মোহঘোর #পর্বঃ৪০

0
486

#মোহঘোর
#পর্বঃ৪০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

এলোথেলো চুলে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল রেহাংশী। তার উদ্ভাসিত চোখ জোড়া বিস্মিত। রেহাংশীর উপস্থিতি বুঝতে পেরে সপ্রতিভ হলো ইনজাদ। মখমলে হেসে তার দিকে তাকিয়ে বলল—

“এসো।”

রেহাংশী এলোমেলো নরম পায়ে এগিয়ে এলো। তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল ইনজাদ। বেদনাবিধুর আননে রাজ্যের মায়া! রেহাংশীর শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল ইনজাদ। স্বল্প ঘুমের চোখ দুটো শ্রান্ত, চাহনিতে শিথিলতা। ইনজাদ ফিচেল গলায় বলল—

“খোলা চুলে তোমায় ভালো লাগে। তাই বলে সবসময় নয়। চুল বাঁধনি কেন? কী অবস্থা হয়ে আছে!”

ইনজাদ আলতো হাতে মুখের আশেপাশের অবাধ্য হয়ে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দেয়। কপালে লেপ্টে থাকা কেশের বহর আঙুলের সাহায্যে সরিয়ে দেয়। মোলায়েম স্বরে বলল—-

“বেঁধে নাও।”

রেহাংশী নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে আদেশ প্রাপ্ত ভৃত্যের মতো চুল বেঁধে নেই। ছোট্ট করে হাসল ইনজাদ। মায়ময় গলায় বলল—

“এসো।”

রেহাংশীকে টেবিলে নিয়ে বসায় ইনজাদ। পরোটার ওপর ডিমের আস্তরণ লাগিয়ে ভেজে রেখেছে। রেহাংশী চোখ তুলে তাকিয়ে বলল—

“আপনি রান্নাঘরে গেলেন কেন?”

চেয়ার টেনে রেহাংশীর পাশে বসল ইনজাদ। সহজ গলায় বলল—

“কেন, রান্নাঘরটা কী আমার নয়?”

” এসব করতে কে বলেছে আপনাকে?”

“বলেনি তো। শোনার প্রয়োজনবোধ করিনি। খেয়ে নাও। কাল থেকে কিছুই খাওনি। শরীর খারাপ করবে।”

“আপনি আর রান্নাঘরে যাবেন না।”

রেহাংশীর কণ্ঠে কঠোরতার আভাস পেল ইনজাদ। স্থির অধরে চঞ্চল হেসে বলল—

“ওকে, ওকে যাব না। খেয়ে নাও। আমি আসছি।”

“আপনি খেয়েছেন?”

“হুম। তুমি খাও।”

রেহাংশীর পেলব কপালে শুষ্ক ঠোঁট ছোঁয়াল ইনজাদ। চেয়ার থেকে উঠে নিজের কক্ষে ফিরল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। আচানক মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। মোবাইলের স্ক্রিনের নামটা দেখে ভ্রূ কুঁচকালো ইনজাদ। রিসিভ করল বিনা দ্বিধায়।

“হ্যালো!”

“হাই! কেমন আছ?”

ইনজাদ ঠান্ডা স্বরে বলল–

“ভালো। তুমি?”

সিন্ধুজা কথার জবাব না দিয়ে বলল—

“রেহাংশী কেমন আছে?”

“আগের চেয়ে ভালো।”

ওপাশের যুবতীর দীর্ঘশ্বাস টের পেল ইনজাদ। দুই প্রান্তে মৌনতা নেমে এলো। ইনজাদ কথা খুঁজে পেল না। সিন্ধুজা অনুরক্তির সুরে বলল—

“ড্যাডের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। আমি কল্পনাও করতে পারিনি এভাবে সম্পর্ক জুড়ে যাবে আমাদের!”

ইনজাদ কথা বলল না। শুনে গেল। সিন্ধুজা পূনরায় বলল—

“আমার বায়োলজিক্যাল ফাদারের ডেথের পর ড্যাড আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছে। কখনো পর বলে অবহেলা করেনি। কিন্তু নিজের রক্তের সম্পর্কের সাথে এমনটা…!”

