#মোহঘোর
#পর্বঃ৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
বাড়ির সুবিশাল দাওয়ায় বসে আছে রেহাংশী। যার দুইপাশে বেড় দেওয়া। আর সামনের দিকে দুটো পিলার পর্যন্ত বেড়, বাকিটা খোলা ঘরে প্রবেশ করার জন্য। পায়েলের মাথার চুলে অতি যত্নের সাথে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে সে। রেহাংশীদের বাড়িটি বনেদি। তাদের পরিবার চারপুরুষ ধরে এই বাড়িতেই থাকে। বাড়িটির পলেস্তার খসে পড়া শুরু করেছে। শ্যাওলা জমে বাড়ির পেছন দিকটা স্যাঁতসেঁতে। বৃষ্টি এলেই তা সিক্ত হয়ে দেয়াল চুঁইয়ে ভেতরদিকটাও ভিজে ওঠে। পূর্বমুখী বাড়ির সদর দরজা হওয়ায় পেছন দিকটা সূর্যের ম্লান আলোতেই নিজেকে তপ্ত করার সুযোগ পায়।
শীতল, অবিমিশ্র, স্নিগ্ধ মলয়ে পরিবৃত বৈকালের শেষ প্রহর। বাড়ির আঙিনায় স্বমহিমায় শিয়র উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বছর পুরোনো আমগাছটার লম্বা পাতার ফাঁক গলিয়ে ডাকছে ছোট্ট কয়েকটি পাখি। তাদের কুজনে হেসে উঠেছে শেষ বিকেল। তপ্ত প্রভাকরের দাপটে ভাটা পড়েছে। তার ম্লান, নরম রোদে এখন পশ্চিমাদেশ রাঙানো। নীলাভ অম্বরে ধূসরের সাজ।
তেলের কৌটা থেকে হাতের তালুতে তেল নিয়ে তা পায়েলের সিঁথির ওপর ঢেলে দেয় রেহাংশী। সেই তেলে তালু ঘষে চুলের ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে তার মাঝে লেপ্টে দিচ্ছে সে। এক অদৃশ্য আরামে অভিভূত পায়েল। চোখ বুজে আসে তার। বাড়ির উঠোনে পড়ে থাকা পাতার স্তুপে একটু জোর হাওয়া বইতেই তা উড়তে শুরু করে। সদর দরজার পাশে থাকা ছোট্ট নিমগাছটার ডাল এখনো নড়বড়ে। কচি পাতাগুলো হাওয়ায় দোদুল্যমান। রেহাংশী চটপটে হাসে। নিমগাছের খর্ব পাতার ওপর সূর্যের কিঞ্চিৎ আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। তবে তা ক্রমশ লুপ্ত হচ্ছে বাড়ির দীর্ঘ অবয়বের কারণে। রেহাংশী গাঢ় গলায় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল—
“পায়েল আপু, তোমরা যা করছ তা কিন্তু ঠিক নয়।”
পায়েল চমকে ওঠে। মাথার তালুতে তড়াক করে এক অদ্ভুত আওয়াজ হয়। চোখ পাকিয়ে পেছন ফিরে বলল—
“কী বলতে চাস তুই?”
রেহাংশী চাহনি নরম করে। চোখের পলক ফেলে বার দুয়েক। তার টিয়াপাখির মতো লাল ঠোঁট দুটো টানটান করে বলল—
“নুপূর আপুর সাথে কী হয়েছিল মনে আছে? তোমরা কী এবারও আমাকে ফাঁসাতে চাও? আমি কিন্তু এখন ছোটো নই। কথা বলতে জানি।”
পায়েল তপ্ত শ্বাস ফেলে। ফুঁসলে উঠে বলল—
“এই সমস্যা কী তোর? আর আপুর কথা কী বলছিস?”
