#যদি_বলি_ভালোবাসি♥
#PART_10
#FABIYAH_MOMO
–বিয়ে হবে কি হবে না সেটা তো আল্লাহ জানেন রাইট? আমার নাম তোর পাশে থাকবি কিনা সেটাও উনার ভরসায় রেখে দে। ভাগ্যে থাকলে অবশ্যই তোর হবো। না হলে……একটা ব্যাপার মাথায় রাখবি মম, মৃত্যু কখনো বলে কয়ে আসেনা। তাই আমি আজ আছি হয়তো কাল নেই….মরেও যেতে পারি, বাচার এবিলিটি নেই মেবি,
আমি ঝিম মেরে বসে আছি কানে শুধু ‘বেচে থাকার এবিলিটি নেই মেবি’ কথাটা মৌমাছির মতো ভনভন করে বাজছে। উনি ড্রাইভিং হুইলে দুই হাত রেখে মাথা নিচু করে বসে আছেন। এসির নরমাল মুডেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের কনা। আমার মধ্যে সাইক্লোন, টর্নেডোর মতো বিরাট ঘূর্ণিপাক বয়ে চলছে। হৃৎপেশির কার্যকলাপ নাইবা বললাম। শিরশির করে হাতের আঙ্গুল কেপেকেপে শাড়ির আচলে দাপুটে দেখাচ্ছে। থমথমে অবস্থায় আমি শান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকলে উনি মাথা উঠিয়ে সিটবেল্ট খুলে আমার কিছুটা কাছে চলে আসেন। মধ্যবর্তী দূরত্ব দশ ইন্ঞ্চি। আমি এখনো চুপটি মেরে বসে আছি, উনি কাছে এসে কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে দিলেন। সিটে বসে ম্লান কন্ঠে বলে উঠলেন-
–বাইরে চল। গাড়ির ভেতরে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করা যায় না। সরি, কিছু উল্টা পাল্টা কথা বলে তোর মুড খারাপ করে দিয়েছি। এক্সট্রেমলি সরি। বাইরে চল।
উনি গাড়ির দরজা খুলে বাইরে চলে গেলেন। গাড়িতে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। চোখের পাতা বন্ধ করে হালকা এক শ্বাস ছেড়ে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বের হলাম। উনার পাশে যেয়ে দাড়ালে উনি পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে উঠেন-
–কোথায় বসবি? রেস্টুরেন্টে নাকি আউটসাইড?
–যেখানে আপনি নিয়ে যাবেন ওখানেই যাবো।
একটু মুচকি হাসলেন। পকেট থেকে ডানহাতটা বের করে চুল গুলো সামনে থেকে পিছনে নিয়ে নিলেন। ঝরঝরে সুন্দর চুলগুলো হাতের ছোয়া পেয়ে এলোমেলো হয়ে গেলো।দেখতে রোমান্ঞ্চকর!! ‘চল’ বলে আমাকে পিছু পিছু আসতে বললেন। আমিও উনার পিছন পিছন হেটে চলছি। লেকসাইড জায়গা এটা, শান বাধানো উচু টিলা আকারে জায়গাটা উপভোগ্য স্পট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। লেকের ধার ঘেষে অনেক গুলো কাপল বসে আছে। মুগ্ধ ভাইয়া হাটতে হাটতে একটু দূর নিরিবিলি কোনায় নিয়ে গেলেন, সেখানে একজন বুড়ো করে দাদু ঝালমুড়ির আয়োজন বসিয়েছেন। ভেবে অবাক হলাম, উনি বিদেশি কালচারে বড় হয়েছেন, দেশের মাটিতে বহু বছর যাবৎ যোগাযোগ নেই তবুও যেয়ে রোডসাইড খাবারে মন বসালেন। অদ্ভুত!! উনি আমাকে পাশে থাকা একটা বেন্ঞ্চে বসতে বলে, গেলেন স্টল থেকে ঝালমুড়ি আনার জন্য। এখানে কোনো কাস্টমার নেই, খালি। বুড়ো দাদুটা অনেকক্ষন যাবৎ একলা বসে ছিলেন। সম্ভবত এই জেনারেশন তাদের ডেটিং প্রক্রিয়া চালানোর জন্য ফুচকা বা রেস্টুরেন্টের সদর ধরেন। ঝালমুড়ির ঠোঙায় তারা ক্লাস খুজে পাননা। মুগ্ধ ভাইয়াকে দেখেই দাদুটা হাত চালিয়ে মুড়ি বানাতে লেগে পড়লো। বয়সের ভারে আজ দাদু নুইয়ে…একসময় বেশ জমজমাট ছিলেন হয়তো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই ভাইয়া আসলেন দুই ঠোঙা ভর্তি ঝালমুড়ি নিয়ে, একটা আমার হাতে দিয়ে উনি পাশে বসলেন ঘেষে। আমি জিজ্ঞেস করে বসলাম-
–আপনি রেস্টুরেন্টে যেতে পারতেন, এসির নিচে বসে আয়েশ করে চাইনিজ, ইতালিয়ান ফুড খেতে পারতেন….এখানে কেন???
