মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-২৮

0
2067

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২৮]

৩৮,
ছয়ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে মেহেরের। মেহেরের জ্ঞান ফিরতেই ওকে কেবিনে শিফট করা হয়। সৈয়দা মাহবুবা মৌ আর আলিহান ডক্টরের থেকে অনুমিত পেয়ে সাথে সাথে মেহেরের কেবিনে ডুকে যায়। রাহি সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে সে কি মেহেরের সাথে দেখা করতে যাবে! রাহনাফ করিডোরে বসে এক হাত গালে রেখে তাকিয়ে আছে মেহেরের কেবিনের দিকে। তার চোখ মুখে এখন হাসির ঝলক ফুটে উঠেছে। এতক্ষণ যে দুটি চোখে চিন্তা ছাপ ছিলো এখন সেই চোখে রয়েছে প্রাপ্তির হাসি। মেহেরের জ্ঞান ফিরেছে এর থেকে খুশির খবর তার কাছে আর কি হতে পারে। ওর শরীরে জড়ানো আছে সে রক্তাক্ত টিশার্ট। রক্তগুলো শুকিয়ে জমাট বেধেগেছে। রাহি এসে রাহনাফের সামনে দাঁড়িয়ে ওকে পা থেকে মাথা অব্ধি অবলোকন করে নিলো তারপর বলল,

– তুমি ভিতরে গেলে না রাহনাফ?

রাহনাফ তার দৃষ্টি নামিয়ে রাহির দিকে নিক্ষেপ করলো। গাল থেকে হাত নামিয়ে মাথার চুলগুলা উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,

– তুমি ভিতরে যাওনি?

– যাব তো। চলনা রাহনাফ আমরা একসাথে ভিতরে যাই। আসলে আমার কেমন আনইজি ফিল হচ্ছে, তুমি চল না আমার সাথে। মৃদু হেসে বলে রাহি।

রাহির কথার কোন জবাব দেয়না রাহনাফ। ওর মুখশ্রীর দিকে সে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়। সামনের দিকে কয়েক পা এগিয়ে যায় সে। তারপর পিছনে তাকিয়ে দেখে রাহি এখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সে রাহিকে ডাক দিয়ে বলে,

– দাঁড়িয়ে আছো কেন! চল।

রাহনাফের কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় রাহি। প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ পাল্টে যায় কই রাহনাফ তো পাল্টে যায় নি। আগে রাহি রাহনাফ কিছু করতে বললে ওমনি সেটা করে দিত। কোথাও যাওয়া, কলেজ থেকে ফিরতে দেরী হলে রাহি আগে রাহনাফকেই কল করতো। কোন কাজে ব্যাস্ত না থাকলে রাহনাফ গিয়ে রাহিকে বাসায় পৌঁছে দিত। আজও রাহির কথামতো রাহনাফ ওকে নিয়ে মেহেরের কেবিনের দিকে যাচ্চে। মৃদু হেসে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে রাহনাফের পাশে দাঁড়ায় গিয়ে। রাহনাফের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠে,

– আমরণ তোমার হাত ধরে পাশাপাশি হাটার স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। সেটা তো আর হলো না। এখন না হয় এইটুকু রাস্তায় একসাথে হাটি। তোমার হাত ধরে না হাটতে পারলাম, পাশাপাশি হাটছি এটাই অনেক। সারাজীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে এই মুহূর্তটা আমার কাছে।

মেহেরের হাত ধরে শিয়রের পাশে বসে মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সৈয়দা মাহবুবা। তার দৃষ্টি স্থির মেহেরের মাথায়। অপর পাশে মেহেরের আরেক হাত ধরে বসে আছে মৌ। আলিহান ওর সামনেই বসে গালে হাত দিয়ে গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছে। মেহের এদিক ওদিকে চোখ বুলাচ্ছে। সবার মাঝে সে বিশেষ একজনকে খুঁজে চলেছে। সবাই তো এখানেই আছে তাহলে সে কোথায়! আলিহানকে তার ব্যাপারে জিগ্যেস করবে সেটাও পারছে না কারন তার পাশে বসে আছেন সৈয়দা মাহবুবা। মেহের একবার কেবিনের দরজার দিকে তাকাচ্ছে তো আবার মৌ-এর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকাচ্ছে। মৌ মেহের এমন চাওনির মানে বুঝতে পারছে না। সে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে বাকা চোখে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। মৌ-য়ের মনে গভীর প্রশ্ন জাগে, “মেহের তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেন? আচ্ছা এখানে কি ওর কোন অসুবিধা হচ্ছে! নাকি গুরুত্বপূর্ণ কিছু? যেটা সে সবার সামনে বলতে পারছে না। সে মেহেরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

– এমন করে তাকাচ্ছিস কেন মেহু। হিসু করবি। নাকি অন্যকিছু। আমাকে বল আমি তোকে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছি নয়তো কোন নার্সকে ডেকে দিচ্ছি।

