মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-৩৯

0
1840

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৩৯]

আমি বিংশ শতাব্দীর মানুষ, কিন্তু এখনো আমি কৃত্রিম আলোয় ডুবে যাই নি।আর সবার মতো ফ্লোরোসেন্ট আলো আমাকে ভোলাতে পারে নি।আদিম সেই চন্দ্রালোকিত শিহরণের কথা।
অনাদিকাল ধরে শরীরে এক আশ্চর্য শিহরণ বোধ করে।
আমি সেই মানুষগুলোর একজন, যারা এখনো আকাশ দেখতে ভুলে যায় নি।এখনো যারা রোমাঞ্চ খোঁজে জোছনায়, পূর্ণিমায়।

ফোনের অপর পাশ থেকে কথাগুলা বলল রাহনাফ। রাহনাফের কথা শুনে মেহেরের মনে হীম শীতল শিহরণ বয়ে যায়। অধোর কাঁপছে, কথাগুলো গলায় এসে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। কথাগুলো যে তাকে ঘিরেই বলা হয়েছে এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি মেহেরের। মেহেরকে এমন চুপচাপ দেখে ওপাশ থেকে রাহনাফ বলে উঠে,

– লেখিকার মন খারাপ বুঝি।

স্মিত হাসে মেহের। সে রাহনাফের কথার কোন জবাব দিচ্চে না। ইচ্ছে করেই দিচ্ছে না। সারাদিন একটি বারের জন্যে মেহেরের খোজ নেয়নি সে। আর এখন জ্যোৎস্নাময় রাতে রোমান্টিক কথা বললেই সব ভুলে যাবে। মোটেও না। দূর আকাশের ওই চাদের দিকে তাকায় মেহের। লম্বা করে শ্বাস টেনে বলে,

– আকাশের ওই মিটিমিটি তারার সাথে কইবো কথা।তোমার স্মৃতির পরশভরা অশ্রু নিয়ে গাঁথবো মালা নাই-বা তুমি এলে।

মেহেরের এমন অভিমানী কথা শুনে মৃদু হাসে রাহনাফ। অতঃপর বলে,

– অভিমানীনি।

কোন জবাব দেয়না মেহের। মোবাইলে কানের কাছে ধরে বসে থাকে। ওপাশ থেকে রাহনাফও তাই। কেউ কোন কথা বলছে না। এভাবেই চলছে সময়।

– নিচের দিকে তাকাও লেখিকা সাহেবা। প্রায় ঘন্টা খানেক পা বলে রাহনাফ। মোবাইলটা তখনো মেহেরের কানের কাছেই ছিলো। রাহনাফ কথা বলছে না দেখে সে মোবাইল কানের কাছে ধরে দু-চোখ বন্ধ করে রেখেছে। দু-চোখে নেমে আসছে রাজ্যের ঘুম। হঠাৎ করেই রাহনাফের কন্ঠ শুনতে পেয়ে চমকে উঠে সে। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে মোবাইলের দিকে তাকায়। রাহনাফ এখনো কে কাটে নি, মানে মোবাইল থেকে আওয়াজ আসছে। আরো একবার পরখ করে নিল সে মোবাইলটা। তারপর বলল,

– রাহনাফ আপনি এখনো কল কাটেন নি।

– নিচে তাকাও।

– কেন! কি আছে নিচে।

– তাকালেই দেখতে পাইবা। তাকাও!

রাহনাফের কথা মত নিচের দিকে তাকায় মেহের। মেহেরের বারান্দা বরাবর নিচে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় সে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাহনাফের হাসি মুখটা জ্বলমল করছে। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাহনাফ। কিন্তু রাহনাফ তো তার বাড়িতে! তাহলে সে এখানে কি করছে! এটা তার মনের ভুল নয়তো। নিজের হাতে চিমটি কাটে মেহের। ব্যাথা লাগছে। তার মানে সত্যিই রাহনাফ এখানে। আনমনে হেসে উঠে মেহের। অধোরে হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠে,

– রাহনাফ আপনি এখানে!!

