মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-বোনাস_পার্ট।

0
1918

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর।
#বোনাস_পার্ট।

৫০,
কলেজের অনুষ্ঠান শেষে আজ দুদিন হলো কলেজে যায় না মেহের। বেশীর ভাগ সময় সে নিজের রুমের ভিতরে কাটায়। ইদানিং সে রাহিকে খুব মিছ করে কিন্তু মুখে বলে উঠতে পারে না। দ্বিধাবোধ করে সে। সৈয়দা মাহবুবাও আজ বাসায়। ইচ্চে করেই ছুটি কাটিয়েছেন তিনি। কোন কাজে মন বসাতে পারছেন না সৈয়দা মাহবুবা। তার কেন জানি মনে হচ্ছে এক বিশাল ঝড় আসতে চলেছে তাদের জিবনে। ছাদে দাড়িয়ে অতিতের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছেন তিনি। এখন আর কোন কিছুতে পিছ পা হবেন না সৈয়দা মাহবুবা। এখন আর কোন কিছুকে ভয় করেন না তিনি। সমাজের নিয়মের বাইরে গিয়ে সে তার পরিচয় গড়ে তুলেছেন। হয়েছেন একজন সিঙ্গেল মাদার। যাকে সমাজ এখন স্বীকৃতি দিয়েছে। একজন স্বাধীন আত্নপরিচয় সম্পন্ন সু-প্রতিষ্ঠিত নাগরিক হিসাবে। আজ তার নিজেরই একটা পরিচয়। এত কিছু এমনি এমনি হয়নি। সমাজের মানুষের অবহেলা লাঞ্ছিনা আর কটু কথা শুনতে হয়েছে। তবুও সৈয়দা মাহবুবা হাল ছাড়েন নি। সে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়েছেন, মেয়েরা চাইলে সব করতে পারে। একটা চলতে পারে বাচতে পারে। হয়েছেন হাজারো অবহেলিত নারীর অহংকার। যাকে দেখলে অবহেলিত নারীরা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। চসমাটা উচু করে শাড়ির আচল দিয়ে চোখ মুছে নিলেন সৈয়দা মাহবুবা। নিচের দিকে তাকাতেই দেখতে পান রাহনাফকে। রাহনাফকে দেখে বেশ অবাক হোন সৈয়দা মাহবুবা। কেননা রাহনাফ আজ বড় গাড়ি থেকে নামছে। তারপর হাতে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে সদর দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করছে সে। সৈয়দা মাহবুবা ছাদ থেকে মেনে আসেন। বসার ঘরে আসতেই দেখতে পান সেখানে আগ থেকে মৌ আর আলিহান বসে ছিলো। রাহনাফও ওদের সাথে যোগ দেয়। সৈয়দা মাহবুবা গিয়ে মৌ-য়ের পাশে বসেন। মৌ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

– তোমরা কথা বল আমি তোমাদের জন্যে চা করে নিয়ে আসছে।

চলে যেতে নেয় মৌ। তখন পিছন থেকে রাহনাফ বলে উঠে,

– মেহেরকে একটু ডেকে দাও।

মৃদু হাসে মৌ। মাথা নাড়িয়ে চলে যায় সে রান্নাঘর। চুলায় মৃদু আচে গরম পানি বসিয়ে দিয়ে সে চলে যায় মেহেরের রুমে। মেহের বিছানায় উবু হয়ে মোহাম্মাদ জাফর ইকবাল স্যারের, রবন নগরী বইটা পড়ছিল তখনি রুমের মধ্যে আগমন ঘটে মৌ-য়ের। বই পড়ায় মেহেরের মনোযোগ এতটাই যে সে মৌ-য়ের উপস্থিত টের পেলো না। মৌ গিয়ে সোজা মেহেরের উপর শুয়ে পরে তারপর বইটা নিয়ে সে পড়তে থাকে। পড়ার ভান করে আর কি! মেহের বিছানায় শুয়ে পড়ে আর মৌ মেহেরের উপর শুয়ে বই পড়ার ভান করে। এভাবে কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর মেহের একটু উঁচু হয়ে বলে,

