যদি তুমি জানতে’পর্ব-১৯

0
401

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_19
তুরানের দরজার সামনে হাতে তুরানের দেওয়া কালো শাড়ী আর নুপুর জোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুপা। রুপার চোখে মুখে স্পষ্ট রাগের চিহ্ন। চোখে জল ছলছল করছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে একটু আগে খুব কেঁদেছে।
রুপা কে এই অবস্থায় দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রুপার দিকে তাকিয়ে আছে তুরান। রুপা মুর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে এক দৃষ্টিতে তুরানের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ রুপার মুখের রাগান্বিত ভাবটা কেটে যায়, এখন রুপা কে দেখেই বুঝা যাচ্ছে তীব্র অভিমানে দাঁড়িয়ে থাকা এক রমনী। নিরবতা ভেঙে তুরান বলে,
-‘ কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে রয়েছো কেন? আর হাতে শাড়ি,নুপুর কেন?’
তুরানের কথার প্রত্যুত্তর করছে না নুপুর। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এভাবে কথা না বলে তাকিয়ে থাকা রুপার রাগ, অভিমান টা কে আরো তীব্র করে তোলে। তুরান এবার চিন্তিত হয়ে গেল। রুপার আগের সেই অসুখ টা দেখা দিয়েছে কি? সে জন্যই কি রুপা অস্বাভাবিক আচরণ করছে? নাকি রিং ফেরত দিয়েছি বলে?
-‘ কিছু বলবে তো? নয়ত বুঝবো কিভাবে?’
এতক্ষন রুপার চোখে জোরপূর্বক আটকে থাকা অবাধ্য জল ফোঁটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। রুপা হাতে থাকা শাড়ীটা আর নুপুর জোড়া তুরানের দিকে ছুঁড়ে মারলো। এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে চলে যেতে লাগলো। তুরান দৌড়ে গিয়ে রুপার পথ আটকে দাঁড়ালো। পথ থেকে তুরান কে সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে রুপা। তীব্র রাগ আর ক্ষোভে ফেটে পড়ছে যেন। এতক্ষন নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে যে রাগ সঞ্চয় করেছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবার।
তুরান ব্যস্ত হয়ে পড়ল রুপার রাগ ভাঙাতে।রাগের কারনে টা কি রিং ফেরত দিয়েছে সেটা?
-‘ বলবে তো আমি কি করেছি? না বলবে বুঝবো কিভাবে?’
এখনও চুপ করে আছে রুপা। চোখ দিয়ে যেন সমস্ত রাগ প্রকাশ করছে।
-‘ রুপা এভাবে তাকাবে না কিন্তু! ভয় পাই আমি।’
এ পর্যায়ে রুপার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠে। ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,
-‘ এত ভাব কিসের আপনার? রিং টা ফেরত দিলেন কেন? শপিং এ বসে শার্ট, প্যান্ট নিতে বললাম তখনো ভাব করেছেন।’
রুপার গম্ভীর মুখ টা ফ্যাকাশে হয়ে উঠে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে,
-‘ আপনি আমার দেওয়া কিছু নিতে চান না।আমি কেন নিবো?’
খুব জোরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তুরান। রুপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলে,
-‘ এজন্য এত রাগ করা লাগে রুপা বাবু টার।’
-‘চুপ একদম চুপ রং ঢং এর কথা বলে রাগ ভাঙানোর ব্যর্থ চেষ্টা করবেন না।’
তুরান কি ভেবে যেন একটু হাসলো। রুপার রাগ যেন উপভোগ্য কিছু। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে না দেখে আচমকা রুপা কে পাঁজা কোলা নিয়ে রুমে চললো রুপা। রুপা অবাধ্য ভাবে হাত পা ছুড়তে শুরু করলো কোল থেকে নামার জন্য।
রুমে এনে রুপা কে জোর করে চেয়ারের উপর বসালো।রুপা ব্যর্থ চেঁচামেচি করতেই থাকলো। তুরান খুব আদুরে গলায় বলল,
-‘এভাবে আমার রুমে বসে চেঁচামেচি করলে আমায় কিন্তু আজিজ চৌধুরী এ বাসা থেকে বের করে দিবে।’
অমনি চুপ হয়ে যায় রুপা। রুপার রাগটা পুনরায় অভিমানে পরিনত হয়।
-‘ আমি আপনার জন্য ভালোবেসে কিনলাম আপনি কিভাবে পারলেন সেটা ফেরত দিতে?’
