বত্রিশ বছরের অপ্রকৃতিস্থ মামুনকে অস্থিতিশীল অবস্থায় দেখে পাড়ার বাচ্চারা হাসতে লাগল। ছোটো ছোটো লাল টুকরো ইট ছুড়তে লাগল হাসির ছলে। মামুন ব্যাথায় কাতরে উঠলেও প্রতিবাদ করল না। অগোছালোভাবে শরীরের নিম্নাংশ হাত দিয়ে চুলকাতে লাগল। তার গলদেশে বেশ খানিকটা জায়গা লাল হয়ে আছে। ধূলোয় মাখা কালো রঙের প্যান্টের বিভিন্ন জায়গায় ছেঁড়া। পায়ের আঙুলের ডগায় রক্ত জমে কালো হয়ে আছে। গায়ে পরা চেক শার্টের বুকের কাছে প্রায় অর্ধেক অংশ ছিঁড়ে নিচের দিকে ঝুলে আছে। মুখভর্তি দাঁড়ি -গোফের গহন অরন্য ভেদ করে তার পুরু ফ্যাকাশে ওষ্ঠাধর দৃশ্যত। কপালের নিচে এসে চোখ ঢেকে ফেলেছে অযত্নে বেড়ে উঠা খসখসে চুল। গায়ে কাদা, শার্টের গায়ে পানের পিচ এমনকি ডোবার ময়লার দুর্গন্ধ লেগে আছে।
প্রায়ই পূর্বাকাশে অরুণের আগমনি বার্তা মামুনের চোখের পাতায় পড়তেই সচল হয় সে। নিশীথের তমসার অবসান ঘটিয়ে সূর্যকিরণ উদ্ভাসিত হতেই মামুন ছুটে আসে নুপূরদের বাড়ির সামনে। ঘণ্টা ভরে সে এখানেই বসে থাকে। দিনের রোশনাইতে যখন সয়লাব হয় বসুন্ধরা, পত্রীদের কুহরণে কুজিত হয় প্রকৃতি, অবগুন্ঠিত পূর্বাকাশ উন্মোচিত হয় আপন মহিমায় তখন পাড়ার ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে মামুনের অস্থিতিশীল অবস্থা দেখে হাসিতে প্লাবিত করে নুপূরদের বাড়ির দরজা। সময় অসময়ে সুযোগে দুই একটা ইট-পাথর ছুড়ে দিয়ে নিজেদের তুষ্টির সীমান্ত বিস্তৃত করে তারা। মামুনের কাতর, ব্যাথাতুর চিৎকারে তখন বাড়ির ভেতর থেকে কেউ এলেই রক্ষে তার। বাচ্চারা তল্পিতল্পা গুটিয়ে ছুটে পালায় কণ্ঠরোধ করে।
আজও তাই হলো। বাড়ির ভেতর থেকে আজ স্বয়ং নুপূর এসেছে। তাকে দেখেই দুই হাতে তালির সরব তাল তোলে মামুন। দুই পাশে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের আত্মহারা খুশির প্রকাশ ঘটায়। পুরু অধরের ভঙ্গি বদলে যায় অনুপলেই।
দীর্ঘ কেশের এক লাস্যময়ী নারী নুপূর। তার নিটোল চেহারায় বঙ্কিম ভ্রূ যুগলের নিচের পদ্মলোচনে চোখ আটকে, ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা সকালের স্নিগ্ধ, সতেজ, মিষ্টি মলয়ে আকণ্ঠ ডুবে থাকা ইনজাদের। ইনজাদ স্থবির হয়ে গেল। নিমেষহীন, আকীর্ণ চাহনি।
