মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-৪১

0
1842

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৪১]

৫১,

দিনের শেষ অংশ টা খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যায় ! পড়ন্ত বিকেল হয়তো একেই বলে ! আর দিনের শেষ ভাগের এই রংটাই বুঝি গোধুলী ! ছাদে বসে গাঢ়ো কমলা রঙ এর অস্তায়মান সূর্য টা দেখছেন সৈয়দা মাহবুবা। সূর্যকে দেখে মনে হচ্ছে সূর্য্যি মামা বুড়িয়ে গেছে , তাকিয়ে আছেন অবলিলায় । চোখে বিন্দু মাত্র আঁচ লাগছে না তার। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে তার সৌন্দর্য অবলোকন করলেন সৈয়দা মাহবুবা। কি জানি ! হয়তো সত্যিই সুন্দর প্রকৃতির এই দিন রাতের সন্ধ্যিক্ষন । সৈয়দা মাহবুবা কঠিন হৃদয়ের মানুষের পক্ষে তা খুজে পাওয়া রিতিমত দুঃসাধ্য কাজ । কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চোখ ঘুরিয়ে মনযোগ দিলেন এক ঝাক ঘরে ফেরায় ব্যাস্ত পাখিদের দিকে।উড়ে চলেছে নিজ গন্তব্যে ! কি ছকে বাঁধা নিয়ম ওদের ! ভোর হতেই জেগে ওঠা , খাবার এর খোজে বেরিয়ে পরা , সারা দিনের সমস্ত কাজ সাঝ বেলার আগেই শেষ করে ঘরে ফেরা ।সত্যিই হয়তো সুন্দর ।
কিছুক্ষন পর সূর্য্যি মামার দিকে তাকিয়ে দেখেন সে কয়েক মিনিটের ব্যাবধানে অনেকটা দূরে চলে গেছে !
এইতো ! কিছুক্ষণ আগেই ঐ মরা বেল গাছটার মাথার উপর ছিলো ,আর এখন নেমে গেছে অনেক নিচে ।
সূর্য্য কে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলো তোর কি বড্ড তাড়া !
নাকি সারাদিন ঠায় দাঁড়িয়ে তুই ক্লান্ত ! ধীরে ধীরে সূর্য টা বেলগাছ টার ওপাসে বড় বড় গাছে আড়ালে হারিয়ে গেল । তখনও হয়তো সে ডুবে যায় নি । তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে দিনটাকে আলোকিত করে রাখার চেষ্টা করে গেল । মনে হচ্ছে আকাশ যেখানে মাটি ছুয়েছে ! সেখান কেউ কমলা রং ঢেলে দিয়েছে ।বেচারা ক্লান্ত সূর্য টা অবশেষে আঁধারের মাঝে হারিয়ে যেতেই বাধ্য হলো হয়তো ! সন্ধা তারা তার মহিমায় গোটা শহরে ঢেলে দিলো আবছা কালো অন্ধকারে। চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল। তখন শহর নিয়ন আর সোডিয়াম আলোয় আলোকিত ! তবু রাত্রি কে হারাতে পারেনি সে নানা রং এর আলো। কি অদ্ভুত তাইনা! সৈয়দা মাহবুবা চলে আসেন তার রুমে। আযান হয়েছে নামায আদায় করতে হবে।