– বিয়ের পর তোর ওয়েট বেড়েছে দেখছি। বোন আমার উপর থেকে সরে যা আমি ভর্তা হয়ে যাচ্ছি। করুন সূর মেহেরের।

মৌ কিছু না বলে উঠে বসে। তারপর সে মেহেরকে টেনে তুলে বসিয়ে দেয়। বসতে পেরে মেহের বুকের উপর হাত রেখে বড় বড় করে শ্বাস নেয়। অতঃপর বলে, দিন দিন মুটি হয়ে যাচ্ছিস। বইটা পাশে রাখে মৌ। অতঃপর সে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে,

– আমার কাছ থেকে ট্রেনিং নিতে পারিস।

– কিসের! ভ্রুযুগলে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে প্রশ্ন করে মেহের।

– কিভাবে শুঁটকি টি ভুটকি হওয়া যায়। মৌ আরো কিছু বলতে যাবে তখন মনে পরে সে চা বসিয়ে দিয়ে এসেছে। তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়ায় মৌ। মেহের দিকে তাকিয়ে কোন রকমে বলে, রাহনাফ এসেছে তোকে ডাকছে। তারপর সে চলে যায় রান্নাঘরে। মেহের মৌ-য়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সেও চলে যায় বসার ঘরে।

বসার ঘরে মাদুর পেতে তার চারিপাশে বসে আছে সবাই। রাহনাফ মাদুরের উপর একটা নকশা রাখে। আলিহান সুধায় এটা কিসের নকশা। দেখে মনে হচ্ছে কোন প্রোপার্টির! আলিহান নকশাটা হাতে নিয়ে ভালো করে খুটিয়ে নাটিয়ে দেখে নেয়। নকশাটা দেখা শেষ হলে সে অবাক চোখে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,

– এই নকশাটা তোর কাছে কি করে? তুই জানিস এটা নিয়ে কত ঝামেলা চলছে। কিছুূদিন আগেও খান আর শিকদার পরিবারের সাথে এই জমি নিয়ে ঝামেলা করে দুই পক্ষের মাঝে সংঘর্ষ হয়। সেখানে খান পরিবারের একজন আহত হয়।

– হ্যাঁ জানি আমি। এই জমির প্রকৃত মালিক আরওয়ান শিকদার মানে আমার বাবা। আমার বাবার অনুপস্থিতিতে এটা খান পরিবার দখল করে চাইছিলো। তাই এত ঝামেলা। এখন এই জমির অংশীদার আমি। আমি এখানে একটা এনজিও গড়ে তুলতে চাই সেইজন্য এখানে আসা। আন্টি আপনি অনুমিত দিলে আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।

সৈয়দা মাহবুবা আলিহানের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার রাহনাফের দিকে তাকায় অতঃপর বলে,

– কি বলতে চাও বলো।

– আন্টি আমি এই জমিতে women Association in Bangladesh [WAB] নামে একটা সংস্থা গড়তে চাই। যে সংস্থান সভাপতি হবেন আপনি। আন্টি আপনি আমার দেখা একটা ideal woman. যার কাছ থেকে প্রত্যেকটা নারীর কিছু না কিছু শিখার আছে। সমাজ রাষ্ট্র এবং পরিবারের অবহেলিত নারী গুলো আপনাকে অনুসরণ অনুকরণ করে বড় হোক। আন্টি আপনি একজন সাকসেসফুল নারী। যার জীবনের গল্প শুনলে হয়তো প্রত্যেকটা অবহেলিত নারী নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখবে।

সৈয়দা মাহবুবা অবাক হয়ে রাহনাফের বলা কথাগুলো শুনছে। তিনি কিছু বলার আগে পাশ থেকে মেহের বলে উঠে,