সিন্ধুজার গলা বসে গেল। সে কিছুটা সময় নিয়ে বলল—

“ড্যাড সত্যিই অনুতপ্ত ইনজাদ। কাল ফেরার পর থেকে নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছে।”

ইনজাদ ঠাস করেই বলে উঠে—

“এতে তার অন্যায় তো ঢাকা পড়বে না। একটা বাচ্চা মেয়ে তার শৈশব, কৈশোর কাটিয়েছে বাবা-মায়ের ভালোবাসা ছাড়া। পরিবারের প্রতিটি মানুষ, যাদের ও অক্লান্ত ভালোবেসেছে তাদের থেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ছাড়া কিছুই পায়নি। ”

“আমি মানছি ইনজাদ, ড্যাড যা করেছে ভুল করেছে। কিন্তু তার একার ভাগীদার সে নয়।”

“মানে?”

সিন্ধুজা গাঢ় শ্বাস ফেলল। উন্মুক্ত গলায় বলল—-

“ড্যাডের সাথে মমও দোষী। দোষী আমরা সবাই। মম শুধু নিজের সন্তানের কথা ভেবেছেন। নিজের প্রতিপত্তি, অর্থ দিয়ে ড্যাডকে আটকে রাখতে চেয়েছেন। এছাড়া কোনো পথ ছিল না। কারণ, তাদের মাঝখানে সৌরভ এসে দাঁড়িয়েছে। আমার মামারা, আমার বায়োলজিক্যাল ফাদারের সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে চেয়েছিল। মমের পাশে এসে দাঁড়ায় ড্যাড। এক টুকরো ভরসার হাতকে সে হারাতে চায়নি। ভুল করেছিল মম। রেহাংশীর মায়ের ক্যান্সার ছিল। যা ড্যাড কাউকে জানায়নি। তার চিকিৎসার টাকার জন্যই সে শহরে এসেছিল। কিন্তু….। ড্যাড ভুলে করেছিল। তার ওই অবস্থায় রেহাংশীর মাকে ছেড়ে আসা উচিত হয়নি। জীবনের শেষ দিনগুলো না জানি কত কষ্টে পার করেছেন তিনি। রেহাংশীকে আনতে গিয়েছিল ড্যাড। কিন্তু, ওর ঘৃণার কাছে হেরে গেল সে। যেইবার বাড়ি গিয়ে রেহাংশীকে ড্যাড পায়নি, ওর বড়ো মা বলেছিল, রেহাংশীকে ওর মামারা নিয়ে গিয়েছিল। ও ওখানেই থাকবে। ড্যাডের সাহস হয়নি ওই বাড়িতে যাওয়ার। সে তার সমস্ত সম্পত্তি রেহাংশী নামে করে দিয়ে এসেছিল। মমও এটাই চেয়েছিল। নিজের সন্তানদের খুশির জন্য তিনি স্বার্থপর হয়েছেন।”

“এসব কে বলেছে তোমাকে?”

“মম বলেছে। ড্যাড কারো সাথে কথা বলছে না।”

“রেহাংশীর বড়ো মাকে তো আমার সহ্য-ই হয় না। এতটা জঘন্য কোনো মানুষ হয় কী করে! ওর মামারা তো কিছুদিন পরই ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যায়। আর স্যার! আরেকবার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না? সম্পত্তি লিখে দিলেই সন্তানের প্রতি সব দায়িত্ব শেষ?”