–তোর কি বেশি খারাপ লাগছে? এখানে ঝালমুড়ির স্টলে বসিয়ে খাওয়াচ্ছি বলে অকয়ার্ড ফিল হচ্ছে? খারাপ লাগলে বল, সামনে রেস্টুরেন্টে যেতে পারবো!!!
— আরে না না, খারাপ লাগার কি আছে। আমি নিজেই খুশি হয়েছি আপনি আমার মতো রোডসাইড ফুড খান। কলেজ থেকে ছুটি হলে ডেলি আমি ফুচকা, ভেলপুরি, ঝালমুড়ির আসর বসাই। সেইইই লাগে!!
–একচুয়েলি আমি ট্রিপিক্যালি প্রেমিক না বুঝলি!! রেস্টুরেন্টে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা খাওয়ার মাঝে তৃপ্তি পাইনা একদম। চিন্তা করলাম একটু ভিন্ন ট্রায় করি। দ্যাটস হোয়াই এই অপশন চুজ….মামা ঝালমুড়িটা অসাম বানিয়েছে, পাকনি!!
–ঠিক। দারুন স্বাদ। আচ্ছা বাসা থেকে মিথ্যা বলে বাইরে আনলেন কেন? কিছু জরুরী ব্যাপারে কথা বলবেন?
উনি আমার প্রশ্নে মুড়ি খাওয়া থামিয়ে দিলেন। চোখের পলক ঝাপটানো অফ। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম-
–কি হলো বললেন না যে…মিথ্যা কথা বললেন কেন?
–কিছু না…..তুই খাতো। পরে কথা বলা যাবে।
একঘন্টার মতো বাইরে ছিলাম আমরা। তারপর খাওয়া শেষে উঠে দাড়ালাম। মুগ্ধ ভাইয়া পেমেন্ট করার জন্য মামাকে বললেন-
–মামা আপনার হাতের মুড়িটা কিন্তু চমৎকার!! কতদিন পর পুরোনো ঝালমুড়ির স্বাদ পেলাম। মুখে এখনো লেগে আছে । মামা কত হলো?
মামা ফোকলা দুটো দাতের মাঝে অমায়িক এক হাসি দিলেন। হাসিটা অনেক মায়া লাগানো। বয়োবৃদ্ধ হিসেবে উনার প্রতি মায়া কাজ করছে।চুল দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে, মুখে,শরীরে বয়সের ভাজ। মামা মুখে হাসি টেনে বলে উঠলেন-
— তোমার টাকা দেওয়া লাগবে না, ইয়াং ম্যান!!আসলে আমার কাছে কাস্টমার আসেনা। তোমরা দ্বিতীয় তাই ফ্রি দিলাম।
আমরা একে অন্যের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছি । ঝালমুড়ি দাদু কত সুন্দর শুদ্ধ ভাষায় ইংলিশে কথা বললেন। মুগ্ধ ভাইয়া পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে মামার কাছে কাধ ধরে দাড়ালেন,
–মামা আপনি খুব সুন্দর কথা বলতে পারেন!! আপনি কি এডুকেটেড?
