মোহঘোর”পর্বঃ৫

0
661

#মোহঘোর
#পর্বঃ৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

খন্দকার বাড়িতে সকাল সকাল বিরাট কান্ড ঘটল। জুলহাস খন্দকার বাড়ি থেকে বের হতে যাবেন তক্ষুণি হেমায়েত মেম্বারের খাসলোক গফুর দৌড়ে আসেন। তিনি জানান হেমায়েত মেম্বার খন্দকার বাড়িতে আসছেন। তারা পথেই। অবাক হলেন জুলহাস খন্দকার। ব্যক্তি হিসেবে মেম্বার সাহেবকে তিনি পছন্দ করেন না। যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন। কিন্তু আশ্চর্য হলেন তার এহেন আগমনে। বাড়ির সকলে উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত, চিন্তিত।

হেমায়েম মেম্বার দিলখোলা হাসলেন। তার পাশেই নতমুখে বসে আছে রতন। ছেলের একমাত্র বায়না পূরণ করতে আজ খন্দকার বাড়িতে তার আগমন। রতন বিয়ে করতে চায় রেহাংশীকে। তা জানতে পেরেই ঘরের দরজা বন্ধ করে সমানতালে ফুপিয়ে যাচ্ছে রেহাংশী। ঝিনুক বেগমের চিত্ত দুলে ওঠল। যত দ্রুত সম্ভব রেহাংশীকে তিনি এ বাড়ি থেকে বিদায় করতে চান। আধঘণ্টা সময় ব্যয়ে নানা রকম খাবারের আয়োজন করলেন তিনি। জুলহাস খন্দকারের মুখ থমথমে। ঝলমলে আকাশে যেন আচমকাই অসিত মেঘে জমে গেল। তিনি নিশ্চুপ। নুহাশের তীক্ষ্ম দৃষ্টি। হাত -পা নিশপিশ করছে তার। ইচ্ছে করছে রতনের মাথাটা দেয়ালে দুটো ধাক্কা দিয়ে থেতলে দিতে। রেহাংশীকে ছোটোবেলা থেকেই পছন্দ করে নুহাশ। কিন্তু মেয়েটা তাকে পাত্তাই দিলো না। এই বাড়িতে এসেও সে রেহাংশীর জন্য। রেহাংশীর ওপর করা সকল অন্যায় প্রতিহত করতে না পারলেও তার সারথি হওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পায়েলটা মাঝখানে গড়মিল করে ফেলে। অযথা গা ঘেঁষাঘেঁষি যেন নিত্যদিনের স্বভাব। তার ওপর নারী সৌন্দর্যের অভয়ারণ্য। তার তপ্ত লহুকে জমাট বাঁধতে সদা তৎপর পায়েল। রাগে শরীর কেঁপে যাচ্ছে নুহাশের। স্বচ্ছ চোখে লালাভ আভা।

হেমায়েত মেম্বার কিছু খেলেন না। মুখের ভেতর শুধু একটা সাজানো পান ঠুসে দিলেন। ভজভজ করে চিবুতে চিবুতে বললেন—

“রতন আমার একমাত্র পোলা। আমার সবকিছুতো ওরই হইব। আপনাগো মাইয়া রাণির হালে থাকব। আর বড়ো কথা সব জাইনা শুইনাও আমি আপনাগো মাইয়ারে আমার ঘরের বউ করতে চাই। খালি আমার পোলাডা আপনাগো মাইয়ারে পছন্দ করে হের লাইগা। আপনাগো কোনো আপত্তি নাই তো?”

জুলহাস খন্দকার আপত্তি করে কিছু বলার আগেই সানন্দে টগবগিয়ে উঠেন ঝিনুক বেগম। গালভর্তি খুশি নিয়ে বললেন—

“আরে কী কন ভাইসাব, কোনো আপত্তি নাই। এইটা তো ওর ভাগ্য। আর রতনের মতো ছেলে ওরে পছন্দ করছে এইটাই অনেক। তবে একটা কথা।”

হেমায়েত মেম্বার সমান্তরাল কপালের মাঝ বরাবর কুঞ্চন করে বললেন—

“কী কথা?”

ঝিনুক বেগম গদগদ হাসলেন। অলজ্জ গলায় হেসে হেসে বললেন—

” আমরা কিন্তু তেমন কিছু দিতে পারব না। জানেন তো, ওর মা মারা গেছে। ওর বাপটা যে কই তা কেউ জানে না। আমাদের নিজেরও দুটো মেয়ে আছে। তাদের কথাও ভাবতে হবে।”

“আরে চিন্তা কইরেন না। আমার একমাত্র পোলা। বিয়ার সব খরচ আমার। বরং এই বিয়ার জন্য আপনাগোরে আমি আরও দুই লাখ টাকা দিমু। ”

ঝিনুক বেগমের চোখ চকচক করে ওঠল। নুহাশের ঘাড়ের রগ দপদপ করছে। জুলহাস খন্দকার প্রতিবাদ করে বললেন—

“টাকা-পয়সার কোনো দরকার নেই। আপনার ছেলেকে বলেন আগে নিজের স্বভাব ঠিক করতে। মেয়ে ভেসে আসেনি আমাদের। বিয়ের খরচ আমরাই দেবো।”

হেমায়েত মেম্বারের হাসি উবে গেল। রতনের মুখ খিঁচে এলো। তাকে চোখের ইশারায় শান্ত হওয়ার আভাস দিলো তার বাবা।
হেমায়েত মেম্বার গলা পরিষ্কার করে বললেন—

“ছোডো বয়সে পোলাপান মানুষ ভুল করেই। সে অনেকদিন হইছে। ভুল কইরা ফেলছিল। এখন তো আর সে ছোডো নাই। আর ঘরে বউ আসলে সব ঠিক হইয়া যাইব। ”

জুলহাস খন্দকার চোখ বাকিয়ে তাকালেন। ঝিনুক বেগম আর কোনো কথা বাড়াতে নিষেধ করলেন।
,
,
,
হাত-পা ছড়িয়ে কেঁদেই যাচ্ছে রেহাংশী। আঙুল থেকে আংটি খুলে অনেক আগেই ছুড়ে ফেলেছে। সে বিয়েতে কোনোভাবেই রাজি নয়। মানা করা সত্ত্বেও ঝিনুক বেগম একরকম জোর করেই আংটি পরতে বাধ্য করেছে রেহাংশীকে। জুলহাস খন্দকার চেয়েও কিছু করতে পারলেন না।

নুহাশ ঢোকে অতি সন্তর্পনে। তাকে দেখেই হাউমাউ করে উঠে রেহাংশী। ঝমঝমিয়ে কেঁদে বলল—

“নুহাশ ভাইয়া, তুমি কিছু বলো না। বড়ো আব্বুকে বলো না আমাকে ওই রতনের সাথে বিয়ে না দিতে।”

নুহাশ ফোঁস করে দম ফেলল। বিছানায় আরাম করে বসে হাতের ভরে পেছনে হেলান দিলো। রেহাংশী ঝট করেই বলল—

“তুমি কিছু করো না প্লিজ। আমি এই বিয়ে করব না।”

নুহাশ আলতো গলায় বলল—

“তাহলে আংটি পরলি কেন?”

“আমি পরেছি? ওরাই তো জোর করে পরিয়ে দিলো।”

নুহাশ সোজা হয়ে বসে। কোলের মধ্যে হাত রেখে বলল—

“তাহলে এখন বিয়ে করে নে।”

রেহাংশী ঝট করে হাঁটু মুড়ে নুহাশের সামনে বসে। তার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল—

“প্লিজ নুহাশ ভাইয়া, তুমি তো জানো রতন কী করেছে? এই বিয়েটা আমি করতে পারব না।”

রেহাংশীর নরম, মসৃণ হাতের কোমল স্পর্শে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল নুহাশের শক্তপোক্ত শরীরে। চোখের নমনীয়তায় এলো ব্যাকুলতা। নম্র গলায় বলল—

“আমাকে বিয়ে করবি? এই বাড়িতে আমি কিন্তু তোর জন্যই এসেছি।”

রেহাংশী ক্ষুব্ধ গলায় বলল—

“নুহাশ ভাইয়া! এসব কী বলছ?”

নুহাশ স্বীকারোক্তির সাথে বলল—

“ঠিকই বলছি। আমি তোর জন্যই এসেছি। তুই যা ভাবছিস তেমন কোনো সম্পর্ক নেই আমার আর পায়েলের মাঝে। আমি কখনো আমার লিমিট ক্রস করিনি। ওই বারবার আমাকে অপদস্ত করেছে। আমিও তো পুরুষ। তবুও নিজেকে সংবরণ করেছি শুধু তোর জন্য। দেখ, এই বিয়ে আটকানোর একটাই উপায় তোর বিয়ে। তুই একবার বল আমার সাথে যাবি। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, তোকে আমি এখান থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাব। কেউ তোকে খুঁজে পাবে না।”

রেহাংশী তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়ায়। গা ঝাড়া দিয়ে বলল—

“ছিঃ! তুমি এতটা নিচ আমি ভাবতেও পারছি না। পায়েল আপু তোমাকে কত ভালোবাসে। আর তুমি?”