এদিকে যখন মৌয়ের ঘুম ভাঙ্গে তখন সে দেখতে পায় তার পুরো রুম বাচ্চাদের ছবি আর খেলনা দিয়ে সাজানো। রুমের চার দেয়াল ভর্তি শুধু বাচ্চাদের ছবি। কেবিনেট টা সাজানো হয়েছে খেলনা দিয়ে। খানিকটা অবাক হয়ে মৌ! এইটুকু সময়ের মধ্যে এত খেলনা আর ছবি কোথা থেকে আসলো? চারিদিকে চোখ বুলায় সে। জানালার দিকে তাকাতেই তার চোখ আটকে যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা তিনমূর্তি মানবের দিকে। আলিহান রাহনাফ আর মেহের তিনজনে বারান্দায় কফির আড্ডা জমিয়েছে। তাদের অধোর জুড়ে লেগে আছে প্রাণোচ্ছ্বাস হাসি আর কথার ফোয়ারা। মৌয়ের চোখ আটকে যায় আলীহানের মুখের দিকে। আজ আলিহান কে একটু বেশি খুশি লাগছে। আলিহানের এমন দন্ত বিকাশ হয়তো আগে কখনও দেখিনি মৌ। প্রাণ খুলে হাসছে আলিহানশুধু তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। মৌ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে আলিহানের হাসিমাখা মুখের দিকে। কথার ফুড়ন কাটিয়ে যখন মৌ-য়ের দিকে তাকায় আলিহান তখনই মৌ-য়ের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয়। স্মিত হাসে সে। অতঃপর উঠে দাঁড়িয়ে মৌ-য়ের কাছে আসে। মৌ ততক্ষণে উঠে বসার চেষ্টা করে। আলিহান লম্বা পা ফেলে মৌ-য়ের কাছে এসে ওকে আলতো করে ধরে বসিয়ে দেয়। পিছন থেকে রাহনাফ আর মেহের দুজনেই হাসি মুখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। আলিহান মৌ-য়ের পাশে বসে বলল,

– যা কিছু প্রয়োজন হবে আমাকে বলবে ওকে। একা একা ব্যাঙয়ের মতো লাফাবে না বলে দিলাম। ওয়াশরুমে যাবে?

মৌ অবলার মতো তাকিয়ে থাকে আলিহানের দিকে। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে একটা মানুষের মাঝে এত পরিবর্তন হয় কি করে? আচ্ছা বাবা হওয়ার আনন্দটাই মনে হয় এরকম। আমার বাবারও এরকম আনন্দ হয়েছিলো। ছোট বেলাতে মায়ের মুখে শুনেছি, আমার জন্মের এক বছর পর্যন্ত বাবা কোন দিন রাতে ঠিক মতো ঘুমায়নি। বাবা মায়ের কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে যায় মৌ-য়ের। বিষন্নতায় ছেয়ে যায় তর মুখখানা। আলিহান মৌ-য়ের গালে হাত রেখে বলে,

– কষ্ট হচ্ছে তোমার! বমি করবে?

দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে নাসূচক জবাব দেয় মৌ। অতঃপর আলিহান মৌ-কে নিয়ে বারান্দায় বসিয়ে দিয়ে সেখান থেকে প্রস্তান করে। মেহের এসে মৌ-য়ের নিকটে বসে দুইঠোট প্রসারিত করে হাসি দিয়ে বলে,

– আমি খালামনি হবো মৌ। আমাদের বাড়িতেও একটা ছোট্ট রাজকন্যা আসবে। আমার আরেকটা মা আসবে।
পুরো বাড়ি দৌড়াবে, ছোট ছোট হাত দিয়ে আমার সাথে খেলা করবে। আধো আধো করে সবাইকে ডাকবে। আমার তো ভাবতেই কেমন কেমন অনুভূতি হচ্ছে। আচ্ছা মৌ তোর কেমন লাগছে রে। শোননা কাল মার্কেট গিয়ে বেবীর জন্যে ছোটছোট জামাকাপড় কিনে নিয়ে আসবো কেমন।

– মৌ তোমার বোন নিহাত পাগল হয়েছে। অতি সুখে পাগল যাকে বলে । আড় চোখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল রাহনাফ। রাহনাফের কথা শুনে মেহের তার ভ্রুদ্বয়ে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে বলে উঠে,

– এই আপনি চুপ করুন তো। বাড়িতে নতুন মেহমান আসছে। তার জন্যে সব সব কিছু আগে থেকেই ঘুছিয়ে রাখতে হবে তাইনা। আবারও অধোর প্রসারিত করে হাসে মেহের।

– হুম সেটাই। তুমি যা শুর করেছ তাতে মনে হচ্ছে নতুন অতিথির আগমন ঘটে গেছে। আরে বাবা এখনো অনেক সময় বাকি। তাছাড়া তুমি জানলে কি করে রাজকন্যা আসবে? রাজপুত্র তো আসতে পারে তাইনা।

রাহনাফের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় মেহের। ছেলে বাবুর জন্যে সে কি জামাকাপড় কিনবে ভেবে পায়না। কিছুক্ষণ পর আলিহান আসে হাতে এক প্লেট ফল নিয়ে। মৌ-য়ের পাশের চেয়ার টেনে বসে আলিহান। তারপর এক এক করে সে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে থাকে। রাহনাফ উঠে দাঁড়ায় তারপর সবাইকে বিদায় জানিয়ে প্রস্থান করে।