রেহাংশী কণ্ঠ শক্ত রেখে বলল—
“নুহাশ ভাইয়া আর তুমি যা করছ তা ঠিক নয়। আমি আগেও বলেছি। ধরা পড়লে আমাকে জড়াতে পারবে না এসবে।”
পায়েল ক্ষেপে ওঠে। সপাৎ করে এক চড় বসায় রেহাংশীর গালে। রেহাংশীর চোখে জল থৈ থৈ। ভরা যমুনার জল গলায় নিয়ে বলল—
“মারলে কেন আমাকে? ভেবো না এবার আমি চুপ করে থাকব। গতবার তোমরা শুধু শুধু আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছ। এবার এমন করলে আমি বড়ো আব্বুকে সব বলে দেবো।”
পায়েল ঠাস করে আরেক চড় বসায় রেহাংশীর গালে। রেহাংশী অবেলার বর্ষণের মতো কপোল ভাসিয়ে ফেলে। সোমা চমকিত গলায় তিরস্কার নিয়ে বলল—
“মাইঝা আফা, ছোডো আফারে মারেন ক্যান? কী করছে হেয়?”
পায়েল খেমটি মেরে বলল—
“তোকে বলতে হবে? যা এখান থেকে।”
“যাইতাছি। মারেন, মারেন। হগ্গলতে মিল্লা মাইয়াডারে মাইরা ফালান।”
পায়েল দাপিয়ে ওঠে। রেহাংশী মোড়া থেকে উঠে সরে দাঁড়ায়। তার নরম গাল কনকন করছে। পায়েল শাসিয়ে বলল—
“আমার আর নুহাশের বিয়ের আগে যদি একথা কারো কানে যায় তাহলে তোর খবর আছে। মনে রাখিস?”
রেহাংশীর জলস্রোতে বুক ভাসে। আচ্ছন্ন রোদনে মাকে মনে পড়ে। মা নেই কেন তার? মা না থাকায় তার আস্ত জীবন খড়কুটোর চেয়ে অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। নির্বাক রেহাংশীর চোখের জলে বায়ুতে সৃষ্টি হয় গুঞ্জন। সে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। চোখের অগ্নিশিখায় যেন ভষ্ম করে দেবে পায়েল। তার ধমনীতে প্রবাহিত শোণিত টগবট করে ফুটছে।
,
,
,
বাড়ির নীল রঙা গেইটের পাশে দেয়ালে এক পা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইনজাদ। নীরব, নিস্তব্ধ, জনশূন্য রাস্তায় তার স্পষ্ট ছায়া ছাড়া আর কোনো মনুষ্যের উপস্থিতি নেই। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে সূর্য। তার কমলা রঙের আভা প্রলীণ হয়ে রক্তিম আভার বিচ্ছুরণ হচ্ছে। সূদুর অন্তরিক্ষের সেই রক্তিম সূর্যের দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে ইনজাদ। তার পুরু অধরের ভাঁজে জ্বলন্ত সিগারেট। ধোঁয়ার কুন্ডলিতে সে দেখতে পেল খন্দকার বাড়ির ছাদের সেই ক্রন্দনরত মেয়েটিকে। ইনজাদ সিগারেট ফেলে দেয়। তাদের বাড়ির নেমপ্লেট সেঁটে আছে তার মাথার কাছে। ভ্রূকুঞ্চন করল সে। রেহাংশীর কান্না সে দেখত পেল না। তার চর্মচক্ষুতে এক নারীর বিমর্ষ, বিষণ্ণ মুখটাই দৃশ্যমাণ হলো। সূর্য ডুবে যাচ্ছে সাঁঝের মায়ায়। ঘন আঁধার নেমে আসছে ধরণীর বুকে।
ইনজাদ তাদের বাড়ির বাউন্ডারি দেয়াল থেকে রাস্তার এপাশটায় এলো। রেহাংশীদের বাড়ির পাশে বিস্তৃত খালি জায়গা। যার মালিক বর্তমানে শহরে থাকেন। ভদ্রলোক নিজের জমির দখলদারী ঠিক রাখতে বাউন্ডারি করে গেছেন।
সেই দেয়াল থেকে একটু দূরে দাঁড়ল ইনজাদ। গলা চড়িয়ে বলল—
“এই যে শুনছেন! ও মিস বিষবাণ! শুনছেন?”
