মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-৩৪

0
1842

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৩৪]

মেহেরকে নিয়ে একটা দোকানের নিচে বসে আছে রাহনাফ। রাহিরে তুমুল ঝড় হচ্ছে আর বজ্রপাত হচ্ছে। ভয়ে মেহের রাহনাফকে জড়িয়ে রেখেছে। আর রাহনাফ মেহেরকে দুহাতে আগলে রেখেছে। বায়ুর গতিবেগ দেখেই রাহনাফ বুঝে যায় ঝড় হবে। তাই সে মেহেরকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যেতে চায় কিন্তু পথিমধ্যেই ঝড়ের গতি আরো তীব্র হয়ে উঠে যার কারনে ওদের রাস্তার পাশে এই দোকানের নিচেই আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে সব দোকান আগে থেকেই বন্ধকরে দোকানীরা যার যার বাসায় চলে যায়। এখন মেহের আর রাহনাফ সদ্য দুজন যুবক যুবতী বসে আছে এই দোকানের সামনে। সয়ম যত প্রবাহিত হচ্ছে ঝড়ের গতি যে আরো তীব্র হচ্ছে সাথে বজ্রপাত তো আছে। ভয়ে মেহের কাচুমাচু ধরে বসে আছে। এর আগে এমন কোন পরিস্থিতিতে পরে নি সে।

– এই ঝড় কি আজ শেষ হবে না, আড়ষ্ট কন্ঠ মেহেরের।

রাহনাফ কোন জবাব দেয় না। সে মেহেরকে আরো জোরে চেপে ধরে নিজের সাথে। রাহনাফের থেকে কোন জবাব না পেয়ে মেহেরের ভয়টা যেন আরো গাঢ় হলো। সে রাহনাফকে নিজের সাথে চেপো ধরে বলল,

– আমি বাসায় যাব। আমাকে বাসায় নিয়ে চলুন।

– এই ঝড়ের মধ্যে কিভাবে যাব লেখিকা সাহেবা। ঝড়টা আর একটু কমেনিক আমরা বাসায় চলে যাব। তুমি ভয় পেও না লেখিকা সাহেবা। আমি আছি তো তোমার সাথে। আমি থাকাতে তোমাকে কোন বিপদ-ই ছুঁতে পারবে না।

মেহের কোন কথা বলে না। সে জানে রাহনাফ থাকতে তার কোন অসুবিধা-ই হবে না। রাহনাফ তাকে সব সময়ই প্রোটেক করবে। মেহের রাহনাফকে ছেড়ে দিয়ে ওর দু-গালে হাত রেখে রাহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাহনাফ মেহেরের হাতের উপর হাত রাখে। অতঃপর বলে,

– কি দেখছো এভাবে?

মেহের কোন জবাব দেয়না। কিছু সময়ের জন্যে চোখদুটি বন্ধকরে রাখে। রাহনাফ মেহেরের গালে আলতো করে হাত রেখে বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে প্রশ্ন করে,

– শরীর খারাপ লাগছে?

মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয় মেহের। রাহনাফের হাত আপনাআপনি ভাবে সরে যায়। স্তব্ধ হয়ে যায় রাহনাফ। মেহের অসুস্থ এটা জানা সত্বেও সে কেন মেহেরকে বাহিরে নিয়ে আসলো। এখন যদি মেহেরের কিছু হয় তাহলে! রাহনাফ মেহেরের মাথায় হাত রেখে বলে,

– কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল আমাকে। পাশেই হসপিটাল আছে ডক্টরের কাছে যাব। ওয়েট আমি একটা গাড়ি ডাকছি।

ব্যাস্ত হয়ে পরে রাহনাফ। ওর মাঝে এক প্রকার অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। এই ঝড়ের তীব্র বাতাশে ঘামছে রাহনাফ। রাহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে যায়। সে মেহেরের দিকে হাত বাড়ায় মেহের কে উঠানোর জন্যে। কিন্তু মেহের তার হাতে হাত রাখে না। সে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে পরে। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে রাহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অতঃপর বলে,

– আমার এই রোগ ডক্টর সারাতে পারবে না মিস্টার রাহনাফ।

মেহেরের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় রাহনাফ। তার কপালে আপনা আপনি কয়েকটা ভাজ পরে যায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে মেহেরের মুখপানে। মেহেরের কথার মানে সে বুঝতে পারে নি। ডক্টর রোগ সারাতে পারবে না মানে কি! কি হয়েছে মেহেরের। কিছুক্ষণ ভাবনায় ডুবে থাকে রাহনাফ। অতঃপর বলে,

– মেয়েলি প্রবলেম?

