মোহঘোর #পর্বঃ৩৫

0
509

#মোহঘোর
#পর্বঃ৩৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

প্রস্ফুটিত সূর্যের তীর্যক রশ্মি! এলোমেলো হয়ে ছুঁইছে পিচঢালা সড়ক পথ। ঝিম ধরা কোলাহলে যান্ত্রিক নগরী সয়লাব। দুপুর রোদে জেগে উঠেছে গা পোড়া ভাব। হেমন্তের এই প্রভাযুক্ত বিষন্ন দুপুরটাও মন খারাপের একটা কারণ হতে পারে!

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রেহাংশী। ঘণ্টা হয়েছে গ্রাম থেকে ফিরেছে তারা। গোসলে ঢুকেছে ইনজাদ। তটস্থ সে। রেহাংশীর পূর্ণ প্রস্ফুটিত আঁখিযুগলের নিষ্কম্প, উৎসুক চাহনি বাড়ির নিচে দাঁড়ানো হকারের দিকে। গুটিকতক ললনার ভীড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বিক্রেতা। গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে আস্ত নজরে অবলোকন করছে তা। বিক্ষিপ্ত শব্দে বেজে উঠল ইনজাদের মুঠো ফোন। সরব হলো রেহাংশী। আস্তব্যস্ত হয়ে ছুটে এলো সে। বিছানার পাশ টেবিলের ওপর রাখা অনবরত বাজতে থাকা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে সিন্ধুজার নাম স্পষ্টত। রেহাংশী দ্বিধান্বিত হলো। বেজে যাচ্ছে মোবাইল ফোন। কৌতূহল নিয়ে তাকাল ওয়াশরুমের দিকে। পরক্ষণে নজর ফিরিয়ে আনল মোবাইল ফোনের ওপর। বিভ্রান্ত চিত্তে তুলে নিল যন্ত্রটি। রিসিভ করে কান পাতল তাতে।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো ইনজাদ। সফেদ তোয়ালের ঘর্ষণে শুষে নিচ্ছে চুলের পানি। উন্মুক্ত, প্রশস্ত বুকের পাটায় জমে আছে শীতল জল। ইনজাদ সপ্রতিভ চোখে চাইল। তার এলোথেলো চুল কপাল ঢেকে রেখেছে। বিছানার হেডবোর্ডের কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়াল রেহাংশী। তার অবারিত চাহনি ইনজাদের দিকে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে রেহাংশীর কাছে এসে দাঁড়াল ইনজাদ। নরম শ্বাস ফেলে তার ভিজে অধরৌষ্ঠের অনমনীয় ছোঁয়া ঠুকে দিলো রেহাংশীর গণ্ডদেশে। ঝুম বৃষ্টির শীতল নহরে সিক্ত হলো রেহাংশী। তার অন্তঃরিন্দ্রিয় কেঁপে উঠল নিগূঢ়ভাবে। ইনজাদের প্রণয়স্পর্শ নেমে এলো মন্থর গতিতে। কণ্ঠদেশে সংসর্গ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো। যন্ত্রণাদায়ক সূখানুভূতির ক্ষত সৃষ্টি করল প্রণয়িনীর কন্ঠমনির সংলগ্নে। লাজহীন হাসল প্রণয়ী। লাজুকতার অতল জলারণ্যে আকণ্ঠ ডুবে গেল রেহাংশী।

ইনজাদ ভারী প্রতিক্রিয়া ছাড়া বিছানায় বসল। পাশে দাঁড়ানো সহগামিণীর দিকে মায়াময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল—

“কে ফোন করেছে?”

রেহাংশী ব্রীড়াতে আড়ষ্ট হওয়া কণ্ঠে বলল—

“সিন্ধুজা।”

“কী বলেছে?”

“আপনাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।”

ইনজাদ ভেজা তোয়ালে বিছানার ওপর রাখল। আধভেজা চুলে হাত গলাল। চপল পায়ে ছুটল রেহাংশী। আলমিরা থেকে একটা শার্ট এনে ইনজাদের পাশে রাখল। ইনজাদ উঠে দাঁড়াল। দ্রুতহাতে গায়ে শার্ট গলিয়ে নিল। ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা টাই নিয়ে কলারে গুঁজে নিতেই আচানক প্রশ্ন ছুড়ে রেহাংশী।

“কখন ফিরবেন?”

