#মোহঘোর
#পর্বঃ১৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
এক নতুন দিনের নরম, স্নিগ্ধ, মায়াময় প্রভাত। জানালার পর্দা দুলে যাচ্ছে নির্মল, শুদ্ধ, তরল প্রভঞ্জনে। শুভ্র অম্বুরের ছাতি ফুড়ে জেগে ওঠা সূর্যের মিহি, কোমল রোদ চুক চুক করে বিছানার পাটাতন ছুঁইছে নিজের মহিমায়। উপুর হয়ে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন ইনজাদ। ঘাড় ঘুরাতেই হলদে রোদের আভায় ঝিলিক মেরে উঠে চোখের বদ্ধ পাতা। ইনজাদ চক্ষুচ্ছেদ উন্মুক্ত করল। চোখের মনিতে হানা দিলো রৌদ্রাণী। ইনজাদ ক্লান্ত হাসল। চিৎ হয়ে কপালের ওপর আড়াআড়িভাবে হাত রাখল। চোখ ঢেকে গেল তাতে। হাতটা হালকা সরিয়ে চোখে বুলালো পুরো কক্ষে। বিতৃষ্ণা হলো অন্তরিন্দ্রিয়। চট করে উঠে বসল ইনজাদ। শুষ্ক অধরে শ্রান্ত হাসি। সময় প্রহরী তাকিয়ে তাকে ইশারা করছে। ঘুম থেকে ওঠার সময় হয়েছে।
হাত-মুখে ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয় ইনজাদ। মেয়েটা এখনো রুমে আসেনি। উন্মুক্ত বুকে হাহাকার। প্রেয়সী বড্ড পাষান, বোঝে না হৃদয়ের টান!
ধীরেসুস্থে কক্ষ থেকে বের হতেই রান্নাঘর থেকে ক্ষীণ শব্দ শ্রবণ করে ইনজাদ। তাই চলার পথ পালটে রান্নাঘরের চৌকাঠে এসে উঁকি দেয়। রেহাংশী চুলোয় ব্যস্ত। এই একটা কাজে মেয়েটা কখনো আলসেমি করে না। রেহাংশী অবগত হলো না। তার অগোচরেই দুটো মুগ্ধ, নেশাক্ত চোখ তাকে নিগূঢ়ভাবে দেখছে। তার সরু, মেদহীন কোমরে নোনতা জলের বিলাস। পিষ্ঠদেশের স্মিত দরিয়ায় ডুবতে ইচ্ছে হলো ইনজাদের। তার নেশাক্ত চোখ জোড়া বুঁদ হয়ে গেলো গভীর,অতলস্পর্শী প্রেমসায়রে। কাজের ব্যগ্রতা দেহভঙ্গিমা বদলাচ্ছে রেহাংশী। তার সুক্ষ্ম অপ্রকৃতিস্থ ভঙ্গিমা পলে পলে ঝড় তুলছে ইনজাদের পুরুষ মনে। রান্নাঘরের ভেতরে পা রেখে থমকে যায় ইনজাদ। কিছু একটা ভেবে পেছন ফিরতেই রেহাংশীর মনে হলো কারো উপস্থিতি তার চারপাশে। দরজার দিকে তাকাতেই ইনজাদ চলে যাওয়ার ঈষৎ দৃশ্যই তার চোখের মনিতে ধরা দেয়। গরম তাওয়ায় পরোটা ভেজে প্লেটে রাখল রেহাংশী।
,
,
,
মেহমাদের কক্ষের দরজা ভেজানো। ইনজাদ ভেতরে প্রবেশ করেই বুঝতে পারল মেহমাদ ওয়াশরুমে। পানি পড়ার আওয়াজ হানা দিচ্ছে তার কর্ণরন্ধ্রে। বিছানার ওপর একটা মেরুন রঙের পোলোশার্ট রাখা। ইনজাদ বাঁকা হাসল। রঙ দেখেই বুঝে গেল তিয়া গিফ্ট করেছে মেহমাদকে। তার উন্মুক্ত গায়ে গলিয়ে নিল তা। মেহমাদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই হকচকিয়ে গেল। চক্ষু গরম করে বলল—
“তুই আমার গেঞ্জি পড়লি কেন? খোল, খোল বলছি।”
ইনজাদের সাথে হাতাপায়ি শুরু করে মেহমাদ। ইনজাদ হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। প্রায় গলা পর্যন্ত উঠিয়ে ফেলা পোলোশার্টটা ইনজাদ নিজেই খুলে ছুড়ে মারে বিছানায়। মেদমাদ দাঁত-মুখ খিঁচে বলল—
“কী শুরু করলি তুই? তিয়া আমাকে জানে মেরে ফেলবে।”
ইনজাদ হাসতে হাসতে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ে। মাথার নিচে হাত দিয়ে বলল—
“তোর চেয়ে আমাকে মানায় ভালো।”
চোখ পাকালো মেহমাদ। পরম যত্নে পোলোশার্টটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দুঃখ বিলাস করে বলল—
“গেঞ্জিটার কী অবস্থা করেছিস তুই!”