–হ্যা এডুকেটেড। পেশাগত জীবনে টিচার ছিলাম। শেষ বয়সে বেকার হয়ে আছি।(হেসে)…তোমার টাকা দেওয়া লাগবে না।রাখো। তোমার জন্য ফ্রি দিলাম…
–এখন তো ফ্রি নিলে চলবে না মামা….আপনার মতো শিক্ষক এভাবে রাস্তার ধারে মুড়ির স্টল বসিয়ে রোজগার করে জিনিসটা কটু দেখায়। আপনি একজন শিক্ষক হয়ে রাস্তায় কিভাবে মামা?
–লম্বা কাহিনি বাবা। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর রাস্তায় ঠাই করে মুড়ি বেচি এখন। আমার সোনার টুকরা দুইটা ছেলে বিদেশে গিয়ে ভুলে গেছে আমাকে। সহায় খালি ঝালমুড়ির স্টল…
মুগ্ধ ভাইয়া পকেট থেকে একটা একহাজার টাকার নোট বের করে মামার হাতে ধরিয়ে বললেন-
–টাকাটা রাখুন মামা। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
–না বাবা, বিশটাকার মুড়ির জন্য একহাজার টাকা দিও না। আমার আত্মগরিমায় দাগ লাগবে…কষ্ট করে টাকা উর্পাজনে সুখ আছে বাবা। আমি আমার শোকের কথা শুনিয়ে টাকা ইনকাম করতে চাইনা। তুমি বরং বিশ টাকা দাও।
–কথা যদি এটাই হয় তাহলে আমি একহাজার টাকাই দিব। কষ্ট কিন্তু করতে হবে মামা!! শুনুন, রাস্তা বসে থাকা ছোট বড় অভুক্ত মানুষ দের ঝালমুড়ি বানিয়ে পেট ভরিয়ে দিয়েন। মুড়িটা মজাদার, কেউ একবার খেলে বারবার খেতে চাইবে। আপনি টাকাটা রাখুন। আমার পক্ষ থেকে না খাওয়া মানুষদের জন্য ছোটখাট ট্রিট এটা। রাখুন। আর হ্যাঁ…..
বলেই উনি ওয়ালেট থেকে একটা কার্ড বের করে মামার ছেড়া শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে বললেন-
–আমি একজন ডাক্তার, মামা। দোয়া করবেন আমার জন্য। যখন আপনার দরকার হবে কার্ডে থাকা নাম্বারটায় শুধু একটা মিস কল করবেন আমি আমার টিম পাঠিয়ে দিব। আপনার জন্য আমার তরফ থেকে লাইফটাইম ফ্রি চিকিৎসা। ভালো থাকবেন। আসি।
মুগ্ধ ভাইয়ার কাজে বয়স্ক মামা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছেন। কালি জমানো চোখের মনিতে বর্ষার পানির মতো টলমল করছে। মুগ্ধ ভাইয়া মামার পিঠে হাত বুলিয়ে বিদায় জানালেন। আমি উনার হাত ধরে হেটে চলছি আকাশে তাকিয়ে এক বুক ভরা মুগ্ধতার পলকে।
“সম্মান মানুষকে সম্মানিত করলেও, অহংকারী বানায় না সবসময়🍁”
.
.
বাসায় যেয়ে পা রাখলাম কেবল। আম্মু এসে মুগ্ধ ভাইয়াকে খাবার খেতে টেনে নিয়ে গেছে। আমি সদর দরজা লাগিয়ে ড্রয়িং রুমের দরজার পাশে দাড়ালাম। রাফিয়া, আন্টি, রাফিন ভাই, আঙ্কেল, আব্বু, ভাইয়া সবাই সোফায় নিজ নিজ আসন গেড়ে বসেছেন। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া চলছে এখন। মিরাআপু কুনো হয়ে রাফিয়ার পাশে বসে আছে। রাফিয়া আমাকে দেখে উঠে এসে ভেতরে আনলো। আন্টির পাশে বসিয়ে ও আমার ডান পাশে বসলো। আন্টি মাঝে, বামপাশটায় রাফিন ভাই, ডানপাশটায় আমি। আঙ্কেল বলে উঠলেন-
–টুকটুকি, পা ঠিক আছে তো? রাদিফ দেখেছে ভালোমতো?