“ওর ভালোবাসার দৌড় আমার জানা আছে। রতন তোর সাথে কী করবে তা তুই ভালো করে জানিস! ওদের বংশে বহু বিয়ের প্রচলণ আছে। তোকে দিয়ে তো সবে শুরু।”

রেহাংশীর সিক্ত চোখে অশ্রুর স্ফীত ধারা প্রবল বেগে গড়াতে লাগল। শব্দও হতে লাগল মুখে। নুহাশ শ্রান্ত গলায় বলল—

“কাঁদছিস কেন? বিয়ে এখনো হয়নি। আর আমি তোকে যা বলেছি তা ভেবে দেখিস। তোর সাথে আমি জোর করছি না।”

নুহাশ উঠে দাঁড়ায়। রেহাংশীর নিকটে গিয়ে চাপা স্বরে বলল—

“পায়েলকে আমি কখনো ভালোবাসিনি। মনে রাখিস।”

“এখানে কী করছ তুমি?”

পায়েলের কড়া গলার আওয়াজে সপ্রতিভ হয় নুহাশ। সচল চোখে চেয়ে দৃঢ় স্বরে বলল—

“কিছু না। রতনের সাথে বিয়ে ঠিক করে মামা কাজটা একদম ঠিক করেনি।”

রেহাংশী ডুঁকরে যাচ্ছে। পায়েল কটমট করে ওঠে। চোখ রাঙিয়ে তীর্যক গলায় বলল—

“এখানে কান্নার কী আছে? রতন এখন ভালো হয়ে গেছে।”

রেহাংশী কাষ্ঠ গলায় বলল—

“হলে হোক। করব না ওকে বিয়ে আমি।”

“তো কাকে করবি? তুই কী ভাবছিস তোর জন্য রাজপুত্র আসবে? তুই কোথাকার রাজকন্যারে? ভালোই ভালো বিয়েটা করে নে। ভালো থাকবি।”

“কীসের ভালো? তোমরা নিজেদের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে পারো। নুপূর আপু এত কিছু করেও এখনো দিব্যি তাকে ভালো ছেলের সাথে বিয়ের দেওয়ার জন্য তোমরা বসে আছ। আর আমার বেলায় এত কথা! কেন?”

পায়েল তেড়ে এসে রেহাংশীর গায়ে হাত তুলতে গেলেই তার হাত ধরে ফেলে নুহাশ। হাত ঝাড়া মেরে বলল—

“পায়েল! বিহেব ইউর সেল্ফ। কিছু হলেই ওর গায়ে তোলা লাগে তোমাদের? ”

“তুমি ওর পক্ষ নিচ্ছ কেন? আর ও নিজেকে কী মনে করে? আকাশের পরী?”

নুহাশ ফুঁসতে থাকে। ইচ্ছেতো করছে পায়েলকে ঠাটিয়ে এক চড় মারতে। নিজেকে দমিয়ে নিল সে।
,
,
,
বিকেলের রোদ্দুরে তপ্ত পরিবেশে। ইনজাদ একটু আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। ধীর পায়ে এগোতে লাগল পাড়ার মোড়ের দোকানটার দিকে। দুপুরে দোকান বন্ধ করে বাসায় গিয়েছিল লিমন। বাসায় খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে মাত্রই দোকান খুলে বসেছে সে। ইনজাদ গিয়ে দাঁড়াল দোকানের সামনে। মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল—

“মামা সিগারেট দাও তো।”

এ কয়েকদিনে লিমনের জানা হয়ে গেছে ইনজাদ কোন সিগারেট খায়। সে কোনো পালটা প্রশ্ন না করে ইনজাদকে সিগারেট দিলো। ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট পুরে দিয়ে ঝুলন্ত লাইটার দিয়ে তা জ্বালিয়ে নিল। মাথাটা ভনভন করছিল তার। দুপুরে খেয়ে আর বের হয়নি। কিন্তু ড্রয়ার হাতড়ে দেখে সিগারেটের প্যাকেট ফাঁকা। মেজাজ খিচতে গেল।

দৈবাৎ বাচ্চাদের হৈ হৈ শব্দে ভ্রূকুটি করে ইনজাদ। সতেজ চোখে চাইতেই দেখল পিপলু আরও কয়েকটা বাচ্চাকে নিয়ে মিষ্টি খেয়ে আনন্দ-উল্লাস করছে। ইনজাদ সিগারেট শেষ করল। সেইটা ফেলে দিয়ে পিপলুর কাছে এগিয়ে এলো। কিশোরী বিকেলের মোলায়েম রোদ। উষ্ণ পবনের ছড়াছড়ি। পিপলুকে ধরে প্রশ্ন করে ইনজাদ—

“এত খুশি কেন?”