রেহাংশী চকিতে ফিরে তাকায়। তার রোদনভরা আঁখিদ্বয় মুহূর্তেই ঝর্ণা আটকে দিলো। সে ঝাপসা চোখে তাকাল ইনজাদের দিকে। ইনজাদ হাসল। চোখের তারায় ঝলকানি নিয়ে বলল—
“শুনছেন, পাড়ার মোড়ে পিপলুকে দেখলাম। বলেছিলেন না ঘাড় ভেঙে দেবেন? চলুন তাহলে। আমার বড্ড শখ হয়েছে দেখার। ও মিস বিষবাণ! শুনছেন?”
রেহাংশী ভড়কে গেল। অমীমাংসিত দ্বন্ধে সমাচ্ছন্ন হয়ে ভ্রূ কুঁচকাল। ইনজাদের হাসি মুখটা দেখে তার ভাবনায় এক অনাস্বাদিত অনুভূতির সঞ্চার হলো। অন্তঃকরণে অপ্রতিরোধ্য অভীপ্সা। অনুপলেই নিজেকে ফেরাল সে। মুক্ত গলায় বলল—
“কী সমস্যা? ”
“কিছু নাগো বিষবাণ। ইচ্ছে হলো একটু মফস্বলের মেয়েদের তেজ দেখতে। বললেন না পিপলুর ঘাড় ভাঙবেন? তাই বলছিলাম আর কি!”
“আপনাকে ভাবতে হবে না। নিজের চরকায় সুতো কাটুন। অন্যের তাঁতে নজর কম দিন। পিপলুকে আমি হাতের নাগালে পাবোই। ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।”
ইনজাদ মুচকি হাসল। মেয়েটার কথা-ই যেন ছুরির তীক্ষ্ম ফলা। সে পূনরায় রসালো গলায় বলল—
“আশাহত করলেন। ”
রেহাংশীর ক্ষুণ্ণ মনে প্রজাপতি উড়তে লাগল। ইনজাদের সহজ ভঙ্গি আর সাবলীল আচরণে তার মনের দীর্ঘশ্বাসে আশার প্রদীপ জ্বলে ওঠে। পুরুষদের প্রতি বিতৃষ্ণা তার। বাবার করা গর্হিত কাজের সাজা তাকেই সারাজীবন বয়ে চলতে হবে।
নিজের অজান্তেই রেহাংশী হেসে ওঠে। স্বর ভারী করে বলল—
“বিষবাণ কেন বললেন?”
“বললেন না সেদিন। বিষের কথা। আপনাকে তাই মনে হয়।”
স্বশব্দে হেসে উঠে রেহাংশী। সে আওয়াজ শুনতে পেল না ইনজাদ। তবে রেহাংশীর দেহের পরিবর্তে সে ঠিকই আন্দাজ করতে পেল। মেয়েটা হাসছে!
” আমাকে বিষ মনে হয় আপনার?”
ইনজাদ লাজুক হাসল। আঁধার ঘনিয়েছে। ধীরে ধীরে অস্বচ্ছ মুখায়ব অন্ধকার অবয়বে রূপান্তরিত হলো। অস্পষ্ট হয়ে গেল দুই মেরুতে দাঁড়ানো দুই মানব-মানবী একে অপরের কাছে। ইনজাদ কেমন অদ্ভুত আঁখুটে সুরে বলল—
“অমৃত মনে হলে কী দেবেন?”
