মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-৩৬

0
1811

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৩৬]

৪৫,
জ্যোৎস্না রাত আলােকময় প্রকৃতির এক বৈচিত্র্যময় উপহার। ভরা পর্ণিমার রাতে নিটোল চাদ তার ঝলমলে আলাের পসরা নিয়ে উপর আকাশে আবির্ভূত হয়। চাদনি রাত প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের মনে বিচিত্র ভাব ও উদ্দাম আনন্দের সঞ্চার করে। চাদনি রাতের নৈসগিক পরিবেশ যেমন দৃষ্টিনন্দন, চিত্তাকর্ষক তেমনি উপভােগ্য।
চাদনি রাতের মােহনীয় রূপ-সৌন্দর্য প্রতিটি মানুষের মনেই রং ধরায়। সুখ-শয্যায় ঘুম আসে না, অথচ ঘুম না আসার কোনাে গ্লানিও অনুভূত হয় না। কেমন যেন বুকের তলে জমা হয়, অথচ সেই ভাব প্রকাশের ভাষা নেই । মূলত জ্যোৎস্নার মায়াবী রাঙিয়ে তােলে মানুষকে। অথচ এমন একটা মায়াময়ী রাতের সৈয়দ নওশাদের মনে পড়ছে বিষাদের কথা। মাহবুবার সাথে করা অন্যায়ের কথা। কতনা অমানুষিক কষ্ট দিয়েছে সে মাহবুবাকে। মেয়েটা সব মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছে। কখনো প্রতিবাদ করেনি। অথচ আজ তার জায়গায় এসে রাজত্ব করছে আফিয়া। জায়গাটা এক শুধু চরিত্র দুটো আলাদা। একজন যে সবার অপমান সহ্য করে হাসি মুখে সবার আদর যত্নকরে যেত আর অপরজন যে সবার উপর অত্যাচার করে বেড়ায়। কিছুক্ষণ আগেও আফিয়া আহমেদের সাথে ঝগড়া হয়েছে সৈয়দ নওশাদের। ঝগড়ায় বিষয়টা হলো সৈয়দ নওশাদের মা। সৈয়দা কেন তার মাকে নিয়ে আশ্রমে রেখে আসে না, কেন তাকে এত আদর যত্নকরে! কেন সৈয়দ নওশাদ তার মা-কে নিয়মিত ঔষুদ দিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলছে। বুড়ো মানুষ দুদিন পর তো মরেই যাবে তাহলে কেন তার পিছনে এত টাকা খরচ করছে সে, সেটা নিয়েই আফিয়া আহমেদের সাথে তুমুল ঝগড়া হয় সৈয়দ নওশাদের। ঝগড়ায় এক পর্যায়ে সৈয়দ নওশাদ তার মেয়ে আর মা-কে নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে চাইলে আফিয়া সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। রাহি আর সৈয়দ নওশাদকে তিনি কোথাও যেতে দিবেন না। তখন সৈয়দ নওশাদ আফিয়া আহমেদকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে, কারন তিনি তার সাথে একই বাড়িতে থাকতে পারবেন না। যে মানুষটা আফিয়া আহমেদকে ভালোবাসা ছাড়া কোন দিন মোটা স্বরে কথা বলে নি সেই মানুষটা তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে। অভিমানে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় আফিয়া আহমেদ। আফিয়া আহমাদের চলে যাওয়ার পর সৈয়দ নওশাদ হাটু গেরে সেখানেই বসে পরেন। সত্যিটা এটাই যে তিনি আফিয়া আহমেদকে খুব ভালোবাসেন। প্রথম যেদিন দেখেছে তার পর থেকে আজ অব্ধি শুধু তাকে ভালোবেসে গিয়েছে। তাকে ভালোবেসে তার সকল অন্যায়গুলোও হজম করে নিয়েছেন। অথচ আজ তাকেই বাড়ি থেকে বের করে দিলেন সৈয়দ নওশাদ।কোথায় যাবে আফিয়া! কার দুয়ারে দাঁড়াবে সে! এই ভু-খন্ডে সৈয়দ নওশাদ ছাড়া আফিয়ার আর কেউ আছে বলে জানা নেই তার।বুকে হাত রেখে হাটু গেরে বসে পড়েন। এর আগে তিনি কখনো এতটা ভেঙে পড়েন নি। বুকের বা পাশটা খুব ব্যাথা করছে। নিজেই নিজের বুকের উপর মালিশ করতে থাকেন সৈয়দ নওশাদ। নাহ, ব্যাথাটা কিছুতেই কমছে না। আরে গাঢ় হচ্ছে। রাহিকে ডাকবে, কথা বলতে পারছে না সৈয়দ নওশাদ। গলায় এসে সব কথা কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সে নুইয়ে পরে।

আফিয়া আহমেদ যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তখন রাহি ড্রয়িংরুমে বসে মোবাইলে গেইম খেলছিলো। সৈয়দ নওশাদের মা তাকে আটকাতে গেলেও রাহি সেখানেই বসে ছিলো। রাহি বারবার করে চাইছিলো তার মা নিজ চলে যাক। পরে নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারুক। সে তার ভুলের জন্যে সকলের কাছে ক্ষমা চান। কিন্তু আফিয়া আহমেদ সেটা করেন নি। সে নিজের জেদ বজায় রাখতে বাড়ি থেকে চলে যায়। এতে যেন রাহির কোন আপসোস নেই। সে আগের ভঙ্গিতে বসে বসে গেইম খেলছে আর আইসক্রিম খাচ্ছে।

– পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন মোবাইল টিপবি আর অপথ্য গুলো খাইবি। খাবি, তাইলো ভালো কিছু খা, যেগুলা খাইলে বল শক্তি বাড়বো সেগুলা খা, তা না করে সারাক্ষণ শুধু অপথ্য জিনিসগুলা খাবি। আইসক্রিমের বাটিটা নিয়ে কঠিন গলায় কথাগুলো বলল রাহির দাদী।

দাদির কথাশুনে রাহি কপাল কুচকে সামনে তাকায়। মোবাইলটা অফ করে রেখে, দাদিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– উহঃ দাদী তোমাকে না নভেল দেওয়া উচিৎ। এত মজা করে আইসক্রিম খাচ্ছিলাম তুমি আমার মজাটা নষ্ট করে দিলে। এবার আমাকে আইসক্রিমেী বাটিটা দাও। আর যাও তোমার ছেলেটাকে কিছু খাইয়ে দিয়ে এসো।

– বাবা হয় তো। সুন্দর করে কথা বল।

– ঠিক আছে ঠিক আছে। এখন যাও বাবাকে কিছু খাইয়ে দিয়ে তুমিও খেয়ে নাও। তুমি আমাকে আইসক্রিমের বাটিটা দিচ্চো না কেন? খাবা দিয়ে দাদির হাত থেকে বাটিটা নিয়ে নেয় রাহি। দাদী কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে রাহির পাশে বসে পরে। রাজি কপাল কুঁচকে দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে,

– তোমার আবার কি হলো?

– আফিয়াকে আটকালি না কেন? সবাই কি বলবে, শ্বাশুড়ি এসেই ছেলে আর বউয়ের মাঝে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে। ছেলের বউটাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।

দাদীর কথাগুনে রাহি দাদী হাতের উপর হাত রেখে বলে,

– পাছে লোকে কিছু বলে! বলুক না তাতে তোমার আমার কি যায় আসে। পিছে তো কু*ত্তাও ঘেওঘেও করে। দেখ দাদী কিছু মানুষ আছে যাদের কাজই হলো পরনিন্দা পরচর্চা করা। নিজের খাবে আর মানুষের গীত গাইবো। তারা ভালো কাজের নিন্দে করে আর খারাপ কাজের উৎসাহ দেয় তাদের ভয়ে তো আমরা আমাদের মানুষত্বটাকে বিসর্জন দিতে পারি না। মায়ের চলে যাওয়া নিয়ে আমার কোন আপসোস নেই। দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল অনেক ভালো। দাদী, তোমাকে আশ্রমে থাকতে হয়েছে। মেহের আপুকে মরণ যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়েছে সেই তুলনায় আফিয়া আহমেদ তো কোন শাস্তুি পায়নি। তুমি কোন চিন্তা করো না দাদী সে ফিরে আসবে। দেখে নিও তুমি মা আবার এই বাড়িতে ফিরে আসবে। অধোর চেপে হাসে রাহি।

– মেহের এখন কেমন আছে রে রাহি?

– ভালো। রাহি আবার মনোযোগ দেয় মোবাইলে গেইম খেলার। দাদী উঠে একটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে চলে যায় সৈয়দ নওশাদের রুমের দিকে।

সৈয়দ নওশাদের রুমের লাইট অফ করা। রাতের বেলা চোখে দেখতে পান না তিনি তবুও হাতের সাহায্যে এগিয়ে গিয়ে লাইট অন করেন। পুরো রুমে চোখ বুলিয়েও সৈয়দ নওশাদকে দেখতে পেলেন না। খাবারটা টেবিলের উপর রেখে বারান্দায় চলে যান। সেখানে গিয়ে সৈয়দ নওশাদকে দেখেই দু-হাতে মাথা চেপে ধরে, চিৎকার করে উঠেন।

৪৬,
কলেজ কতৃপক্ষ একটা সংস্কৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাইছে। এবার তাদের তাদের কলেজ ডিবেট এ বিজয়ী হয়েছে মূলত সেই কারনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। মেহের এতদিন অসুস্থ ছিলো তাই করা হয়নি। এখন মেহেরও সুস্থ। মেহেরের সাথে কথা বলে আজ থেকেই অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করা হয়েছে। কলেজে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ। সবাই এখন অনুষ্ঠানে মনোনিবেশ করছে। মেহেরকে নৃত্য পরিবেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

হলরুমে যখন মেহের সবার নাম লেখছিলো তখন কলেজের নতুন স্যার আড়াল থেকে তাকে দেখছিলো। তার চোখে ছিলো একরাশ মুগ্ধতা। নাম লেখার ফাঁকেফাঁকে মেহের যখন সবাইকে নাচের স্টেপগুলো দেখিয়ে দিচ্ছিলো তখন তার অধোরে ছিলো মুগ্ধকর হাসি। প্রিন্সিপ্যালের ডাকে পিছনে ফিরে তাকায় নতুন স্যার। নতুন স্যার প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে সালাম দিয়ে
সুধায়,

– স্যার আপনি!

– এখানে কি করছো তুমি আহসান।

মেহেরের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে আহসান। অতঃপর বলে,

-এমনি, দেখছিলাম আর কি!

প্রিন্সিপ্যাল স্যার হয়তো তার দৃষ্টি লক্ষ করেছে তাই সে আহসানের কাঁধে হাত রেখে বলে,

– মেয়েটা ভিষন ভালো। তোমাকেও আমার পছন্দ হয়েছে!

স্যারের কথাশুনে অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে আহসান। এই স্যার বলে কি! আহসানের এমন অবাক করা দৃষ্টি দেখে স্যার মৃদু হেসে বলে,

– মেহেরকে সাহায্য করো গিয়ে। মেয়েটা একা এটা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে ।

আহসান গিয়ে মেহেরের পাশে দাঁড়াতেই মেহের আহসানকে সাইড দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হল রুমের সবাই তখন তাদের পারফরমেন্সে মন না দিয়ে আহসানের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। আর আহসানের দৃষ্টি স্থির মেহেরের দিকে। মেহের কয়েকজনের নাম লিখে তাদের নাচের স্টেপগুলো দেখিয়ে দিতে যাবে এমনি সময় তার মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠে। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করতেই দেখতে পায় স্কিনে রাহনাফের নামটা জ্বলমল করছে। খুশির ঝলক ফুটে উঠে মেহেরের চোখ মুখে। সে তার এক সহপাঠীকে দায়িত্ব দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে। পিছন থেকে আহসান করুন চোখে তাকিয়ে থাকে মেহেরের চলে যাওয়ার দিকে। মেহের চলে আসাতে তার মুখে বিরক্তি ভাব প্রকাশ পায়। আহসানও সেখান থেকে চলে আসে।

মিষ্টি সূরে হেসে হেসে কথা বলে রাস্তাদিয়ে হেটে যাচ্ছে মেহের। হঠাৎ করেই কেউ তার হাত ধরে টান দেয়। মেহের চিৎকার দিতে চাইলে লোকটা ওর মুখ চেপে ধরে। তারপর ওকে টানতে টানতে একটা বিল্ডিং এর পাশে নিয়ে গিয়ে মেহেরের মুখ ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়ে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে কঠিন গলায় বলে উঠে,

– এটা কেমন আচরন! আমার প্রাণটাই বের হয়ে যাচ্ছিলো।

মেহেরের রাগ দেখে মৃদু হাসে রাহনাফ। এতে মেহেরের রাগটা আরো বেড়ে যায়। সে রেগে গিয়ে রাহনাফের গলা চেপে ধরতে যায় তখন রাহনাফ তার হাত ধরে হাতের মধ্যে চুমু খেয়ে বসে। বিস্মিত চোখে তাকায় মেহের। তখন রাহনাফ তাকে চোখ টিপ দিয়ে হাটু গেরে বসে পরে। ঘটনার আকস্মিক আরো বেশী অবাক হয়ে যায় মেহের।সে অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাহনাফ মেহেরের দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলে,

– পা-টা দাও।

– মানে!

রাহনাফ কিছু না বলে মেহেরের পায়ের জুতা ছাড়িয়ে নিয়ে পর হাটুর উপর রাখে। তারপর সে তার পকেট থেকে একটা পায়েল বের করে সেটা মেহেরের পায়ে পড়িয়ে দেয়। অবাক হয়ে যায় মেহের সাথে খুশিও। সে এতটাই খুশি হয়েছে সে কিছু বলার ভাষা হাড়িয়ে ফেলছে।

– একদম পারফেক্ট। মেহেরকে আবার জুতা পড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় রাহনাফ। তারপর বলে,

– পছন্দ হয়েছে লেখিকা সাহেবা?

মেহের কোন কথা বলে না শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাহনাফ ধরে নেয় এটা মেহেরের পছন্দ হয়নি। সবাই যোখানে গার্লফেন্ডের বড় বড় গিফ্ট দেয় সেখানে রাহনাফ দুইশো টাকার একটা পায়েল কিনে দিয়েছে। এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। মেহের রাহনাফের হাতের উপর হাত রেখে বলে উঠে,

-ভিষন। খুব খুব পছন্দ হয়েছে আমার। রাহনাফের মুখে হাসি ফুটে উঠে। মেহের আবার বলে উঠে,

– আমার চাহিদা এত বড় নয় রাহনাফ। আপনার এই ছোটছোট গিফ্টগুলো আমাকে যতটা আনন্দ দেয় সেটা বড় বড় কোন গিফ্টে পাওয়া যাবে না। আসলে ছোট বিষয়ে আনন্দটা একটু বেশীই। জানেন ছোট বেলাতে পাঁচ টাকা নিয়ে স্কুলে যেতাম। দুই টাকার ঝাড়মুড়ি খেতাম দুই টাকার ফুসকা খেতাম। আর এক টাকা রেখে দিতাম লজেন্সের জন্যে। এক টাকায় চারটা লজেন্স কিনে খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম। আর সেটাতেই অনেক খুশি ছিলাম। আর এখন দুই তিনশো টাকার চকলেট খেয়েও সেই আনন্দ পাইনা। আমার সেই পাঁচ টাকার আনন্দটা এখন হাজার টাকায়ও খুজে পাইনা। আপনি সেই রকম আমায় ছোট ছোট জিনিস দিয়ে আনন্দ রাঙিয়ে তুলুন রাহনাফ। এতেই আমি অনেক খুশি।

মেহেরের হাতের উপর হাত রাখে রাহনাফ অতঃপর বলে,

– চল আমার সাথে। তারপর সে মেহেরের হাত ধরে টেনে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

চলবে,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here