মৌ-য়ের কথা শুনে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহের। সে মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে দাত কটমট করে কিছুক্ষণ তারপর সে কেবিনের দরজার দিকে তাকায় আর তখনি তার চোখের সামনে ভেসে উঠে রাহনাফের মলিন মুখখানা। রাহনাফকে দেখতেই মেহেরের অধোরে হাসি ফুটে উঠে। কেবিনে ডুকতেই রাহনাফের ও প্রথমে চোখ আটকে যায় মেহেরের চোখের দিকে। মেহের নিঃপলক তাকিয়ে থাকে রাহনাফের মুখপানে। রাহনাফও তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সে তার দৃষ্টি নামিয়ে আলিহানের দিকে নিক্ষেপ করে। আলিহান তখনো গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভেবে চলেছে। তার পাশে যে রাহনাফ এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল নেই আলিহানের। সে রাহনাফের উপস্থিতি টের পায়নি তাই রাহনাফ আলিহানের কাঁধে তার হাত রাখে। মেহের তখনো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহনাফের দিকে। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে রাহনাফের চেহারার একি হাল হয়েছে। সত্যিই যদি মেহের না ফেরার দেশে চলে যেতে তখন কি হতো রাহনাফের! সেটাই ভাবছে মেহের। রাহনাফ আলিহানের দিকে তাকিয়ে বিধায় সে মেহেরে এমন মুগ্ধ দৃষ্টি দেখতে পায় নি। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে আলিহান। মাথা ঘুড়িয়ে পিছনে তাকাতেই দেখতে পায় রাহনাফকে। সে রাহনাফের দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে সৈয়দা মাহবুবার দিকে তাকায়। সৈয়দা মাহবুবা তখনো মেহেরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। বড় করে শ্বাস ফেলে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে আলিহান। বিনিময়ে রাহনাফ ও হাসে। তারপর সে মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কিছু বলে। আর মৌ মেহেরের হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। আলিহান সৈয়দা মাহবুবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– ছোটমনি তোমার শরীর অনেক ক্লান্ত এবার বাসায় ফিরে যাও। রেস্ট নাও। না- হলে তুমিও অসুস্থ হয়ে পরবে। মেহুর পাশে আমরা আছি।

– আমি ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে তোদের এত ভাবতে হবে না। মেহু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেলে আমিও একদম ঠিক হয়ে যাব। বলেই চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু ফেললেন সৈয়দা মাহবুবা। তখন মৌ গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছে দেয়। তারপর বলে,

– আন্টি চল আমরা এখব বাড়ি ফিরে যাই কাল সকালে আবার চলে আসবো। ততক্ষণে মেহুও সুস্থ হয়ে যাবে আর আমরা অনেক গল্প করবো। এখন চলনা আমরা ফিরে যাই।

আলিহান আর মৌ অনেক্ষণ বুঝানোর পর সৈয়দা মাহবুবা বাড়ি যেতে রাজি হয়ে যায়। আলিহান ওদের নিয়ে বেড়িয়ে যায়। রাহিও তার ড্রাইভারকে কল করে হসপিটালে আসার জন্যে। একে একে সবাই যখন কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায় তখন রাহনাফ গিয়ে মেহেরের পাশে বসে। সে মেহেরের গালে আলতো করে হাত রেখে অপলক ভাবে তাকিয়ে থাকে মেহেরের মুখ পানে। তারপর সে মেহেরের কপালে তার অধোর ছুঁইয়ে উষ্ণ ভালোবাসার স্পর্শ একে দেয়। মেহের তার আখি বন্ধ করে রাহনাফের স্পর্শ অনুভব করে। তারপর তার গালে রাখা রাহনাফের হাতের উপর হাত রাখে। রাহনাফ মেহের হাত নিজের হাতের মুঠিবদ্ধ করে নেয়। অতঃপর সে মেহেরের হাতের উল্টোদিকেও চুমু খায়। মেহের শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের মুখের দিকে।

রাহনাফকে চোখের ইশারায় মেহেরের কাছে এসে বসতে বলে মেহের। রাহনাফ মেহেরের হাত ছেড়ে দিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসে তখন মেহের তার মাথা তুলে দেয় রাহনাফের কোলে। রাহনাফ মেহেরের চুলে নিজের হাত ডুবিয়ে দেয় আর মেহের রাহনাফের এক হাত ধরে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর মেহের বলে,

– আপনি খুব ভয় পেয়েছিলেন না? প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মেহের।

– ভিষন। আমার তো প্রাণটাই বেড়িয়ে যাচ্ছিলো মনে হচ্ছে। জবাব দেয় রাহনাফ।

রাহনাফ জবাব শুনে ওর হাতটা আরো শক্তকরে ধরে মেহের। অতঃপর বলে,

– আপনি কি ভেবেছিলেন! আমি আর ফিরবো না। শুনুন এত সহজে আমি আপনাকে ছেড়ে যাচ্ছি না বুঝলেন মশাই। এখনো আমাদের অনেকটা পথ চলার বাকি।আমি হবো রাত আর আপনি হবেন চাঁদ। জোছনা এ ঘর আমাদের!

– আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিবো না লেখিকা সাহেবা। ভালোবাসা চাদরে আজীবন আমার বুকে জড়িয়ে রাখবো আপনাকে। একটাই জিবন আমাদের আর এই জিবনটাই আপনাকে গভীরভাবে ভালোবেসে যাবো। যে ভালোবাসার থাকবেনা অন্ত।

হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই একটু নড়েচড়ে বসে রাহনাফ। মেহেরের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ওর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here