ইনজাদ খলখলিয়ে হাসে। মেহমাদ চটজলদি জামাটা পরে নেয়। তৎক্ষণাৎ মুঠোফোন বেজে উঠে তার। স্ক্রিনে তিয়ার নাম দেখেই বুক ধড়ফড় শুরু করে মেহমাদের। রিসিভ করেই বলল—
“বাবু, পাখি আমার, জাস্ট টু মিনিট।”
ওপাশের রমণীর বলা কথা শুনল না ইনজাদ। তবে তার বুঝতে অসুবিধা হলো না। মেহমাদ তিরিক্ষি স্বরে বলল—
“আরে আমি কী দিয়েছি না কি! ওই ই পরে নিল।”
টুট করে কেটে গেলে লাইন। ইনজাদের মেঝে স্পর্শ করা ঝোলান পায়ে লাথি বসাল মেহমাদ। বাজখাই গলায় বলল—
“তোকে কতবার বলেছি না তিয়ার দেওয়া কিছু পরবি না। শালা তুই আবার সেল্ফি পাঠিয়েছিস ওকে!”
ইনজাদ একটু উঁচু হয়ে কাত হলো। কনুইয়ে ভর দিয়ে তালুতে মাথা রেখে বলল—-
“কেন, তোর ললিপপের সমস্যা কী?”
আরেকটা লাথি মারল মেহমাদ। তা বিছানার বোর্ডের সাথে লাগল। কথা বলার সময় নেই। কোনোমতে চুলে ব্যাক ব্রাশ করে মোবাইল আর ওয়ালেট নিয়ে হাঁটা ধরল। আর শাসালো ইনজাদকে।
“রাতে এসে যদি তোর সুখের ঘরের আগুনে ঘি না ঢেলেছি আমি…। মনে রাখিস।”
ইনজাদ খলখল করে হেসে বলল—
“তার আগেই আগুন নেভাবো আমি। যা ভাগ।”
হনহন করে ছুটতে লাগল মেহমাদ। মাথাটা পূনরায় বিচানায় ফেলল ইনজাদ। তার বিষবাণের আজ রাগ ভাঙাতে হবে। এভাবে আর থাকা যাবে না।
,
,
,
কাউকে বিরক্ত করার উত্তম উপায় হলো তার দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে অপ্রস্তুত করা। তা ভালোভাবে সিদ্ধ করেছে ইনজাদ। অনিমেষ চেয়ে আছে রেহাংশীর দিকে। নিজেকে একটু নাড়াতেও যেন দশবার ভাবতে হচ্ছে মেয়েটাকে। ইনজাদ প্রস্ফুটিত চাহনির সাথে চোরা হাসছে। বিরক্ত রেহাংশী। কিছু বলতেও পারছে না। ইনজাদ দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরের তাকের সাথে হেলান দিয়ে। বুকে হাত ভাঁজ করে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে। রেহাংশীর শরীরে নিগূঢ় কাঁপন। তিরতির করছে ওষ্ঠাধর। ইনজাদ মুচকি হাসল। বুক থেকে হাত নামিয়ে একটু একটু করে রেহাংশীর পাশে এসে দাঁড়াল। ভেতর কম্পনে ধরাশায়ী অবস্থা রেহাংশীর। মানুষটা এত কাছে আসলো কেন?
রেহাংশী পাশ ফিরতেই তার সামনে পাহাড়ের মতো দাঁড়াল ইনজাদ। সে চোখ তুলল না। সরে এলো।পূনরায় পথ আটকালো ইনজাদ। রেহাংশীর শ্বাস দীর্ঘ হচ্ছে। তার মুখের দিকে চাইল ইনজাদ।গহন, স্থির,প্রশস্ত চাহনি। নিচু হলো সে। হুট করেই বলল—
“ও চুপকথা! কেন বাড়াও বুকের ব্যথা?”