ইনজাদ সোজা গলায় বলল—

“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সন্ধ্যার মধ্যেই ফেরার চেষ্টা করব।”

রেহাংশী থেমে গেল। তার ভাবনার রঙ বেরঙের ফড়িংগুলো অযথাই জ্বালাতন করছে তাকে। ইনজাদ নিজেকে ঠিক করল। দৃঢ় হয়ে দাঁড়াল রেহাংশীর শিরের সামনে। শিরদাঁড়া পর্বতের ন্যায় অটল করে পকেটে হাত গুঁজে নিল ইনজাদ। যৎসামান্য ঝুঁকে রেহাংশীর অদৃষ্টে উষ্ণ চুম্বন করল। সতর্ক চোখে তাকাল রেহাংশী। ইনজাদ মৃদুহাস্য অধরে মায়া লেপন করে বলল–

“চিন্তা করো না। যত দ্রুত সম্ভব আসার চেষ্টা করব। রান্না করবে, না কী খাবার কিনে এনে দেবো?”

তরল গলায় প্রত্যুত্তর করে রেহাংশী—

“লাগবে না। আমি রান্না করে নেবো। আপনি সাবধানে যাবেন।”

“হুম। আসি, খেয়াল রেখো নিজের। না খেয়ে থাকবে না একদম। তাহলে কিন্তু ভালো হবে না।”

রেহাংশী মুচকি হেসে বলল—

“থাকব না।”

ইনজাদ ঘাড় বাঁকিয়ে আদর আঁকল রেহাংশী নরম গালে।

দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে অনিমেষ চেয়ে আছে রেহাংশী। সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে ইনজাদ। চোখের দর্পণে যতক্ষণ তার দেহপিঞ্জর দেখা যাচ্ছিল রেহাংশী অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আড়াল হতেই স্বামীর অস্পষ্ট পদধ্বনি শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে রইল সে। তার দিব্য দৃষ্টি তাকে তার প্রাণেশ্বরের অবয়বের অস্বচ্ছ আভাস দিচ্ছে।
,
,
,
অস্তাভা সূর্যের রক্তিম আভা লুপ্ত হয়ে গেল কালচে নীলাভ অম্বরের বুকে। ঘন তমসার সাথে মিহি কুয়াশার এক দাম্ভিক মিলন ঘটেছে! মৃদু শীতল প্রভঞ্জন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল নগরবাসীকে। গাড়ির খোলা জানাল দিয়ে তরতর করে ঢুকছে বায়ু। সিটের সাথে হেলান দিয়ে অন্যমনষ্ক চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে ইনজাদ। অচিরেই থেমে গেল যান্ত্রিক বাহন। ইনজাদ সম্বিৎ ফিরে পেল। ড্রাইভিং সিটে বসা ললনার দিকে গাঢ় চোখে চেয়ে বলল—

“গাড়ি থামালে যে?”

সিন্ধুজা প্রসন্ন হেসে রহস্য করে বলল—

“নামো, তারপর বলছি।”

ইনজাদ সন্দিহান চিত্তে চুপ করে বসল। সিন্ধুজা ব্যস্ত হয়ে নেমে এলো গাড়ি থেকে। জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ইনজাদকে উদ্দেশ্য করে বলল—

“কাম অন। কাম ফাস্ট!”

ইনজাদ ধীরগতিতে গাড়ি থেকে বের হলো। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দেখল বিশাল এক শো-রুম। শো- রুমের সামনেই দাঁড়ানো তারা। ইনজাদ ঔৎসুক্য গলায় বলল—

“এখানে কেন?”

সিন্ধুজা গাড়ির ডিকির সামনে এলো। ইনজাদ এগিয়ে গেল সামনে। নিজের স্বীকারোক্তিতে সিন্ধুজা বলল—

“একচুয়েলি আই এম ভেরি এক্সাইটেড!”

ইনজাদ ছোট্ট করে হাসল। সহসা কপাল কুঞ্চন করল। চোখের কোটর ক্ষুদ্র করে বলল–

“হোয়াই?”

সিন্ধুজা চমৎকার হাসল। শো-রুম থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে আসা আলোতে সেই হাসি স্পষ্ট দেখল ইনজাদ। অভাবিত খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সিন্ধুজার মুখচ্ছবি। ইনজাদ চমকিত হলো। সিন্ধুজা চট করে বলল—

“ড্যাড বাঙালি পোষাক পরতে ভালোবাসে। আমার অবশ্য এসবে কোনো ধারণা নেই। আমি চাচ্ছি তিয়ার বিয়েতে ড্যাডকে একটা পাঞ্জাবি গিফ্ট করতে। তুমি আমাকে সাহায্য করবে।”

ইনজাদ বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে বলল—

“আমি?”