– এটি কি ধরনের সংস্থা।

সকল ধরনের বৈষম্যমুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা, যেখানে কোন নারী পেছনে পড়ে থাকবে না। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সংস্থাটি যে মিশন বা অভীষ্ট অবলম্বন করবে তা হলো, সমাজ রূপান্তরের চালিকাশক্তি ও পরিবর্তনের কারিগর হিসেবে নারীর সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে সকল ক্ষেত্রে তাদের সম্পৃক্ত করা। [WAB] বৈষম্যহীনতা, বৈচিত্র্যময়তা ও ধর্মনিরপেক্ষতা সংস্থার সকল কর্মকাণ্ডে এই তিনটি দিক অনুসরণ করবে। প্রধান কর্মসূচি চারটি, যার আওতায় তার যাবতীয় প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হয়। এগুলো হলো ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, নীতি সংস্কার ও গণউদ্যোগ। এভাবেই এগিয়ে যাবে আমাদের সংস্থা।

তারপর রাহনাফ আরো কয়েকটা জমির নকশা দেখায় যেখানে সে তার বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য একটা আশ্রম খুলতে চাই। আহনাফের কর্মকাণ্ড ও তার উদ্যোগে সকালে তার জন্য প্রাউড ফিল করে। মেহের মনে তার জন্যে সম্মানটা আরো দ্বিগুণ বেড়ে যায়। সকল আলোচনা সেরে সবাই একসাথে লাঞ্চ করতে বসে। আর তখনি মৌ খাবার সামনে গিয়ে গলগল করে বমি করে দেয়। আলিহান উঠে মৌ-কে ধরে তাদের রুমে নিয়ে যায়। রাহনাফ ও আলিহানের পিছু যায় যদি ওদের কিছু প্রয়োজন হয়। সৈয়দা মাহবুবা সেই জায়গাটা পরিষ্কার করতে তাকে মেহের তাকে সাহায্য করতে চাইলে সে মেহেরকেও মৌ-য়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

বমি করে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মাথাটা ঝিমঝিম করছে অস্থির লাগছে তার। ডক্টর কে কল করে আলিহান। মিনিট বিশেক এরমধ্যে ডক্টর চলে আসে এবং মৌকে চেকআপ করে দেখে নেয়। তারপর সে আলিহানের সামনে গিয়ে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়, অতঃপর বলে

– কনগ্রেচুলেশন মিস্টার আলিহান। আপনি বাবা হতে চলেছেন।

ডাক্তারের কথাশুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় আলিহান। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে মৌ-য়ের দিকে। মৌয়ের চোখে অশ্রুর ভিড়। তবে এই অশ্রু দুঃখের নয় আনন্দের, আনন্দ অশ্রু এটা! রাহনাফ গিয়ে আলিহান কে জড়িয়ে ধরে তারপর তার পিঠে হাত বুলিয়ে কংগ্রেজুলেশন জানায়। আলিহান কোন প্রতিক্রিয়া করে না। সে আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে মৌ-য়ের মুখ পানে। রাহনাফ আলিহানকে ছেড়ে দিয়ে ডক্টরকে এগিয়ে দিতে যায়। মেহের ওদের স্পেস দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। সবাই চলে যাওয়ার পর আলিহান ধীর পায়ে মৌ য়ের পাশে বসে গিয়ে। মৌ আবেশে তার চোখদুটি বন্ধ করে নেয়। আলিহান মৌ-য়ের এক হাত তার হাতের মুষ্ঠিতে আবদ্ধ করে নিয়ে অন্যহাত মৌ-য়ের গালে রাখে। চোখ মেলে তাকায় মৌ। আলিহান বলে উঠে,

– সবকিছু কেমন স্বপ্নের মত লাগছে। আচ্ছা ঘুম ভেঙে গেলে সব আবার আগের মত হয়ে যাবে তাইনা মৌ। মৌ আমি ঘুমাতে চাই, স্বপ্ন দেখতে চাই। আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিও না মৌ।

– আলিহান, আলিহান এটা স্বপ্ন নয় সত্যিই। তুমি বাবা হতে চলেছ আর আমি মা।

আলিহান মৌ-য়ের পেটের উপর হাত রেখে সেই হাতে আলতো করে চুমু খায়। স্মিত হাসে মৌ। আলিহান মৌ-য়ের পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। মৌ আলিহানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকে। আর আলিহান মৌ-য়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here