-‘ সেটাই তো আমি এত অমানুষ কেন? আমি রুপার ভালোবাসা বুঝলাম না। আমার ফাঁসি হওয়া উচিত। হুকুম করেন আপনার
জল্লাদ কে মহারানী। আমার এখনই ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যেতে বলুন।’
তুরানের রসিকতা দেখে আর না হেসে পারলো না রুপা। রুপার হাসি দেখে তুরানের মন প্রশান্তি যে ছেয়ে যাচ্ছে।
-‘ তুমি একদম থ্রী,ফোরে পড়া বাচ্চাদের মত রাগ করো। তোমার ভালোবাসা ,রাগ,অভিমান সবই ইউনিক।’
কথাটা বলে রুপা কে আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তুরান। রুপা হয়ত এতক্ষন এটাই চেয়েছিল। রুপা তুরানের বুকে মিশে রইল। তুরান হেসে বলে,
-‘ মেঘ হলো, বিদ্যুৎ চমকালো, বজ্রপাত হলো, বৃষ্টি হলো এখন আবার রোদ। আবহাওয়া শুধু চেঞ্জ হয়।’
রুপাও হেসে উঠলো।
-‘ তখন যদি রিং টা নিতেন তাহলে মেঘ, বৃষ্টি কিছুই হতো না।’
-‘ এখন তো নিচ্ছি। কি ডেঞ্জারাস তুমি! শাড়ী,নুপুর সব ফেরত নিয়ে আসছো।’
রুপা ভেংচি কেটে বলে,
-‘ভালোই করেছি।’
দুই জনেই আবার হেসে উঠলো। পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস বোধ হয় মেয়ে মানুষ। হাসতে সময় লাগে না, কাঁদতেও সময় লাগে না। পৃথিবীর প্রত্যেক টা মেয়েই বোধ হয় নিজ নিজ রহস্যে রহস্যমণ্ডিত। রুপা রহস্যে আর চার- পাঁচ টা মেয়ে মানুষের থেকে এক কাঠি সরেস।
অদ্ভুত রুপা! অদ্ভুত ধরনের রাগ! অদ্ভুত রকমের ভালোবাসা! ওঁদের ভালোবাসা টাও অদ্ভুত। এসব ভেবে আনমনে হেসে উঠে তুরান।

রুপা ইজি চেয়ারে বসে বসে দুলছে। ওর চেহেরায় দেখে এখন যে কেউ বলতে পারবে মেয়েটার মনে এখন কোন কারনে খুব আনন্দ কাজ করছে। হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। মাঝে মাঝে মিটিমিটি হাসছেও। মৃদু বাতাসে ঘাড়ের কাছের চুল গুলো মুখে উড়ে এসে পড়ছে। অন্য সময় হলে বোধ হয় বিরক্ত বোধ করতো। কিন্তু এখন বাতাসে উড়ে আসা মুখের উপর পড়া চুল গুলো যেন রুপার রোমাঞ্চকর মনের চপলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বারান্দার টবে লাগানো ফুলের মৃদু ঘ্রান রুপার নাকে লাগছে। সব কিছু এখন রুপার কাছে এখন রোমাঞ্চকর লাগছে।
সাহেলা বেগম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রুপার দিকে তাকিয়ে আছে। সাহেলা বেগম একজন দক্ষ সাইকিয়াট্রিস্ট। তাঁর বুঝতে বাকী নেই যে রুপার মনে কিছু একটা চলছে। অনেকক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রুপার কান্ড দেখছে।
-‘কি ভেবে এত খুশি আম্মা আপনি?’
চারদিকের নিরবতার মাঝে কারো কন্ঠ শুনে ধড়পড়িয়ে উঠে রুপা।
-‘ উফ আম্মু তুমি! এভাবে হঠাৎ কেউ এসে কথা বলে।’
-‘ তুই যে প্রতিদিন রান্না ঘরে গিয়ে আমায় ভয় দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করিস!’
