যদি তুমি জানতে’পর্ব-৩৩

0
347

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_33
সকাল সকাল তুরানের ঘুম ভাঙে তুরানের মায়ের ডাকে। হসপিটালেই তুরানের বাবার পাশে আড়মোড়া হয়ে কোন রকম ভাবে ঘুমাচ্ছিলো তুরান। তুরানের মা বাসায় ছিলো। হঠাৎ হসপিটালে এসে এভাবে ঘুম কেন ভাঙালো? এই কয়দিনে খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে তুরান। ঘুম ঘুম চোখে জিজ্ঞাসা করলো,
-‘ মা তুমি হসপিটালে আসলে কেন এই সকাল বেলা? আমি তো বাবাকে নিয়ে আরেকটু বাদে বাসায় যেতাম। দেখো বাবা এখন প্রায় সুস্থ।’
তুরানের মা এক দৃষ্টিতে তুরানের দিকে তাকিয়ে আছে। কোন কথা বলছে না, দু চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে শুধু। মায়ের এমন অস্বাভাবিক কান্নার কারন বুঝতে পারছে না হঠাৎ ঘুম ভাঙার কারনে। তুরান ভালো ভাবে তাকালো এবার। এমন কান্না দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। বললো,
-‘ মা কি হয়েছে কাঁদছো কেন? আরে বাবা তো সুস্থ।’
তুরান একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। তুরানের মা কান্নার কারনে কোন জবাব দিতে পারলো না। কোন রকম ভাবে কান্না থামিয়ে বললো,
-‘ হসপিটালের ওদিকে সব মালপত্র। এত কষ্ট করে এই দিন দেখার জন্য তোকে লেখাপড়া করিয়েছি? এই অপমান সহ্য করার জন্য?’
তুরান বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছে না কি হয়েছে? কিসের মালপত্র হসপিটালের সামনে? কিসের অপমান? তুরান বললো,
-‘ কান্না থামাও মা। কি হয়েছে ভালো করে না বললে কিছুই বুঝতে পারবো না।’
তুরানের গালে কষিয়ে কয়টা চড় দিলো তুরানের মা । তুরান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। তুরানের বাবার ঘুম ভেঙে যাবে তাই তুরান কে বারান্দায় আসতে বললো তুরানের মা। তুরান ধীর পায়ে মায়ের পিছু পিছু বারান্দায় গেলো। তুরানের মনে নাড়া দিলো রুপার কথা। এই নিয়ে কি কিছু হয়েছে ।
বারান্দায় গিয়ে তুরানের মা অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে বললো,
-‘সাহেলা বেগম সব মালামাল পাঠিয়ে দিয়েছে বাসার। আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে অপমান করেছে।’
তুরানের মায়ের কান্না আবার বেড়ে গেলো। তুরানের মাথায় যেন বাজ পড়লো। কি বলছে এসব ? তুরান হতবাক হয়ে গেল! স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তব তাও বুঝতে পারছে না। একদম নির্বুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো তুরানের। সব কি শেষ হয়ে গেলো? রুপা কে নিয়ে কি কিছু হলো? তুরান নিচু গলায় বললো,
-‘মা কিসের জন্য অপমান করেছে তোমায়? মালামাল কেন পাঠিয়ে দিয়েছে? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।’
তুরানের মা রক্ত বর্ন চোখে তুরানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘ তোর মতো জানোয়ার পেটে ধরেছি বলে অপমান করেছে। কিছুই বুঝিস না এখন? ওই রুপা মেয়ের সাথে কিসের সম্পর্ক তোর? ‘
তুরানের মা এ পর্যায়ে আরো চেঁচিয়ে আবার বললো,
-‘কিসের সম্পর্ক?’
তুরান কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। তুরানের মাথায় কিছুই খেলছে না। তুরানের বুক জুড়ে ভূমিকম্প বয়ে যেতে লাগলো। সব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সবই তো ঠিক ভাবে চলতে ছিলো। হতভম্ব হয়ে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে তুরান। তুরানের মা আবার চেঁচিয়ে উঠে বললো,
-‘দেশে আর মেয়ে ছিলো না তোর জন্য? একটা বিয়াত্তা মেয়ের সাথে প্রীত করছোস?’
তুরান চোখ বড় করে তাকালো। কোন রকম ভাবে বললো,
-‘কে বিয়াত্তা? কি বলছো তুমি মা এসব? মা তোমায় কে বলছে এগুলো? মা…।’
তুরান আর কিছু বলতে পারলো না। বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলো না। এটা কি করে সম্ভব রুপা বিবাহিতা? এমনটা কখনো হতে পারে না। কখনো না! তুরানের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। সবকিছু তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। বিশ্বাস হওয়ার মতো কথা না এসব। তুরানের হাত-পা কাঁপতে লাগলো। তুরান কাঁপা কাঁপা গলায় আবার বললো,
-‘ মা কে বিবাহিতা রুপা? মা তুমি বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলছো।’
-‘ আমি মিথ্যা বলছি না?’