“আই এম সরি ইনজাদ।”

“তুমি কেন সরি বলবে? এতে তোমার কোনো দোষ নেই। ”

“আচ্ছা, রাখছি আমি। রেহাংশীর খেয়াল রেখো। কোনো হেল্প লাগলে জানিয়ো আমাকে। আপন না হই, কিন্তু বোন তো। ”

“ওকে, বাই।”

ইনজাদ লাইন কেটে তীব্র শ্বাস ফেলল। সম্পর্কের জটিলতায় সে পর্যদুস্ত।

দেহভঙ্গিমা বদলাতেই রেহাংশীকে দেখতে পেল। নিষ্প্রাণ দুই আঁখি মেলে ভ্যালভ্যাল করে চেয়ে আছে। তার স্থির চাহনির বিপরীতে হাসল ইনজাদ। পা বাড়িয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। গতকালের বিষয়ে আর একটি কথাও নয়। এই জটিল সম্পর্কের টানা-পোড়েন থেকে রেহাংশীকে বের করে আনতে চায় সে।

“রেডি হও। আজ মানান ভাইয়ের মেয়ের জন্মদিন। তোমাকে স্পেশালি যেতে বলেছে।”

রেহাংশী শক্ত করে জবাব দিলো।

“যাব না আমি।”

“যেতে হবে রেহাংশী। যাও তৈরি হয়ে নাও।”

রেহাংশী আড়ষ্ট হয়ে রইল। ইনজাদ প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ফের বলল—

“দাঁড়িয়ে আছ কেন? শাড়িটা চেঞ্জ করে নাও। নাকি আমি হেল্প করব?”

“না।”

“ফিক করে হেসে ফেলে ইনজাদ। চটপটে গলায় বলল—

“তাহলে তাড়াতাড়ি রেডি হও।”

“জোর করছেন কেন?”

রেহাংশীকে নিজের কাছে টেনে নেয় ইনজাদ। বক্ষপুটে সমাহিত করে বলল—

“ভালোবাসায় জোর করতে হয়। তাতে অন্যায় হয় না। এইটা অধিকার। আর জোর করে তো অধিকার আদায় করিনি, অর্জন করে নিয়েছি।”

রেহাংশী তার বিধ্বস্ত, ধ্বসে পড়া মনে দুই হাতে আঁকড়ে ধরল ইনজাদকে। অতল বিশ্বাস তার অন্তঃকরণে বাসা বাঁধতে শুরু করল। এই মানুষটাকে সে বিশ্বাস করতে পারে, ভরসা করতে পারে। রেহাংশী গাল ঘষতে থাকে ইনজাদের বুকে। আদুরে সুরে বলল—

“দাওয়াত তো দুপুরের। এখন যাব কেন?”

“তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাব। তাড়াতাড়ি রেডি হও।”

“কোন শাড়ি পরব?”

“যেইটা তোমার ইচ্ছে।”

“আপনি বলুন।”

“তোমাকে তো আমার শাড়ি ছাড়াও ভালো লাগে।”

রেহাংশী মাথা সরিয়ে কয়েকটা দূর্বল ঘুষি বসায় ইনজাদের বুকে। ইনজাদ সরল হেসে বলল—

“আরে, সবসময় নেগেটিভ ভাবো কেন? আমি তো বলেছি তোমাকে সবকিছুতেই আমার ভালো লাগে। ডার্টি মাইন্ড!”

রেহাংশী কপাল কুঁচকে বলল—

“আপনার।”

“হ্যাঁ, তা তো দেখলাম-ই কার।”

রেহাংলী লজ্জায় নেতিয়ে গেল।

“ধুর! যান এখান থেকে।”

সশব্দে হেসে উঠে ইনজাদ।
,
,
,

অতিরিক্ত জনসমাগমে নিজেকে ধাতস্থ করতে পারে না রেহাংশী। তার মনে অজানা আশঙ্কা ঢোল পিটাতে থাকে। মানানের মেয়ে তুষ্টির জন্মদিনে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের সাথে তাদের বাবা-মায়েরও আগমন ঘটেছে। এত অচেনা মানুষের মাঝে নিজেকে ঘুটিয়ে নিচ্ছে রেহাংশী। কিন্তু তার ঢাল, তার ছায়া, তাকে ছেড়ে নড়ছে না। ইনজাদ শক্ত করে রেহাংশীর হাত চেপে ধরে রেখেছে। ছাড়বে না সে। যে হাত পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একবার সে ধরেছে, সে হাত কোনো কিছুর বিনিময়ে সে ছাড়বে না। বাচ্চাদের ছোটাছুটিতে রেহাংশীর ভার মন একটু একটু করে হালকা হতে লাগল। মন খারাপের জমাট মেঘ তুলোর মতো উড়তে লাগল। মানানের মেয়ে তুষ্টি চট করে রেহাংশীর কোমড় জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী গলায় বলল—

