মোহঘোর #পর্বঃ৩৬

0
434

#মোহঘোর
#পর্বঃ৩৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ম্লান চোখে তাকিয়ে আছে রেহাংশী। তার অস্থির অন্তঃকরনে শরতের নিরবধি উড়ে চলা মেঘের মতো সহস্র প্রশ্নের বহর।
ইনজাদ সরব চোখে চাইল। খাওয়ার মাঝে বিরতি দিয়ে স্ত্রীর কোমল মুখের দিকে তাকিয়ে বলল—

“না খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?”

রেহাংশী চোখে নামাল। প্লেট ভর্তি খাবারের মধ্যে হাত ডুবিয়ে বলল—

“সিন্ধুজার বয়স কত?”

ইনজাদ চিবুতে থাকা দন্তপাটির নিষ্পেষণ বন্ধ করল। মোলায়েম চোখে চেয়ে মৃদু হেসে বলল—

“মেয়ে মানুষদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই। পাপ হয় এতে বুঝলে!”

রেহাংশী ভার গলায় বলল—

“সিন্ধুজা বিয়ে করছে না কেন?”

ইনজাদে চোখে ঈষৎ বিরক্তি ফুটে ওঠল। গ্লাস নিয়ে পানি পান করে সতেজ গলায় বলল—

“ও কেন বিয়ে করছে না তা আমি কী করে বলব? আজব প্রশ্ন করো তুমি আজকাল! আর ও এত পড়াশোনা করেছে চুলো ঠেলতে নয়। বিজনেসের প্রতি প্রবল ঝোঁক ওর। এত পড়াশোনা, কিছু তো করুক। তারপর না হয় বিয়ের কথা ভাববে।”

রেহাংশী নিভে গেল। নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে বলল—

“আমি তো পড়ালেখা পারি না।”

“পড়ালেখা পারো না এইটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। উচ্চ শিক্ষা নিতে পারোনি। আমাদের সমাজে এমন অনেক মেয়েরা আছে। গ্রামে এর পরিমাণ আরো বেশি। আর তুমি করতে পারোনি তোমার পাগলা গারদের মানুষদের জন্য। বলেছি তোমাকে আমি। তুমিই তো রাজি হলে না।”

রেহাংশী মৌনতার জলেশ্বরে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। ইনজাদ ফের বলল—

“জরুরি নয়, সবাইকে উচ্চ শিক্ষা নিয়েই কিছু করতে হবে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয় তার শ্রেষ্ঠ কাজের জন্য। মাদার তেরেসাকে স্বরণ করা হয় তার নিঃস্বার্থ কাজের জন্য। মেয়েরা এখন কোনো কিছুতে পিছিয়ে নেই। মর্তভূমিতে যেমন তাদের বিচরণ, তেমন আকাশ পথেও তাদের আধিপত্য। মেয়েরা কৃষিকাজ যেমন করে, তেমন প্লেনও ওড়ায়।
এছাড়াও আছে অনলাইন বিজনেস, বিভিন্ন ব্লগ, আমাদের দেশীয় কুটির শিল্প, তাঁত শিল্প; কোথায় নেই মেয়েরা? সবকিছুতে উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন একাগ্রতা, নিষ্ঠা, অদম্য ইচ্ছা শক্তির। রান্না দিয়ে আজকাল মানুষ বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছে। অনলাইনে খাবার ডেলিভারির মাধ্যমে নিজের পরিচিতি বাড়াচ্ছে, নিজের নাম কামাচ্ছে। তুমি চাইলে অবশ্যই আমি তোমাকে মানা করতাম না।”

ইনজাদের খাওয়া প্রায় শেষ। সে তার খালি প্লেট নিয়ে উঠে চলে যায় বেসিং এর কাছে। রেহাংশী ক্ষুণ্ণ গলায় বলল—

“আমি তো এসবের কিছুই পারি না।”

ততক্ষণে ইনজাদ রেহাংশী কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘাড় নিচু করে পেছন দিক থেকে তার গালে টুপ করে চুমু খেয়ে বলল—

“তোমাকে কিছু পারতে হবে না। ভালোবাসতে পারো তো! তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।”

