যদি তুমি জানতে’পর্ব-২৩

0
466

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_23
রুপা নিজের অনিচ্ছাকৃত ভাবে সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরীর সাথে তাঁদের গাড়িতে কমিউনিটি সেন্টারে গেলো। রুপার মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেছে। ইচ্ছা ছিলো তুরানের সাথে এক রিকশায় চড়ে যাবে। তুরানের সাথে রিকশায় চড়তে খুব ভালো লাগে রুপার। মুখে চরম বিরক্ত ভাব নিয়ে গাড়িতে বসে রইলো রুপা।
রুপা কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছার একটু পর পরই তুরানও চলে আসলো। তুরান কে দেখা মাত্রই রুপার মন খারাপ উবে গেল। তুরানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিলো।
রুপা এতক্ষন তুরানের অপেক্ষায় গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। সাহেলা বেগম অনেক বার সেধেছে ভিতরে যাওয়ার জন্য কিন্তু রুপা কোন কথা না বলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলো।
-‘ এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার জন্য ওয়েট করছেন সুন্দরী?’
-‘ আমার সুন্দর মানুষ টার জন্য।’
মুখ গম্ভীর করে রুপা আবার বলে,
-‘ আমি উনাদের সাথে আসতে চাই নি জোর করে নিয়ে আসছে। আমার ইচ্ছা ছিলো আপনার সাথে আসবো।’
-‘ সে জন্য মন খারাপ করা হয়েছে? এখন মন ভালো করুন আমি এসে গেছি।’
তুরান একটু থেমে সিরিয়াস হয়ে আবার বলে,
-‘ আমাদের একটু দূরে দূরে থাকতে হবে। সাহেলা আন্টি সন্দেহ করতে পারে।’
রুপা ঠোঁট বাঁকিয়ে জোর গলায় বলল,
-‘ করলে করুক! চলুন তো গেটের ভিতরে।’
গেট দিয়ে ঢুকতেই রুপার চোখে আটকে যায়। রুপা অবাক হয়ে দেখছে সব কিছু। কত সুন্দর করে সাজানো! অবাক চোখে রুপা চার দিকটা দেখছে। গেটের উত্তর দিকে সাজানো হয়েছে স্টেজ। নানা রকমের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে স্টেজটা। রুপার দৃষ্টি আবার আটকে যায় স্টেজে‌ বসে থাকা বর‌ বউ কে দেখে। কত সুন্দর গহনা ঘাঁটি আর লাল শাড়ি তে বউ সেজেছে নীড়া। একদম অন্যরকম লাগছে নীড়াকে । নীড়ার বর টাও বেশ চমৎকার। রুপা আনমনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব অবলোকন করতে লাগলো।
-‘ রুপা বউ সাজতে ইচ্ছে করছে বুঝি?’
রুপার ভাবনার জগৎ থেকে না বেরিয়েই বেখেয়ালি মনে বলল,
-‘ হু।’
-‘ আরে বাবা তাকিয়ে থাকার কি আছে এভাবে?’
রুপা এবার মনযোগ দিয়ে তুরানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ আমাদের এমন বিয়ে হবে কবে?’
তুরান একটা চেয়ার টেনে বসলো। রুপাও পাশের চেয়ার টায় বসলো।
-‘ আর কয়েক মাস পরে আমার ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম শেষ। তারপর আর তোমার বউ হওয়া ঠেকাবে কে?’
তুরান চিন্তিত গলায় আবার বলল,
-‘ আচ্ছা রুপা তোমার ফ্যামিলি যদি আমাদের বিয়ে নিয়ে কোন ঝামেলা করে? আই মিন তাঁরা মানবে তো?’
