মোহঘোর”পর্বঃ১৬

0
609

#মোহঘোর
#পর্বঃ১৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

গত এক সপ্তাহের হিসাব সংরক্ষণ বই খতিয়ে দেখছে ইনজাদ। ব্যস্ত ভঙ্গিতে পাতা উলটিয়ে যাচ্ছে। তার জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করা আছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের একপাশে বসে নিজের কাজে মনোযোগী সে। থাই গ্লাসের অস্পষ্ট আওয়াজে চকিতে চোখ তুলল ইনজাদ। ছোট্ট, গোলগাল মুখের তিমন থাই স্লাইড করে মাথা ঢোকাল। অনুরক্তির সুরে বলল—

“স্যার আসব?”

ইনজাদ নীরব সম্মতি দিলো। ছোটো ছোটো পায়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে প্রবেশ করল তিমন। ইনজাদ প্রশ্ন ছুড়ল—

“কিছু বলবে?”

“হুম।”

“কি?”

“আমাকে একটু যেতে হবে স্যার।”

ইনজাদ দেয়াল ঘড়িতে তাকাল। ভ্রূ কুঞ্চি করে বলল—

“এখনো তো চারটা বাজেনি!”

“আমার একটু দরকার ছিল স্যার। গতকাল মানান স্যারকে জানিয়ে ছিলাম।”

“আচ্ছা যাও। যাওয়ার আগে সাইন করে যেয়ো। আর কাল ঠিক সময় মতো চলে এসো।”

“জি স্যার।”

ইনজাদের সম্মতি পেয়ে দেরি করল না তিমন। চলার গতি বাড়িয়ে বেরিয়ে এলো। বিকেল চারটা পর্যন্ত প্রথম শিফট। কিন্তু তিমন জরুরি প্রয়োজনে আগেই যেতে চাইছে।
নিজের কাজে মনোনিবেশ করে ইনজাদ। গত এক সপ্তাহের লাভ-ক্ষতির হিসেব কষছে সে। বিরক্তি এলো নাকের ডগায়। বেসুরে বেজে উঠল মোবাইল ফোন। ইনজাদ দৃষ্টি আবদ্ধ করল। পারভেজ মির্জা কল করেছেন। প্রশান্তি নেমে এলো ইনজাদের চোখের পাতায়। বদ্ধ অন্তঃকরণে হিমেল হাওয়া বইল। কল রিসিভ করেই দাঁড়াল বদ্ধ কাঁচের জানালার কাছে।

“আসসালামু আলাইকুম,বাবা। কেমন আছ?”

পারভেজ মির্জা সহজ গলায় বললেন—

“ভালো। তুই কেমন আছিস?”

“ভালো। আম্মার কী খবর? মামা-মামি চলে গেছে?”

“হ্যাঁ। আজ সকালেই চলে গেছে ওরা।”

ইনজাদ ভড়কাল। তমালিকার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। কান থেকে মোবাইল সরিয়ে তাকে শান্ত হওয়ার আহ্বান করছেন পারভেজ মির্জা। কিন্তু হিতে বিপরীত। আরো জোরে চিৎকার করছেন তিনি। চিন্তিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে ইনজাদ—

“কী হয়েছে বাবা? আম্মা চিল্লাছে কেন?”

পারভেজ মির্জা সময় নিলেন। কণ্ঠে মলিনতা। রয়ে সয়ে বললেন—

“একটা কথা বলার ছিল তোকে।”

ইনজাদ কণ্ঠের অস্বাভাবিকতা বুঝতে পেরে বলল—

” কী হয়েছে বাবা? এমন করে কথা বলছ কেন? আর তুমি কবে থেকে পারমিশন নিতে অভ্যস্থ হলে আমার কাছ থেকে। ছেলে হই তোমার।”

পারভেজ মির্জা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলেন। ইনজাদ চতুর গলায় বলল—

“রতন আবার এসেছিল? ঝামেলা করেছে কোনো?”

“না, ওকে তোর মামা-ই সাবধান করে দিয়েছে।”

“তবে..?”

“আসলে পাড়ার লোকেরা কীসব বলাবলি করছে। আর রতনও সেদিন কীসব বলে গেল!”

