যদি তুমি জানতে’পর্ব-১৮

0
850

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_18
একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে এখন। ঘাসের উপর হালকা হালকা কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। ফুল স্পীডে ফ্যান ছেড়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে তুরান। আজ ফ্রাইডে। ভার্সিটি বা টিউশনি যে যাওয়ার কোন তাড়া নেই। কিন্তু রুপার জন্য যে বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারবে না সে কথাও অজানা নয়।
হাতে দুই মগ কফি নিয়ে রুপা এসে হাজির। উঠতে ইচ্ছে করছে না তুরানের, ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো। রুপা এসে টান মেরে তুরানের গায়ের কাঁথা টা ফেলে দিলো। চোখে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠলো রুপা।
-‘ এত বড় ছেলে থ্রী কোয়ার্টার ফ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট পরে শুয়ে আছে।’
তুরান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কাঁথা টা গায়ে টেনে দিয়ে বলল,
-‘ তুমি যাও যাও। আমি শার্ট প্যান্ট পরে আসছি।’
তুরান ফ্রেশ হয়ে শার্ট, প্যান্ট পরে এলো। কেমন একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলল রুপা! হাতের দুইটা মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুপা। রুপা তুরান কে দেখেই লাজুক হাসি দিলো। কেন হাসে কে জানে। তুরানের হাতে মগ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘ হট কফি তো কোল্ড কফি হয়ে গেছে। তারপরও খেতে হবে আপনার।’
তুরান এক চুমুক মুখে দিয়ে বলে,
-‘ একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে তো। তবে কফিটা বেশ হয়েছিল। লুকিয়ে এনছো তাই না?’
-‘ নিজের হাতে বানিয়েছি। আপনি লেট করেছেন তাই তো ঠান্ডা হয়ে গেছে। যেমন হোক খেতে হবে।’
তুরান বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল,
-‘ কি তুমি বানিয়েছো! তোমার হাতের বানানো ঠান্ডা কফি ও যেন অমৃত। ঠান্ডা কফি কেন শুধু? তোমার হাতে বিষ পান করতেও আমি শত বার রাজি।’
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো তুরান। নাক মুখ কুঁচকে রুপা বলে,
-‘ ঢং করা হচ্ছে? ঢং রং যাই করেন আপনারই এই কফি খেতে হবে।’
-‘ তোমার ভাষায় এটা ঢং কিন্তু কবি সাহিত্যিকে ভাষায় এটা প্রেম।’
এবার হেসে উঠলো রুপা। হাসি থামিয়ে বললো,
-‘ আপনি কি জানেন আপনি আমার মত বাঁচাল হয়ে যাচ্ছেন।’
খানিকক্ষণ চুপ থেকে তুরান বিড়বিড় করে বলে,
-‘ আসলেই কি আমি বাঁচাল হয়ে যাচ্ছি?’
-‘ বিড়বিড় করে কি বলেন?’
তুরান হেসে বলে,
-‘ তোমার সাথে প্রেম করলে বাঁচাল হওয়া কি স্বাভাবিক নয়?’
এ পর্যান্ত বলে তুরান আবার বিড়বিড় করে বলে,
-‘ সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।’
রুপা তুরানের কথা বুঝার চেষ্টা করলো না। তুরান কয়েক চুমুক কফি খেয়ে তারপর শরবতের মত ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো।
রুপা তুরানের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,
-‘ এটা কি হলো?’
-‘ রুপার হাতের স্পেশাল কফির শরবত খাওয়া হলো।’
এর ভিতর ডাক আসলো সাহেলা বেগমের। রুপা চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘ উফ!’
-‘ হয়েছে বিরক্ত হওয়ার দরকার নেই তাড়াতাড়ি যাও।’
রুপা হনহন করে হেঁটে চলে গেল। তুরান রুপার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
সাহেলা বেগম রুম গোছাচ্ছেন। পুরো রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আজিজ চৌধুরীর বই। বিরক্ত হয়ে বই গুলো গোছাচ্ছেন যেন। রুপাকে দেখেই বিরক্ত ভাবটা মুখে প্রকাশ করে বলল,
-‘ কত বার বলি এখানে সেখানে বই ফেলে রাখবে না।’
রুপা কিছু না বলে চেয়ার টেনে চেয়ারের উপর বসলো। সাহেলা বেগম নিজের মনে রুম গোছাচ্ছে।
রুপা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-‘ ডাকছো কেন?’
-‘ তোর বাবা টাকা পাঠিয়েছে তোর শপিং এর জন্য। যা ইচ্ছা কিনতে বলেছে।’
-‘ হঠাৎ টাকা মতলব কি?’
-‘ থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো। নন সেন্স এর মত কথা। তোর মা-বাবা তোর পিছনে কত লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেছে আর তুই সামান্য শপিং এর টাকার জন্য মতলব খুঁজছিস।’
সাহেলা বেগমের রিয়্যাক্ট দেখে খানিকটা ভয় পেয়ে যায় রুপা। বিড়বিড় করে বলে,
-‘ সব আমায় ফুঁসলিয়ে তাদের কাছে নেওয়ায় ধান্দা।’
সাহেলা বেগম কোন কথা বলে না।
-‘ আচ্ছা দেও দেও টাকা দেও। কত লক্ষ টাকা পাঠিয়েছে শুনি?’
সাহেলা বেগম মেজাজ খারাপ হচ্ছে প্রচুর। রাগ সংযত করে বলে,
-‘ শপিং এর জন্য লাখ টাকা লাগে? আর তোর যদি প্রয়োজন হয় লাখ টাকাই দিবে। ত্রিশ হাজার টাকা পাঠিয়েছে , টাকা আরো লাগলে তোকে ফোন দিতে বলেছে।’
রুপা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
-‘ সবই বুঝি।’
-‘ আর শোন, আমার আজ অনেক কাজ আছে আমি যেতে পারবো না। ওই বাসার তু্রান ছেলে টা কে বলে দেখি যায় কিনা, ছেলে টা খুব ভালো।’
রুপা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
-‘ না,না তোমার বলতে হবে না ,আমিই বলছি।’
সাহেলা বেগম নিজের কাজে মন দেয়।
তুরান আবার ঘুমাচ্ছে। রুপার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় এত ঘুমানোর কি আছে?
এক গ্লাস পানি তুরানের মুখের উপর ঢেলে দেয়। তুরান উঠে বসে। ঘুম ঘুম চোখে বলে,
-‘ আরে রুপা আমার ঘুম পাচ্ছে খুব।’
-‘ ওকে ঘুমান।’
রুপা রুম থেকে বের হয়ে গেল। রুপা কি রাগ করে চলে যাচ্ছে? তুরান দৌড়ে গিয়ে রুপার পথ আটকে দাঁড়ালো।
-‘ আরে কোথায় যাচ্ছো? আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম না, তোমায় দেখে ভান করছি।’
-‘ জানি কি করছেন। পথ ছাড়ুন! আমি বাসায় যাবো।’
তুরান রুপার হাত ধরে জোর করে রুমে নিয়ে যায়। রুপা মুখ গোমড়া করে বসে আছে।
-‘ আমি শপিং করতে যাবো। আম্মু ব্যস্ত তাই আপনায় নিয়ে যেতে বলেছে। আর আমি এই সুযোগটাই খুঁজছিলাম।’
তুরান অবাক হয়ে বলল,
-‘ সাহেলা আন্টি আমায় নিয়ে যেতে বলেছে! আসলেই তাঁরা দুই জন খুব ফ্রেশ মাইন্ডের।’
তুরান রুপার আর একটু কাছে গিয়ে বললো,
-‘ আচ্ছা.. আচ্ছা তুমি এই সুযোগ খুঁজছিলে কেন?’
