মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-২৬

0
2184

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২৬]

– কি হলো ডক্টর, আপনি চুপ করে আছেন কেন? বলুন মেহু কেমন আছে?

ডক্টর মেহের সম্পর্কে কিছু বলছে না তাই একটু উত্তেজিত হয়ে বলল আলিহান। ডক্টর এখনো কিছু বলছে না নিচের দিকে তাকিয়ে অধোর চেপে ঘন ঘন শ্বাস ত্যাগ করছে। মৌ রাহি রাহনাফ সবাই তাকিয়ে আছে ডক্টরের মুখের দিকে। ডক্টর বলবে পেশেন্ট সুস্থ আছে এই আশা নিয়ে। আলিহান ডক্টরকে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। মৌনতা ভেঙে ডক্টর বলে উঠলো,

– আই এম সরি। আমরা পেশেন্টকে,,, আর কিছু বলতে পারলো না তার আগেই আলিহান ডক্টরের কলার চেপে ধরলো। মৌ আর রাহি দুজনে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করে দেয়। রাহনাফ দু-পা পিছিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে। অশ্রুতে ভরে গেছে তার চোখের কোটর। কানের কাছে এখনো ডক্টরের বলা কথাটা ভেজেই চলেছে। আলিহান ডক্টরের কলার চেপে ধরে বলতে লাগলো, কি বললেন আপনি, আমার মেহু! আমি আপনাকে ছাড়বো না। ডক্টর আলিহানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে সৈয়দা মাহবুবা। ডক্টর আর আলিহানকে এভাবে হাতহাতি করতে দেখে তিনি বলে উঠলেন,

– কি হয়েছে আলিহান! তুই ডক্টরকে মারছিস কেন?

সৈয়দা মাহবুবার কণ্ঠস্বর শুনে সবাই তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। সৈয়দা মাহবুবা কি সব শুনে ফেলেছে, কখন জ্ঞান ফিরেছে তার। সকলে চিন্তায় পরে যায়। সৈয়দা মাহবুবা দ্রুত পায়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় ততক্ষণে আলিহান ডক্টরের কলার ছেড়ে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায়। সৈয়দা মাহবুবা এসে ডক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– ডক্টর আমার মেহু কেমন আছে ডাক্তার সাহেব?

ডক্টর কোন জবাব দেয়না। অধোর চেপে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মৌ এসে সৈয়দা মাহবুবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। রাহিও কাঁদছে। আলিহান অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে ডক্টরের মুখ পানে। সৈয়দা মাহবুবা ডক্টরকে চুপ করে থাকতে দেখে ধৈর্য হারা হয়ে আবারও প্রশ্ন করেন,

– আমার মেহু কেমন আছে ডক্টর! আপনি কিছু বলছেন না কেন? আলিহান, রাহনাফ তোমরা আমাকে আমার মেহুর কাছে নিয়ে চল।

ডক্টর মাথা তুলে সৈয়দা মাহবুবার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি ওটির ভিতর থেকে একটা নার্স এসে বলে,

– স্যার, পেশেন্ট রিসপন্স করছে। নার্সের কথা শুনে একপ্রকার চমকে উঠে ডক্টর। সে সৈয়দা মাহবুবার মুখ পানে এক পলক তাকিয়ে ততক্ষণাৎ অটির ভিতরে প্রবেশ করে। রাহনাফ আলিহান ওরা যেন তাদের প্রান ফিরে পেল। সৈয়দা মাহবুবা দু-পা পিছিয়ে যেতেই মৌ তাকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,

– মেহুর কিছুই হবে না, তুমি দেখে নিও আন্টি। মেহু আবার আগের মতো হয়ে যাবে। আর যে আমাদের মেহুর এই অবস্থা করেছে তাকে খুঁজে বের করে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তুি দিবো আমরা। তুমি একদম চিন্তা করো না আন্টি।

