#মোহঘোর
#পর্বঃ২৩
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
তপ্ত রোদের বিভীষিকায় ক্লান্ত যান্ত্রিক নগরী। নাভিশ্বাস উঠা যন্ত্র মানবদের নিরন্তর পথচলা। দগ্ধ রোদে ঘাম জড়িয়ে পিচঢালা সরু পথে হুলস্থুল অবস্থা। পথের ধারে ঝুড়ি পেতে বসা বিক্রেতা। খদ্দেরের আশায় বুক পেতে থাকা। কোলাহলে জর্জরিত পড়ন্ত বিকেলের ঝিমুনি ধরা পরিবেশ। এই যান্ত্রিক শহরে কেউ কারো নয়। নিজেতে মশগুল সবাই। বিবস্নানের ম্লান আলোকচ্ছাটাও পৌঢ়া তেজ। তা অবলীলায় বিধ্বস্ত করছে জনজীবন। ডাসা ডাসা চোখ মেলে চেয়ে আছে রেহাংশী। অপরিচিত, অজানা শহর ঢাকাকে দেখছে গাঢ় চাহনিতে। জ্যাম লেগে আছে মিনেট পাঁচেক ধরে। হালকা টান লেগে আবার স্তব্ধ রিকশার তিন চাকা। ইনজাদের কাঁধের দিকে মাথা হেলিয়ে আস্বাদন করছে শহুরে কালো ধোঁয়ার মিশ্রিত মলয়ের তীক্ষ্ম গন্ধ। গাড়ির হর্ণ, তেল পুড়ানো ধোঁয়া, মানুষের হট্টগোল, সব মিলিয়ে এক ব্যস্ত, কর্মমুখর শহর। রেহাংশী অবলীলায় চোখ মেলে তা দেখছে। আর ভাবছে তার শান্ত, স্নিগ্ধ, ভালোবাসায়পূর্ণ গ্রামের বাড়ির সেই আধপাকা মেঠোপথ, ধান গাছের ডগার ঢেউ, বিস্তৃত নদীর বুকে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ হলদে রোদের ঝিলিক, গাছের ডালে বসে থাকা ডাহুক পাখি, জানালার পাশে বেড়ে ওঠা সেই মস্ত আমগাছ, ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতে পাওয়া সেই সুপারি আর তাল গাছের সারি। কিছুই নেই শহরের এই যন্ত্র মানবদের পরিবেশে। শ্বাস নিতেও যেন মেপে নিতে হয়। বিষাক্ত ধূলিকণা, গ্যাস কমিয়ে আনে জীবশ্বাস।
মাথার ওপর আস্ত নীলাভ আকাশ। রেহাংশী সেই দিকে পূর্ণ নজর ক্ষেপন করল। নীলাভ নভোলোকের মাঝে গুচ্ছ গুচ্ছ শুভ্র জলদ। রেহাংশী হালকা মাথাটা নিচু করে পশ্চিমাদেশে তাকাল। কোথাও শুভ্রতার মায়া নেই। তার একটু ওপরে নীলাভের ভাঁজে ভাঁজে সেজে আছে শুভ্র মেঘ। একদম সমান্তরালে মাথার ওপরের দিকটায় সাদার মায়া যেন হারিয়ে দিলো নীলচে আকাশকে। রেহাংশী মৃদু হাসল। আকাশ নিশ্চয়ই রাগ করবে!
ইনজাদ পাশ ফিরে মেয়েটিকে দেখল। কথা বলা টিয়াপাখি চুপচাপ। সে গাঢ় স্বরে বলল—-
“চুপকথা ! কেন বলো না কথা?”
রেহাংশী চট করে মাথা নিচু করল। অধরে দোল খেলালো প্রাণবন্ত হাসি। মৃদু শ্বাসে খুশির আমেজ। ইনজাদ প্রশ্বস্ত করল আঁখি। বিকেলের এই নরম আভায় ঘেমে গেছে মেয়েটি। তীক্ষ্ম নাকের ডগায় স্বচ্ছ মুক্তোর দানার মতো ঘাম। গলার কাছটায় জমেছে নোনতা জল। সামনে থাকা ছোটো ছোটো কেশ অবাধ্য কিশোরীর মতো অগোছালো হয়ে আছে। ইনজাদ আলগোছে ললাটের কুন্তল সরিয়ে দিলো। প্রশ্ন করল—
“গরম লাগছে?”