-‘ ইস ন্যাকা! কিছু বুঝে না। উনারা যদি জানে আপনার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক তাহলে বুঝবেন কেমন মাইন্ডের।’
তুরান অনেক সময় চুপ করে রইল। তারপর বললো,
-‘ রুপা তুমি আগের থেকে অনেক টা চেঞ্জ হচ্ছো। আগে অনেক পাগলামি করতে কিন্তু এখন অনেক টা স্বাভাবিক হয়ে গেছো।’
কথা শেষ‌ করে রুপার দিকে তাকায় তুরান। না..রুপা এসব কথা নিয়ে বরাবরের মত মন খারাপ করলো না কিংবা পাগলামিও করলো না বরংচ মুচকি হেসে বলল,
-‘ আম্মু বলেছে আমি ধীরে ধীরে আরো সুস্থ হয়ে যাবো।’
রুপা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
-‘ আপনি সব সময় জানতে চান না আমি কেন এমন? আজকে বলছি শুনুন।’
তুরান অধিক আগ্রহী আর শঙ্কিত হয়ে বলে,
-‘বলো।’
-‘ আমার একটা অসুখ হয়। তারপর আমি এলেমেলো হয়ে যাই।’
এ পর্যন্ত বলে উদাস হয়ে যায় রুপা। তুরান স্বস্তি বোধ করে। যাক তাহলে অসুখের কারনেই রুপা এমন হয়েছে, লেখাপড়া ও হয়ত ছেড়ে দিয়েছে। জটিল কোন কারন নেই ।
-‘ আচ্ছা রুপা রাখো এসব কথা। চলো শপিং এ যাই। এসব নিয়ে ভেবে তুমি একদম মন খারাপ করো না।’
রিক্সায় পাশাপাশি বসা দুই জন। রুপা তুরানের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। রিক্সার সিট গুলো বোধ হয় দিনে দিনে সংকীর্ণ হচ্ছে। রুপা একটার পর একটা কথা বলেই যাচ্ছে। কথার মাঝে কোন ব্রেক দিচ্ছে না। তুরানও মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছে।
-‘ তোমার লম্বা চুল গুলো মিস করছি খুব।’
রুপা মুখ কালো করে বলে,
-‘ আমিও মিস করি খুব।’
একটা শপিং মলের সামনে রিক্সা থামায়। তুরানের হাত ধরে হাঁটছে রুপা। রুপা হাঁফিয়ে গেছে যেন।
-‘ এত মানুষের হৈচৈ ভালো লাগছে না আমার। তাড়াতাড়ি করেন একটু।’
তুরান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-‘ কেনাকাটা করবে তুমি আর তাড়াতাড়ি করতে বলছো আমায়?’
-‘ আপনায় সাথে এনেছি কেন ? আপনি পছন্দ করে কিনে দিবেন তাই।’
-‘ আমি মেয়েলি জিনিস পত্র পছন্দ করতে পারি নাকি?’
-‘ আমি জানি পারেন ।আপনার বোনদের জন্য কেনাকাটা করেন তখন?’
রুপার তর্কের সাথে পেরে উঠতে পারছে না তুরান। তুরান নিজের পছন্দ মত সব কিছু কিনে দিয়েছে রুপা কে।
তুরানের পছন্দ বেশ ভালোই!
-‘ হয়েছে আমার জন্য আর কিছু লাগবেনা। এখন আপনি আপনার জন্য হোয়াইট কালারের শার্ট আর ব্লাক প্যান্ট চুজ করেন।’
তুরান এ ব্যাপারে নারাজ। গার্লফ্রেন্ডের টাকায় শপিং ব্যাপারটা তুরানের পার্সনালিটির সাথে যায় না। রুপাও জিদ ধরে বসে আছে। তুরানের কোন রকম যুক্তি মানছে না।
-‘ আপনি যদি আমার কথা না শুনেন আমি এখন সিন ক্রিয়েট করব।’
এই বলে তুরানের হাত থেকে শপিং এর সব ব্যাগ গুলো নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে নেয় রুপা।
-‘ আচ্ছা.. আচ্ছা কোন পাগলামি করোনা। আমি তোমার কথা মানছি।’
বিশ্বজয়ের হাসি দেয় রুপা।
-‘ রুপা তুমি তো খুব ডেঞ্জারাস।’
শপিং মল থেকে বের হয়ে রিক্সা নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। রিক্সা চলতে শুরু করলো। চারদিকে এত কোলাহল , যানজট বিরক্ত লাগছে রুপার। তুরানের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে।
-‘ জুয়েলারির দোকানের সামনে রিক্সা থামাবেন একটু।’
-‘ কেন জুয়েলারির দোকানে কি কাজ?’
-‘ আছে একটু কাজ।’
রিক্সা কিছুদূর আসতেই জুয়েলারির দোকান দেখে রিক্সা থামালো তুরান।
রুপা রিক্সা থেকে নেমে বলে,
-‘ দুই মিনিট দাঁড়ান এখানে আমি যাবো আর আসবো।’
-‘ এখানে তোমার…..!’
তুরানের কথা শেষ না হতেই রুপা তুরান কে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-‘ দাঁড়িয়ে থাকেন এখানে।’
তুরান রুপার কথা মত দাঁড়িয়ে রইল। জুয়েলারির দোকানের পাশেই একটা চুড়ির দোকান।এই ফাঁকে তুরান রুপার জন্য কয়েক মুঠ চুড়ি কিনে নেয়।
জুয়েলারি দোকানে মাঝ বয়সী এক ভদ্র মহিলার সাথে দেখা হয় রুপার। রুপাকে দেখেই ভদ্র মহিলা আন্তরিকতার সাথে বিস্মিত হয়ে বলে,
-‘ শতরুপা তুমি এখানে? তুমি এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়েছো? কত দিন পর তোমায় দেখছি।’
রুপা কিছু না বলে মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকে।
-‘ আরে তুমি আমায় চিনতে পারছো না? আগে বলো কেমন আছো তুমি?’
-‘ ভালো।’
ভদ্র মহিলার তীব্র উৎকণ্ঠা এবং আন্তরিকতার বিপরীতে শুধু ভালো বলে উত্তর দেওয়া যেন অপমান জনক। রুপা রিং এর টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে চলে আসে।
শতরুপা? কে শতরুপা? মানুষ কথা গুলো বড্ড অদ্ভুত লাগে। এমন সব কথা বলে যেসব কথার সাথে ও পরিচিতই না।
-‘ জুয়েলারির দোকানে কেন গিয়েছে?’
-‘ বাসায় গিয়ে বললো।’
তুরান চুড়ির ব্যাগ টা রুপার হাতে দেয়। চুড়ি গুলো দেখে রুপার সব মন খারাপ উবে গেল। আনন্দে রুপার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। সামান্য জিনিসে রুপার এই খুশি হওয়ার ব্যাপারটা তুরানের খুবই ভালোলাগে। যে সামান্য তে খুশি হয় সুখ তাঁর কাছে ধরা দিতে বাধ্য।
বাসার গেটের সামনে এসে রুপা তুরানের হাতে ছোট একটা জুয়েলারির বক্স দেয়।
তুরান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-‘ কি এটা?’
-‘ বক্সটা খুলে দেখেন আপনার জন্য এনেছি। দেখেন তো আপনার আঙুলে হয় কিনা?’
তুরান বক্সটা না খুলেই রুপার হাতে দিয়ে দিলো। ক্ষুব্ধ গলায় বলে,
-‘ বিকাল আমার সাথে সেই জুয়েলারির দোকানে যাবে এটা ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে আসবে। আর যদি টাকা না দেয় তাহলে তুমি নিজের জন্য কিছু কিনবে।’
রুপা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় তুরান। রুপা হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
তুরান এমন কেন করলে? শ্যার্ট, প্যান্ট কিনতে বললো তাও কিনতে চাইলো না। আবার রিংটা এভাবে ফেরত দিলো।
তুরানের দেওয়া শাড়ি আর নুপুর জোড়া নিয়ে তুরানের রুমের দিকে যায় রুপা। তুরান যদি আমার দেওয়া জিনিস না নেয় আমি কেন নিবো?
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here