ইনজাদ ব্যস্ত হয়। পেলব ললাটে ভাঁজ ফুটে ওঠে। চোয়ালের পেশি শক্ত হয়। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হয় অচিরেই। গাঢ় গলায় বলল—

“প্লিজ বাবা, কী হয়েছে খুলে বলো।”

পারভেজ মির্জা গাঢ় শ্বাস ফেললেন। উত্তুরে শীতল হাওয়ার স্পর্শের মতো জারকাটা দিয়ে উঠল তার শরীর। তমালিকার ভৎসনা বন্ধ হলো না। দ্বিগুন বেগে উগড়ে দিচ্ছেন তিনি। পারভেজ মির্জা শ্রান্ত সুরে বললেন—

“সবাই বলাবলি করছে কয়েক বছর আগে না কী এহসাসকে রেহাংশীর জন্য জেলে দিয়েছিল জুলহাস খন্দকার।”

থমকে গেল ইনজাদের পৃথিবী। ধূসর আঁধার নেমে এলো তার চোখের সামনে। শরীরের নিম্নাংশ স্থবির হয়ে এলো। মানান ঢুকল চট করে। ইনজাদকে লক্ষ্য করে কিছু একটা বলল। কিন্তু তা কর্ণকুহর হলো না তার। হাতের ইশারায় যেতে বলল ইনজাদ। পারভেজ মির্জা আরও বললেন—

“সবার ধারণা রেহাংশীর সাথেই…। আমার তা মনে হয় না। মেয়েটাকে আমি যতদূর চিনেছি ও এমন কাজ করতে পারে না।”

“তুমি খন্দকার সাহেবের সাথে কথা বলেছ?”

“না। তিনি অসুস্থ। নুপূরকে নিয়ে যাওয়ার দিন প্রচুর ঝামেলা করে মামুন। হাতাহাতির এক পর্যায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হোন খন্দকার সাহেব। আর এমনিতে তারা আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে অপারগ। মিসেস খন্দকার এই সম্পর্কে একটুও খুশি নন।”

ইনজাদ ঘামতে শুরু করল। এসির শীতলতা তার ভেতরকার উষ্ণতা কমাতে পারছে না। লাইন কেটে দিয়ে চেয়ারে বসল। সামনে থাকা শোকেসে তাকাতে নিজের বিধ্বস্ত চেহারাটা দৃষ্টিগোচর হলো তার। আর ভাবতে পারছে না ইনজাদ। রেহাংশীর জীবনে সে প্রথম পুরুষ নয়?
,
,
,
গাঢ় আঁধার। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো আপন মহিমায় জ্বলছে। গভীর রাত। বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল কমে গিয়েছে। তবুও শহরের রাস্তা কোলাহলপূর্ণ। পবনে মিশ্রিত কালো ধোঁয়া। তূরন্ত বেগে ছুটে চলা গাড়ি। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গুটিকতক মানুষ। গলির মোড়ে ঢুকতেই শান্ত হলো সব। সিএনজি থেকে নেমে দাঁড়াল ইনজাদ। ভাড়া মিটিয়ে গেইটে আওয়াজ করল।

ঘুমে ঢুলঢুলে অবস্থা দাড়োয়ানের। দরজা খুলেই ঘুমন্ত হাসল। ইনজাদ কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। দাড়োয়ান ইদ্রিস চমকিত হলেন। হাসি লেগে থাকা ছেলেটার হাসি আজ হারিয়ে গেল কেন?

বিধ্বস্ত, বিমর্ষ পায়ে সিঁড়ি বাইছে ইনজাদ। কলিং বেল চাপতেই দ্রুতহস্তে দরজা খুলে রেহাংশী। মুখভর্তি হাসির ঝলক। চোখের কোটরে সায়রভরা খুশি। ইনজাদ গম্ভীর মুখেই ভেতরে ঢুকল। ন্যাওটা বাচ্চাদের মতো দরজা লাগিয়ে ইনজাদের পেছন পেছন পা বাড়াল রেহাংশী। প্রফুল্ল গলায় বলল—

“আজ এত দেরি করলেন কেন? বিকেলে কতবার ফোন করলাম, একবারও ধরেননি। আবার ফোনও করেননি। আজকে বুঝি খুব ব্যস্ত ছিলেন?”

ইনজাদ কথা বলল না। বুকের ভেতর দামামা বাজছে। মাথাটা টনটন করছে। বিষিয়ে উঠছে সব। রেহাংশীর হাসির ফোয়ারা থামল না। বরঞ্চ বাড়ল। আহ্লাদী গলায় বলল—

“আজ আমি একটা জিনিস রান্না করেছি। আপনার খেতে খুব ভালো লাগবে।”

ইনজাদ শার্টটা খুলেই ছুড়ে মারে। হকচকিয়ে যায় রেহাংশী। এক নিমিষে বুকটা কেঁপে উঠল তার। ভয়জড়িত গলায় বলল—

“কী হয়েছে আপনার? কথা বলছেন না কেন?”

ইনজাদ বিছানায় বসল। রক্তিম চোখ জোড়া ছড়িয়ে কর্কশ স্বরে বলল—

“এহসাসের সাথে তোমার কীসের সম্পর্ক?”

থম মেরে যায় রেহাংশী। গা কাটা দিয়ে উঠে তার। কাঁপন শুরু হয় দেহে। আচানক কণ্ঠে বিস্তার করে ঊষরতা। ইনজাদ গাঢ় গলায় ফের বলল—

“কথা বলছ না কেন? কী সম্পর্ক তোমার এহসাসের সাথে? কেন এসেছিল সে মৃধার বিয়েতে তোমার সাথে দেখা করতে?”

রেহাংশী অটল রইল। তার নেত্র সিক্ত হলো নোনা জলে। কলিজা লাফিয়ে যাচ্ছে। চিনচিন ব্যথা হচ্ছে বুকের ভেতর। ইনজাদ গর্জে ওঠে। দারাজ গলায় চিৎকার করে বলল—

“কথা যাচ্ছে না তোমার কানে? কথা বলছ না কেন? কী সম্পর্ক তোমার ওর সাথে? কেন এসেছিল ও?”

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে রেহাংশী। বুকশেল্ফের সাথে সেদিয়ে রইল। ইনজাদের রাগ বাড়ল দ্বিগুন হারে। টেবিলে থাকা বাটি ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। চেয়ারে বসাল এক ভয়াল লাথি। ছোট্ট কক্ষটায় জায়গা কম। সবকিছু গিয়ে পড়ল রেহাংশীর পায়ের কাছে। শখ করে স্বামীর জন্য পায়েস রান্না করেছিল। এখন তা গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝের বুকে। বুক কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে রেহাংশী। গলা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। এই ছিল তার কপালে। ইনজাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। এই মেয়ে কথা বলবে না! বলতে ওকে হবেই। ক্রোধে বিহ্বল হয়ে বলে উঠে ইনজাদ—

“কথা বলছ না কেন তুমি? কী করেছ তুমি ওর সাথে? ধোঁকা দেওয়ার জন্য আর কাউকে পেলে না? লজ্জা করছে না তোমার? সবগুলো বোন একই রকম। কেউ কারো চেয়ে কম না। ওরা তো ভালো অন্তত সত্যি বলছে। তুমি তো জঘন্য। একজনের সাথে তামাশা করে আবার আমাকে বিয়ে করেছ। ছিঃ!।”

রেহাংশী ফুঁসলে ওঠল। চোখ ভর্তি জলস্রোত বইয়ে বলল—

“চুপ করুন। কী বলছেন এসব আপনি?”

ইনজাদ তেড়ে গিয়ে সজোরে চেপে ধরে রেহাংশীর বাজু। আর্ত গলায় বলে উঠে রেহাংশী—

“আহ! ছাড়ুন। লাগছে আমার।”

রাগে থরথর করে কাঁপছে ইনজাদের বলিষ্ঠ দেহ। ফোঁস ফোঁস করছে সে।

“আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও তুমি?”

“দেবো না। ভাঙচুর কেন করছেন আপনি? এত রাগ কেন দেখাচ্ছেন? শুধু আমার ওপর সবাই রাগ করতে পারেন। দুর্বল নই আমি। অবুঝ নই। ছাড়ুন আমাকে।”

ইনজাদ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় রেহাংশী। নিজের স্বামীকে এখন আহত কোনো বাঘ মনে হচ্ছে তার। এত ভালোবাসাপূর্ণ, নরম মানুষ এতটা ভয়ংকর কী করে হয়! রেহাংশী কান্না গিলে নিল। সরব গলায় বলল—

“কোনো সম্পর্ক নেই আমার, কোনো সম্পর্ক নেই। কিচ্ছু করিনি আমি। সেদিন আমার সাথে নয় নুপূর আপুর সাথে দেখা করতে এসেছিল এহসাস ভাইয়া। কিন্তু ধরা পড়তেই আমার ওপর সব দোষ চাপিয়ে দিলো। কেউ শুনল না আমার কথা। বড়ো আম্মু দুই দিন আমাকে ঘরে আটকে রাখল, খেতে দিলো না পর্যন্ত। কেন? কী করেছি আমি? আমি অনাথ তাই? আমার কেউ নেই তাই সব আমাকেই সহ্য করতে হবে?”

ডুকরে উঠে রেহাংশী। শ্বাস থমকে যায় ইনজাদের। কী বলছে এই মেয়ে? ব্যথাতুর গলায় ডেকে ঊঠে—

“রেহাংশী!”

রেহাংশী কান্না দলিত কণ্ঠে বলল—

“আমি-ই এহসাস ভাইয়াকে খবর দিয়েছি নুহাশ ভাইয়াকে বলে। কেন দেবো না! বিবাহিত হয়েও আবার বিয়ে করতে এসেছে। হ্যাঁ, ইচ্ছে করেই করেছি সবকিছু আমি। কেন করব না? সেদিন কেন সব দোষ আমার ওপর চাপিয়ে দিলো? যখন আমি কিছুই করিনি। কেন দিলো?
হ্যাঁ, খারাপ আমি। সত্যিই খারাপ। নিন আপনার আংটি।”

সেই লুকোনো আংটি ছুড়ে মারে ইনজাদের দিকে। সে অবাক চোখে চেয়ে বলল—

“এটা কোথায় পেলে তুমি?”

“আমি সরিয়েছি। তবুও তো আপনি চুড়ি পড়িয়েছেন তাকে। এতই যখন তাকে পছন্দ কেন বিয়ে করলেন আমায়?”

নিরস্ত্র সৈনিকের মতো ভেঙে পড়ল ইনজাদ। শ্বাস ভারী করে বলল—

“রেহাংশী আমার কথা শোনো।”

“না, কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।”

অসহনীয় শ্বাস ফেলে ইনজাদ। নাকের পাল্লা ওঠানামা করছে। চোখে কাতরতা। বুকে অসহায়ত্ব। হৃদয়ভেদী স্বরে বলল—

“আই এম রিয়েলী সরি রেহাংশী। জান আমার কথা শোনো প্লিজ।”

ইনজাদ এগিয়ে যেতে ঝাঁঝিয়ে উঠে রেহাংশী। হুংকার ছেড়ে বলল—

“একদম ছোবেন না আমাকে। আমার কাছে আসবেন না।”

ইনজাদ ক্ষীণ গলায় বলল—

“একটু বোঝার চেষ্টা করো। বললাম তো সরি। প্লিজ বিষবাণ! এমন কোরো না প্লিজ।”

“না, আপনারা সব পুরুষ এক। শুধু নারীরাই কেন দোষী হয়? কেন সব দোষ নারীদের?”

রেহাংশী থামল না। বাতাস ভারী করে তুলল সে। ইনজাদ ভীতসন্ত্রস্ত। মেয়েটা কাঁদছে আর তার ভেতরটা মুছড়ে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে বুকের পাটা, ছিড়ে যাচ্ছে কলিজা, ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে হৃৎপিন্ড। সহ্য করতে পারছে না ইনজাদ। এ কেমন মোহঘোর! না কী সত্যিই ভালোবাসা!
আচানক গা গুলিয়ে উঠে রেহাংশীর। শরীরের সর্বত্র ঝিমুনি দিয়ে ওয়াশরুমে ছুট লাগায়। ঘোলা চোখে ওয়াশরুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় ইনজাদ। ডেকে উঠল—

“রেহাংশী! রেহাংশী! ঠিক আছ তুমি?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here