–জ্বি আঙ্কেল। পা পুরোপুরি ঠিক আছে।
–চিন্তায় ফেলে গেছিলে টুকটুকি। পায়ে আবার ইনফেকশন হলোই কিনা, তাই ভেবে টেনশনে ছিলাম।
–ভাইয়া দেখেছেন আঙ্কেল। সব নরমাল।
একটু পর মুগ্ধ ভাইয়া রুমে ঢুকে আবির ভাইয়ার পাশে যেয়ে বসলেন। সবাই যার যার মতো নানা টপিক তুলেই হাসাহাসি। আন্টি আমার হাত ধরে উনার হাতের ভাজে মিলিয়ে বলে উঠলেন-
–রাফিনের বাবা শুনছো, সব পাকাপাকি করবো? আংটির কাজ করবো কিনা বলো….আমার আর তর সইছে না গো..
আমি চমকে উঠলাম। আংটি? বিয়ের সম্বন্ধে পাকাপাকির কথা চলছে? হাবভাব দেখলে তো সেটাই বোঝা যায়। মুগ্ধ ভাইয়া ফ্যানের নিচে শার্ট চুবিয়ে ঘামছেন। চোখ ফ্লোরের দিকে। আবির ভাইয়া আন্টির কথায় স্থির হয়ে আছেন। ভাইয়া আমার দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন, অর্থ হলো- ‘ওই আন্টি কিসের কথা বলছে?’। আমি ঠোট উল্টিয়ে বুঝিয়ে দিলাম, ‘কি জানি’। আন্টি উনার পার্স থেকে একটা আংটি বের করে উঠে দাড়ালেন। আন্টি স্থান ত্যাগ করায় রাফিন ভাই এবং আমি এক সোফায় বসা দুই যাত্রী হয়ে গেছি। মুগ্ধ ভাইয়া সামনে থাকা টি টেবিল থেকে কাচের গ্লাসে পানি ঢেলে নিলেন। ঢোকের পর ঢোক গিলছেন। আমি মিরা আপুর দিকে তাকালে আপু আহত দৃষ্টিতে খারাপ কিছুর নমুনা দিচ্ছেন। আন্টি রাফিন ভাইয়ের হাতে আংটি দিয়ে বলে উঠলেন-
–রাফিন নে পড়া ওকে। নে…
আমি মুগ্ধ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে জমে গেছি। আন্টি মুগ্ধ ভাইয়াকে বলবেন না? কাকে বললেন? যাকে আমি চিনিই না তাকে বিয়ে….কল্পনা করতেও রূহ কাপছে আমার! আব্বু আম্মু সবাই উল্লাসিত, ভাইয়া চোখ বড় করে হা করে আছেন। মিরা আপু মাথা হেট করে ফ্লোরে তাকিয়ে। আন্টি বলছেন-
–টুকটুকি হাত দেও…..আংটি পড়তে হবে না!!!বাড়ির বউমা বানাতে আর অপেক্ষা করতে চাইনা।।
আমি রাফিন ভাইয়ার দিকে চোখ তুলে তাকালাম। উনি বিয়ে করবেন? লজ্জা নেই? এখন পযর্ন্ত মুখ ফুটে কথা বলতে পারলেন না উনি বিয়ের পযর্ন্ত পানি উঠালেন? হাত বাড়ানোর শক্তি নেই….মূহুর্ত্তের মধ্যে রাফিন ভাই আমার হাত টেনে তরতর করে আংটি পরিয়ে দিলেন। সবাই করতালিতে উচ্ছাস প্রকাশ করছে। আমি জমের মতো মরিচিকা হয়ে আছি।।আঙ্কেল বলে উঠলেন-
–রাদিফের মা, টুকটুকি মম দেখি কথা বলছেন না। হাসির বুলিও নেই….
