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন?
– আমি আমার চোখ বন্ধ করতে পারছি না। যতবার আমার দু-চোখের পাতা এক করেছি ততবারি রাহনাফের মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মায়ের কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বসে পরলো মেহের।
মেহেরের কথা শুনে সৈয়দা মাহবুবার হাত থেমে যায়। সে তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করে নিলেন তারপর বললোন,
– রাহনাফ কে দেখতে পাস মানে কি?
– হ্যাঁ মা। তারপর রাহনাফের ভালোবাসার কথা আর ওর পাগলামিগুলার কথা বলে তার মাকে। সব শুনে সৈয়দা চুপকরে বসে থাকে কিছুক্ষণ তারেপর সে নিজে রাহনাফের নাম্বারে কল করে বলো,কাল তার সাথে দেখা করতে।
এদিকে রাহনাফ সারারাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনি।সন্ধায় রাহি কল করে অনেক কান্নাকাটি করেছে। রাহনাফ মোবাইলে ওকে কিছু বলতেও পারছিলো না। কখন সকাল হবে আর রাহির সাথে কথা বলবে সে। যে করেই হোক রাহিকে বুঝাতে হবে। রাহিকে সে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবে না। তার মন জুরে শুধু মেহেরের বসবাস। আজ না হয় কাল মেহের তার ভালোবাসা গ্রহণ করবেই এটা নিজের উপর বিশ্বাস রাহনাফের। সত্যি কারের ভালোবাসা কখনো হেরে যেতে পারে। প্রকৃতি এটা কিছুতেই মেনে নিবে না। সকাল হতেই রাহনাফ কোন রকমে ফ্রেশ হয়ে রাহির সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বের হয়।।
চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।