রেহাংশী ছোট্ট করে জবাব দিলো—
“না।”
চোখের হাসির সাথে ওষ্ঠাধরেও বহমান হলো সেই হাসি।
“তাহলে ঘামছ কেন?”
“কই?”
ইনজাদ চাপা স্বরে বলল—
“বিষবাণ এত অবুঝ হয় কী করে?”
রেহাংশী গাঢ় মায়ায় হাসল। শেষ বিকেলের মলিন আভা তার হাসিতে প্রাণ এনে দিলো। মেয়েটির এই দুর্বোধ্য, গূঢ়, হৃৎকুঠির বিদীর্ণ করা হাসিতে বারংবার এক অক্লান্ত , অবিমিশ্র, অপরাস্ত, অপ্রেময় প্রণয়ে আহত হয় ইনজাদ। অক্ষিকোটর হতে নিঃসৃত ঝলক দেওয়া চাহনির নিরবচ্ছিন্ন আঘাতে বিক্ষত হয় তার বুকের পাঁজর। স্বগতোক্তি করল ইনজাদ—
“যদি হাজার রজনী বিনিদ্র কাটে তোমার প্রতিক্ষায়, আমি মেনে নেবো সেই অতন্দ্রি নক্তের আহ্বান। যদি সহস্র বছর কেটে যায় তোমার অভিমানে, আমি ধরণীর প্রতিটি দিন কাটাব তোমার শ্বাসে সংগোপনে।”
চট করে রিকশা থেকে নামল ইনজাদ। আঁতকে উঠে প্রশ্ন ছুড়ে রেহাংশী—
“কোথায় যাচ্ছেন?”
ভীতসন্ত্রস্ত রেহাংশীর কোমল মুখে তাকিয়ে এক দুর্দমনীয় ইচ্ছা জাগল ইনজাদের। বঙ্কিমের ভ্রূ এর মাঝে দেখা গেল চঞ্চলতা। চোখের পাতা ভয়ে প্রসারিত হলো। এক আস্ত চুমু খেতে ইচ্ছে হলো ইনজাদের রেহাংশীর কোমল অধরে। নিজেকে সংযমী রেখে স্বাভাবিক গলায় বলল—
“তুমি বসো, আমি আসছি। মামা খেয়াল রাখবেন। একমাত্র বউ আমার। দ্বিতীয় বিয়ে করার টাকা নাই।”
রিকশাওয়ালার তার পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে প্রসন্ন হাসল। রেহাংশী জড়োসড়ো হয়ে বসল। ইনজাদ দুষ্ট হাসির ছলে তার লজ্জার ভাব বাড়িয়ে দিলো দ্বিগুন।
সিনএনজি আর প্রাইভেট কারের ফাঁক গলিয়ে ফুটপাতে উঠল ইনজাদ। একটা চা-সিগারেটের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল।
ইনজাদের আঙুলের ভাঁজে সিগারেট। স্বগৌরবে তা ঠোঁটের ভাঁজে দিয়ে ফুঁকে যাচ্ছে। রেহাংশী একটু পরপর বিব্রত হয়ে শাড়ির আঁচল ঠিক করছে। ঝিমঝিম করছে তার শরীর। রিকশা থেকে ইনজাদকে দেখার জন্য ঘাড় ঘুরাতেই রিকশাওয়ালা সাবধানী গলায় বলল—
“ঠিক কইরা বহেন মামি। চিন্তা কইরেন না। ঢাহা শহরের জেম এত সহজে ছাড়ত না।”
রেহাংশী নীরস চোখে এই রোবটপুরীকে দেখে। তার ভালো লাগে না এই শহর। নেই শীতল হাওয়া, পাখির কলতানে ঘুম ভাঙা, রোদের সোনালী আঁচ, রিমঝিম বৃষ্টির টুপটুপ শব্দ। আছে শুধু কোলাহল!