“হ্যাঁ, তুমি। আই থিংক, ইউর চয়েজ ইজ ভেরি গুড। ড্যাডেরও পছন্দ হবে। যেহেতু এইটা সারপ্রাইজ, তাই ড্যাডকে বিয়ের দিনই দেবো। ছেলেদের ড্রেস সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। ”

ইনজাদ নরম হাসল। কপাল টানটান করে বলল—

” ওকে। বাট, স্যার যদি রেগে যান তাহলে কিন্তু দোষটা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নেবো। নাহলে চাকরি নিয়ে টানাটানির পড়বে আমার।”

ঝুমঝুমিয়ে হেসে উঠল সিন্ধুজা। রোদে ভরা তপ্ত দুপুরে আকাশ ফুঁড়ে নামা অকস্মাৎ বৃষ্টির মতো ইনজাদের হাত ধরে টেনে নিতে থাকে সিন্ধুজা। ইনজাদ অপ্রস্তুত হলো। মুখে কিছু বলতে পারল না।

পাঞ্জাবির কর্ণার হতে দুটো পাঞ্জাবি পছন্দ করে সেখান থেকে সরে আসে ইনজাদ। তার বেখেয়ালি চাহনি হঠাৎ থমকে গেল গাঢ় বেগুনি রঙের ব্যাকলেস গাউনে। ইনজাদ ধ্যানমগ্নের মতো এগিয়ে গেল ডিসপ্লেতে রাখা গাউনটির কাছে। আলতো স্পর্শে কাপড়ের কোমলতা দারুনভাবে মোহিত করল তাকে। ব্যাকলেস গাউনটির বক্ষের কাছটায় আড়াআড়ি করে ভাঁজ ভাঁজ তাকের সৃষ্টি। যা দেখতে অনেকটা শাড়ির কুচির মতো।কোমরের কাছে ওই রঙের বেল্ট। তার ওপর পার্ল বসানো। গাউনটির নিচের অংশ ভারী করতে তার পাড়ে লাগানো হয়েছে সরু বর্ডার। তাতে পার্লের সাথে সুতোর মিহি কাজ যার দরুন তা ছড়িয়ে থাকবে। এক ঝটকায় ইনজাদ রেহাংশীকে কল্পনা করল তাতে। লাজুক হাসল সে। সেল্সবয়দের পারমিশন নিয়ে একটা ছবি তুলে তা হোয়াটসএপে সেন্ট করল রেহাংশীকে। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করে রেহাংশীকে কল করল। একপাশে দাঁড়িয়ে ওপাশের কামিনীর প্রতিউত্তর শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল সে। রেহাংশী কল রিসিভ করেই সালাম দেয়। ইনজাদ সালামের উত্তর দিয়েই বলল—

“ড্রেসটা পছন্দ হয়?”

রেহাংশী নাক কুঁচকে চাপা স্বরে বলল—

“ধুর! এইটা কী জামা! এইটা পরে কী মানুষের সামনে যাওয়া যাবে না কী?”

ইনজাদ প্রণয়সিক্ত গলায় বলল—

“মানুষের সামনে যাবে কেন? আমার সামনে পরবে। শুধু আমি দেখব। নিয়ে আসবো?”

“উঁহু। আমি পরব না। ধুর! কেমন দেখায়!”

“আমার যে পছন্দ হয়েছে বিষবাণ! ফেলে আসতে তো পারব না। নিয়ে নিয়েছি। তুমি যখন পরবে না, তাহলে সিন্ধুজাকে দিয়ে দিই।”

রেহাংশী মৌনতার গর্তে ঢুকে গেল। চুপ করে শ্বাস ফেলছে সে। ইনজাদ মুচকি হেসে বলল—

“নিয়ে আসছি আমি। আধা ঘণ্টা লাগবে আমার ফিরতে। রাখছি এখন।”

লাইন কেটে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকাল ইনজাদ। পেছন ফিরতেই চকিত হলো সে। তার মুখের সামনে শপিং ব্যাগ। ইনজাদ বিব্রত কণ্ঠে বলল—

“কী হলো।”

“দিস ইজ ফর ইউ।”

“মানে?”

“ব্যাকলেস ডার্ক ভায়োলেট গাউন!”

ইনজাদ চোখে হাসল। ব্যাগটা নিয়ে বলল—

“তুমি দাঁড়াও, আমি বিল পে করে আসছি।”

“আমি পে করে দিয়েছি। ডোন্ট ওয়ারি।”

“তুমি কেন?”

“ইটস ওকে ম্যানেজার সাহেব। ধরো, এইটা আমি আমার বোনকে গিফ্ট করলাম। ওকে।
চলো এবার।”

শো-রুম থেকে বেরিয়ে এলো দুইজন। ইনজাদ ভেবে রাখল, যথা সময়ে সে সিন্ধুজাকে তার রিটার্ন গিফ্ট দিয়ে দেবে।

চলবে,,,

এইটা আমার গ্রুপ। ইচ্ছে হলে এড হতে পারেন। সেখানেও নতুন একটা গল্প পোস্ট করা হচ্ছে।

https://m.facebook.com/groups/575775953721303/permalink/576002033698695/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here