মৃদু হাসে মেহের। দুদিক মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয় সে। এতে রাহনাফ আরো অবাক হয়ে যায়। তাহলে কি হতে মেহেরের। তার ভাবনার মাঝেই মেহের তার এক হাত ধরে টান দিয়ে রাহনাফকে তার পাশে বসিয়ে দিয়ে অধোরে চুমু বসিয়ে দেয়। ঘটনা আকস্মিক স্তব্ধ হয়ে যায় রাহনাফ। মেহের এমন কিছু করে বসবে সেটা কল্পনাও করতে পারে নি সে। দুজন দুজনের অধোরের স্বাধ গ্রহন করতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। এদিকে রাস্তার পাশে থাকা সিসি ক্যামেরায় সে তাদের এই দৃশ্যবলি রেকর্ড হচ্ছে সেটা কারো বোধগম্য হচ্ছে না করোরই।

সন্ধা থেকে শুরু হয়েছে ঝড় এখনো থামার কোন নামই নেই। সকালে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আজ ঝড়ের কথা শুনলেও কোথায় কোথায় ঝড় হবে সেটা শুনেননি সৈয়দা মাহবুবা। রাতের নয়টা বাজতে চলল অথচ এখনো ছেলেমেয়েদুটো বাড়ি ফিরে এল না। চিন্তায় দু-চোখের পাতা এক করতে পারছে না সৈয়দা মাহবুবা। মনে হচ্ছে তার ছেলেমেয়ে দুটো ভারী বিপদে পরেছে। পরনে থাকা চসমাটা একটু নাড়িয়ে চাড়িয়ে ঠিক করে নিলেন সৈয়দা মাহবুবা। নিভু নিভু জ্বলতে থাকা মোমবাতির দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। ঝড়ের কারনে কারেন্ট বন্ধ আছে এখানে। মোমবাতিটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি, মেহের আসছে কি-না সেটাই দেখতে। দূরে নিষক কালো অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলন না তিনি। বাহির থেকে হাওয়া এসে মোমবাতিটাও নিভে গেল। এবার তিনি তার আসনে বসবেন কি করে। বয়সের ভাড়ে সে তার চোখের দৃষ্টি শক্তিও লোপ পেয়েছে। শাড়ির আঁচলে মুখটা মুছে নিলেন। তখন আকাশের মাঝে গটা করে বিদ্যুৎ চমকালো। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে আলোকিত হলো চারিদিক। সৈয়দা মাহবুবা সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখতে পায়। না, আর বসে থাকলে চলবে না। ছেলেমেয়ে দুটোর কোন বিপদ হলো কি-না কে জানে। নিষক কালো অন্ধকারের মধ্যে বাহিরে যাওয়ার জন্যে সামনের দিকে এক কদম এগিয়ে যায় সৈয়দা মাহবুবা। দ্বিতীয়বার পা ফেলতেই তার পা-টা পিছলে যায়। ধপ করে নিচে পরে যায় সৈয়দা মাহবুবা। মোমবাতিটা পরে সেটা গড়ানি খেতে খেতে চলে যায় বাহিরে। সৈয়দা মাহবুবা উঠার চেষ্টা করতেই কোমড়ে তীব্র ব্যাথা অনুভব করে। কোন হাত রেখে, ও মা” বলে চিৎকার করে উঠে সে। তার পাশের রুমেই ছিলো মৌ আর আলিহান। এই ঝড়ের রাতে তারা হয়তো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। সৈয়দা মাহবুবার চিৎকার শুনে দুইজনেই বেড়িয়ে আসে। মৌ আর আলিহান দুজনে মিলে সৈয়দা মাহবুবাকে তুলে খাটের উপর বসিয়ে দেয়। মৌ তার কোমড়ে বরফের ছেকা দিতে দিতে বলে,

– কোথায় যাচ্ছিলে তুমি হ্যাঁ। পেলে তো কোমড়ে ব্যাথা। এখন শান্তি হয়েছে তোমার। বজ্রের ন্যায় কন্ঠ মৌ-য়ের। আলিহান সৈয়দা মাহবুবার পাশে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এই বয়সে সে কোমড়ে ব্যাথা পেয়ে বসলো। এখন যদি তার কোমড়টা ভেঙে যায় তাহলে উপায়!! করুন চোখে সৈয়দা মাহবুবার দিকে তাকায় সে। অতঃপর বলে,

– এই ঝড়ের মধ্যে কোথায় যাচ্ছিলে তুমি ছোটমনি!

– মেহু, মেহু আর রাহনাফ এখনো ফিরেনি। এই ঝড়ের রাতে কোথায় আছে দুজনে! আমার খুব টেনশন হচ্ছে রে গুড্ডু।

সৈয়দা মাহবুবার কথা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এই বজ্র ঝড়ের রাতে কোথায় আছে দুজনে। আধো ওদের কোন বিপদ হলো কি-না কে জানে! মা- তো টেনশন করবেই।

– তুমি শান্ত হোও ছোটমনি, আমি দেখছি। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে আলিহান । মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ভালোকরে বরফগুলা ঘসে দাও। চলে যায় আলিহান। পাশের রুমে গিয়ে রাহনাকে কল করে কয়েকবার। প্রতিবারই রাহনাফের মোবাইল সুইচ অফ দেখায়। নানা রকমের চিন্তা বেকে বসে তার মাথায়। বাধ্য হয়ে সে ঝড়ের রাতে বেড়িয়ে পরে রাহনাফ ও মেহেরকে খুঁজতে।

৪৪,
জানালার পর্দা বেদ করে সূর্যের লাল রশ্মি এসে মুখে পরতেই হুরমুর উঠে বসে মেহের। কাল রাতে ঝড়ের পর আজ সূর্যিমামা একটু বেশীই প্রখর। বিছানা ছেড়ে সোজা মায়ের রুমে যায় মেহের। সৈয়দা মাহবুবা কোমড়ে ব্যাথা পাওয়ার কারনে এখনো উঠেন নি। খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে কাজী নজরুলের বই পড়ছেন। মেহের গিয়ে সৈয়দা মাহবুবার পাশে বসে। সৈয়দা মাহবুবা তার দৃষ্টি বই থেকে নামিয়ে মেহেরের দিকে নিক্ষেপ করেন। অতঃপর বলেন,

– বিকালে রাহনাফকে বাসায় আসতে বল।

– রাহনাফ তো রোজ-ই আসে। নতুন করে আর বলার কি দরকার! সৈয়দা মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলে মেহের।

সৈয়দা মাহবুবা বইটা তার পাশে রেখে মেহেরের হাত ধরে বললেন,

– আমি তোদের বিয়ে দিতে চাই আর সেটা খুব তাড়াতাড়ি। দিনরাত এভাবে একটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়ালে এটা দৃষ্টিকটু দেখায়। লোকে মন্দ কথা বলে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোদের বিয়ে দিয়ে দিবো। আশাকরি এতে তোর কোন আপত্তি নেই।

মৃদু হাসে মেহের। যাকে ভালোবেসেছে তার সাথেই বিয়ে হবে এতে আপত্তি কেন থাকবে! তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। একটা পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হবে তারা এর থেকে খুশির খবর আর কি হতে পারে। কিন্তু পরক্ষনেই তার মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। বিয়ে হলে তো সবাই শ্বশুড় বাড়ি চলে যায়। মেহেরকেও কি তাই চলে যেতে হবে। না -সে কি করে তার মাকে একা ছেড়ে চলে যাবে। সৈয়দা মাহবুবা মেহেরের এমন বিষন্নমাখা মুখ দেখে বললে,

– তোর আবার কি হলো। মুখটা অমন চুপসে গেল কেন?

– না কিছু না।

উঠে চলে যায় মেহের। সৈয়দা মাহবুবা মেহেরের চলে যাওয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন,

– এই মেয়েটার মনে যে কখন কি চলে বুঝা বড় দায়। সে আবার মন দেয় তার বই পড়ায়।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

[বিঃ দ্রঃ- গল্পের ঘটনা বিন্যস্তে একটু আঠার প্লাস টানতে হয়ছে ৃআশাকরি কেউ বাজে মন্তব্য করবেন না। আসসালামু আলাইকুম ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here