স্মিত হাসে রাহনাফ। অতঃপর বলে,

– বাহিরে আসতে পারবে।

– এখন অনেক রাত। কেউ দেখতে পেলে বদনাম হবে।

– বদনাম হলে হোক না! মন কুটিরে জায়গা করে দিব তোমায়। বলতে ইচ্ছে করলেও সেটা মুখে প্রকাশ করল না রাহনাফ কল কেটে মোবাইলটা পকেটে পুরে মেহেরের রুমের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। সামনে তাকা দেয়াল ডেঙ্গিয়ে মেহেরের রুমে চলে আসে রাহনাফ। মেহের প্রথমে ভয় পেলেও পরে সে নিজেকে সামলে নেয়। মেহের ও রাহনাফ দুজনে মিলে মেহেরের বারান্দায় জ্যোৎস্না বিলাস করছে। রাহনাফের কাঁধে মেহেরের মাথা। আর রাহনাফ এক হাতে মেহেরকে আগলে ধরে অন্য হাতে মেহেরের এক শক্ত করে ধরে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর রাহনাফ তার পকেট থেকে একটা রিং বের করে মেহেরের হাতে পরিয়ে দিয়ে হাতের উল্টোদিকে আলতো করে নিজের অধোর ছুঁইয়ে দেয়। লজ্জা পেয়ে মেহের রাহনাফের বুকে মুখ লুকার। স্মিত হাসে রাহনাফ। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

– ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা, ও বাতাস আঁখি মেলো না
আমার প্রিয়া লজ্জা পাচ্চে যে।

৪৯
– আজ বৃষ্টির মাঝে সকাল সাজে, মেঘের শবদ্দ খানেতে বাজে। কিছু বিরহের স্মৃতি বুকের মাঝে প্রণয় সৃষ্টি করে রাহির। মনের ভিতরে কষ্টের ঘন্টা বাঝতে শুরু করে। তার জীবনটা কেন প্রেমহীন, কেন তার জিবনে প্রিয় মানুষের ভালোবাসা নেই। চোখ মেলে জানালার থাই গ্লাসের দিকে তাকায় রাহি। বৃষ্টির ফোটা গ্লাসের উপর পরে সেটা শিড় বেয়ে নিচে পরে যাচ্ছে। বাহিরে থাকা গাছগুলাকে আজ সতেজ লাগছে। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার কাছে যায় সে। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিকে ধরার ব্যার্থ চেষ্টা করে। হাত থেকে বৃষ্টির ছিটা এসে তার মুখে পরছে। আজ সকালটা বেশ অন্যরকম লাগছে রাহির। সুন্দর স্মৃগ্ধ বেশ ফুরফুরে সকাল। বৃষ্টির পানি গায়ে মাখছে রাহি। ইশ কতদিন এমনটা খেলা হয় না। এর আগের বছর যখন রাহি বৃষ্টিতে ভিজত তখন তার মা তাকে কত বকাঝকা করবো। তাই চুপিচাপি বৃষ্টিতে ভিজতো। মা যখন কিছু বলতো তখনি সে তার বাবার পাশে গিয়ে লুকাতো। অতীতের কথা মনে পড়তেই দু-চোখ অশ্রুতে ভরে উঠে তার। মাস কয়েকের মাঝে তার জিবন কতটা বদলে গেছে। কত বড় হয়ে গেছে রাহি। ভাবতেই স্মিত হাসে সে। ইশ এসব ভাবতে গিয়ে সে ভুলেই গিয়েছে তার বাবার কথা। রাহিকে হসপিটালে যেতে হবে।সৈয়দ নওশাদকে সুস্থ করে তুলার জন্যে ফিজিওথেরাপি দেওয়া হয় । জানালা ছেড়ে এসে ওয়াশরুমে ডুকে পরে।

ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই থমকে যায় রাহি। চারিদিকে স্তব্ধ, শূন্যতা অনুভব করে সে। সামনে থাকা লোকটাকে দেখে যতটা না রাগ হচ্ছে তার চেয়ে বেশী ঘৃনা হচ্চে। রাগে নিজের হাতের শক্ত মুঠি করে নেয় সে। নাক ফুলিয়ে দাত কটমট করে দু-পা সামনে এগিয়ে লোকটার নিকটে চলে আসে। আর তখনি সে খেয়াল করে সুফায় বসপ আছে রাহনাফ। নিচের দিকে তাকিয়ে বড় বড় করে শ্বাস ত্যাগ করছে সে। দু-হাতে শক্তকরে কুশন জড়িয়ে রেখেছে। দেখে মনে হচ্ছে এই কুশন খুন করার মতো অপরাধ করেছে তাই তার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে তাকে এভাবে শাস্তি দিচ্চে রাহনাফ। রাহি তার দৃষ্টি সড়িয়ে তার দাদির দিকে নিক্ষেপ করে। দাদি তখন ড্রয়িংরুমের এক কোনে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে আছে। রাহি তার রাহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

– রাহনাফ তুমি এখানে!

মাথা তুলে সামনে তাকায় রাহনাফ। তার চোখের দিকে তাকাতেই একটু পিছনের দিকে ঝুকে পরে রাহি। রাহনাফের চক্ষুদ্বয় লাল বর্ণ ধারন করেছে। মনে হচ্ছে কেউ ওর চোখে লাল মরিচ গুলিয়ে রেখেছে। চোয়ালগুলো শক্ত। ঘারের রগগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্চে রাহি। রাহি কিছুটা ঘাবড়ে যায়। সে বলে,

– রাহনাফ তুমি ঠিক আছো তো। কি হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

রাহির প্রশ্নগুলো উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়ায় রাহনাফ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আফিয়া আহমেদের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহিকে বলে উঠে,

– আমার তোমাকে কিছু বলার আছে রাহি।

– হ্যাঁ বল না কি বলতে চাও।

রাহির দৃষ্টি তখন রাহনাফের দিকে। আর রাহনাফ এখনো কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে আফিয়া আহমেদের দিকে।আফিয়া আহমেদ করুন চোখে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে না করে। রাহনাফ যেন রাহিকে কিছু না বলে। রাহনাফ তার দৃষ্টি সড়িয়ে রাহিকে বলে,

– কোথায় যাচ্ছ এখন।

– হসপিটালে, বাবার কাছে।

– তাহলে চল, যেতে যেতে বলা যাক।

– হুম চল। অতঃপর রাহি আর রাহনাফ দুইজনেই চলে যেতে নেয়। মেইন ডোরের কাছে আসতেই আফিয়া আহমেদ পিছন থেকে রাহিকে ডাক দেয়। দাঁড়িয়ে যায় রাহি। পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই সে বলে উঠে,

– এখনো আমার উপর রেগে আছিস তুই মা।

বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে রাহি। অতঃপর বলে,

– তুমি আমার মা। আমাকে জন্ম দিয়েছো লালন পালন করে বড় করে তুলেছো। আমি কি করে তোমার উপর রেগে থাকবো মা। এটা তোমার বাড়ি তুমি চলে এসেছো ভালো হয়েছে।

– আমাকে নিয়ে যাবি না নওশাদের কাছে।

– এইকয়দিন তুমি কোথায় ছিলে মা, যখন আমার বাবা হাসপাতালে মৃত্যর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল। কোথায় ছিলে তুমি। বাবার পাশে না থেকে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলে তুমি। স্ত্রী হিসাবে কি এটা কোমার কর্তব্যের মধ্যে পরে না।

– আমায় নওশাদের কাছে নিয়ে চল। কান্নামিশ্রত কন্ঠ আফিয়ার।

রাহি কিছু বলে না। নিঃপলক তাকিয়ে থাকে রাহনাফের দিকে।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here