পিপলুর সারা মুখে মিষ্টির রস লেগে আছে। হাতের মিষ্টির বাকি অংশটুকু মুখে দিতেই তার ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে রস বেরিয়ে আসলো। ইনজাদ মুচকি হাসল। পিপলুকে তার দারুন লাগে। যদিও অনেক চঞ্চল আর ইঁচড়েপাকা!
পিপলু অধর ছড়িয়ে তৃপ্তির শ্বাস ফেলে বলল—

“মিষ্টি খাইবেন?”

“কীসের মিষ্টি?”

“ভুতনীর বিয়ার মিষ্টি।”

ধক করে উঠল ইনজাদের বুক। কৌতূহলী গলায় বলল—

“কার বিয়ে?”

“আরে রেহাংশী ভুতনীর বিয়া। রতন ভাইয়ের লগে। আরে এইবার সেই খেলা হবে। ওর বিয়া হইলেই এখান থেকে যাইবোগা। তারপর বল মাইরা ওগো বাড়ির সব জানালা ভাইঙা ফালামু। সেদিন আমারে সেইরাম মারছিল।”

ইনজাদের মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অন্তঃকরণে তীব্র ঝড় উঠেছে। নিচ্ছিদ্র এক যন্ত্রণা, চিনচিন করে তার হৃৎস্পন্দন শিথিল করে দিচ্ছে। ইনজাদ দাঁড়াল না। অগোছালো, অনমনীয় পায়ে হাঁটতে লাগল। বাসার দরজা লাগানো হয়নি। তমালিকা ছেলের জন্য পায়েশ রান্না করছিলেন। ইনজাদের কানে উড়ো কথা ভেসে এলো—

“খন্দকার বাড়ির ছোটো মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। মিষ্টি দিয়ে গেছে।”

ইনজাদের রাগে পুড়ে যাওয়া চোখে দুটো নিবদ্ধ হলো ডাইনিং টেবিলে রাখা মিষ্টির বাটিতে। সে আরও শুনতে পেল পারভেজ মির্জার আহত কণ্ঠস্বর।

“তারা আর ছেলে পেল না। রতন! এই ছেলে একবার জেল খেটে এসেছে। মারামারি করে কোন ছেলের কান কেটে ফেলেছিল । মেয়েটার জীবনটাই নষ্ট করে ফেলবে।”

“নষ্ট হবে কেন? ছেলেটার একার দোষ না কি? একটা মেয়েকে নিয়ে লেগেছিল। প্রেম করে অন্য কাউকে বিয়ে করছিল তাই ওমন করেছে। মেয়েটার ভাই না কি ওর গায়ে হাত তুলেছে। বয়স কম, রক্ত গরম ছিল। আর সে অনেক আগের কথা। এই মেয়ে এমনিতেও অপয়া। নিজের মাকে পর্যন্ত ছাড়েনি।”

পারভেজা মির্জা রাগান্বিত গলায় বললেন—

“গ্রামে এসে তোমার মাথাটা একদম গেছে। কীসব কুসংস্কার নিয়ে পড়ে আছ! মেয়েটাকে একবার ভালো করে দেখেছ?”

“দেখতে হবে না। সেদিন দেখলাম ইনজাদ মেয়েটার সাথে কথা বলছে। ও মেয়ে যেন আমার ছেলের আশেপাশে না আসে। আমার একটাই ছেলে।”

রাগে রি রি করছে ইনজাদের দীর্ঘকায় দেহ। হাতের পেশি ফুলে ওঠেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে চোখের পল্লবে কম্পন শুরু হয়েছে। গ্রীষ্মের খা খা রোদ্দুরে হঠাৎ বর্ষণের মতো অযাচিত এই রাগের কারণ ইনজাদ বুঝতে পারছে না। রাগে বিহ্বল হয়ে মিষ্টির বাটিতে খাবলা বসায়। চারটা মিষ্টির সবগুলোই এখন লন্ডভন্ড হয়ে মেঝের বুকে পড়ে আছে। সে দৃশ্য রান্নাঘর থেকে বের হতে গিয়ে দেখলেন পারভেজ মির্জা।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here