#মোহঘোর
#পর্বঃ৪১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
ম্লান বিকেল! দিবাকরের ঝিমুনি ধরা নিষ্প্রাণ আভা। একটু পরেই টুপ করে ধূসর আকাশের ওই নিষ্প্রভ আলোক টুকরোকে গিলে নেবে সায়াহ্নের আঁধার। ঝিম ধরা শহরের বুকে মিহি কুয়াশার চাদর নামছে। বারান্দায় শিঁড়দাড়া দৃঢ় করে দাঁড়িয়ে আছে ইনজাদ। তার প্রস্ফুটিত চোখ সূদুরে।
কলিং বেল বাজলো! ইনজাদ সরব হলো। কক্ষে প্রবেশ করে বিছানার দিকে তাকাল। রেহাংশীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন মুখে অপরিমেয় মোহ। ইনজাদ মুচকি হাসল। ফের বাজলো কলিং বেল। ইনজাদ দ্রুত পা চালালো। পাছে রেহাংশীর ঘুম ভেঙ্গে যায়!
দরজা খুলতেই বিস্মিত হলো ইনজাদ। জিবরান খন্দকার দাঁড়িয়ে। গলায় কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে ইনজাদ—
“স্যার আপনি?”
জিবরান খন্দকারের কণ্ঠে জোর নেই। মুমুর্ষু রোগীর মতো চেয়ে আকুল গলায় বললেন—
“রেহাংশী….।”
“ভেতরে আসুন।”
জিবরান খন্দকার ভেতরে প্রবেশ করলেন। এদিক-ওদিক চাহনিতে কাউকে খুঁজতে লাগলেন। ইনজাদ গাঢ় স্বরে বলল—
“বসুন স্যার।”
জিবরান খন্দকার খেলনা হারানো বাচ্চাদের মতো মুখ করে বললেন—
“রেহাংশী…. ওকে একবার দেখতে দেবে?”
“আপনি বসুন, স্যার।”
জিবরান খন্দকার কাউচে বসলেন। তার অস্থির চাহনি একবার রান্নাঘরে, একবার শয়ন কক্ষের দিকে ঘুরতে লাগল। তিনি অসহনীয় চিত্তে কিছু খুঁজছেন। তার অধৈর্য, উৎপীড়িত, মন মস্তিষ্কের সান্ত্বনার জন্য ইনজাদ বলে উঠে—
“রেহাংশী ঘুমোচ্ছে স্যার। ঘুমের ঔষধ দিয়েছি। যতক্ষণ জেগে থাকবে ততক্ষণ শুধু কাঁদবে।”
জিবরান খন্দকার আঁখুটে গলায় বললেন—
“একবার ওকে দেখতে দেবে আমায়?”
“নো, স্যার।”
জিবরান খন্দকার কণ্ঠ মলিন করে বললেন—
“শুধু একবার দেখতে দাও!”
“নো, স্যার। আমি চাই না আপনি ওর মুখোমুখি হোন। অনেক কষ্টে সামলাচ্ছি ওকে আমি। কী করে পারলেন আপনি এমন করতে? নিজের সন্তান, নিজের রক্তকে এভাবে ভুলে যেতে? একবারো ভাবেননি আপনি ছাড়া ওর কী হবে?
বাবা-মা ছাড়া একজন সন্তানের কী অবস্থা হয়? আপনি জানেন, ওর বড়ো মা আর তার মেয়েরা ওর সাথে কেমন ব্যবহার করত? ইভেন আপনার মা?
খেতে দিতো না রেহাংশীকে, বাড়িতে কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও ওকে দিয়ে কাজ করাতো। ওর বিয়ে ঠিক করেছিল কার সাথে জানেন? রতনের সাথে; একজন জেল ফেরত আসামী। আর কিছু শুনতে চান?”
জিবরান খন্দকার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। জমাট চোখের বান ছুটেছে। ইনজাদ অপ্রস্তুত হলো। জিবরান খন্দকার অপরাধী মুখ করে বললেন—
“আমি জানি আমি ভুল করেছি। অনেক বড়ো ভুল করেছি। শহরের রঙ চকচকে জীবন আমার সত্যিকারের অস্তিত্ব মিটিয়ে দিয়েছে। আমি ভাবিনি আমার মেয়েটা এত কষ্টে আছে! ভাবীকে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলল- রেহাংশী ভালো আছে। আমার প্রতি ঘৃণার কারণে আমি আর ওর সামনে যাইনি। ভাইয়াকে বলেছি, ওকে দেখে রাখার জন্য। এখানে এলে সাবরিনা ওকে মেনে নিতো না। আর আমি ওদেরও ছাড়তে পারছিলাম না। আমি ভাবতে পারিনি, আমার মেয়েটার সাথে ওরা এমন করবে! ”
“তাই বলে, এত বছরে একবারো খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না? সত্যি আপনার মেয়ে ভালো আছে কি না?”
“স্বার্থপর, স্বার্থপর হয়ে গেছি আমি। সাবরিনার প্রতি আমার মোহ বোঝার পূর্বেই সৌরভে জন্ম। আমি সবকিছুর বিনিময়ে জয়ার চিকিৎসার টাকা পাই। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল! নিজের দোষে আমি জয়াকে হারিয়ে ফেললাম। সাবরিনার প্রাক্তন স্বামীর হঠাৎ অ্যাকসিডেন্ট হয়। তার সব সম্পত্তি পেয়ে যায় সিন্ধুজা।সিন্ধুজার মামারা উঠে-পড়ে লাগে সেই সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে। এইসব কিছুর মাঝে এমনভাবে মিশে গেলাম যে নিজের মেয়েকে ভুলে গেলাম। আমি ভেবেছি ও ভালো থাকবে। কিন্তু জয়ার মতো ওরা আমার মেয়েটার সাথেও এমন করবে আমি ভাবিনি। ক্ষমা চাইব না আমি। আমি ক্ষমার যোগ্য নই। শুধু একটিবার ওকে আমায় দেখতে দাও। একবার ইনজাদ!”
ইনজাদ শক্ত কণ্ঠে বলল—
“না, স্যার। আমি আপনাকে সে অধিকার দিতে পারি না। আপনি আসতে পারেন। ওই বাড়ির সাথে রেহাংশীর কোনো সম্পর্ক নেই, আর না আপনার সাথে। ও এখন শুধু আমার স্ত্রী, আমার আম্মা-বাবা পুত্রবধূ। ওর ওপর আর কারো অধিকার ফলাবে না।”
জিবরান খন্দকার হৃদয়ভেদী কণ্ঠে বললেন—-
“মরার আগে একবার কী ওর মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে পারব না?”
ইনজাদের মন কেঁপে ওঠল। তবুও দৃঢ়তার সাথে বলল—-
“আমার জানা নেই। আপনি এখন আসতে পারেন। রেহাংশী যেকোনো সময় উঠে যাবে। আর আপনাকে এখানে দেখলে…।”
জিবরান খন্দকার পরাস্থ হলেন। চোখের ধারা মুছে নিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একজোড়া নুপূর বের করেলেন। ইনজাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন—-
“একবার আমার কাছে নুপূর চেয়েছিল। দিতে পারিনি। এইগুলো একবার ওর পায়ে পরিয়ে দিয়ো। আমি ভেবে নেবো ও আমাকে ও ক্ষমা করে দিয়েছে। ”
জিবরান খন্দকার ভারাক্রান্ত মন নিয়ে উঠলেন। তিনি যেতেই নিজের কক্ষে এলো ইনজাদ। দেহভঙ্গি বদলেছে রেহাংশী। পাতলা চাদরের বাইরে তার টলটলে পা দুটো বেরিয়ে আছে। ইনজাদ পায়ের দিকটায় এসে দাঁড়াল। রেহাংশীর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করে বলল,” সরি, রেহাংশী! বুড়ো মানুষটা একটা আবদার করেছে।”
,
,
,
আড়মোড়া ভেঙে চোখের পাতা খুলে রেহাংশী। ভারী পল্লব প্রসারিত করে চাইতেই কৃত্রিম বাতির ঝলমলে আলো তার চোখের কোটরে বিঁধে গেল। পায়ে পায়ে ঘষা লাগতেই অপ্রস্তত হলো রেহাংশী। বিধ্বস্ত শরীরটা টেনে উঠে বসল। জ্বলজ্বলে, রুপালি নুপুরে অবাক হলো সে। পলেই মুখের ভাবভঙ্গি বদলে গেল। টেনে-হিচড়ে খুলতে চাইল নুপুর। অপরিণত মস্তিষ্কের মনুষ্যের মতো কাজ! নুপুরের শক্ত ধাতুর ঘর্ষণে পায়ের গোড়ালি এবড়ো-থেবড়ো। ঝরতে লাগল রক্ত। ইনজাদ মাত্রই ভেতরে এলো। রেহাংশীকে অপ্রকৃতিস্থর মতো আচরণ করতে দেখে ছুটে এসে হাত ধরল। উদ্বেলিতে কণ্ঠে বলল—
“কী করছ এসব? পাগল হয়ে গেছ?”
এলোমেলো চুলে, চোখের পানির সাথে একাকার হয়ে আছে মুখ। রেহাংশী রোদনভরা কণ্ঠে বলল—
“কেন পরিয়েছেন এসব? ওই লোকটা কেন এসেছে এখানে? কেন ওই লোকটার সাথে কথা বলেছেন?”
“দেখো, রেহাংশী আমার কথা শোনো।”
“কোনো কথা শুনতে চাই না। এগুলো খুলুন, খুলুন বলছি। সব ফেলে দেবো আমি, সব।”
এলোপাথাড়ি টানা -হেচড়ায় রেহাংশীর পায়ের অবস্থা বেহাল। ইনজাদ ধমকে ওঠল।
“ওকে খুলছি। প্লিজ, স্টপ দিস।”
শান্ত হয় রেহাংশী। ইনজাদ নুপুরের লক খুলতেই তা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয় রেহাংশী। ছুড়ে ফেলে মেঝেতে।
ফুঁসতে থাকে রাগে। ইনজাদ মেঝের ওপর বসে তার উরুর ওপর পা রাখে রেহাংশীর। বিছানার ওপর থাকা তোয়ালে নিয়ে পায়ের রক্ত মুছে দিতে দিতে বলল—-
” এমন করে কেউ! কী অবস্থা করেছ!”
ঝপ করে ইনজাদের বুকের মাঝে সিদিয়ে যায় রেহাংশী। ইনজাদ চমকে যায়। দুই হাতে স্বামীকে জড়িয়ে তার বক্ষপুটে মাথা রাখে রেহাংশী। ইনজাদ আলতো করে জড়িয়ে রাখে রেহাংশীকে। সরস গলায় বলল—
“বিছানায় বসো রেহাংশী। ঠান্ডা লেগে যাবে।”
রেহাংশী অস্পষ্ট স্বরে বলল—
“উঁহু।”
“এত রাগ!”
“ওই লোকটাকে আমি কোনোদিনও ক্ষমা করব না। খুনি!”
ইনজাদ চুপ রইল। রেহাংশী পূনরায় অধিকার নিয়ে বলল—
“আপনি আর ওদের ওইখানে কাজ করবেন না। ওদের কারো সাথে কথা বলবেন না। আমরা গ্রামে চলে যাব। আপনি তো অনেক পড়ালেখা করেছেন! আপনার তো অনেক বুদ্ধি! আপনিও বড়ো আব্বুর মতো সদরে ব্যাবসা করবেন। আমরা গ্রামে থাকব। আম্মা আর বাবার সাথে থাকব। আমার কিচ্ছু চাই না। শাড়ি, গহনা কিচ্ছু না। আমি তিনবেলা খাবোও না। তবুও এই শহর ছেড়ে দিন আপনি। এই শহরের বাতাস বিষাক্ত। আমি আপনাকে হারাতে পারব না।”
ইনজাদ সরল গলায় বলল—-
“তুমি ভাবলে কী করে তোমাকে না খাইয়ে রাখব আমি?”
“আমরা এই শহরে থাকব না। আমরা গ্রামে থাকব। আপনি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না। কোনো টাকা- পয়সা চাই না আমার। ঘরের সব কাজ করে দেবো আমি। আম্মাকে কিছু বলার সুযোগ দেবো না। আপনার সব কথা শুনব। শুধু শহর থেকে আমাকে নিয়ে চলুন। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে।”
ইনজাদ আরেকটু শক্ত করে নিল হাতের বাঁধন। বিশাল আকাশের টুকরো মেঘের মতো ইনজাদের বক্ষের সাথে মিশে গেল রেহাংশী। আপাতত কোনো কথা বলল না ইনজাদ। সময় সঠিক নয়।
চলবে,,,