রেহাংশী হাসল। খেয়ালিপনায় বলল—
“অধিকার।”
ইনজাদ নিভে গেল। কথা বাড়াল না। নুপূরকে মনে পড়ল তার। দুদিন আগে মেয়েটাকে একবার দেখছে। আর দেখাই হলো না। বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল সে। পূর্ণ নজর ক্ষেপন করল। শঙ্কিত হলো সে। তার চেতন মনের কোণে নুপূরকে ভাবলেও অবচেতন মন বারবার তার বিষবাণকেই ভাবে। অত্যন্ত নিগূঢ়, গহন, নিবিড়ভাবে। যা সে নিজেও বুঝতে পারে না। রেহাংশী সরব গলায় প্রশ্ন ছুড়ে—
“শুনছেন, এই যে পরদেশী! ভয় পেলেন? ভয় পাবেন না। নামে ভুতনী হলেও কাজে নই। সেইটা আমার ভাগ্যের পরিহাস।”
ইনজাদের চাহনি বদলাল। কাতরতা নেমে এলো। ভাগ্যের পরিহাস! কেন?
তার ভাবনা যখন কাটল তখন রেহাংশী ছিল না। ছিল তার রেখে যাওয়া কথার রেশ। ইনজাদের ঘোর কাটে। আঁধার রাতে নিজের কাঁধে দৈবাৎ স্পর্শে কম্পিত হয় সে । পেছন ফিরতেই বাবার নরম হাসি। পুলকিত সে।
পারভেজ মির্জা সন্ধানী গলায় বললেন—-
“এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?”
“কিছু না বাবা। তুমি?”
পারভেজ মির্জা শঙ্কিত গলায় বললেন—
“তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
ইনজাদ আহত গলায় বলল—
“কিছু না। কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
পারভেজ মির্জা ভ্রূ নাচিয়ে বললেন—
“আযান হয়েছে, শুনিসনি?”
ব্রীড়াময় চাহনিতে নতজানু হয় ইনজাদ। এর মানে সে শুনতে পায়নি। বাবা হাত রাখলেন ছেলের কাঁধে। আদুরে গলায় বললেন—
“চল, একসাথে যাই। আসার সময় কিছু বাজার নিয়ে আসতে হবে। না হলে তোর মা আজ ঘরে ঢুকতে দেবে না।”
ইনজাদ সরস হাসল। তার বাবা-মা, বাবা- মা কম, বন্ধু বেশি । একমাত্র ছেলে হওয়ার দরুন বুকের পাটাতনে রেখে বড়ো করেছে ইনজাদকে তারা। সচ্ছল পরিবার হওয়ায় নিজেদের সাধ্যমতো ছেলের সকল ইচ্ছা তারা পূরণ করেছেন।
,
,
,
অন্ধকারে টর্চ হাতে হেঁটে যাচ্ছে রেহাংশী। চাঁদের আলো খুবই ক্ষীণ। রওশন আরা হঠাৎ করেই নুডলস খাওয়ার বায়না ধরলেন। শেষ বয়সে এসে তার বায়নার গতি বেড়েছে। যখন যা খেতে ইচ্ছে হয় তখনই তার সে জিনিস চাই।
থালার মতো গোলাকার চাঁদের অফুরান টিমটিমে আলোতে অস্পষ্ট আধপাকা সরু রাস্তাটা। রেহাংশী যখন ইনজাদদের বাড়ির কাছে আসে ঠিক তখনই অকস্মাৎ কেউ তার হাত টেনে ধরে। রেহাংশী ব্যতিব্যস্ত হয়ে অজানা ব্যক্তিটির মুখের ওপর টর্চের আলো ফেলতেই হকচকিয়ে উঠে সে। চমকিত গলায় বলল—
“আপনি?”
রতন দাঁত কেলিয়ে হাসল। জগত জুড়ানো প্রাণাবেগ নিয়ে বলল—
“তুমি আমার চিঠির জবাব দিলা না ক্যান?”
রেহাংশী দাঁতখামটি মেরে বলল—
“আগে আপনি আমার হাত ছাড়ুন। ছাড়ুন বলছি।”
রতন সহাস্য অধরে বলল—
“যদি না ছাড়ি?”
রেহাংশী চোখ পাকিয়ে হাত মোচড়া মোচড়ি শুরু করে। রতনের ঠোঁটে ক্রুর হাসি। কিছুক্ষণ পর নিজেই হাত ছেড়ে বলল—
“দিলাম ছেড়ে, এবার বলো তুমি আমার চিঠির জবাব দিলা না ক্যান?”