পরেরদিন সকাল সকাল কলেজে পৌঁছায় মেহের। যদিও কলেজে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই ছিলো না তার। প্রিন্সিপ্যাল স্যার কাল রাতে কল করেছিল বিধায় আজ তাকে কলেজে আসতে হয়েছে। কলেজে গিয়েই প্রথমে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সাথে দেখা করে মেহের। স্যার তার হাতে একগাদা খাতা ধরিয়ে দিয়ে বলে এগুলো আহসানের কাছে পৌঁছে দিতে। খাতাগুলো হাতে নিয়ে অবলার মত দাঁড়িয়ে থাকে মেহের। এই আহসান স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে অসস্তি বোধ করে সে। স্যার যখন ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে তখন বেশ বিব্রত বোধ করে মেহের। স্যারকে কিছু বলতে চেয়েও বলে উঠতে পারেনা সে। বেশ অস্বস্তি হয় তার। প্রিন্সিপাল স্যার কে উদ্দেশ্য করে মেহের জড়ানো কণ্ঠে বলে ওঠে,

– আ- আমাকে এগুলো নিয়ে যেতে হবে স্যার।

– এনি প্রবলেম??

মেহের স্যারের দিকে মুখ বাকা করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মিহি কন্ঠে বলে,

– জ্বি জ্বি-না স্যার।

মেহের যখন আহসানের কেবিনে আসে তখন আহসান ভিডিও গেম খেলছিল। মেহের ধীরপায়ে এগিয়ে আহসানের পাশে দাঁড়ায়। হাসানের মনোযোগ দৃষ্টি মস্তিষ্ক সব একসাথে কাজ করছে ভিডিও গেমএর উপর তাই সে মেহের উপস্থিতি টের পেল না। মেহের আড়চোখে হাসানের দিকে তাকায়। আহসান যখন কিবোর্ডের বাটন চাপে তখন তার হাতের সাথে মুখের বিভিন্ন অঙ্গ কাজ করে। তার নাক চোখ ঠোট একেক সময় একেক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেয়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহের। এই ভিডিও গেমের ভিতরে কি আছে যে মানুষ যখন গেম খেলে তখন দিন দুনিয়ার সবকিছু ভুলে যায়, ভেবে পায়না মেহের। খাতাগুলো টেবিলের উপর রাখে সে। চলে আসার জন্য কয়েক পা বাড়াতে গিয়ে পিছন থেকে আহসান তাকে ডাক দেয়।

৫২,
কেটে গেছে সপ্তাহ খানেক। সৈয়দ নওশাদ আহমেদ এখন নার্সিংহোমে থাকে সর্বক্ষণ। নার্সিংহোমে এখন তার বাড়ি। তাকে তিন মাস নার্সিংহোমে রেখে ফিজিওথেরাপি দেওয়া হবে সুস্থ করার জন্য। আফিয়া আহমেদ দু-বেলা নার্সিংহোমে যাওয়া-আসা করেন। রাহি এখন বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে কাটায়। কলেজ টিউশান তারপর বন্ধুদের সাথে আড্ডা, আর কোন কোন দিন রাতের বেলায় বন্ধুদের বাড়িতে থেকে যায়। বাড়িতে আসলে দমবন্ধ লাগে তার। মনে হয় কেউ পিছন থেকে তার গলা চেপে ধরেছে। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কলেজ শেষে রাহি চলে যায় পুলিশ স্টেশনে, পুলিশ স্টেশনের ভেতরে প্রবেশ করতেই তার দেখা হয়ে যায় সেদিনের সেই যুবকের সাথে।যাকে সে হিমুর ছোট ভাই বলে সম্বোধন করেছে। যুবকটিকে দেখে রাহি তার ভ্রুদ্বয়ে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে কারণ তার পরনে আজও রয়েছে হলুদ টি শার্ট । যদিও আজ সে প্যান্টের পরিবর্তে ট্রাউজার করেছে। রাহি তার দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। যুবকটাকে উপেক্ষা করে চলে যায় পুলিশ স্টেশন এর ভিতরে।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here