তুরান কথা বাড়ালো না । কি থেকে কি হয়ে গেলো। সবকিছু অস্পষ্ট, সব মেঘাচ্ছন্ন। তুরান কিছুই বুঝতে পারলো না। আস্তে আস্তে ফ্লোরে বসে পড়লো। তুরানের মা মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদছে।
তুরান দুই হাতে মাথা চেপে ধরলো। নাকমুখ কুঁচকে বললো,
-‘মা কি হয়েছে সবটা বলো। মা আমি রুপা কে ভালোবাসি। অনেক বেশি মা। সাহেলা বেগম তোমায় অপমান করার কে? বাসা থেকে মালপত্র সব পাঠালো কেন?’
তুরান কষ্ট ভেজা কন্ঠে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে লাগলো। তুরানের মা কান্না থামিয়ে দুই চোখ ভালোভাবে মুছলো। তারপর কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নিলো।
-‘খুব সকালে দরজার কড়া নাড়লো। আমি ভেবেছি তুই আর তোর বাবায় এসেছিস। আমি দরজা খুলে দেখি সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরী। এত সকাল সকাল তাঁদের দেখে আমি কিছু টা চমকে গেলাম। উনাদের মুখের ভাবভঙ্গি দেখেই আমি বুঝেছি কিছু একটা হয়েছে। উনারা আমায় যা ইচ্ছে তাই বলতো লাগলো। তোকে যা তা ভাষায় গালি দিতে লাগলো। বললো রুপার সাথে তোর সর্ম্পক। তোরা ভুল পথে এগোচ্ছিস। রুপা বিবাহিতা। তাই তাঁরা চায়না এ সম্পর্ক আর এক পা আগাক। যা ভুল হয়েছে এ পর্যন্ত সমাপ্ত হোক। তাই আমাদের তাঁদের বাসা ছেড়ে দিতে হবে।আমি কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । আমি কিছু বলার আগেই উনারা বাসার সব মালপত্র কুলি ডেকে বের করে দিলো। আর তুই যদি রুপার সাথে কোন রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করিস তাহলে তোকে পুলিশে দিবে।’
মায়ের মুখে এসব শুনে নির্বাক হয়ে রইলো তুরান। মায়ের চোখের অন্তরালে চোখের জল মুছলো। গায়ের সব শক্তি যেন হারিয়ে ফেলল তুরান। গুলো কি হয়ে গেলো একটু সময়ের ব্যবধানে?
তুরান‌ কোন জবাব দিচ্ছে‌না। বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করছে , শূন্যতা আর হতাশায় ছেয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব রঙ বোধ হয় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সব স্বপ্ন গুলো আছড়ে পড়ে আর্তনাদ করছে। খানিকক্ষণের ভিতর পৃথিবী বদলে গেলো বোধ হয়। বদলে গেলো আগামীর স্বপ্ন,আশা , কল্পনা। তুরান কখনও এমন না হবে ভাবেনি। কখনোই না। রুপা বিবাহিতা কিছুতেই তুরান বিশ্বাস করতে পারছে না। কেউ যেন তুরানের গলা টিপে ধরেছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তুরানের। তুরানের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছেনা। তুরান একদম নির্জীব হয়ে আর্তনাদ করে বললো,
-‘মা রুপা বিবাহিতা না বলো? বলো অন্তত এটা মিথ্যা।’
তুরানের মা হতাশ ভঙ্গিতে বসে রইলো। পুরো সংসারের ভরসা ছিলো তুরান। ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন বাবা-মায়ের। তুরানের মা শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে। কষ্ট ভরা কন্ঠে বলল,
-‘ ভালোবাসার জন্য আর মেয়ে পেলিনা? আমাদের কথা একবারও ভাবলি না? একটা বিয়াত্তা মেয়ে! এতটা নীচ তুই! এত ছোট মনের! এত খারাপ রুচির তুই?’
তুরানের মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো আবার। তুরান কোন কথা বলছে না। তুরানের মা আবার বললো,
-‘ তোর বাবা এসব জানলে শেষ হয়ে যাবে। নিজে কখনো ভালো কাপড় পরিনি তোকে লেখাপড়া করিয়েছি। কখনো ভালো বাজার করে খাই নি । তোর লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছি। আজ সেই তোর জন্য মানুষ কুকুরের মত অপমান করে আমায়।’
তুরানের চোখ বেঁয়ে পানি পড়ছে এবার। কোন কথা বলতে পারছে না। তুরানের মা আবার বলল,
-‘হসপিটাল থেকে তোর বাবাকে এখন কোথায় নিয়ে যাবো এবার? বাসা ভাড়া পাবি কই ? থাকবি কই? খাবি কই?’
তুরানের মা আর্তনাদের বুলি বুলতে লাগলো। তুরানের অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে..! তীব্র যন্ত্রণা! সহ্য না করার মতো যন্ত্রণা!
এই যন্ত্রার চেয়ে বোধ হয় মৃত্যুতে শান্তি। বোধ শক্তি হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে ক্রমে ক্রমে তুরান। যেন এখনই ঢলে পড়ে যাবে।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here