একটা ধূসর রঙের স্যালোয়ার স্যুট পরেছে নুপূর। তন্দ্রা কেটে ধরণীর সাথে তাল মিলিয়ে জাগ্রত হয়েছে সে। অবিন্যস্ত চুলের অবাধ্য বিচরণ তার অঙ্গে। পদ্মকোরকের মতো পাতলা ঠোটে মসৃণ হাসি। হাতের থালায় কাল রাতের বানানো মালপোয়া। বাড়ির সামনে বিশাল উঠোন। একটা পুরোনো রডের দরজায় লক লাগানো। বাড়ির ছায়াতল থেকে উঠোনে পা রাখতেই তীক্ষ্ম রোদের ফলা চোখে বিঁধে যায় নুপূরের। চোখ বন্ধ করেই অধর বিস্তৃত করে নুপূর। তার সেই শব্দহীন হাসির ঝিলিক যেন চোখে গেঁথে গেল ইনজাদের। তার নিম্ন দৃষ্টি আরও নিম্ন হলো। নুপূর অমিলীত চোখে তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নিল। সকালের মিষ্টি রোদের প্রথম পরশ, শীতল পবন দোল খেলে গেল তার সর্বাঙ্গে।
নুপূর নরম পায়ে এগিয়ে আসছে। তার খোলাচুল উড়ছে মৃদু সমীরণে। তার বাড়ন্ত প্রতিটি পদযুগলে এক অনাস্বাদিত নেত্র তৃপ্তিতে নিজেকে হৃষ্ট করছে ইনজাদ। মৃত্তিকার বুকে নিজের অস্পষ্ট ছায়ায় পুলকিত হয় নুপূর। দরজার সামনে এসে সন্তর্পণে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতেই আনন্দে ডগমগিয়ে উঠা মামুন নুপূরের পাশ ঘেঁষে আসতেই সরে দাঁড়ায় সে। অপ্রকট রাগ দেখিয়ে বলল—
“তোমাকে না বলেছি এমনভাবে আর আমার বাসার সামনে আসবে না? মনে নেই?”
নয়নের লোভাতুর দৃষ্টি থালায় রাখা মালপোয়াতে। জিব দিয়ে লোলুপ শব্দ তুলে দুই হাতে তা ছিনিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে। নুপূর তেতো গলায় বলল—
“আর যদি এসব ছেঁড়া জামা-কাপড় পরে এখানে এসেছ, তাহলে আমি আর তোমার সাথে কথা বলব না, কিছু খেতেও দেবো না।”
মামুন বাচ্চাদের মতো দুই হাতে তালি মেরে দুই পা পরপর উঠিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। তার সম্পূর্ণ মনোনিবেশ মালপোয়াতে। নুপূর তার দিকে বাড়িয়ে দেয় থালাভর্তি মালপোয়া। যেন দীর্ঘ দিনের খুদা মেটাবে মামুন। দুই হাতে দুই মালপোয়া নিয়ে টপাটপ মুখে পুরে যাচ্ছে। তার দাঁড়ি-গোফ মেখে যাচ্ছে মালপোয়ার উচ্ছিষ্টাংশে। নুপূর চ্যাপ্টা অধরে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। বাড়ির জন্য ঘুরে দাঁড়াতে গেলেই সামনের একতলা বাড়ির ছাদে নজর যায়।
দীর্ঘদেহী অচেনা পুরুষটিকে আগে কখনো দেখেনি নুপূর। তার প্রশস্ত বক্ষপুট উদোম। ইনজাদের চওড়া কাঁধ আর বদ্ধদৃষ্টিতে সচকিত হয় নুপূরের অন্তঃকরণ। পুরুষটি তার গম্ভীর দুই দুর্বোধ্য আঁখিতে নুপূরকেই দেখছে তা প্রতীত হতেই ব্যস্ত পায়ে ভেতর বাড়িতে ছোটে সে। নুপূরের অস্তিত্ব লীন হতেই চোখে হাসে ইনজাদ। তার বক্ষস্থলে ঝংকার তুলেছে সেই অপরিচিতা।
,
,
,
রান্নাঘরের খুটখুট আওয়াজে নুপূরের নিউরণে প্রতীত হয় তার মায়ের উপস্থিতি। বিড়াল ছানার মতো পা টিপে টিপে রান্নাঘরে ঢোকে সে। পেছন থেকে সহসা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরতেই ঝিনুক বেগম লাফিয়ে ওঠেন। কলহাস্যে মেতে উঠে নুপূর। ঝিনুক বেগম রাগী চোখে চেয়ে বললেন—
“আজও পাগলটাকে খাবার দিয়ে এসেছিস?”