মৌ-য়ের কথা সৈয়দা মাহবুবার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। তার কানের কাছে শুধু একটা কথাই বেজে চলেছে” স্যার পেশেন্ট রিসপন্স করছে” তাহলে কি এতক্ষণ মেহু রিসপন্স করছিলো না। হাত পা আলগা হয়ে আসে তার। হাটু গেরে নিচে পরেন। আলিহান আর রাহনাফ এসে তাকে তুলে করিডোরে বসিয়ে দেয়। হসপিটালের দেয়ালে সাঁটানো বড় এলইডি টিভির ভিতরে ঘড়ির টাইম দেখে রাহনাফ। এগারোটয় বাজে ছত্রিশ মিনিট। অনেক রাত হয়েছে।এবার মৌ আর রাহিকে বাড়ি ফিরতে হবে। রাহির মা বাবা হয়তো তার জন্যে চিন্তা করছে। সে আলিহানকে বলে ওদের বাড়ি পাঠাতে চায় কিন্তু মৌ বায়না ধরে মেহেরকে না দেখে সে কোথাও যাবে না। রাহিরও একই মতামত। তাই তারা সবাই মিলে অপেক্ষা করতে থাকে ডক্টরের। কখন ডক্টর আসবে আর মেহের ভালো আছে সুস্তি আছে এই খবর শুনতে পারবে তারা।

৩৭,
বেলকনিতে বসে নিকোটিনের ধোয়া উড়াচ্ছে সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। উপরের দিকে তাকিয়ে ধোয়া উড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি আর সেই ধোয়া নিমিষেই অন্ধকারের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি স্থির করেছেন বিশাল আকাশের ওই রুটির মতো দেখতে চাঁদের দিকে। রাত যত গভীর হচ্ছে কষ্ট গুলো যেন আরো তীব্র হচ্ছে। আফিয়া আহমেদকে এক প্রকার ভালোবেসেই বিয়ে করেছেন তিনি। তাকে প্রথম দেখাতে ভালো লেগেছিলো তার, আফিয়াকে যখন প্রথম দেখে তখন তিনি অবিবাহিতা ছিলেন। মাহবুবাকে বিয়ে করার তিন মাসে পরিচয় হয়েছিলো আফিয়ার সাথে। পরিবারের সাথে বেড়াতে গিয়েছিল স্বপ্নপূরী। আর সেখানে গিয়েই আফিয়াকে প্রথম দেখেছিল সৈয়দ নওশাদ। নওশাদের সেদিন মনে হয়েছিলো স্বপ্নপূরীতে পরি পাওয়া যায়। কারন আফিয়া দেখতে পরির চেয়েও কোন অংশে কম ছিলো না। নওশাদের ধরেই নিয়েছিলো পৃথিবীতে যদি পরি বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে সেটা আফিয়াই হবে। তারপর আফিয়ার সাথে আলাপ হয় তার। আফিয়া তখন বেশী কথা বলতো না সারাক্ষণ নিজের ভাবনায় ব্যাস্ত থাকতো সে। নওশাদের কিছু জিগ্যেস করলে শুধু তার দিকে একপলক তাকাতো। প্রয়োজনের দু একটা কথা বলতো সে। আফিয়ার সাথে কথা বলে জানতে পারলো সেই স্বপ্নপূরীতে একটা কাজে এসেছে। তিন দিন সেখানে ছিলো তারা আফিয়াও ছিলো সেখানে। তিন দিন পর যখন সেখান থেকে চলে আসে নওশাদ তখন পথিমধ্যে মনে হয় ইশ আফিয়ার নাম্বারটা কেন নিয়ে আসলাম না। গাড়ি থেকে নেমে যেতে চায় নওশাদ কিন্তু তার বাবার কারনে যেতে পারে না। নওশাদ ছিলো তার বাবার বাধ্য সন্তান।

বাড়ি ফিরে আফিয়ার কথা খুব মনে পরতো তার। রাতে ঘুমাতে পারতো না সে, চোখ বন্দ করলেই আফিয়ার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠতো। স্বপ্নপূরীতে থাকাকালীন লুকিয়ে আফিয়ার কয়েকটা ফটো তুলেছিলো বাড়িতে বসে সেই ছবি দেখতো নওশাদ আর আফিয়াকে নিয়ে হাজারো স্বপ্নের জাল বুনতো। বাসা থেকে বের হলেই আফিয়ার খুজ করতো সে। কিন্তু আর কখনো আফিয়ার দেখা পায়নি সে।