রুপা ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
-‘ মানা না মানা তাঁদের ব্যাপার। লাইফ আমার সিদ্ধান্ত আমার! সংসার তো আর তাঁরা করবে না।’
রুপার কাছ থেকে এমন সিরিয়ার কথা শুনা যেন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু। তুরান হেসে বললো,
-‘ খুব সিরিয়াস কথা বলতে পারেন দেখছি।’
তুরান একটু থেমে বললো,
-‘ বলা যতটা সহজ করা ততটা সহজ না।’
-‘ রুপার কাছে বলা যেমন সহজ করা তার থেকে বেশী সহজ। আমি এখন রোমান্টিক মুডে আছি। এসব কথা বাদ দেন।’
তুরান আবার হেসে দিলো। সাহেলা বেগমের ডাকে চলে গেল রুপা। তুরান একা একা বসে বোর ফিল করছে। অনুষ্ঠানে কত মানুষ অথচ ওকে এখন একা একা বসে থাকতে হচ্ছে। তুরানের ইচ্ছা করছে নিজের মাথায় বারি দিতে, কেন যে সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারে না সেই অপরাধে।অথচ রুপা টা একদম ওর বিপরীত মেরুর মানুষ যেন। কত অল্প সময়েই মানুষের সাথে ভাব জমিয়ে ফেলতে পারে। তুরানের এমন চুপ-চাপ স্বভাবের কারণে সবাই ভাবে তুরান হিংসুটে টাইপের মানুষ। অথচ কেউ বুঝে না যে কারো সাথে কথা বলতে আনইজি লাগে ওর।
-‘ এই যে ভ্যাবলাকান্ত মশাই।’
পিচ্চি কারো গলা শুনে পিছনে ফিরে তাকালো রুপা। তুরান যথারীতি হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কালকে সেই রোজা পিচ্চি টা। এই নাম তো শুধু ওকে রুপাই‌‌ ডাকতো।
-‘ হাঁ করে তাকিয়ে আছেন কেন? লুপা আপু ডাকছে।’
তুরান নড়েচড়ে বসে বলল,
-‘ ভ্যাবলাকান্ত মশাই কে?’
-‘ আমি জানি নাকি। ওই লুপা আপু আপনায় দেখিয়ে বললো ভ্যাবলাকান্ত মশাই টা কে বলো আমি ডাকি।’
রুপার কাজ‌ তাহলে! রোজা খুব মিষ্টি দেখতে। আরো বেশী মিষ্টি ওর বলা কথা গুলো। সামনে দাঁত না থাকার কারণে র কে ল বলে। তুরান রোজার কথা শুনে কে জানি খুব বেশি মজা পায়।
-‘ আচ্ছা.. আচ্ছা তোমাল নাম টা যেন কি বলছিলে কালকে?’
মেয়েটা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো তুরানের দিকে।
-‘ আমায় ব্যাঙ্গাচ্ছেন?’
এই বলেই হনহনিয়ে চলে গেল রোজা। তুরান হাসতে লাগলো।
তুরান রুপার কাছে গেলো। রুপা তুরান কে একটু আড়ালে নিয়ে গেলো।
-‘ তুমি জানো আমি একা একা বসে বসে বোর হচ্ছিলাম?’
-‘ এত মানুষের মধ্যেও যে একা একা বোর হয় তাঁর জন্য আমার বিশেষ কিছু করার নেই।’
-‘ তুমি জানো না আমি কারো সাথে কথা বলতে পারি না?’
রুপা চোখ রাঙিয়ে বলল,
-‘ এসব বদ অভ্যাস বাদ দেন তো। সবার সাথে মিশে থাকার চেষ্টা করবেন।’
হঠাৎ কন্ঠস্বর পরিবর্তন হয়ে যায় রুপার। খানিকটা আবেগী হয়ে বলল,
-‘ একটা চুমো দিলেন না।’
তুরান রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কেমন করে অভিযোগ করে মেয়েটা! তুরানের হৃদস্পন্দন খানিকক্ষণের জন্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
তূরান আশেপাশে চোখ বুলিয়ে রুপা কে একটু কাছে টেনে নিলো।
-‘দিবো চুমো?’
রুপা মাথা নিচু করে বলল,
-‘ হুম।’
রুপার চোখেমুখে লজ্জার রক্তিম আভা।কেমন জড়োসড়ো হয়ে চুপসে গেল রুপা। রুপার এমন লজ্জা পাওয়া দেখতে ভালো লাগছে তুরান। তুরান রুপা কে লজ্জা দেওয়ার জন্য আবার বললো,
-‘কোথায় দিবো?’