নুপূর টুপ করে কিচেন রেকের উপর উঠে বসে। পা নাচিয়ে অসহ্য গলায় বলল—
“উফ! মা। তোমাকে না বলেছি ওকে পাগল বলবে না। প্রেমে যারা উন্মাদ হয় তাদের পাগল নয় দিওয়ানা বলতে হয়, বুঝলে?”
ঝিনুক বেগম মুখ বিকৃত করে বললেন—
“তোকে বলেছি না ওর এত কাছে যাবি না। কখন কী করে বসে!”
নুপূরের হাসি হাসি মুখটা ক্ষণপলেই নিভে গেল। দুঃখী গলায় বলল—
“মামুন ভাই কত ভালোবাসত মেয়েটাকে তাই না! সত্যিকারের ভালোবাসা পূর্ণতা কেন পায় না বলোতো মা?”
ঝিনুক বেগম অসন্তুষ্ট চোখে চেয়ে গাঢ় স্বরে বললেন—
“তোকে ওসব ভুলে যেতে বলেছি আমি।”
বদ্ধ উন্মাদ মামুন একটি মেয়েকে ভালোবাসত। মেয়েটির বাবা-ভাই জোর করে মেয়েটিকে এক ধনীর দুলালের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের দিন মামুন সেখানে গিয়ে ঝামেলা করলে মেয়েটির ভাই আর মামারা তাকে মেরে আধমরা করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসে। আশেপাশের মানুষ যখন মামুনকে হাসপাতালে নিয়ে যায় তখন তার অবস্থা খুবই খারাপ। প্রায় এক সপ্তাহ পর মামুনের জ্ঞান ফিরে। কিন্তু তারপর থেকে সে কাউকে চিনে না। তার মস্তিষ্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তার বাবা-মা তাকে যতই বেধে রাখে না কেন, ততই সে হিংস্র হয়ে ওঠে। নিজের হাত,পা এমনকি শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কামড় দিয়ে নিজেই রক্তাক্ত করে।
নুপূর ঝকঝক করে হেসে ওঠে। প্রাণবন্ত গলায় শুধাল—
“পায়েল কোথায় মা? ও এখনো ওঠেনি?”
ঝিনুক বেগম নিঃশব্দে না বোধক মাথা নাড়লেন। ঠোঁট কামড়ে বিরক্তি প্রকাশ করল নুপূর। আঁখিপুট ঝাঁকিয়ে কলের পুতুলের মতো রাগ দেখিয়ে বলল—
“এই মেয়ে এত ঘুমাতে পারে! আমি এক্ষুনি ওকে টেনে তুলব। ফাজিল মেয়ে!”
নুপূর তটস্থ পায়ে ছুটে আসে ছোটো বোনের কক্ষে। আপাদমস্তক পাতলা চাদরে মুড়ে বলয় হয়ে ঘুমিয়ে আছে পায়েল। নুপূর গিয়েই টান মেরে চাদর সরিয়ে ফেলে। ঠিক যা ভেবেছিল সে! পায়েল মোবাইল টিপছে। ঘুম থেকে উঠে তার প্রথম প্রদক্ষিণ চলে সোশ্যাল মিডিয়ায়। চোখের তারা স্থির করে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে পায়েল। নুপূর দুষ্ট হেসে তার কোমরের দুই পাশে এলোপাথাড়ি সুড়সুড়ি দিতে থাকে। খলখল হাসিতে মুখরিত হয় ঘরের বাতাস। ব্যস্ত হয়ে উঠে বসে পায়েল। তার চোখ জোড়া সিক্ত। অধরে বিস্তৃত মোলায়েম হাসি। হাত থেকে মোবাইলটা রেখে বোনের সাথে নীরব, আদুরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। চকিতে মায়ের কর্কশ, তাপিত কণ্ঠে দুই বোন থমকে যায়। ত্রস্ত পায়ে দৌড়ে আসে ঘটনাস্থলে। ঝিনুক বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে রেহাংশী। তার নরম, তুলতুলে গালে ঝিনুক বেগমের হাতের পাঞ্জা বসে আছে। খাবার টেবিল থেকে বেখেয়ালিতে পানি খেতে গিয়ে চায়ের কাপ ফেলে দেয় রেহাংশী। নুপূরের বাবা জুলহাস খন্দকার চা পান করে কাপ রেখেছিলেন টেবিলের কোণায় । অসাবধানতায় তা হাত লেগে পড়ে যায় নিচে। ঝনঝন শব্দে ব্যগ্র হয়ে ছুটে আসেন ঝিনুক বেগম। এসেই এক ভয়ংকর চড় বসালেন রেহাংশীর গালে। গলা চড়িয়ে বললেন—
“অপয়া মেয়ে কোথাকার! কোনো কিছুই দেখিস না তুই? দিলি তো আমার নতুন টি সেটের কাপটা ভেঙে?”