রেহাংশী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল—
“আপনার সাহস কী করে হলো আমাকে ছোঁয়ার? আর কীসের চিঠি? নিজের নামটাও তো ঠিক করে লিখতে পারেন না।”
রতন রাগি চোখে তাকাল। টর্চের অগোছালো আলোয় তা স্পষ্ট দেখতে পেল রেহাংশী। তার চোখের সম্মুখে যেন আগ্নেয়গিরির লাভা উদগীরণ হচ্ছে।
রতন তাপিত গলায় বলল—
“আমার প্রশ্নের জবাব দেও।”
“লজ্জা করে না, ছোটো বোনের ক্লাসমেটকে প্রেমের চিঠি দিতে?”
ফিক করে হেসে ফেলে রতন। সজীব গলায় বলল—
“লজ্জার কী আছে? তুমি জানো তোমারে আমি পছন্দ করি। আরে না, ভালোবাসি। সেই রিশার জন্মদিনের দিন থেইকা। বিশ্বাস করো, সেই দিনের পর তোমারে ছাড়া আর কারোর দিকে তাকাই নাই আমি।”
রাগে থরথরিয়ে যাচ্ছে রেহাংশীর লতানো দেহ। প্রেম মানেই বিষকুন্ড। যাতে সে কখনোই লাফিয়ে পড়তে চায় না।
রেহাংশী তীক্ষ্ম করল গলার স্বর। বলল—
“দেখুন, আর একবার যদি আপনি এসব করেছেন তাহলে কিন্তু আমি বড়ো আব্বুকে বলে দেবো। কেমন মানুষ আপনি? পিপলুর মতো ওতো ছোটো বাচ্চাকে দিয়ে এসব জঘন্য চিঠি পাঠান! ”
“আচ্ছা, পিপলুরে পাঠাইলে যদি সমস্যা হয় তাইলে আর পাঠামু না। তুমি একবার কও যে তুমি আমারে ভালোবাসো।”
“না, যান এখান থেকে।”
রতন রুষ্ট হয়। গত তিন বছর রেহাংশীর পেছনে ঘুরঘুর করেও লাভ হচ্ছে না। এই এলাকার মেম্বারের ছেলে সে। কাজকর্ম না করে বাবার দাপটে সারাদিন বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এছাড়াও লোক চক্ষুর আড়ালে আরও কিছু অযাচিত কাজ সে করে।
ঘরের মূল দরজায় এসে বাইরে তাকাতেই মসৃণ কপালে ভাঁজ তুললেন পারভেজ মির্জা। বাইরে অন্ধকার। তবে চন্দ্রকিরণ আছে। পেছনে ইনজাদ দাঁড়িয়ে। ছেলের দিকে অস্পষ্ট নজরে তাকিয়ে বললেন—
“তোর মাকে কতবার বললাম সন্ধ্যার পর রাস্তার দিকের লাইটটা জ্বালিয়ে দিতে। এতে করে মানুষজন একটু আরামে চলাফেরা করতে পারবে। খন্দকার বাড়ির দাওয়ায় জ্বালানো লাইটের আলো রাস্তায় আসে না। কে শোনে কার কথা! বলে কি না শুধু শুধু বিল বাড়িয়ে কী লাভ!”
ইনজাদ চাপা হাসল। তার মা বরাবরই হিসেবি। সরল গলায় বলল—
“তুমি এগিয়ে যাও। আমি লাইট অন করে আসছি। আম্মাকে বললে এখন রান্না ঘর থেকে এসে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবে।”
“তা তো দেবেই।”
পারভেজ মির্জা চাঁদের আলোয় একটু একটু করে বাড়ির গেইটের কাছে এগিয়ে এলেন। গেইটের লক খুলে সেখান থেকে বের হতেই দেখলেন কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে। তিনি গলা কেঁশে বললেন—
“কারা ওখানে?”
তৎক্ষনাৎ আলো জ্বলে ওঠে। পারভেজ মির্জা আস্ত নজরে তাকালেন। দেখতেও পেলেন দুই মানব-মানবীকে। চোখ বাঁকিয়ে তার দিকে তাকাল রতন। রেহাংশী পুরোদস্তুর পেছন ফিরে। পারভেজ মির্জাকে দেখে সরে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করল রতন। ফিচেল হেসে বলল—
“বউ সেজে তো তোমাকে আমার ঘরেই যেতে হবে। মনে রেখো।”
রেহাংশী মাথা ঘোরাল। রতন ততক্ষণে অদূরে চলে গেছে। ধীরে ধীরে তার অবয়ব অস্পষ্ট হচ্ছে। পারভেজ মির্জা এগিয়ে এসে বললেন—-
“হেমায়েত মেম্বারের ছেলে রতন না? এখানে কী করছে?”
রেহাংশী নির্বিকার গলায় বলল—
“যা সারাক্ষণ করে বেড়ায়।”
“ছেলেটা সুবিধার নয়। শুনেছি আমি একটু আকটু।”
রেহাংশী নিষ্প্রভ হাসল। দুঃখী গলায় বলল—
” আপনি একটু জানেন, আর এই এলাকার মানুষ সব জেনেও চুপ থাকে।””
“তুমি এত রাতে বের হলে কেন?”
“দাদি নুডলস খেতে চেয়েছে।”
পারভেজ মির্জা ছোট্ট শ্বাস ফেলে মায়াবী গলায় বলেন—-
“বাসায় আর কেউ নেই?”
“আপু আছে। সে পড়ছে। ভাইয়া আর বড়ো আব্বু এখনো ফেরেনি।”
“ফেরার সময় তাদের নিয়ে আসতে বলতে পারতে?”
“তাদের ফিরতে আরও দেরি হবে। দাদী ততক্ষণ জেগে থাকতে পারবেন না।”
“ও আচ্ছা। সাবধানে চলাফেরা করবে মা। এসব ছেলেপেলারা নিজেরাও জানে না তারা কী করে!”
রেহাংশী মাথা ঝাঁকাল। নম্র গলায় বলল—
“আসি চাচা।”
পারভেজ মির্জা সম্মতি জানালেন। রেহাংশী গুটগুট করে একটু এগিয়ে গেল। আচমকা থমকে যায়। অবাক হলেন পারভেজ মির্জা। চোখের পাতা চওড়া করলেন। রেহাংশী পেছন ফিরে এলো। তিনি সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে রইলেন। রেহাংশী টুক করে বসে সালাম করলেন পারভেজ মির্জাকে। তিনি আবেশিত হলেন। চূড়ান্ত বিস্ময় নিয়ে বললেন—
“কী হয়েছে?”
রেহাংশী হাসল। নির্মল, শুদ্ধ, পবিত্র হাসি। পারভেজ মির্জার মনে হলো তার সামনে এক টুকরো চাঁদ হাসছে।
“আমার বাবা হলেও আমাকেই দোষারোপ করত। পুরুষ মানুষ রিফাইন্ড ওয়েলের মতো। আজীবন তারা স্বচ্ছ-ই থাকে। মেয়ে মানুষ সাদা কাগজের মতো। বৃষ্টির শুদ্ধ জলও তার ছাপ রেখে যায়। আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন। তাই আপনাকে সালাম করতে ইচ্ছে হলো। যদিও সবাই আমাকে অপয়া বলে, তবে বাবাদের কাছে সন্তানরা অপয়া হয় না। ”
রেহাংশী তার গন্তব্য ধরল। ইনজাদ দাঁড়িয়ে থেকে সব দেখল। গেইটের ওপর পা উঠিয়ে ওপরের দিকটা হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে স্থির হয়ে আছে। সে ভেবেছিল মেয়েটির একবার হলেও তার দিকে তাকাবে। কিন্তু তাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে দিলো তার বিষবাণ। ইনজাদ স্বগতোক্তি করল,” ও বিষবাণ, হৃৎপিন্ডের ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে করবে প্রনয়ীর প্রাণনাশ!”
চলবে,,,