একদিন হঠাৎ করেই নওশাদের বাবা এসে নওশাদকে বলে, তিনি তার অফিরে এক কর্মচারীর মেয়ের সাথে নওশাদের বিয়ে ঠিক করেছে। সেদিন প্রথমবার নওশাদ তার বাবার কথা অমান্যতা করে বলেছিলো আমি এখন কাউকে বিয়ে করবো না। তাছাড়া আমিও একজনকে ভালোবাসি আর তাকেই বিয়ে করবো। নওশাদের বাবা সেদিন নওশাদের পছন্দের মেয়েকে দেখতে চেয়েছিলো। কারন তিনি তার ছেলের পছন্দের সম্মান দিতে চেয়েছিলো কিন্তু নওশাদ জানতো না মেয়েটার বাড়ি কোথায়! কোথায় থাকে? কার সাথে থাকে? মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো নওশাদ। রেগে গিয়ে নওশাদের বাবা বলেছিলো,

-আমি তাকদীরে বিশ্বাসী, যদি তুমি কোন ভিখারির মেয়েকেও পছন্দ করে বিয়ে করতে চাও করবে। মনে রাখবে এটা তোমার ভাগ্যে ছিলো। কারন তোমার বাম পাজরের হার থেকে তাকে তৈরী করা হয়েছে শুধু মাত্র তোমার জন্যে। আমি তোমাকে সাত দিন সময় দিলাম তোমার পছন্দের মেয়েকে খুঁজে বের করো অন্যথায় আমার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে তোমার।

সাত দিনের জায়গায় দশদিন কেটে যায় তবুও আফিয়ার কোন খুজ পায়না নওশাদ। ব্যর্থ মনে ভেবে নিয়েছিল, আফিয়াকে তার জন্যে তৈরী করেনি সৃষ্টিকর্তা। তাই সে তার বাবার কথায় তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। নওশাদের বাবা নওশাদকে বলেছিলো, মেয়েকে একবার দেখে নিতে। সেদিন নওশাদ হাসি মুখে বলেছিলো,

– নিজের থেকে তোমার উপর বেশী ভরসা করি বাবা। আমি জানি বাবা তুমি আমার জন্যে সবসময় ভালো কিছুই বেছে নিবে।

নওশাদের বাবা সেদিন নওশাদের মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলো,

– আমি তোর জন্যে এমন একজনকে বেছে নিয়েছি যাকে আগলে রাখলে তোর জিবনটাই বদলে যাবে।

বাবার কথাশুনে মৃদু হেসেছিলো নওশাদ। তারপর ধুমধাম করে মাহবুবার সাথে নওশাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। নওশাদ তখনো জানে না সে কাকে বিয়ে করেছে। কনে বিদায়ের পর যখন সৈয়দ বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছায় তখন নওশাদের মা আসে বউ বরণ করে ঘরে তুলতে। মাহবুবার মুখ তখন লম্বা ঘুমটার আড়ালে। বরণ শেষে নওশাদের মা বউয়ের মুখ দেখার জন্যে ঘোমটা খুলে দেয়। নতুন বউয়ের মুখ দর্শন করেই চিৎকার করে উঠেন তিনি। তার চিৎকার শুনে সকলে অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। নওশাদের মা তার ছেলের দিকে ক্রোধান্বিত হয়ে তাকিয়ে বলে,

– তুই কাকে আমার বাড়ির বউ করে এনেছিস নওশাদ। এতো কয়লার খনি।

নওশাদের মায়ের কথা কথা শুনে অবাক হয়ে যায় নওশাদ। হাত আলগা করে মাহবুবার হাত ছেড়ে দেয়। ঘাড় ঘুড়িয়ে মাহবুবার দিকে তাকাতেই চক্ষুদ্বয় সংকোচিত হয়ে যায় তার। ঘটনার আকস্মিক দু-পা পিছিয়ে যায় সে।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here