” আনটি এসো, তুমি না কী গান করো? পাপা বলেছে। এসো, গান শোনাও।”

হাত সরাল তুষ্টি। ধাতস্থ চোখে চেয়ে রইল। রেহাংশী ভয়ে আঁতকে ওঠল। গান আর সে। এ তো ভয়ংকর ব্যাপার! ইনজাদের চোরা হাসিতে রেহাংশীর ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় তাকে জানান দিলো, এ আকাশ ভাঙা বিদঘুটে কাজ তার স্বামীর। রেহাংশী টের পেল তার উদরে কারো স্পর্শ। ইনজাদের ঠোঁটে দুষ্ট হাসির ছল! পেছনে দিকে মানুষ না থাকায় তার পূর্ণ ফায়দা তুলছে ইনজাদ। লোক সমাগম থেকে খানিকটা দূরেই দাঁড়ানো তারা। তুলতুলে, পেলম, মসৃণ উদরে স্বামীর পুরুষালী গহন স্পর্শে ঝনঝনিয়ে উঠল রেহাংশীর দেহ। তার কণ্ঠরোধ হয়ে এলো। ভাঙা কণ্ঠে বিধুর হয়ে বলল—

“কী করছেন আপনি? হাত সরান।”

“তাহলে হাসো। মুখের মধ্যে কী আলাদিনের চেরাগ লুকিয়ে রেখেছ না কি তোমার দাঁত হীরে দিয়ে বাঁধানো! হাসো বলছি।”

“হাসব না। কী করবেন আপনি?”

“কী করছি টের পাচ্ছ না? এখন কিন্তু সবার সামনে…।”

ইনজাদ আর রেহাংশীর অগোছালো কথার মানে তুষ্টির বোধগম্য হলো না। সে ভাসন্ত চোখে চেয়ে রইল। ইনজাদ কণ্ঠ খাদে নামিয়ে তার অর্ধেক কথার বাকিটুকু রেহাংশীর কান ফুঁকে দিলো।

“এখন সবার সামনে চুমু খেয়ে নেবো।”

রেহাংশী নাকের ডগায় বিরক্তি ঝুলিয়ে বলল—

“হাত সরান না।”

“আগে হাসো।”

রেহাংশী নিজেকে সংবরণ করতে পারল না। সবকিছু ভুলে ইনজাদের ডান বুকে ঠাসা এক কামড় বসিয়ে দিলো। তুষ্টি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চিৎকার করতে গেলে তার মুখ চেপে ধরে ইনজাদ।

“এই, তুষ্টিমনি, চিৎকার করে না। চকলেট নাও। আর আনটির কথা কাউকে বলো না। কেমন?”

ইনজাদ হাত সরাতেই তুষ্টি ভাবুক গলায় বলল—

“তুমি ব্যাথা পাওনি আঙ্কল?”

“উঁহু। ব্যাথা পায়নি। তুমি যাও, আর কাউকে বলবে না, ওকে? তাহলে আনটিকে সবাই পঁচা বলবে। কিন্তু আনটি তো ভালো, তাই না?”

“তাহলে কামড় দিলো কেন?”

ইনজাদ ঝলমলে হেসে তুষ্টির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল—-

“তোমার জন্য চকলেট এনেছি, কিন্তু আনটির জন্য আনিনি তাই। যাও, এখন।”

“আচ্ছা।”

তুষ্টি যেতেই সোজা হয় ইনজাদ। রেহাংশীর দিকে তাকিয়ে বলল—

“দাঁতের জোর বেড়েছে! বুকটা আমার ড্রাকুলার দাঁত দিয়ে ফুটো করে দিলে!”

রেহাংশী ভাবান্তরহীন । এমনটা করা তার উচিত হয়নি। মানুষটা ব্যাথা পেয়েও হাসছে!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here