যদি তুমি জানতে’পর্ব-৩৯

0
688

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_39
কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে পড়লো রুপা। কোন কথা বলছে না ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। নিচু গলায় সাহেলা বেগম কে বললো,
-‘আম্মু তুরান কি সত্যিই বিয়ে করেছে? নাকি মিথ্যা বলছো? ওর সাথে একবার দেখা করবো। ওর বাসার ঠিকানাটা দেও।’
সাহেলা বেগম অপ্রস্তুত ভাবে বললো,
-‘মিথ্যা বলবো কেন তোকে? আর তু্রানের সাথে তোর কি সম্পর্ক ছিলো? থাকলে ভুলে যা ওসব। দেখলিই তো ছেলেটা কত স্বার্থপর!’
আজিজ চৌধুরী তীক্ষ্ণ চোখে সাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে। কি নিখুঁত অভিনয় করছে সাহেলা বেগম!
রুপা জানালার গ্রিলের ফাঁক করে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। কিছুই ভাবতে পারছে না।সাহেলা বেগমের কথাও বিশ্বাস করতে পারছে না। এরকম কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলো না রুপা। কষ্টে নির্বিকার হয়ে বসে রইলো। এ যেন তুরানের উপর তীব্র অভিমান। কেন করলো তুরান এমনটা? রুপার চোখ থেকে এখন আর পানি পড়ছে না অথচ হৃদয় রক্তক্ষরণ হতে লাগলো। রুপা কাঁপা কাঁপা গলায় আবার বললো,
-‘আমি তুরানের সাথে দেখা করবো। তোমরা কিছু একটা করো। নয়ত আমি বাঁচতে পারবো.. কিছুতেই না।’
রুপার বাবা-মা সাহেলা বেগমের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি তাঁদের! রুপার মা হাতের ইশারায় সাহেলা বেগম কে রুম থেকে বের হতে বললো। বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসলো রুপার মা,সাহেলা বেগমও বসলো। রুপার মা ছলছল চোখে সাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে রইল। আর সাহেলা বেগম অপরাধীর ভঙ্গিতে বসে রইলো। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হতে চায়নি সাহেলা বেগম তাই তুরান কে বাসা থেকে বের করে রুপা কে তাঁদের কাছে দিয়ে দিলো। অথচ আজ সেই পরিস্থিতিরই মুখোমুখি হতে হলো। রুপার মা অস্ফুট স্বরে বললো,
-‘ তুই জানিস না রুপার জীবনটা? নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হবে তোকে? আমার মেয়েটার সাথে কেনই বা এমন হচ্ছে বলে? একটার পর একটা বিপদ তছনছ করে দিচ্ছে ওকে। তুই ওর দিকে একটু খেয়াল রাখবি না?’
-‘আমি যথেষ্ট খেয়াল রেখেছি কিন্তু এমনটা হবে ভাবতে পারিনি।’
তারপর কিছুক্ষণ দুইজনের মাঝে নিরবতা বিরাজ করলো। দুজনই চিন্তিত মুখে বসে রইলো। নিরবতা ভেঙে রুপার মা বললো,
-‘ওই ছেলেটার সাথে কত দিনের সম্পর্ক ওর? এখন কি করবো আমি বল? আর যন্ত্রণা নিতে পারছি না, আমার চোখের সামনে আমার মেয়েটা তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি।’
-‘ সম্পর্ক কতদিনের তা জানিনা। আমি যখন এ ব্যাপারটা জানতে পেরেছি তখনই তুরান কে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।’
-‘ শতরুপা যে বলছে ছেলেটা বিয়ে করছে?’
-‘ মিথ্যা বলেছি আমি। এ ছাড়া আর কি বললো বল?’
রুপার মা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো আবার। তারপর বললো,
-‘যা হওয়ার তা তো হয়েছিই। এখন এই সমস্যার সমাধান কি হতে পারে? রুপা কে দেশের বাইরে নিয়ে যাবো কয়দিন বাদেই। কিন্তু ও যদি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। ভয় হচ্ছে। তাই জোরপূর্বক কিছুই করতে চাচ্ছি না। তাছাড়া প্রনয় আসবে সামনের মাসে।’
সাহেলা বেগম প্রত্যুত্তরে কিছুই বলছে না। সাহেলা বেগম কে নিরুত্তর দেখে রুপার মা আবার বললো,
-‘আরেকটা কাজ‌ করতে পারি আমরা।’
সাহেলা বেগম আগ্রহী গলায় বললো,
-‘কি কাজ বল?’
-‘আমরা ওই ছেলেটার সাথে এ ব্যাপারে কথা বললেই পারি। শিক্ষিত ছেলে আশা করি বুঝবে। রুপার অতীত , রুপার সব এক্সিডেন্টের কথা।’
-‘ ছেলেটা যদি না বুঝে?’
-‘না বুঝলেও কিছু এসে যায় না। আর অবশ্যই বুঝবে। আর আমায় একটা কথা বল তো ছেলেটা কি জানতো না রুপা হিন্দু?’