রেহাংশীর আঁখি দিয়ে অঝোর ধারা ঝরলেও কোনো শব্দ নেই তাতে। শান্ত স্বরে বলল—
“আমি ইচ্ছে করে ফেলিনি বড়ো আম্মু। হাত লেগে পড়ে গেছে।”
“তুই কী ইচ্ছে করে করিস? সব তো হাত লেগেই হয়। অলক্ষুণে মেয়ে কোথাকার। যা আমার সামনে থেকে। এ বেলাও তোর খাওয়া বন্ধ।”
জুলহাস খন্দকার দুঃখ প্রকাশ করে বললেন—
“আহা! কী শুরু করলে সকাল সকাল। কাল রাতেও মেয়েটাকে খেতে দাওনি। আবার এখন! ”
“আপনি চুপ থাকুন। ওকে যে এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছি তাই ই অনেক। তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা আমার চোখের সামনে থেকে।”
রেহাংশী কান্না রোধ করে নিল। এটাই তার নিত্য জীবন। ছোটোখাটো ভুলেই তার খাওয়া আটকে দেয় ঝিনুক বেগম। নুপূরের বাবারা দুইভাই এক বোন। বড়ো ভাই জুলহাস খন্দকারের দুই মেয়ে, নুপূর আর পায়েল। পিঠেপিঠি দুইবোনের গলায় গলায় ভাব। জুলহাস খন্দকারের ছোটো ভাই জিবরানের মেয়ে রেহাংশী। সঙ্গত কারণে তিনি এই বাড়িতে থাকেন না। ছোটো বেলা থেকে এই বাড়িতে একা বেড়ে উঠা রেহাংশীর একমাত্র আপন রাতের আঁধার।
,
,
,
বালিশে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে যাচ্ছে রেহাংশী। কাল রাতেও সে ঠিকমতো খেতে পারেনি। অর্ধেক খাবার জুটেছে। এখন পেটের মধ্যে নাড়িভুঁড়ি পেঁচিয়ে যাচ্ছে। দরজায় করাঘাত পড়তেই বালিশ থেকে মুখ সরায় রেহাংশী। দমকা হাওয়ার মতো আচমকাই ঠোঁটের কাণে হাসি ফুটে ওঠে তার। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবিষ্ট হয় নুহাশ। তাকে দেখেই চঞ্চল হয় রেহাংশীর শান্ত মন। নুহাশ কাছে এগিয়ে আসতেই বিছানায় শক্ত হয়ে বসে সে। নুহাশ স্মিত হাসে। আলুলায়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করে—
“খিদে পেয়েছে তোর?”
রেহাংশী মাথা ঝাঁকায়। নুহাশ নরম হেসে হাতের বাটিটা এগিয়ে দেয়। গালভর্তি সতেজ হাসে রেহাংশী। বাটিটা হাতে নিতেই উৎফুল্ল হয়। দুই পিচ গরুর মাংসের সাথে দুটো চালের রুটি। রেহাংশী সময় ব্যয় করল না। খেতে শুরু করল। নুহাশ হাসল। মৃদু কম্পনে। আড় চোখে তাকাল রেহাংশী। সন্দিহান গলায় বলল—
“এখানে হাসার কী হলো?”
নুহাশ নির্লিপ্ত। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল—
“সাবধানে থাকতে পারিস না?”
নুহাশ তার হাত বাড়ায় রেহাংশী দিকে। ছিটকে সরে এসে বলল সে—
“একদম ছোঁবে না আমাকে।”
নুহাশের টানটান কপালে ভাঁজ পড়ে। তীক্ষ্ম গলায় বলল—
“এমন ছ্যাত ছ্যাত করিস কেন তুই?”