ইনজাদ শয়ন কক্ষের দিকে পা বাড়ায়। রেহাংশী স্থির হয়ে বসে রইল। সে তো কিছুই পারে না। কোনো গুন নেই তার। গুনহীন এই ক্ষণস্থায়ী রূপ দিয়ে কতদিন ধরে রাখবে নিজের স্বামীকে? এই শহরটা বড্ড নোংরা ! তার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। রেহাংশীর ভয় হয়। এই বুঝি তার সব শেষ হয়ে গেল?
,
,
,
আবছা মোলায়েম, স্নিগ্ধ, কোমল আলোর অবিশ্রান্ত পরশ। রেহাংশীকে বুকের মাঝে জড়িয়ে রেখেছে ইনজাদ। রেহাংশীর উষ্ণ শ্বাস তার বুক পাঁজরে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রণয় স্রোতোস্বিনীর অতল সাতরে ক্লান্ত রেহাংশী। ইনজাদের উষ্ণ দেহের সাথে নিজেকে আরোও জড়িয়ে নিল সে। প্রস্ফুটিত আঁখিযুগের মোহবিষ্ট চানিতে দেখতে লাগল ইনজাদের জাগরূক আনন। স্বামীর উষ্ণ, নিরন্তর প্রশ্বাস এই হিমরাতেও রেহাংশীকে বিগলিত করছে। সন্তর্পণে আঙুলের আলতো পরশ আঁকতে থাকে ইনজাদের চোখের পাতায়, গালে, ঠোঁটে। ইনজাদের সপ্রতিভ মস্তিষ্ক হেসে ওঠে। অশিথিল পেষনে সূচ পরিমাণ দূরত্ব দূর করে নেয় নিজেদের মধ্যকার। চোখ খুলে ইনজাদ। তার নির্বাক, আদুরে, মায়াময় চাহনিতে লজ্জাতে মিইয়ে যায় রেহাংশী। দুর্দমনীয় প্রেমময় সংসর্গে তার স্থির কায়াতে উঠে নিগূঢ় কম্পন। স্বামীর ছোঁয়ায় ধাতস্থ হয়ে প্রশ্ন করে রেহাংশী–

“কাল কখন যাব আমরা?”

নেশার পরিমাণ কমেনি। বাড়তে লাগল দ্বিগুন হারে। ইনজাদ অপারগ স্বরে বলল—

“কাল সকালে দিয়ে আসবো তোমাকে।”

“আর আপনি?”

“বিয়ে পরশু রাতে। আমি পরশু রাতেই যাব।”

“কী বলছেন?”

রেহাংশীর কণ্ঠে ভয়ের আভাস পেল ইনজাদ। মাথাটা হালকা তুলে ওষ্ঠাধরের মদিরা পান করল। সংকীর্ণ স্বরে বলল—

“মেহমাদ এমনিতেই আমার ওপর রেগে আছে। তোমাকে দুই দিন আগে পাঠাতে বলেছে। ওকে তো আর বলতে পারিনি, আমার বউ আবার আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না।”

রেহাংশী স্নেহার্দ্র ভরা এক কিল বসায় ইনজাদের অসংবৃত বুকে। টপাটপ চুমুর বর্ষণ ঘটায় ইনজাদ। স্বামীকে বাধা দিতে পারল না রেহাংশী। তার শাড়ির আঁচল ঝুলে আছে বিছানা থেকে মেঝেতে। ইনজাদ গাঢ় হেসে বলল—

“চিন্তা করো না। আঙ্কল -আনটি তোমাকে দেখে রাখবে। একটা রাতের-ই তো ব্যাপার! আর বিয়ে বাড়িতে কেউ ঘুমায় না কি?”

রেহাংশী ছোট্ট করে হাসল। ইনজাদ হাত গলাল রেহাংশীর অবিন্যস্ত চুলে। রেহাংশী একটু উঁচু হয়ে ইনজাদের মুখের কাছে নিল নিজের মুখ। ইনজাদের বুকে হাত রেখে ছোট্ট শ্বাসে বলল—

“দেখে রাখবে কেন? আমি কী বাচ্চা?”

“বাচ্চা নয়তো কী? এই যে অন্ধকারে ঘুমাতে পারো না!”