-‘হয়ত বা না।’
-‘ তুই আমায় ওর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা কর। ছেলেটা কে তুই বাসা থেকে বের করে দিলি, এভাবে কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না । আর সম্পর্কে জড়ানোটা ভুলের তেমন কিছু না, এই বয়সে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ভুল হলো ওদের দুইজনের এক পথে চলা সম্ভব না । ছেলেটা জানে না রুপার সম্পর্কে। এভাবে বাসা থেকে ওকে বের করে দেওয়া ঠিক হয়নি ,এটা এক ধরনের মূর্খতা।’
পূজা রায়ের কথা গুলো যৌক্তিক বটে। সাহেলা বেগম এভাবে কখনো ভেবে দেখেনি। আজিজ চৌধুরীর কাছে তুরানের ফোন নম্বর ছিলো। সাহেলা বেগম আজিজ চৌধুরীর কাছ থেকে ফোন নম্বর চেয়ে নিলো তুরানের। আজিজ চৌধুরী বুঝতে পারছে না সাহেলা বেগম কি করতে চাচ্ছে? আজিজ চৌধুরীর কোন কথার জবাব দিচ্ছে না সাহেলা বেগম।
পূজা রায় নিঃশব্দে কাঁদছে। মেয়ের জন্য আর কত কাঁদতে হবে তার অন্য নেই! কি অসহ্য একটা যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ গুলো।
পূজা রায় বললো,
-‘ ছেলেটা কে ফোন দিয়ে নিচ তলায় আসতে বল।‌ শতরুপা যেন না দেখে ওকে।’
.
রুপা বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় আছে। কাঁদতে পারছে না হাজার চেষ্টা করেও। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও পড়ছে না। সব পানি যেন শুকিয়ে গেছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছে। সব কিছু বিষাদ আর যন্ত্রণাময় মনে হচ্ছে।‌‌‌এত যন্ত্রণা নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়?
তুরানের সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত।‌ তুরানের দেওয়া চিঠি গুলো, পায়ের নুপুর, কালো শাড়ি টা। কি নিদারুন যন্ত্রণা! তুরানের স্পর্শ এসব ভাবতেই তুরানের যন্ত্রণা আরও তীব্র হয়ে উঠছে।‌‌‌‌‌‌‌ আর যাই হোক এত তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। মুর্তির মত বসে আছে রুপা। নিস্তেজ হয়ে গেছে একদম।
.
সাহেলা বেগমের ফোন পেয়ে খুব বেশি চমকে গেছে তুরান। কয়েকবার এসেছিলো রুপার খোঁজে কিন্তু দারোয়ান গেট দিয়ে ঢুকতে দেয়নি। সাহেলা বেগম নিষেধ করেছে দারোয়ান কে। হাজার চেষ্টা করেও রুপার সাথে দেখা করতে পারেনি তুরান।
গায়ে প্রচন্ড জ্বর তুরানের। সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে, নির্জীব হয়ে পড়েছে তুরান। চোখের পানি আটকে রাখতে পারছে না হাজার চেষ্টায়, রুপার কথা ভাবতেই দুই এক ফোঁটা পানি আপনা-আপনি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে। রুপার সাথে দেখা করার জন্য এত চেষ্টা করলো কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হলো তুরান। জীবন টা দিনে দিনে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তুরানের। এত টা কষ্ট বয়ে বেড়াতে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তুরান এখন স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে সাহেলা বেগম মিথ্যা বলেছে, রুপা বিবাহিতা নয়।
সাহেলা বেগমের ফোন পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেলো তুরান। কেন যেতে বলেছে সাহেলা বেগম? তুরান ভাবতে পারছে না কিছুই। হাজার প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তুরানের মনে। রীতিমত ঘামতে শুরু করলো তুরান। কি এমন কারন থাকতে পারে যার জন্য সাহেলা বেগম ফোন করেছে? তুরানের ভাবনা শেষই হচ্ছে না । যদি এমনটা হয় রুপার সাথে সম্পর্ক মেনে নেয় সবাই নাকি খারাপ কিছু হবে? উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসছে তুরানের।
পড়নে যা ছিলো তাই পড়ে রওয়ানা হলো তুরান। পথ যেন শেষই হচ্ছে না তুরানের। হাত-পাও খানিকটা কাঁপছে। রুপার মুখটা কতদিন দেখছে না! কেমন আছে রুপাটা কে জানে? হয়ত খুব পাগলামি করছে।
-‘মামা একটু তাড়াতাড়ি রিকশা চালান না!’
রিকশাওয়ালা বিরক্ত হয়ে তুরানের দিকে তাকায়। এই নিয়ে কম হলে দশ বার এই কথাটা বলেছে‌ তুরান।
-‘আপনের এতই যহন তাড়া হেলিকপ্টারেই তো যাইতে পারতেন।’
রিকশাওয়ালার কথার প্রত্যুত্তর করলো না তুরান। যেন পথই শেষ হচ্ছে না। কি বলতে ডেকেছে সাহেলা বেগম? তুরানের বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠছে বার বার।
রিকশা এসে থামে চিরপরিচিত সেই বাড়িটার সামনে। তুরান রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাড়ির গেটের ভিতরে ঢুকলো।
তুরান কে দেখে এগিয়ে আসলো সাহেলা বেগম। বাড়ির নিচ তলায় তিনটা চেয়ার পাতা। তুরান কে দেখে রুপার মা বললো,
-‘ বোস।’
সাহেলা বেগম চেয়ার টেনে বসলো। তুরান দাঁড়িয়ে রইলো। রুপার মা আবার বললো,
-‘বসছো না কেন? আমি কে তাই ভাবছো? আমি শতরুপা রঙ্গন রায়ের মা। যাকে তুমি রুপা নামে চিনো।’
তুরান তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে দেখছে পূজা রায়কে। সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া ,হাতে সাদা শাঁখা। তুরান অস্ফুট স্বরে বলল শতরুপা রঙ্গন রায়!
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here