চট করেই তার পাশে এসে বসল ইনজাদ। রেহাংশী চকিতে তাকাল। তার ভ্রূ যুগল টানটান হলো। অক্ষিকোটর ভরে গেল উৎসুকতায়। ইনজাদ মোহবিষ্ট হাসল। রেহাংশীর দিকে ঠান্ডা পানীয় এগিয়ে দিয়ে বলল—
“এইটা খাও। ”
কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল—
“ভেতর থেকে ঠান্ডা করে দেবে তোমায়। আর যেইটুকু উষ্ণ থাকবে ওইটা আমার জন্য।”
রেহাংশী চোখ-মুখে খিঁচে নিল। লোকটা কীসব বলে!
“কি হলো খাও।”
“আপনি খেয়েছেন?”
“না। তুমি খাও।”
বোতলের মুখ খুলে দিলো ইনজাদ। তাতে চুমুক লাগায় রেহাংশী। তার মুখের দিকে অতলান্ত প্রেমময় চাহনিতে আড়ষ্ট হলো ইনজাদের বাঁধনহারা নয়নযুগল। নিচের অধরের খাঁজে জমা নোনতা বৃষ্টির ফোঁটা আঙুল দিয়ে মুছে দিলো ইনজাদ। রেহাংশী থামিয়ে দিলো তার ঠান্ডা পানীয়ের স্রোত গেলা। ইনজাদের দিকে ভরাট চোখে চাইল। ডানহাতে থাকা ফ্লাওয়ার ক্রাউনটা চট করে মাথায় বসিয়ে দিলো ইনজাদ রেহাংশীর। বিস্ময়ে আবিষ্ট হলো সে। ইনজাদ সরস গলায় সম্মোহিতের ন্যায় বলল—
“মাই ফ্লাওয়ার গার্ল, উইল ইউ বি মাই হার্ট?”
রেহাংশী চোখ গুঁজে দিলো ইনজাদের বাহুর সাথে। লজ্জানত মুখ রাঙা হলো শিমুল ফুলের রক্তিম আভায়। আরক্ত মুখের ব্রীড়াতে কাতর রেহাংশীকে বাঁচাতে চোখ ফেরাল ইনজাদ। মেয়েটার লজ্জা কমাতে পারেনি সে। আনমনেই তার অধর বিস্তৃত হলো নিজের পরাজয়ে। রেহাংশী আড়চোখে চাইল ইনজাদের দিকে। জ্যাম ছুটলেই রিকশা চলতে শুরু করল। তার মাথায় শোভা পাচ্ছে ফুলের মুকুট। যেন ফুল রাজ্যের রাজকন্যা সে, আর পাশে তার সুদর্শন রাজকুমার। ইনজাদের হাতে দিকে তাকাল রেহাংশী। প্রেমাত্মক চাহনিতে চাইল ইনজাদের মুখের দিকে। পবনের আধিক্যতে উড়ছে ইনজাদের ঝাকড়া চুল। সেইদিকে বদ্ধদৃষ্টি রেখে ইনজাদের আঙুলের ভাঁজে নিজের আঙুল গুঁজে দিল রেহাংশী। আস্ত কাঁধ জুড়ে নিজের ভর ফেলে অন্য হাত দিয়ে সেই আঙুলের ভাঁজ গুঁজে দেওয়া হাত বুকের সাথে জড়িয়ে নিল সে।
রেহাংশীর পীড়িত মনে জাগ্রত হয় এক ভয়ংকর,অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়। এই মানুষটা তাকে ছেড়ে যেতে পারে না। সে চায় না তার মায়ের সাথে যা ঘটেছে তার সাথেও তাই ঘটুক। ভালোবাসা যেন মোহঘোর না হয়ে যায়!
নিজের ভয় কমাতে আরেকটু জোরে চেপে ধরল ইনজাদের হাত। ইনজাদ অস্বাভাবিকতা আঁচ করে চাইল। রেহাংশীর নির্বিকার, নিমেষহীন, সমাহিত চাহনি। ইনজাদ চক্ষু আড়ালে তার অধর ছোঁয়াল রেহাংশীর ললাটে। আবক্ষ প্রেমে ডুবল রেহাংশী।
চলবে,,,