-‘ তুমি তো ভয় পাও না।’
সাহেলা বেগম আগ্রহী কন্ঠে বলে,
-‘তা এত রোমাঞ্চ রোমাঞ্চ ভাব কেন তোর মনে? প্রনয়নের কথা মনে পড়েছে বুঝি?’
মূহুর্তেই মুখ টা ফ্যাকাশে হয়ে যায় রুপার। কিছুক্ষণ সাপের মত ফুঁসে থাকে,এই বুঝি ছোবল দিবে।
সাহেলা বেগম হেসে বলে,
-‘ সরি,সরি মা মনি।আর বলবো না।’
-‘ আর বলবে না আর বলবে না! প্রতিদিনই তো বলো।’
সাহেলা বেগম হেসে হেসে কথা বলে রুপার রাগ কমানোর চেষ্টা করছে।
কালকে আজিজ চৌধুরীর বাসার তিন তালায় যে ফ্যামিলি ভাড়া থাকে তাঁদের মেয়ের বিয়ে। বিয়ে আগেই হয়েছে ঘরোয়া ভাবে,এখন আনুষ্ঠানিক ভাবে।
মেয়েটা চট্টগ্রাম থেকে লেখাপড়া করে,রুপার সাথে তেমন ভাব নেই। মাঝে মাঝে এখানে আসলে একটু আধটু কথা হত। লোকটা অনেক বছর ধরে আজিজ চৌধুরীর বাসায় ভাড়া থাকে সে সুবাদে আজিজ চৌধুরীর সাথে সম্পর্ক খুব ভালোই!
অনুষ্ঠান হবে কমিউনিটি সেন্টারে। মেয়েটার নাম নীড়া। দেখতে বেশ সুন্দরী! লেখাপড়ায়ও নাকি অনেক ভালো। নীড়া দের বাসায় মেহমানে ভরপুর। আজিজ চৌধুরী আর সাহেলা বেগমও গিয়েছে সে বাসায়। রুপা কে অনেক বার সেধেছে কিন্তু রুপা যাবে না। রুপার এমন আচরনে নতুন করে অবাক হচ্ছে সাহেলা বেগম। একা রুমে বসে বসে পাঁয়তারা করছে রুপা।
মনে চাচ্ছে নীড়া দের বাসায় যেতে। সবার সাথে ভাব জমাতে। কিন্তু ভার্সিটি তে যাওয়ার আগে তুরান বরাবরের মত একটা কাগজ ছুঁড়ে মেরেছে রুপা দের বারান্দায়। কাগজে লেখা ছিলো,
‘ আমি না আসা পর্যন্ত বিয়া বাড়িতে যাবে না । নীড়ার অনেক কাজিনরা এসেছে। তোমার দিকে অসভ্যের মত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।’
চিঠিটা পড়ে খুব হেসেছিল রুপা। কিন্তু পরমুহূর্তেই মন খারাপ হয়ে যায় বিয়ে বাড়ি যেতে পারবে না তাই।
একা রুমে থেকে থেকে রুপার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। বিল্ডিং এর সবাই কম বেশি বিয়ের আনন্দে ব্যস্ত। রুপা একটা ব্লেড নিয়ে ছাদে চলে গেল। প্রথমে ছাদে রোদ দেওয়া প্রতিটা শার্টের পিঠে ব্লেড দিয়ে লাভ আকৃতি করে কেটে নিলো শুধু তুরানের শার্ট টা বাদে। আর মহিলা দের জামা কেটে শার্ট করে দিলো।
তারপর দ্রুত ছাদ থেকে নেমে গেল রুপা। রুমে গিয়ে হেসে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
এর ভিতর শিষ বাজানোর শব্দ শুনতে পেল রুপা। তার মানে তুরান এসেছে। রুপা কে মাঝে মাঝে না দেখলে শিষ দিয়ে তুরান নিজের উপস্থিতির জানান দেয়।
হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক হয়ে তুরানের কাছে যায়। মনে মনে এখন খুব ভয় পাচ্ছে। ছাদে রোদ দেওয়া সব জামা কাপড় কেটে ফেলেছে, তুরান জানলে খুব রাগাবে।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here