মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-২২

0
2233

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২২]

রাহনাফকে নিয়ে সোজা নিজের বাসায় চলে আসে মেহের। যদিও এতে রাহনাফের আপত্তি ছিলো বেশ। মেহের জোর করেই তার সাথে করে বাড়িতে নিয়ে আসে রাহনাফকে। আশ্রমে তার দাদিকে দেখা মাত্রই মেহেরের গা জ্বলে উঠার মতো অনুভব হয়। তার দিকে কটাক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে আসতে নিলে রাহনাফ ওকে আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু মেহের রাহনাফের কোন কথাই শুনে না। সে চলে আসে। পিছন থেকে তার দাদীও অনেকবার ডেকেছে কিন্তু পিছনে ফিরে তাকায়নি মেহের। সে প্রস্হান করে। রাহনাফের আর কি করার, সেও বৃদ্ধাকে বিদায় জানিয়ে মেহেরকে পিছু করতে থাকে। আশ্রমের গেটের বাহিরে আসতেই সে একটা বড় গাড়ি দেখতে পায়। গাড়িটা আশ্রমের ভিতরে প্রবেশ করছে। এত বড় গাড়ি নিয়ে এই আশ্রমে আবার কে আসবে সেটা দেখার জন্যেই গাড়িটাকে ভালো করে পরখ করে রাহনাফ। কেন জানি তার মনে হলো এই গাড়িটা সে আগেও দেখেছে, বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে গাড়িটাকে। থমকে দাঁড়িয়ে যায় রাহনাফ। দূর থেকে মেহের রাহনাফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাতের ইশারায় কয়েকবার ডাক দেয় কিন্তু সে খেয়াল নেই রাহনাফের, সে গাড়িটাকে দেখতে ব্যাস্ত। তাই মেহের নিজে রাহনাফের কাছে এসে দাঁড়ায় আর মৃদু সূরে রাহনাফকে ডাক দেয় রাহনাফকে। রাহনাফ এখনো কোন রিসপন্স করে না তার দৃষ্টি দূরের গতিশীল গাড়ির দিকে। রাহনাফের দৃষ্টি অনুসরণ করে মেহের তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিন্তু দেখার মতো কোন কিছুই তার চোখের সামনে পরে না। তাই সে রাহনাফ হাতে নাড়া দিয়ে বলে,

– ওদিকে কি এত দেখছেন! কখন থেকে ডাকছি আপনার কোন রিসপন্সই নাই।

নিজের হাতে শীতল স্পর্শ পেতেই সামনে তাকায় রাহনাফ। মেহেরকে দেখে ভ্রু দ্বয়ে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে জিগ্যেস করে,

– কিছু বলছেন লেখিকা সাহেবা?

– আপনি কি ভাবছেন বলুন তো?

মেহেরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবার সেই গাড়ির দিকে তাকায় রাহনাফ। গাড়িটা ততক্ষণ ওদের দৃষ্টির অগোচরে চলে গেছে। রাহনাফ তড়িৎগতিতে মেহেরের হাত চেপে ধরে বলে চলুন, তারপর ওকে নিয়ে সেই গাড়ির পিছু করতে থাকে। এত তাড়াহুড়া করে কোথায় যাচ্ছে রাহনাফ সেটা কয়েকবার জিগ্যেস করে মেহের, কিন্তু কোন জবাব দেয়না রাহনাফ। সে মেহেরের হাত শক্তকরে চেপে ধরে শুধু সামনের দিকে এগোতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর সেই বড় গাড়িটা দেখতে পায় রাহনাফ। গাড়ির ভেতর থেকে একটা যুবক কোট প্যান্ট করে বের হয়ে পিছনের দরজা খুলে দিলো। সেখান থেকে একজনক অর্ধবয়স্ক মহিলা বের হলো যার গায়ে জড়ানো সাদা থান আর কাধে একটা কালো শাল। অর্ধবয়স্ক মহিলাটিকে দেখে যেন রাহনাফের পুরো দুনিয়া থমকে যায়। আলগা হয়ে আসে তার হাত। থো মেরে দাঁড়িয়ে থেকে স্থির দৃষ্টিতে সে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেহের তার হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে রাহনাফের মুখের দিকে তাকায়। রাহনাফের মলিন মুখ দেখে মেহের তার বুকের বা পাশটায় চিনচিন ব্যাথা অনুভব করে। শ্বাস আটকে আসে তার। আচ্ছা রাহনাফের এমন বিষন্নমাখা মুখ দেখে মেহেরের কেন খারাপ লাগছে! তবে কি মেহের রাহনাফকে ভালোবেসে ফেলেছে। প্রিয় মানুষের বিষণ্ণতায় যদি আমি এক পৃথিবী সমান ব্যাথা অনুভব করি তবে এর নাম বুঝি ভালোবাসা। বুকের উপর হাত রেখে রাহনাফের মুখের দিকে দৃষ্টি রাখে মেহের। রাহনাফের দৃষ্টি তখনো স্থির সামনে থাকা সেই অর্ধবয়স্ক মহিলার দিকে। মহিলাটি যখনি পিছনের দিকে ঘুরে তাকায় রাহনাফ খপ করে মেহেরের হাত ধরে পিছনের দিকে ঘুরে যায়। রাহনাফ এতটাই শক্তকরে মেহেরের হাত ধরেছে সে মেহের তার হাতে ব্যাথা অনুভব করছে আর তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই রাহনাফের, সে নিজের মুখ লুকাতে ব্যাস্ত।

অর্ধবয়স্ক মহিলাটি রাহনাফকে ছাড়িয়ে চলে যায় আশ্রমের ভিতরে। সে চলে যেতেই বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে রাহনাফ। পিছনের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় সেই গাড়ির পিছনে একটা ছোট ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছে। দুজন হেল্পার ট্রাকের ভিতরে থেকে বড় বড় খাবারের পাত্র বের করছে। রাহনাফ সে দিকে তোয়াক্কা না করে সেই অর্ধবয়স্ক মহিলাটিকে ফলো করার জন্যে তার পিছু ছুটে। মেহের অবাক চোখে রাহনাফের কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে শুধু।

অর্ধবয়স্ক মহিলা আশ্রমের সকল বৃদ্ধা ও বাচ্চাদের মাঝে খাবার আর বস্র বিতরণ করেন এবং তার ছেলের জন্যে সকলের নিকট দোয়া চায়। এক কৈশোর তার কাছে তার ছেলে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি মৃদু হেসে বলেন,

– আমি অনেক আগেই তাকে হাড়িয়ে ফেলেছি। মন খারাপ হয়ে যায় মহিলার। থানের আচল দিয়ে চোখ মুছে নেয় সে। এই দৃশ্য দূর থেকে রাহনাফ। তার চোখের কোটর বেদ করে পানি গড়িয়ে পরে। মেহেরের মুখ হা হয়ে যায়। রাহনাফ কাঁদছে! কে এই মহিলা? রাহনাফ কেন তাকে লুকিয়ে দেখছে! আর তাকে দেখে রাহনাফ কেনই বা কাঁদছে। তবে কি এনিই রাহনাফের মা। চোখ বড় বড় হয়ে যায় মেহেরের। রসোগোল্লার মতো চোখ নিয়ে একপলক রাহনাফের দিকে তাকিয়ে আবার সে মহিলার দিকে তাকায়। দুইজনেই কাঁদছে, দুজনের চোখেই রয়েছে আপনজনকে হাড়ানোর তীব্র যন্ত্রনা। মেহের আলতো করে রাহনাফের এক হাত ধরে বলে উঠে,