আম্মু বলে হেসে উঠলেন,
–ভাই মেয়ে আমার সংবাদ পেয়ে চুপচাপ হয়ে গেছে!!…
এরই মধ্যে ‘ঠাসস’ করে কিছু ভাঙার শব্দ হলো! করতালি থামিয়ে সবার নজর আটকালো মুগ্ধ ভাইয়ার দিকে। উনি কাচের গ্লাস হাতের মুষ্ঠি চেপে ভেঙে ফেলেছেন…হাত গড়িয়ে রক্ত । কাচের গ্লাস ভেঙ্গে ফ্লোরে ছিটকে গেছে, লাল রক্তের ফোটা ছিটকে সাদা টাইলস ভরে যাচ্ছে। সবাই ভ্রূ যুগল কুচকে মুগ্ধ ভাইয়ার হাত কাটার দিকে তাকালে, উনি তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসির সুরে বলে উঠলেন-
–ইশশ…খুশির ঠেলায় গ্লাস ভেঙ্গে ফেলেছি!!! সরি সরি এভ্রিবডি!!ঠেলাঠেলির ধাক্কায় কি কান্ডই না করে ফেললাম!!!….সরি সরি…
উনি দ্রুত উঠে দাড়িয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলেন। পাশ থেকে ভাইয়া উঠে মুগ্ধ ভাইয়ার পিছনে চলে গেলেন। মিরা আপু পরিস্থিতি সামলাতে বলে উঠলেন-
–কাকি তুমি মিস্টি আনো তো…খুশির মেজাজে মুগ্ধ ভাইয়া উতলা হয়ে গেছে…ছেলেদের অবস্থা তো জানোই।।
আপুর কথায় সবার প্রশ্নবোধক অবস্থা কিছুটা তাল মেলে ক্ষান্ত হলো। আম্মু মিষ্টি আনতে চলে গেলেন। এদিকে রাফিন ভাইয়া আব্বু, আঙ্কেলের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।।। আমি তোয়াক্কা না করে উঠে চলে গেলাম আমার রুমে।
সমস্ত শরীরের ভর ছেড়ে বিছানায় হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছি। চোখ কান্নায় ঝাপসা। মুগ্ধ ভাইয়া ধোকা দিলেন…আরো একবার কথা গোপন করে দূরে যাওয়ার প্রস্তুতিপর্ব করলেন। বাহহ…বেশ তো..আব্বু আম্মু একটা বারো আমার মত নেওয়ার ইচ্ছা পোষন করলেন না। আর আমি দিন দুপুরে মনের কোনে স্বপ্ন বুনে চলছি মুগ্ধ ভাইকে বিয়ে করার!!বাহহ…মুগ্ধ ভাইয়ার টার্নিং পয়েন্টটা দেখার মতো!! কাদা উচিত? আচ্ছা কিভাবে কাদব? হাওমাও করে? চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে? হায়রে…কাদার কথা বলে চোখ ভরে ভরে পানি ফেলছি…অশ্রু চোখে ফুপিয়ে চলছি আবার নিজেকে জিজ্ঞেস করছি কিভাবে কাদব ….
দরজা ধাক্কাচ্ছেন আম্মু। বাইরে বের হচ্ছি না। কি হলো আমার।
–মম দরজা লাগিয়ে বসে আছিস কেন? বের হ…তোর আঙ্কেল আন্টিরা চলে যাচ্ছে। বিদায় দিয়ে যা..বের হ।
নাক টেনে চোখ মুছে বলে উঠলাম-
–আম্মু….শাড়ির কুচি নষ্ট হয়ে গেছে। আমি আসতে পারবো না। যাও তুমি…প্লিজ।
আম্মু চলে গেল। কিন্তু আমি বেতাল ভাবে বসে আছি…. কান্না করে চলছি। শাড়ি চেন্জ করে কামিজ পড়বো আমার সেই হুশ জ্ঞান মোটেও নেই। নাক ফুলে শ্বাস নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছি। চোখের পাতা ফুলে ভার হয়ে গেছে…চোখের জলস্রোত তবুও ফেলছি। ঝাপসা চোখের অশ্রুধারায় মুগ্ধের সাথে খেয়ালিপনার মূহুর্তসব স্মরন করছি। প্রথমদিন দুমড়ে এসে আজ দুমুখো হয়ে গেছেন উনি। আংটি পড়ানোর সময় হাত কাটলেন কেন? ঢঙ করেছেন ?….. নাটকীয় ঢঙ ছিলো তাহলে?আম্মু আব্বু মনের কথাগুলো বুঝলেন না কেন? তিল থেকে তাল বুঝে সপে দিচ্ছেন ভুলজনের কাছে? হঠাৎ আমার জানালা দিয়ে কেউ লাফিয়ে ঢুকলো। বিস্ময়কর ব্যাপার লাগেনি…কারন, জানালা দিয়ে ভাইয়ু আর মুগ্ধ ভাইয়া ছাড়া আর কেউ ঢুকেন না। আমি আগের মতোই বিছানায় হেলে ফ্লোরে বসে আছি। চোখ বন্ধ। সে আমার কাছে এসে ফ্লোরে বসলো-
–হেই মম, হোয়াটস অ্যাপ? আর ইউ ওকে? প্লিজ লুক এট মি…..
অন্য কোনো পুরুষের কন্ঠ পেয়ে আমি মাথা উঠিয়ে চোখ মুছে তাকাই। এক ঝটকায় কয়েক কদম পিছিয়ে বসি। রাফিন ভাই বসে আছেন। আমি বিছানা ধরে উঠে দাড়িয়ে ঝাঝালো গলায় জিজ্ঞেস করলাম-
–আপনি এখানে কেন! সাহস কি করে হলো আমার রুমে আসার!জানালা দিয়ে আসলেন কোন সাহসে!!
উনি উঠে দাড়িয়ে জানালার ওখানে হাতভাজ করে দাড়ালেন।
–কেন কেন….তোর রুমে আসার অধিকার স্রেফ মুগ্ধের? আমার না?আমি তোর হবু বর কিউটু…একটু আগে আংটি পড়ানো হয়েছে।। ভুলে গেলে চলবে???
–আপনি সীমানা অতিক্রম করবেন না! চলে যান এখান থেকে! আপনি আমার কি হওয়ার যোগ্য আর কি হওয়ার যোগ্য না…সময় বলে দিবে! চলে যান!
–একটা কথা বলতো দেখি…মুগ্ধ তোর উপর কিসের জাদু করেছে…তুই দেখি মুগ্ধ বলতেই পাগল!!
–তুই যে একটা লুইচ্চা হারামি জিনিসটা প্রত্যক্ষ চোখে দেখলাম! মিরা আপু কেন বলছিলো বুঝতেছি! দেখ, তোকে আমি সাবধান করতেছি তুই আমার কাছ একশো হাত দূরে থাক! নাহলে স্যান্ডেলের বারি একটাও মাটিতে পড়বো না!এমন উত্তম ধোলাই দিবো বাপের জন্মেও ভুলবিনা!চলে যা!
–‘আপনি’ থেকে ‘তুই’ !!! গুড জব কিউটি!! তোর মুখ থেকে তুই ডাকটা উফফফফ মধুর মতো লাগে। প্লিজ !!!তুই করেই ডাক..
–তোর মতো শয়তানের সাথে চাপাবাজি করতেও আমার মুখ ঘেন্না করে, বুঝছিস! ঘেন্না করে!
–মুখে মুখ লাগালে ঠিক হয়ে যাবে মম। এক সপ্তাহের ভেতরে বিয়ে করে আমার বউ বানিয়ে তুলছি…এরপর তোকে ছাড়ছিনা…উমমম..
-তুই মুগ্ধ ভাইয়াকে কি বলে বশ করছিস জানি না। তুই সিউর থাক আমি মরলেও তোর বউ হবো না! তোকে আমিও চিনিয়ে ছাড়বো আমি মম কি জিনিস! (তুড়ি বাজিয়ে) তুই চোখ কান খোলা রাখিস, দেখিস আমি তোরই নাকের তল দিয়ে কিভাবে মুগ্ধকে বিয়ে করে দেখাই! খালিহাতে ঢোল পিটাতে রেডি থাকিস তুই!
রাফিন হোহো করে লুটোপুটি খেয়ে হাসছে। ওর হাসির শব্দ আমার গা পিত্তি ধপধপ শিখায় জ্বলে উঠছে! হাসি থামিয়ে বলে উঠলো-
–তোর আব্বু আম্মু মানলে তো পারবি…আন্টি ছোটবেলা তোর সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য ওয়াদা করেছে পাগলি!! আন্টি আমার হাতে তোকে তুলে না দিয়ে মুগ্ধের হাতে তুলে দিবে! হাহা হাসালি…ও হ্যা…মুগ্ধের বিয়েও ঠিক হয়ে আছে। আমাদের ফুপির মেয়ে রুপার সাথে। মেয়েটা ভারি মিষ্টি!!মুগ্ধের বউ বানিয়ে ভাবি হিসেবে ঝাক্কাশ লাগবে…..
রাফিনের মুখ থেকে মুগ্ধ ভাইয়ার বিয়ের কথা শুনে নিঃস্তদ্ধ হয়ে আছি…এই দিকে দুই প্রান্তে দুই তরী ডুবানো? আজ কি মুগ্ধ ভাই উনার বিয়ের কথা বলতে চেয়েছিলেন? এ কারনে কি মিথ্যা বলে বাসা থেকে বের করেন? করবোটা কি আমি!! উনি উনার বিয়ের কথা জানাতে গিয়ে জানাতে পারলেন না !!আর এইখানে আমার সাথে রাফিনের বিয়ে পাকাপাকি!! সহসা আমার মাথা কাজ করছে না….পুরোপুরি হ্যাং মেরে ঘাপলা চুকিয়ে আছে। আমি ভাবনার দুনিয়ায় ডুবে থাকলে রাফিন বলে উঠে-
–তোকে একমাত্র আমি বিয়ে করবো! অন্যকারোর চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দে।মুগ্ধের চেয়ে অনেক বেশি সুখে রাখবো, কোনোকিছুতে কমতি রাখবো না। তুই শুধু বিয়ের পিড়িতে বসার জন্য তৈরী হয়ে নে।
রাফিন জানালা ধরে আগের মতো চলে গেল। কিসের হুশিয়ারি দিলো… মাথা থেকে মুগ্ধের চিন্তা বের করা? অসম্ভব! অসম্ভবের চেয়েও বিরাট অসম্ভব!আমি জীবিত থাকতে এটা কক্ষনো সম্ভব না! চোখের পানি মুছে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে লাগলাম। আমি একটা মেয়ে। মেয়েদের সহ্য-ধৈর্য্য সব থেকে বেশি। আশা-স্বপ্ন-কল্প-ইচ্ছা হয়তো বেশি বা কম। ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে আর মতের বিপরীতে ভালোবাসা আমি মেয়ে বলে সহ্য করবো না। এক চিলতে শস্য পরিমানও না! যেটা আমার..ওটা জাস্ট আমার! আমার ওটা!
.
.
শাড়ি পাল্টে দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে আছি। থেমে থেমে কান্না করছি। একটু আগে আম্মুকে যেয়ে পুরোটা বিষয় জানালাম। উনি ডান গালে চড় মেরে চুপচাপ বিয়ের মন মানসিকতায় উপস্থিত থাকতে বলেছেন। আমি ছোট থাকতে আম্মুর সবচেয়ে কাছের বান্ধুবী রাবেয়া আন্টি উনার বড় ছেলের জন্য হাত চেয়েছিলেন। আম্মু-আব্বু সেই ওয়াদার সুবাদে রাবেয়া আন্টির কথা পালন করছেন।আমি যে রাফিন কে না মুগ্ধ ভাইয়াকে চাই, আম্মু কথাটা কানে নিতেই চড় উপহার দিলেন। আব্বু চোখ রাঙিয়ে দৃষ্টিগোচরে প্রস্থান করলেন। আবির ভাইয়া মন খারাপ করে আছেন। আমার মতকে প্রধান্য দেওয়ার কেউ নেই। আব্বু আম্মু মুখ তিক্ত করে নিয়েছেন। আর ভাইয়া তো চাচাতো বোনকে বিয়ের কথা বলবেন। কোন মুখে বলবেন তা নিয়ে ভাইয়া ভীষণ চিন্তিত।।
বালিশ ভিজে গেছে। নাক বন্ধ হয়ে একাকার অবস্থা…শ্বাস নিতেও মুখ হা করে নিতে হচ্ছে। চোখের পাতা কান্নার ব্যকুলে ব্যাথা হয়ে আছে। হঠাৎ জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন মুগ্ধ ভাইয়া। আমি উনার পদতলের শব্দ শুনে চিনে গেছি উনি এসেছেন। চোখ খুলে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালাম। মুগ্ধ ভাইয়া বলে উঠলেন-
–সরি এভাবে এসে তোর টাইম নস্ট করার জন্য। আমি আর সামনে আসবো না মম। দূরে দূরে থাকব। কাছে আসলে মন আটকে যাবে। ভুলতে কষ্ট…..(থেমে গেলেন)
আমি গলার ওড়না দিয়ে চোখগুলো ভালোভাবে মুছে নিলাম। একটু কেশে গলা ঠিক করে উনার দিকে তাকালাম। হাতটা ব্যান্ডেজ করা। গায়ে নীল টিশার্ট, ধূসরবর্ণের ট্রাউজার। আমার সিক্ত গালটা মুছে উনার সামনে যেয়ে আস্তে করে বলে উঠলাম-
–শুনলাম ফুপাতো বোনকে বিয়ে করবেন।যাক ভালোই। সুখে থাকবেন বলে আশীর্বাদ করতে পারলাম না। আমাকে কষ্ট দিয়ে নিজে সুখে থাকবেন…এই দোয়া করা পসিবল না । মাফ করবেন।
উনি একটু স্মিত হাসলেন। ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন-
–তুই আর সোজা হলি না পাকনি!! ত্যাড়া ত্যাড়া কথা আছেই!! রাফিন ভাই তোকে ভালো রাখবে মম পাকনি। তোকে খুব সুখে শান্তিতে রাখবে।
–আর আপনি?
–আমি আর কি…আমি একটা ফালতু ছেলে….এমন ছেলের কপালে আল্লাহ সুখ যেন না দেয় প্লিজ!! আমার ভাগ্যে সুখ ভান্ডারে যতটুকু সুখ পাওনা তার চেয়ে বেশি সুখ তোর ভাগ্যে যেনো চলে যায়। আমার বেয়াদবি সব ভুলে তুই রাফিন ভাইয়ের সাথে নতুনভাবে শুরু কর… আমার আর কিচ্ছু চাইনা। রাফিন ভাই হাজারগুনে ভালো……
ঠাসস করে এক চড় উনার গালে বসিয়ে দিলাম। রাগে নিজেকে সামলানো দায় হয়ে দাড়িয়েছে! উনি ওই নষ্টা ছেলের সাথে নিজের তুলনা করছেন! কার সাথে কিসের তুল্য?
উনি গাল ধরে দাড়িয়ে আছেন। চুপচাপ ক্লান্ত দৃষ্টিতে। আমি কলার টেনে ঝুকিয়ে ধরলে উনি কিছু বলতে যান,
— ‘সরি আমি…’
ঠাসস করে ননস্টপ দুই গালে দুইটা চড় বসিয়ে দিলাম। পুনরায় কলার টেনে বলে উঠলাম-
–ফুপাতো বোনকে লাভ করেন? ভালোবাসেন? চুপ করে থাকলে আরো চারটা চড় বসাবো! তাড়াতাড়ি বলুন!
উনি আমার হাতে চড় খেয়ে তোতলানো সুরে বলে উঠলেন-
–ওই মেয়েককে আমমি ওমমন ননজরে দেদেখিনা…পাককনি…
-চলবে
-Fabiyah_Momo