রুপা লজ্জা পাচ্ছে আবার মেজাজও খারাপ হচ্ছে। তুরানের সব সময় রুপা কে লজ্জা দেওয়ার ধান্দা। রুপা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
-‘ ছাড়ুন। লাগবে না কিছু।’
তুরান ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বলল,
-‘ লাগবে না কেন? বৃথা চেষ্টা করো না। ছাড়বো না।’
রুপা তুরানের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। তুরান কাছে আসলেই রুপার ইচ্ছা করে দৌড়ে পালাতে,আবার পালিয়ে গেলে নিজের বোকামির জন্য নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছা করে।
তুরান রুপার দুই গালে হাত দিয়ে রুপার মুখটা উঁচিয়ে ধরলো। রুপা এখনো চোখ বুঁজে আছে। তুরান সাত-পাঁচ না ভেবে রুপার ঠোঁটে‌ আলতো করে ঠোঁটে ছুঁইয়ে দিলো। সর্বাঙ্গে কেঁপে উঠলো রুপা মনে হচ্ছে এখনি দম বন্ধ হয়ে যাবে। হার্ট বিট অস্বাভাবিক রকমের বেড়ে গেছে। রুপা বরাবরের মত হঠাৎ তুরানের ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেলো। তুরানের কাছে থাকলে দম বন্ধ হয়ে যাবে মনে হচ্ছিলো।এমন অদ্ভুত রকমের অনুভূতির সাথে রুপা মোটেও পরিচিত ছিলো না।
রুপা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো। এই প্রথম তুরান ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছে। এ ভালোলাগার অনুভূতি প্রকাশ করার মত না।
তুরান নিজের মনে হাসছে। রুপা খুব বেশি লজ্জা পেয়েছে। লজ্জা পাওয়া ব্যাপারটার মধ্যেও অন্যরকম ভালোলাগা, মুগ্ধতা কাজ করে। রুপা কোথায় পালিয়ে গেল? তুরান আশেপাশে তাকাতে লাগলো। রুপা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি।তুরান আস্তে গিয়ে রুপার পাশে দাঁড়ালো। রুপার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
-‘রুপা।’
রুপা হকচকিয়ে পিছনে তাকালো। তুরানের ঠোঁটে আবার দুষ্টুমির হাসি ,হাসিটা যেন রুপাকে লজ্জা দিতে চাচ্ছে।
রুপা তুরানের গায়ে এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি দিতে লাগলো।
-‘ কুত্তা, শয়তান, বিলাই আপনি! লজ্জা দেন শুধু আমায়।’
-‘ তোমার হাতের মার এতো মিষ্টি কেন?’
তুরান উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
-‘রুপা,থামো। চারদিকে মানুষ কিন্তু।’
রুপা জিহ্বায় কামড় দেয়। বিড়বিড় করে বলে,
-‘ আসলেই তো।’
রুপা বার বার নীড়া আর নীড়ার বরের দিকে তাকাচ্ছে। খুব মানিয়েছে দুই জনকে। ফটোগ্রাফার ছবি তুলছে ,সবাই বর আর বউয়েয় সাথে ছবি তুলছে। প্রত্যেক টা মেয়েকেই বোধ হয় বিয়ের সাজে মিষ্টি লাগে।
তুরান আর রুপা বর বউয়ের দুই পাশে বসে অনেক গুলো ছবি তুললো। ছবি তোলার ব্যাপারে তুরান ইন্টারেস্টলেস কিন্তু রুপা খুব ইন্টারেস্টেড! রুপা ইচ্ছা করছিলো তুরানের হাত ধরে ছবি তুলতে, কিন্তু এত মানুষের ভিতর তা সম্ভব না।
রুপা আবার বিয়ার আনন্দে মত্ত হয়ে গেলো। তুরান আগের মত এক কোণে চেয়ারে বসে রইলো। রুপার অনেক বেশী আনন্দ হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর রুপা তুরান কে খুঁজতে লাগে। তুরান চেয়ারে বসে আসে, তুরানের চেয়ার ঘেঁষে আরেকটা চেয়ারে বসে আছে খুব সুন্দরী একটা মেয়ে ,তুরান মেয়েটার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। মেয়েটা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে তুরানের সাথে ছবি তুলছে। রুপা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল! তুরান কি রুপার মত এই মেয়েটাকেও ভালোবাসে? রুপার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। রুপা বুঝতে পারছে না কেন এমন হচ্ছে। আর বুঝতেও চাইলো না। তুরান কেন অন্য মেয়ের সাথে কথা বলবে? রুপার মাথায় আগের মত যন্ত্রণা হতে লাগলো। আগের মত সবকিছু ভাঙচুর করতে ইচ্ছে করল। তুরান রুপাকে খেয়াল করে নি।
রুপা দৌড়ে সাহেলা বেগমের কাছে গেলো। রুপার চোখ অদ্ভুত রঙ ধারণ করেছে। অস্বাভাবিক লাগছে রুপাকে। রুপার অবুঝ ব্রেন এখন উত্তাল হয়ে গেল । সাহেলা বেগম রুপা কে দেখে ঘাবড়ে গেলো । রুপার এই রুপ সাহেলা বেগম চিনে। রুপা যখন অস্বাভাবিক হয়ে যায় তখন এমন দেখায় রুপা কে। রুপা ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো,
-‘ আমি বাসায় যাবো, এক্ষুনি বাসায় যাবো।’
সাহেলা বেগম কথা না বাড়িয়ে রুপাকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে চলতে লাগলো। এত মানুষের ভিতর যদি রুপা পাগলামি করে তাহলে মান – সম্মানের প্রশ্ন। সাহেলা বেগম বুঝতে পারলো না রুপা কেন এমন আচরন করছে?রুপা তো স্বাভাবিকই ছিলো।
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here