– এনি কি আপনার,,,,,

– মা। এনিই আমার মা। মেহেরকে থামিয়ে বলে উঠে রাহনাফ। রাহনাফের কথা শুনে একটুও অবাক হয়নি মেহের। কারন সে এমনটাই আন্ধাজ করেছিলো। রাহনাফ অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহেরের দিকে। মেহেরের এখন বড্ড অসহায় লাগছে। সে পারছেনা রাহনাফের চোখের পানি মুছে দিতে আর না পারছে ওকে ওর মায়ের সাথে মিলিয়ে দিতে। খুব অসহায় লাগছে মেহেরের। সে করুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের দিকে। তখন দুজনের মাঝে দৃষ্টি সংযোগ হয়। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা হয় চোখে চোখে। দুজন দুজনের চোখের ভাষা বুঝে নেয় কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করে না কেউ। রাহনাফ মেহেরের হাতটা শক্তকরে ধরে জড়ানো কন্ঠে বলে উঠে,

– চলুন লেখিকা সাহেবা ফিরে যাই।

– রাহনাফের কথায় সায় দেয় মেহের। তারপর দুইজনেই সেখান থেকে প্রস্তান করে। আধেক রাস্তা আসার পর রাহনাফ তার বাসায় ফিরে যেতে চাইলে মেহের জোর করে রাহনাফ তার সাথে তার বাসায় নিয়ে আসে।

৩৩,
মৌ আলিহান আর রাহি তিনজন মিলে রাহনাফের জন্যে নানা রকমের খাবার রান্না করে। আলিহান রাহনাফের পছন্দের কেক তৈরী করে। আশ্রমে মেহের রাহনাফের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে আলিহান কে কল করে রাহনাফের জন্মদিনের কথা জানায়। আর ওর পছন্দের সব খাবার রান্না করতে বলে। কারন মেহের রাহনাফকে তার সাথে নিয়ে আসবে। আলিহান রাহিকে কল করে বাসায় আসতে বলে। এই সুযোগে যদি মেহের আর রাহির মাঝে একটু ভাব জমে। রাহিও এত ভালো একটা সুযোগ মিছ করতে চায়না। তাইতো আলিহান কল করার সাথে সাথে সে ছুটে চলে আসে মেহেরের বাসায়। মৌ আর আলিহানের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করে রাহি। সৈয়দ মাহবুবা বিকালে বাসায় ফিরে আজ। তিনি ফিরলে সবাই মিলে একসাথে রাহনাফকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় আর কেক কাটে। তারপর সবাই মিলে এক সাথে এক টেবিলে খাওয়া দাওয়া করে করে। এতে করে রাহনাফ আর মেহের আজ অনেক কাছাকাছি চলে আসে। রাহনাফ মেহেরকে খাইয়ে দেয়, মেহের দেয় রাহনাফকে খাইয়ে। এই দৃশ্য দেখে হাতের মুঠি শক্ত করে বসে থাকে রাহি। খাবার প্লেটে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করে শুধু কোন খাবার তার মুখ অব্ধি পৌঁছায় না। আড় চোখে রাহনাফ আর মেহেরের হাসিমুখ দেখে রাহি। কারন এখন রাহনাফ আর মেহের যতটা কাছাকাছি চলে আসছে রাহি ঠিক ততটাই দূরে চলে যাচ্ছে। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নেয় রাহি। একপক্ষ ভালোবাসার চেয়ে দূরে চলে যাওয়াটা ভালো মনে করে সে। কারন তাদের দুজের মিল হওয়ার মাঝে সে নিজেকে মস্ত বড় দেয়াল মনে করে। যে দেয়াল টপকে গিয়ে মিলন হতে পারছে না রাহনাফ ও মেহেরের। মৃদু হাসে রাহি। মেহের ও তার জিবনে ভালোবাসা পেয়েছে। তার বোনটা কাউকে ভালোবাসতে পেরেছ এটা যে তার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। অধোর চেপে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে উপরের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রর্থনা করে, তাদের ভালোবাসা যেন সারাজীবন অটুট থাকে। তারা যেন একে অপরকে এভাবেই ভালোবাসে সবমসময়।

– রাহি, কি এত ভাবছিস বলতো? কিছুই তো খাচ্ছিস না।

-আলিহানের কথায় ঘোর কাটে রাহির। সে আলিহানের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে।

– এইতো খাচ্ছি। এক লোকমা ভাত মুখে দেয় রাহি। আলিহান ও রাহি একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here