“অন্ধকারে ভয় হয় আমার। সব হারিয়ে যায় অন্ধকারে। আমি আমার সব হারিয়ে ফেলেছি অন্ধকারে। আপনাকে হারাতে পারব না। পারব না।”

রেহাংশীর চোখের আচানক বর্ষণে চমকে যায় ইনজাদ। দুই হাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে বলল—

“কোথাও যাব না আমি তোমাকে ছেড়ে, কোথাও না।”

রেহাংশী শ্রান্ত গলায় ফুফাতে লাগল। ইনজাদ তাকে বক্ষস্থলে পরম মমতায় আঁকড়ে রাখল। ঘরের অন্ধকারে রেহাংশীর এত কেন ভয় তা আজও জানতে পারল না ইনজাদ।
,
,
,
সায়াহ্ন প্রহর! সাঁঝবাতির স্বরূপ জেগে উঠেছে রুপালি চাঁদ। কালচে আকাশের মোহজালে কী নিদারুণ তার জাগ্রত রূপ!
চন্দ্রাতপে মুগ্ধ ধরণী। ঘন কালো তমসা ছিন্নভিন্ন করে চন্দ্র কিরণ মেখে দিচ্ছে পরম আদরে।

কৃত্রিম বাতির আলোকচ্ছটায় ঘোর লেগে যাবে যে কারো! কমিউনিটি সেন্টারের চারদিকে উজ্জ্বল বাতিদের যেন স্বয়ংম্বর চলছে! রেহাংশী চোখ ধাঁধিয়ে তা দেখছে। আলোয় আলোয় তার চোখ নিভে আসছে।
গতকাল সে মেহমাদদের বাড়িতেই ছিল। মেয়েটা একটুও ঘুমাইনি। না ঘুমাতে দিয়েছে ইনজাদকে। বিছানায় কাত হয়ে শুতেই চোখে লেগে এসেছিল রেহাংশীর। মেহমাদ জাগায়নি তাকে। লাইট অফ করে চলে গিয়েছিল। আচানক চোখের পাতা খুলতেই ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল সে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটে এসেছিল সকলে। রেহাংশীকে থামাতে না পেরে মেহমাদ ফোন করেছিল ইনজাদকে। সেই মাঝরাতে ইনজাদকে ছুটে আসতে হয়েছিল মেহমাদের চাচার বাসায়। এরপর বাকিরাত ইনজাদের বুকেই সমাহিত ছিল রেহাংশী। এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়েনি ইনজাদের গেঞ্জি। খামচে ধরে রেখেছিল। সকালে সেই নির্ঘুম চোখ নিয়ে বাসায় ফিরে গিয়েছিল ইনজাদ। সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে রেস্তোরাঁয় গিয়েছিল। বিকেলে বাসায় ফিরে, ফ্রেশ হয়ে কমিউনিটি সেন্টারে এসেছে।

“কী দেখো এমন করে?”

রেহাংশী অবাক গলায় বলল—

“শহরের বিয়েতে কত খরচ!”

“খরচ সব জায়গাতেই হয়। তবে এইটা নিজস্ব ব্যাপার। কেউ বাড়ির ছাদে শামিয়ানা খাটিয়ে হল খরচ বাঁচায়, কেউবা নিজের খুশিকে বিস্তৃত করে। বিয়েতো আর বারবার করবে না।”

রেহাংশী আলতো চোখে তাকাল। কালো রঙের স্যুট পরেছে ইনজাদ। রেহাংশীর পরনে খয়েরী রঙের জামদানি শাড়ি। সাথে ডার্ক মাল্টিকালারের ফুলস্লিভ ব্লাউজ। মাথায় আস্ত খোঁপা। তাতে গোলাপের গুচ্ছের সাথে বেলি ফুলের সরু লহর যা দিয়ে খোঁপাকে পেচিয়ে রেখেছে। গলায় কিছু না থাকলেও কানে ঝুলছে বড়ো বড়ো দুটো ঝুমকো। রেহাংশী নিবিড় মায়াচ্ছন্ন হয়ে ইনজাদের হাত ধরল। নিঃশব্দ হাসল ইনজাদ। চকিতে ভেসে এলো মেয়েলী সুর।

“হাই! ”

দুই জোড়া চোখ চট করেই সামনে তাকাল। ক্ষণপলেই কুঁচকে গেল রেহাংশীর ভ্রূ যুগল। সিন্ধুজা এসেছে। তার পরনে একই রকম গাউন যেমনটা ইনজাদ রেহাংশীর জন্য এনেছিল, শুধু রঙটা আলাদা। গাঢ় খয়েরী! অনাবৃত গলায় ডায়মন্ডের হালকা হার, কানে দুল। রেশম কালো চুলে নেই বাধ্যবাধকতা। আজও তারা উন্মুক্ত রোজকার ন্যায়। রেহাংশীর কৌতূহলী, অপ্রসন্ন, ভীত চোখজোড়া ইনজাদের দিকে নিবদ্ধ হলো। ইনজাদ গাঢ় মায়ায় হাসছে। শ্বাস ভারী হলো রেহাংশীর!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here