#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৪২]
পুলিশ স্টেশন থেকে বের হয়ে রিক্সার জন্যে রাস্তার মাঝখানো দাঁড়ায় রাহি। গ্রীষ্মের তীব্র রোদ এসে পড়ছে রাহির মুখপানে। বাম হাতটা কপালের উপর রেখে উত্তাপটা কমানোর চেষ্টা করছে সে। পরন্তু দুপুর। রাস্তায় খুব একটা যানবাহনের চলাচল নেই। রিক্সার জন্যে এদিক ওদিক উকি ঝুঁকি দিচ্ছে রাহি। আর তখনি কেবলা মার্কা হাসি দিয়ে রাহির সামনে এসে দাঁড়ায় সেই যুবকটা। যাকে যাকে দেখামাত্রই ভ্রুদ্বয় কুঁচকে দু-পা পিছনে চলে যায় রাহি। যুবকটা তার বত্রিশ পাটি বের করে বলে উঠে,
– আপনি কিন্তু এখনো ধন্যবাদ দেননি।
রাহির চোখমুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠে। কপাল কুঁচকে বলে উঠে,
– আপনি? আপনি এখানে কি করছেন?
রাহির করা প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বত্রিশ পাটি বের কর হেসে নিজের উপস্থিতি বুঝায় যুবকটা। ফেসটাতে সিরিয়াস ভাব এনে বলে,
– পুলিশ স্টেশনে কি করতে এসেছিলন আপনি?
– সবাই যা করতে আসে আমিও তাই করতে এসেছি। আড়ষ্ট কন্ঠে কথাটা বলে সমানের দিকে কয়েক পা এগিয়ে যায় রাহি। সামনেই একটা রিক্সা এসে দাঁড়িয়েছে। রাহি গিয়ে রিক্সায় উঠে বসে একবারও পিছনে ফিরে তাকায় না সে। পিছন থেকে যুবকটা চেঁচিয়ে বলে,
– পুলিশ স্টেশনে তো ক্রিমিনালরা আসে। আপনি কোন ধরনের ক্রাইম করেছেন! চুরি নাকি মার্ডার! যুবকটার কথা শেষ করার আগেই রিক্সা ছুটে চলে যায়। যাওয়ার আগে রাহি যুবকটার পানে একপলক তাকিয়ে মৃদু হাসে। কেন হাসে সেটাও জানে না সে। যুবকটার ড্রেসকোট দেখে নাকি তার করা বেহায়াপনা দেখে! শুধু জানে যুবকটাকে দেখে তার হাসতে ইচ্ছে করছে। রাহির হাসি দেখে যুবকটা তার ডানহাতটা বুকের বা পাশে রাখে। বিড়বিড় করে বলে উঠে,
– চুরি তো করেছেন আপনি মিছ ধানি লংকা তবে সেটা এই অবুজের মন।
_____________________
দেখতে দেখতে কেটে যায় তিন মাস। সৈয়দ নওশাদকে এখন তার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। সে তার হাতটা একটু আকটু নাড়াতে পারলেও পা একদমই নাড়াতে পারে না। ডক্টররা তারকে ফিজিওথেরাপি দেওয়া অফ করে দিয়েছে কারন তার আগের অবস্থায় ফেরার কোন সম্ভবনা নেই। শুধু শুধু থেরাফি দিয়ে শরীরের সতেজ কোষগুলো নষ্ট করতে চান না। সৈয়দ নওশাদ আহমেদ এখন হোইল চেয়ারের বসে থাকে সর্বক্ষণ। তাকে কেউ খাইলে দিলে খেতে পায় নতুবা না। তবে তার সেবার জন্যে সর্বক্ষণ নিয়োজিত আছে দুইজন নার্স। আলিহান সৈয়দ আহমেদ ইন্ডাস্ট্রিয়ালের দায়িত্ব নিয়েছে যদিও সে এই দায়িত্বটা নিতে চাইনি। মৌ আর মেহেরের জোড়াজুরি সৈয়দা মাহবুবার উপদেশ মেনেই সে এই কোম্পানির দায়িত্ব নিয়েছে। এই কোম্পানির মালিক শুধু সৈয়দ নওশাদ আহমেদই নয় আলিহানও এর অর্ধেক মালিকানা আছে। সৈয়দ নওশাদ আহমেদ এখন কোম্পানির কোন দায়িত্বই পালন করতে পারবে না তাই পুরো কোম্পানির দায়িত্ব আলিহান নিজের কাঁধে নিয়েছে। আফিয়া আহমেদ এতে বাধা হয়ে দাঁড়ালে রাহনাফের কথায় সে দমে যায়। কোম্পানির দায়িত্ব নেওয়ার পর আলিহানকে তাদের আহমেদ ভিলায় থাকতে বলা হয়েছিলো, আলিহান সেটা প্রত্যক্ষাণ করে মেহেরদের সেই বেরঙ চিলেকোঠায় থাকছে। রাহনাফ ব্যাস্ত এখন তার [WAB] তৈরীর কাজে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে এসে দাড়ায় মেহেরের বারান্দার সামনে। দূর থেকে এক পলক দেখে সে আবার চলে যায়। অবশ্য এই নিয়ে মেহেরের মনে অনেক অভিমান জমে আছে। তবে চোখের তৃষ্ণা মেটাতে মাঝতে সে রাহনাফের পাগলামি সেটা মেহেরের অভিমান ভাঙর জন্যে যতেষ্ঠ। দূর থেকে এক পলক দেখে দুইজনেই চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নেয়। মনটাকে শীতল করে নেয়। রাহির এখন সেই হিমু রুপি যুবকটার সাথে অনেক ভাব জমেছে। এতদিন রাহির সব কাজে সে তার পাশে থেকেছে। রাহির মন খারাপের সময় তার মন ভালো করে দিয়েছে। বেশ ভালো সম্পর্ক হয়েছে তাদের মাঝে।
যুবকটির এবার এক অসুখ হলো। ভীষন মন খারাপের অসুখ। সে রাতবিরেত শুধু রাহিকে নিয়ে ভাবতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে এক সময় তার মনে হলো, হৃদয় নামক প্রণয়ের সমূদ্রের সমূদয় জল আকস্মাৎ শুকিয়ে গেছে। চারিদকে শুন্য মরুভূমি। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে গেল সে। মনে হচ্ছে তার জ্বর আসছে। শরীর কাপিয়ে মন খারাপের জ্বর। বিছানায় শুয়ে নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করলো সে। অজ্ঞাতসারে কল দিয়ে বসলো রাহির নাম্বারে। তাকে কল দিয়েই নিভু নিভু কন্ঠে বলল,
– আমি আজ ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত। মিটিয়ে দিন আমার তৃষ্ণা। আপনার কন্ঠ শুনিয়ে আমাকে একটু শান্তুি দিলে হয় না। একটা লম্বা সুখের দীর্ঘশ্বাসের অনেক প্রয়োজন আমার ।
রাহির সেই সময়ের অস্তিত্ব হীম করা শ্বাস প্রশ্বাসের ধ্বনি আজও যুবকটার মস্তিষ্কে অনুসরণ করে। অথচ আজ বারো দিন তাদের কোন কথা হয়না।যুবকটির মনে পরে তাকে।তার মখমলি চুল স্পর্শ করার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠে তার অন্তরিন্দ্রিয়। পুনশ্চ মনে করিয়ে দেয় সেই সমিকরন, ভালোবাসা এক নিঃসঙ্গতার নাম। ভালবাসলে সে নিঃস্ব হবেই।
আজকের দিনটা অন্যদিনের থেকে আলাদা। রাতে বৃষ্টির পর সকালে সূর্য মিষ্টি আলো দিচ্ছে। বাতাশে বৃষ্টির গন্ধ। সকালের রোদের নমনীয়তা আর মৃদু মন্দ হওয়ায় মন ভালো হওয়ার কথা থাকলেও রাহির মন ভালো হয়নি। জানালার রেলিং এর উপর হাত রেখে দাড়িয়ে রোদ্রউজ্জল সকাল দেখছে। রাতের আকাশের মেঘ কাটিয়ে সকালে সূর্যিমামা উকি দিয়েছে ঠিক যেন #মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। এত সুন্দর। সকালে মন খারাপ রাহির। রেদওয়ানের কথা তার বড্ড মনে পরছে। যদিও তার ড্রেসকোটে রাহি তাকে হিমু বলেই সম্বোধন করে। আর তেরোদিন হতে চলল রেদওয়ানের সাথে কোন যোগাযোগ হয়না রাহির। অবশ্য তার সাথে যোগাযোগের সব রাস্তাই রাহি নিজে বন্ধ করে দিয়েছে। রাহনাফকে ভালোবেসে সে হেরেছে তাই আর নতুন করে কাউকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে চায়না রাহি। রাহনাফ মানুষটা হুট করেই তার জিবনে এসেছিল তেমনি হুট করেই সে হাড়িয়ে গেছে। লম্বা একটা শ্বাস নিলো রাহি। তখনি নিচ থেকে তার মায়ের চিৎকারের শব্দ কানে ভেসে বসে। দেয়ালে সাঁটানো কেলেন্ডারের দিকে তাকিয়ে আজকের তারিখটা দেখে স্মিত হাসে রাহি। চোখের কোটরে তার অশ্রুর ভীড়। অনামিকা আঙ্গুলের সাহায্যে চোখের কোটর থেকে পানি মুছে নিয়ে ধীর পায়ে রুমের বাহিরে চলে আসে।।
ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখতে পায় সেখানে পুলিশের আনাগোনা। তাদের সাথে রেদওয়ানও আছেন। রাহির প্রথমে চোখ আটকে যায় রেদওয়ানের উপর। ছেলেটার চোখের নিচে কালো দাগ বসে গেছে। মাথার চুলগুলো উসকোখুসকো। রাহি তার দৃষ্টি নামিয়ে আফিয়া আহমেদের দিকে তাকায়। সুপায় বসে নিষ্পলক আফিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। রাহি তার বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইন্সপেক্টর রায়হানের সামনে গিয়ে বলে উঠে,
– সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো ইন্সপেক্টর সাহেব।
ইন্সপেক্টর রাহির হাতে একটা ফাইল তুলে দেয়। রাহি ফাইলটা হাতে নিয়ে সবগুলা ডকুমেন্ট ভালো করে পরখ করে নেয়।অতঃপর সে ইন্সপেক্টরের হাতে ফাইলটা দিয়ে বলে,
– আপনারা উনাকে নিয়ে যেতে পারেন।
নিচের দিকে তাকিয়ে অধোর কামড়ায় রাহি। বুক ফেটে কাননা আসছে তার। কোন রকমে নিজের কান্নাটা আটকে রাখে সে। তারপর সৈয়দ নওশাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। একজন মহিলা পুলিশ আফিয়া আহমেদের সামনে দাঁড়িয়ে হাতকড়া উপরে তুলে বলে, তাকে এরেস্ট করার জন্যে। উপস্থিত সকলে হচকচিয়ে যায়। সবচেয়ে বেশী অবাক হয় সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। কিন্তু সে মুখে কিছু বলে উঠতে পারে না। আফিয়া আহমেদ রাহির দিকে তাকায়। রাহির ছিলো তখন অসহায় দৃষ্টি। নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো সে। আফিয়া আহমেদের দিকে তাকানোর সাহস নেই তার। আফিয়া আহমেদ রাহির সামনে দাঁড়িয়ে রাহির মুখের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
– উনারা এসব কি বলছে রাহি! আর আমাকে এরেস্ট কেন করতে চাইছে!
আফিয়া আহমেদের কথায় স্মিত হাসে রাহি। অধোর কামড়িয়ে উপরের দিকে তাকায়। কিছু সময়ের জন্যে চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে নেয় অতঃপর বলে,
– তোমাকে কেন এরেস্ট করতে চাইছে তাইনা মা! মৃদু হাসে রাহি। আমায় হাসালে মা। তুমি সত্যিই জানো না তোমাকে কেন এরেস্ট করতে চাইছে। সত্যিটা তুমি যতই লুকানোর চেষ্টা করো না কেন? একদিন না একদিন সেটা প্রকাশ হবেই। মা তুমি খুনি। একটা মানুষের প্রান নিয়েছো তুমি। তোমার অপরাধের শাস্তি তো তোমাকে ভোগ করতেই হবে।
রাহির কথা শুনে চমকে উঠে সৈয়দ নওশাদ সহ তার মা। অবাক চোখে তারা একবার আফিয়া আহমেদের দিকে তাকায় তো আরেকবার রাহির দিকে তাকায়। আফিয়ার আহমেদের যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। দু-পা পিছিয়ে পরে যেতে নিলে রাহি তাকে আকরে ধরে। আফিয়া আহমেদ রাহির দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বলল,
– এসব তুই কি বলছিস রাহি!
– কেন মা তুমি সব ভুলে গিয়েছ? নাকি ভুলে যাওয়ার অভিনয় করছো কোনটা! আচ্ছা বেশ আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, আরওয়ান শিকদারের কথা মনে আছে তোমার মা।
রাহির কথা শুনে আফিয়া আহমেদের চোখ কপালে উঠে যায়। রাহিকে ধাক্কাদিয়ে সড়িয়ে সুফায় বসে পরেন তিনি। নিচের দিকে তাকিয়ে ঘনঘন শ্বাস ত্যাগ করতে থাকেন। চোখের সামনে ভেসে উঠে আরওয়ান শিকদারের সেই রক্তাক্ত মুখ।
চলবে,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।