রেহাংশী রুটির টুকরো মুখে পুরে দিয়ে বলল—
” আমাকে পায়েল আপু ভেবো না।”
নুহাশ শঠ হাসে। ফিচেল গলায় বলল—
“তুই কী পায়েলের মতো না কি! তুই তো ওর চেয়েও সুন্দরী।”
“এসব ফালতু কথা বলে ভেবো না আমাকেও পায়েল আপুর মতো…।”
রেহাংশী আক্রোশভরা চোখে তাকায়। নুহাশ চিন্তাহীন হেসে বলল—
“আরে আমি তো পায়েলকে ভালোবাসি।”
“ভালো বাসলে বিয়ে করছ না কেন? বিয়ের আগেই এসব কী শুরু করেছ তোমরা!”
নুহাশ মনমরা গলায় বলল—
“আমার কী দোষ বল? নুপূরের বিয়ে না হলে তো আর পায়েলের বিয়ে দেবে না মামানি। আগে নুপূরের বিয়ে হোক।”
রেহাংশী বাটির গায়ে লেগে থাকা গোস্তের ঝোলের শেষ অংশটুকুও চেটে খেয়ে নিল। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলল—
“তাহলে নিজেদের সংযত রাখতে পারো না। যেদিন ধরা খাবে সেদিন বুঝবে।”
নুহাশ দিলখোলা হাসে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল—
“তুই আছিস না। ধরা খাওয়ার চান্স-ই নেই।”
বিতৃষ্ণা চোখে তাকাল রেহাংশী। নুহাশের অধরে লুকায়িত ক্রুর হাসি। নুহাশ রেহাংশীর ফুফাত ভাই। এই বাড়িতেই থাকে। মামার বাড়িতে কোনো ছেলে সন্তান নেই বলে তাকে সবাই সমীহ করে। জুলহাস খন্দকার একা হাতে তাদের ব্যবসায় সামলাতে পারেন না বলে নুহাশকে আনা হয়েছে। নুহাশ আর নুপূর প্রায় সমবয়সী। তাই এই বাড়িতে এসেই তার প্রথম টার্গেট হলো পায়েল আর রেহাংশী। ছোটো বয়স থেকে অযত্নে, অবহেলায় বেড়ে উঠা রেহাংশীর মনে প্রেম জাগ্রত করতে না পারলেও পায়েলকে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে নুহাশ। তার একমাত্র লক্ষ্য মামা বাড়ির একাংশের মালিক হওয়া।
,
,
,
ছাদের পাটাতনে হেঁটে চলছে ইনজাদ। তার বিক্ষিপ্ত, তূরন্ত মস্তিষ্ক। দমকা শীতল হাওয়া তার গায়ের টিশার্ট ভেদ করতে পারলেও তার হৃৎপ্রকোষ্ঠকে শান্ত করতে পারছে না। হাতের ভাঁজের নিকোটিনের ধোঁয়ায় রাতের আঁধার ধোঁয়াশা করে তুলছে। সেই অপরিচিতাকে আরেক ঝলক দেখার আকুল আবদার তার কাতর আঁখিযুগলের। উদ্বেলিত তার দেহপিঞ্জর। চারটা সিগারেটের ফিল্টার ছাদের পাটাতনে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাঁচ নম্বর সিগারেট ঠোঁটের ভাঁজে রাখতেই ইনজাদের ঊষর হৃদয়ে প্রেমবর্ষণ হলো। থমকে গেল তার এলোমেলো,অগোছালো পা। স্থির হলো চোখ। একতলার ছাদ থেকে দোতলার ছাদে নিমেষহীন চেয়ে রইল ইনজাদ।
নভোলোকে উঠেছে জ্যোৎস্নানাথ। রুপোর থালার মতো গোলাকার বিধুর বিমোহিত চন্দ্রাতপ প্রজ্জ্বলিত করছে যামবতীর অন্ধতমিস্রকে। নিকষ তমসার খাঁজে খাঁজে অস্পষ্ট তারার খেল।