রেহাংশী থামল। স্থির দৃষ্টির পাতা উঁচু করে তাকাল ইনজাদের দিকে। ইনজাদের তপ্ত শ্বাস আছড়ে পড়ছে তার নাকের ডগায়। ইনজাদ কথা বলল।
“প্লিজ বিষবাণ! এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।”
কোনোরূপ ভাবাবেশ ছাড়াই রেহাংশী তার পিঠ বাকালে তাকে জড়িয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে ইনজাদ। হৃৎকম্পন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল রেহাংশী। ইনজাদ বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করল তাকে। হাত খোপা করায় পিঠের বাঁক অনাবৃত। ইনজাদ মিহি স্পর্শে কাতর করে রেহাংশীকে। ঘোরগ্রস্ত গলায় বলল—
“প্লিজ কথা বলো রেহাংশী। আর সম্ভব না আমার পক্ষে। প্লিজ!”
রেহাংশী কথা বলল না। কম্পিত দেহের ভাঁজে ভাঁজে স্বামীর আদুরে ছোঁয়ারা আন্দোলন শুরু করেছে। ইনজাদ ঠোঁট ছোঁয়াল, ঘ্রাণেন্দ্রিয়ওর ঘর্ষণে কাতরতা বাড়ালো রেহাংশীর। রেহাংশী নরম হয়ে আসছে। নেতিয়ে যাচ্ছে তার চঞ্চল দেহ। তবে মুখে কোনো শব্দ করল না। আলগোছে ইনজাদের বন্ধন থেকে নিজেকে আলগা করে চুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ইনজাদ কোমল গলায় বলল—
“কেন এমন করছ তুমি? স্বামী হয়ে কী একটা প্রশ্ন করার অধিকার নেই আমার?”
ভারাক্রান্ত মনে প্রশ্ন জাগে রেহাংশীর। প্রশ্ন! প্রশ্ন তো করেনি। সন্দেহ করেছে তাকে। আঙুল তুলেছে তার চরিত্রে। রেহাংশীর নীরবতায় ফাটল ধরাল ইনজাদ। ভার গলায় বলল—
“আমি বুঝতে পারছি না। এসব কেন করছ তুমি? আজ কতগুলো দিন হলো রেহাংশী! কতবার সরি বলেছি তোমাকে। কতবার নিজের ভুলের স্বীকারোক্তি দিয়েছি। আর তুমি?”
রেহাংশী টাইলস করা তাকের ওপর নক ঘষে যাচ্ছে।ভয়ে তার বুক কাঁপছে। তাকাতে পারছে না সে। ইনজাদ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালো। ধাম করে কষে লাথি মারল দেয়ালে সাথে রাখা প্লাস্টিকের তাকে। ঝপাৎ করে তা নিচে পড়ে আলু, পিয়াজ সহ আরো বিভিন্ন মসলা বিক্ষিপ্ত হয়। রেহাংশী স্থির, নিশ্চল, নীরব। ইনজাদ চোয়াল ভারী করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল—
“আসলে ভুলটা আমারই। ভালো তো আমি তোমাকে বেসেছি। তুমি শুধু কর্তব্য পালন করেছে। স্বামীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শুধু স্ত্রী হওয়ার দায়িত্ব পালন করেছ, প্রেয়সী হতে পারোনি। ভালোবেসে নির্ঘুম রাত আমি কাটিয়েছি, নীরব দহনে জ্বলেছি আমি। ওকে, তবে তাই হোক। তোমার জেদের জয় হোক, হোক পরাজয় আমার ভালোবাসার। কিন্তু মনে রেখো, ভালোবাসার পরাজয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। ”
ইনজাদ চলে গেল। দরজার ধরাম আওয়াজে কেঁপে উঠল রেহাংশী। সচকিত চোখে তাকাল। এলোমেলো জিনিসগুলোর মাঝে রক্তের ছোপ। আঁতকে উঠে রেহাংশী। দ্রুত পা চালিয়ে দরজার কাছে আসে। ইনজাদের পা কেটে রক্ত ঝরেছে। দরজা খুলে বাইরে তাকাল। গলা কাঁপল তার। চোখের পাল্লা ভারী হলো। দরজার কাছে রক্তের ছোপ। মানুষটার পা কেটে গেল! যন্ত্রনা হচ্ছে! তীব্র, তীক্ষ্ম, সূচালো যন্ত্রণা !
চলবে,,,
(বি.দ্র:
দুঃখিত, পর্ব ডিলেট হয়ে গিয়েছিল। তাই আবার পোস্ট।)