চাঁদের ক্ষীণ আলোতে ছাদের কার্ণিশে দন্ডায়মান যোষিতা অবয়বটির মুখশ্রী স্পষ্টত নয় ইনজাদের কাছে। তবুও তার দৃষ্টি তৃপ্ত, পুলকিত, স্থবির। তার উষ্ণ শ্বাসের গতি শিথিল হয়েছে। কাম্য নারীর ওই অস্বচ্ছ মুর্তিই যেন আজ কাঁপিয়ে তুলছে ইনজাদের বক্ষপিঞ্জিরায় আবদ্ধ প্রেম নামক অনুভূতিকে। হাতে থাকা সিগারেটের জ্বলন্ত ফিল্টার পায়ের নিচে পিষে ধরে চাঁদের আলোয় প্রেয়সীকে দেখার অতলান্তিক আবেশে আপ্লুত চাহনি তার। কিন্তু মিটছে না তৃষ্ণা। এইটুকুতে ভরছে না মন। প্রেয়সীর অসজ্ঞায়িত আননের স্পষ্ট দর্শনই যেন ইনজাদের প্রেমের উত্তাল সাগরের ঢেউয়ে ভাটা আনতে পারবে। সেই অনিশ্চিত আশায় বুক বেঁধে চেয়ে রইল ইনজাদ।
চন্দ্রের আলো ভালো লাগে না রেহাংশীর। মানুষ না কি চন্দ্রের আলোতেও মূর্ছা যায়! অবাক লাগে তার। রেহাংশীর ভালো লাগে নিকৃষ্ণ আকাশ, চাঁদহীন অমানিশি। শান্ত ঢেউ নয়, উত্তাল তরঙ্গমালা যা ভাসিয়ে নেবে সব। কিছু ফেলে যাবে না।
মানবজীবন তার ভালো লাগে না। তার পাখি হতে ইচ্ছে হয়, খুব করে উড়তে ইচ্ছে হয়, পাখা ঝাপটাতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু তা সে পারে না। এই পৃথিবীর মানুষগুলোকেও তার ভালো লাগে না। সবাই একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। আর এই ঘোর তাদের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে। তারা ভুল করে। ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার সংযোগ মেলে না। সব ধ্বংস হয়ে যায়। রেহাংশীর জীবনটাও ঘোরের সৃষ্টি। বাবা -মায়ের প্রনয়ের পরিণয় ঘটলেও তার জন্ম ছিল ঘোর। আর তাই সে সব থেকেও অনাথ। তার পায়েল আপুও এখন ঘোরের মধ্যের আছে। প্রেম নামক ঘোর। যা একটু একটু করে তাকে শুষে নিচ্ছে। তার নুপূর আপুও বছর কয়েক আগে বিশ্বাস নামক ঘোরে পড়েছিল। তার মূল্যও নুপূরকে চুকাতে হয়েছে। পৃথিবীর সব মানুষ-ই কোনো না কোনো ঘোরের মধ্যে থাকে। আর সেই ঘোর সে ততক্ষণ কাটিয়ে উঠতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তার পরিণতি ঘটে।
রেহাংশী সেই ঘোরের একটা নাম দিয়েছে। মোহঘোর! অর্থাৎ মোহজনিত ভুল বা ভ্রান্তি। এই মোহঘোরে যে একবার পড়েছে তার সর্বনাশ অনিবার্য। মোহাচ্ছন্ন হয়ে মানুষ ভুল করে। তখন সে কিছুই বুঝতে পারে না। নিজেকে ডুবন্ত সাগরে ভাসন্ত মনে হয়। যা মিথ্যে, চোখের ছল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেহাংশী। সে কখনো মোহঘোরে আবিষ্ট হতে চায় না।
কিন্তু জীবন বড়ো অদ্ভুত ! এই জীবনে তাই ঘটে যা আমরা চাই না। রেহাংশীর নজর গিয়ে পড়ে তাদের বিপরীতে থাকা নতুন একতলা বাড়িটির দিকে। কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। রেহাংশী আঁখি সংকোচন করে। তার জানামতে সেই বাড়িতে দুইজন স্বামী-স্ত্রী থাকে যারা মধ্যবয়স্ক। তারা এত রাত ছাদে আসে না। তাহলে যে দাড়িয়ে আছে সে কে? তার চোখের সত্য না কী মোহঘোর?
চলবে,,,
#মোহঘোর
#পর্বঃ১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি