#যদি_বলি_ভালোবাসি♥
#PART_22
#FABIYAH_MOMO🍁
পায়ের ইনজেকশনে ডোজ ছিলো প্রচুর, আমার ঘুম ঠেলে উঠতে দেরি হলো বেশ। ঘড়িতে সাড়ে এগোরটা, উনি সবকিছু গুছিয়ে বিছানার পাশে লাগেজ, ব্যাগ রেডি করছেন। সবটা উনার জিনিসপত্রে গাদাগাদি, আমার সাথে কিছুই ছিলো না, শুধু রাফিয়ার ও মুগ্ধের আনা সর্বমোট চারটা জামা ছাড়া। উনি বইয়ের গাট্টি বেধেছেন, বুক শেল্ফের আশি শতাংশ জায়গা খালি পড়ে আছে। আমি চোখ কচলিয়ে উঠে বসতেই বলে উঠলেন,
–মুখটা ধুয়ে নে মম পাকনি। আমি সব গুছিয়ে ফেলেছি। একচুয়েলি, প্লিজ কুইক! আমি চলে যেতে চাই এখান থেকে। প্লিজ তাড়াতাড়ি করলে বেটার হবে, পাকনি… গেট আপ!!
হাসি দিলেন একটা হৃদয় কাপানো। অসম্ভব রকমের সুন্দর হাসি। হাসিটা দিয়ে যখন মাথা ডানেবামে করেন….মারাত্মক!!অপলক হয়ে যাই আমি। ভয় হয় বুঝলেন!! সুন্দর ছেলেকে বর বানাতে খাপছাড়া হতে হয়!! গালে হাত দিয়ে ভাবলেশ ভাবে উনার দিকে তাকিয়ে আছি….কালো জ্যাকেটের ভেতরে কালো টিশার্ট, কালো জিন্স, জ্যাকেটের হাতা কবজি থেকে কয়েক ইন্ঞ্চি উপরে ফোল্ড করা, লেফট হ্যান্ডে ওয়াচ। চুলের স্ট্রেট নরম স্টাইল। ব্যস!! রাদিফ মুগ্ধ হোল কিলার ফর্ম!! ফ্লোরে একটা হাটু লাগিয়ে লাগেজের চেইন টেনে দিচ্ছেন। এরই মধ্যে উপসর্গ ঘটলো রূপার রূপত্তি! রুমে নক না করেই ভেতরে ঢুকলো ও, উনার লাগেজ লাগানো হাটু গেড়ে বসার পাশে নিজেও বসে নিলো রূপা। মুগ্ধ চেইন লাগানো বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। রূপা মুগ্ধের দিকে কেমন দৃষ্টিকোণে তাকিয়ে থাকতে পারে বুঝে নিয়েন। চেইন লাগানো হুকটা ধরে মুগ্ধ থমকে আছেন, রূপা উনার হাতের উপর হাত রাখলো।
–তুমি চলে যাচ্ছো মুগ্ধ? কার জন্য চলে যাচ্ছো? মমর জন্য? আমার কি হবে, তোমাকে না দেখলে? কাকে দেখে চোখের শান্তি জোগাবো? তোমার মতো কি কেউ আছে মুগ্ধ?প্লিজ যেও না….
স্থির বস্তুর ন্যায় চোখের পলক থামিয়ে রেখেছেন মুগ্ধ। উনি লাগেজের চেইনে পলক আটকে বলে উঠলেন-
–হাত সরা রূপা,
রূপা উনার সুঠাম দেহের বাহুতে এনে হাত রাখলো আরেকটা। আমি জানি না এখন কি হবে উনাদের মাঝে, মুগ্ধের রাগ উঠবে? নাকি নম্রতা ব্যবহার? রূপা ন্যাকামো করে ঢঙি মেয়েদের মতো নাকে সুর তুলে বলে উঠলো-
–তোমাকে একটিবার না দেখলে কেমন ব্যথা হয় জানো মুগ্ধ? তুমি আমার বুকে না ঘুমিয়ে মমকে বুকে নিয়ে ঘুমাও, কত কষ্ট হয়??? আমায় কেন বুঝেও বুঝো না মুগ্ধ? কি দোষের আরোপী আমায় ঠেকালে রাদিফ আবরার মুগ্ধ বলো প্লিজ?? ছেড়ে যেও না, আমরা কেউ তোমায় ছাড়া থাকতে পারবো না….পাগল হয়ে যাব মুগ্ধ, পাগলের ঠিকানায় চলে যাব…
রাগে শরীরে তুখোড় জিদ উঠছে! পায়ের ব্যান্ডেজ না থাকলে এক লাত্থি মেরে বাড়ি থেকে বিদায় করতাম। মুগ্ধ ঘটনার বিস্ফোরণ ঘটানো সাবলীলভাবে, “ঠাসস” করে ঠোট কুচকে এক চড় মেরে দিলেন রূপার ধবল গালের ডানদিকে। গাল ধরে মুগ্ধের হাত থেকে হাত সরালো রূপা, ওষ্ঠধর দুটো হা করে কাদো কাদো হয়ে গেল পুরা।
–তুমি আমায় মারলে মুগ্ধ? তুমি আমায় মারতে পারলে? আমায় স্ল্যাপ কেন দিলে???
আমি হাতের উল্টো পিঠে তালি মেরে দিতাম এক সাক্ষাৎ নাচুনি!! তোর মুখে স্ল্যাপ না ! ছ্যাপ মারা উচিত ছ্যাপ! খাচ্চর বেহায়া প্রস্টিটিউট মেয়ে!
মুগ্ধ গাম্ভীর্য ভয়ঙ্কর ভাবমূর্তি আকার ধারন করলে রূপার অবস্থা একদম নেকড়ে শেয়ালের লেজ কাটা আহতের মতো কুকড়ানো হয়ে যায়। উনি রাগ দেখান না। কিন্তু যখন রাগ দেখান….বায় গড! আমিও কিছু না।
–ডোন্ট ইউ ডেয়ার, রূপা! ডোন্ট ইউ ডেয়ার! আমাকে টাচ করার আগে অসীমবার ভাববি! যে হাতে টাচ করবি হাতের চামড়া তুলে ফেলবো ! আমার সামনে আমার বউকে নিয়ে একটা সাউন্ড করবি গলার ভোকাল কর্ড চুরমার, ওকে বেব! নাও গেট লস্ট !
রূপা মুগ্ধের ধমকানি শুনে শর্ট লেন্থের হাতাকাটা জামায় উঠে দৌড়ে পালিয়ে গেল। উনি খুব ভয়ংকর ভাবে ফুসতে ফুসতে শ্বাস ছাড়ছেন, আমি ছোট থাকতে দেখেছিলাম একবার, কোনো এক ঝগড়ার জেরে পাশের এলাকার রিফাত চামারের সাথে এমন রাগে হাতাহাতি করতে। উনার রাগী মুখের দৃশ্যবিবরণী আমার দিতেই গলা কাপছে!! আমারই ভয় করছে দেখে, কপালের ভাজে কয়েকটা রগের ফুলে উঠা, লালে রক্তিম চেহারা, নাক ফুলানো রাগের বিবৃতি!! ঢোক গিললাম তিন-চারটা উনার দিকে তাকিয়ে, উনি লাগেজে একটা হাতুড়ি মারার মতো ঘুষি মারলেন। আমি ব্রজপাতের ঠাডা পরার ক্লিষ্টের মতো চমকানি দিয়ে উঠলাম। করলেন কি? রেগে পুরো অগ্নিকুণ্ড। ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে তুললে যেরূপ হিংস্রতার গর্জন করে, মুগ্ধ এখন রাগের মাথায় ফুসফুস হুংকার করছেন। আমি তোতলামি সুরে কাপা গলায় বলে উঠলাম,
–আপপনি ররাগগগ কককরে আআছছেন ককেনন মমুগ্ধ… ?ভভয় ককরছে প্লিপ্লিজ শশান্ত হহন…রূরূপা ততো চচলে গগেছে…
উনি চোখ ঘুরালেন অবিলম্বে, ধকল দিয়ে উঠছে শরীরে, উনার রাগ চরমসীমায় চৌচির করছে…আমি গলা ভিজিয়ে জিজ্ঞাসু সুরে কিছুই বলতে পারছিনা। রূপার কথায় উনি চেচিয়ে রাগী অগ্নিআচরন করবেন ভাবতে পারিনি।। উনি রাগী গলায় বলে উঠলেন,
–গেট রেডি ! আমি রূপার ম্যাটারে নট এ্যা সিঙ্গেল ওয়ার্ড কনট্রোভার্সি করতে চাইনা! তোর জন্য ভালো এটাই হবে তুই এসব থেকে দূরে থাক! গেট রেডি ইন দ্যা পাচ মিনিটস! কুইক!
মাথায় উনার রাগীরাগী ফর্ম দেখে বুদ্ধি খেলে আসলো, একটু কাছে যাওয়া যাক!! গালটা টেনে চুলগুলা এলোমেলো করে গালে একটা চুমু বসিয়ে বারোটা টু তেরোটা বাজানো যাক!! যা টেস্ট লাগবেনা উফ! মুখে ব্যাথার বলিভাব টেনে পা ধরে বলে উঠলাম,
–মুগ্ধ?? খুব ব্যথা করছে আমার…আহ্!! আমার না পায়ে অনেক ব্যথা করছে। আল্লাহ মাফ করো!! আপনাকে রূপার সাথে দেখলে বুকের সাথে পায়েরও ব্যথা চাড়া মেরে উঠে কি বলবো!! একটু কোলে নিবেন প্লিজ?
আমার মিথ্যা ভাবের আকিবুকি উনি দেখি বুঝেই গেল। আমি তাও মিথ্যার উপর সত্যের চাদর বিছিয়ে সত্যের ছিটেফোঁটা ছিটকে বললাম,
–না মানে…মানে মুগ্ধ…শুনুন না…আমার পায়ে ব্যান্ডেজ, ওয়াশরুমে যেতে পারবো না!! একটু হেল্প করতেন যদি…..
মুগ্ধ চোখগুলো ছোট করে তীক্ষ্ম তীরের দৃষ্টিতে তাকালেন।
–ওহ রিয়েলি!! কাছে আসতে ইচ্ছে করছে এটা না বলে কি বললি! স্টুপিড কোথাকার! জিলাপির প্যাঁচ না বানিয়ে কথা না পেচিয়ে,ঠিক করে বললে আমি আসতাম না??তুই আর মানুষ হলি না, ড্যাম!!
–আপনি অনেক কিউট মুগ্ধ!! মনিরার ভাষায় মারাত্মক হ্যান্ডসাম!! ইতির ক্রাশ ফ্যাক্টরি হিসেবে কিউটের ডিব্বা!! আর আমার স্টাইলে “মমমুগ্ধকর” চলবে?????
গম্ভীর ভাবেভোলা মুখের দর্শনী রেখে ফিক করে হেসে দিলেন উনি। গালের ছোট গর্ত হিসেবে ঝকঝকে দাতের হাসি, লালচে ঠোটের মুচকি প্রসারণে মনোমুগ্ধকর উনি!! আপনি প্রাণঘাতী রাদিফ মুগ্ধ!! আই হেভ টু টেক কেয়ার!! অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আপনাকে ট্যাকল করতে হবে!!
আমি পায়ে হেটে গাড়িতে উঠতে পারলেও উনি আমাকে ধরে রাখলেন। সব লাগেজ, ব্যাগ গাড়িতে উঠানো শেষ, আমি একবার বিদায় দেওয়ার জন্য আন্টির রুমে গেলাম। উনিও ধরে ধরে নিয়ে গেলেন, যেন স্লিপ কেটে পড়ে না যাই।। ওখানে বড়ফুপি, রূপা, আন্টি, রাফিন বসে গোল মিটিং বসিয়েছে। মুগ্ধ আমাকে ধরে আন্টির দরজায় নক করতেই সবার কানাঘুসো সাময়িক স্থগিত হলো, আর্কষন ঘটলো আমাদের দিকে। রূপা এতক্ষন ফুপির কোলে মাথা দিয়ে কান্না করছিলো, ও চোখ মুছে উঠে বসলো। আন্টি মুখ খুলে কিছু বলবে ফুপি কথা ছিনিয়ে বলে উঠলেন,
–আমার মানিক বাবারে চলে যাচ্ছিস…..যা বাবা…অনেক তো বোঝালাম…আর কত বোঝাবো? অতো বড় ছোকরা ছেলে বউয়ের ইশারায় উঠবস করবে, প্রাচীন থেকেই প্রথা চলছে। থাক বাবা, কথা না বাড়াই….ভালো থাকো,
–ফুপি দুইদিন তো বাসায় ছিলাম। বাড়ির ছোট ছেলের বউ হিসেবে মমকে যেভাবে আপ্যয়ন করলে আমার হাতে উপায় ছিলো না, দূরে চলে যাওয়া ছাড়া। আসি। আসসালামুয়ালাইকুম।
আন্টির ঠোটের চিলতে কোনায় অনেক কিছুই বলার ছিলো, কিন্তু ফুপির মগজ ঢোলাইয়ে আন্টি সত্য-মিথ্যার তফাত বুঝতে পারলেন না। নিজের ছোট ছেলেকে একটা বার কান টেনে বললেন না, “যাস না বাবা, আমার তোর বিয়ে নিয়ে কোনো আপত্তি নেই, বিয়ে তো হয়েই গেছে, কার এখন নাকোচ করার সন্ধিৎসা আছে??”। আল্লাহ হয়তো এ দিনটা দেখালেন না, আমরা চলে আসি। গাড়িতে উনি বসিয়ে দিয়ে নিজে যখন ড্রাইভিং সিটে বসলেন রাফিন এসে দাড়ালো। উনার জ্যাকেটের কলার ধরে বলে উঠলো,
–কিরে রাদিফ সহজেই চলে যাবি? বাসার এড্রেস তো দিয়ে যা, তোর বউয়ের হাতের রান্না খাওয়ার সুযোগ তো দিতেই পারোস, না রে??
মুগ্ধ কি বলবেন? নতুন বাসার ঠিকানা দিয়ে দিবেন? প্লিজ মুগ্ধ প্লিজ!! আপনি ভুলেও রাফিনকে বাসার ঠিকানা বলবেন না, আমি আর আমিতে থাকবো না।। আমি গাড়িতে সিটবেল্ট বেধে বসে আছি, উনাকে কোনো ভাবে “না” বলার ইঙ্গিতবাহী বোঝাতে পারছিনা। উনি হাসি দিয়ে বললেন,
–তাড়া কিসের ব্রো? আগে আমরা উঠি। বউটাকে স্পেস দেই, সুস্থ করি, তারপর মাথায় থট আনবো এড্রেস মেইল করবো কিনা!! সো চিল!!
উনি গাড়ির দরজা খুলে বসে পড়লেন পাশে। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চোখ টিপ মেরে ইশারা করলেন, “লেটস গো বউ”। গাড়ির স্টার্ট প্যাডেলে একটান দিয়ে যাত্রী বানালেন, নতুন নতুন সাজানো গোছানো আমাদের বাসার দিকে।
নতুন বাসার ফ্ল্যাটের বাইরে উনি আমার পিছন দাড়িয়ে গলায় হাত জড়িয়ে ধরে আছেন। “হাবিবা টাওয়ার”, আটতলা ফ্লোর, রুম নাম্বার ৮০৩। পুরো টাওয়ারটা আসলে বারোতলা, উনি আটতলার একটা ফ্ল্যাট আমাদের জন্য কিনেছেন। মুগ্ধ আমার মাথায় উনার থুতনি রেখে বলে উঠলেন,
–রাইট সাইডের জিন্সের পকেটে চাবি আছে মম পাকনি। দরজাটা খুলে নাও প্লিজ।
–আপনি আমাকে ছাড়বেন! পাব্লিক প্লেস মুগ্ধ! কেউ ফ্ল্যাট থেকে বাইরে বেরিয়ে আপনার অবস্থা দেখলে কেমন লজ্জায় পড়বো জানেন?
–দেখলে দেখুক। আমি বউ ধরে দাড়িয়ে আছি, তাদের কি? তুই বকবক না করে দরজা খুল।
–আমি আপনাকে নিয়ে কই যাবো!! ছাড়ুন না প্লিজ, আমার গলায় শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে, পিছন থেকে সরে সামনে এসে দাড়ান।
–এই বেশি কথা বলতে না করেছি! পকেটে হাত ঢুকা, চাবি নিয়ে দরজা খোল!
–আপনি আমার মাথা থেকে থুতনি উঠান, গলায় এমনেই ধরে রাখছেন, এখন কেউ বেরিয়ে পড়লে আমাদের দেখে হাসবে!!
–লিপস্টিক থেরাপি দিবো?
–আল্লাহ ! মাবুদ ! না !! আমি দরজা খুলছি !! এইযে খুলছি!!পকেট কই, পকেটে কোথায় মরলো!! কোনটা রাইট পকেট!! দাড়ান দাড়ান, কিচ্ছু করবেন না প্লিজ!!
উনার আবিষ্কৃত “লিপস্টিক থেরাপি” আমি এখনো পায়নি!! শুধু একদিন উনি থেরাপির ডোজ হিসেবে যে ভয় দেখাইছেন, আমি দশবার কানে ধরে উঠাবসা করছি। ব্যাখ্যা দিতেছি!! শুনেন আপনারাও- লিপস্টিক আমি জীবনেও ওইদিন ইউজ করিনি, ওইদিন মানে প্রথম যেদিন উনার হসপিটালে গেলাম, উনার কেবিনে ছিলাম তখন। বিকেলে আমি নাস্তা নিয়ে ঘাড়ত্যাড়ামি দেখালে উনি মুখনিঃসৃত যে বুলি শুনান!!! তওবা তওবা!! বীভৎস কথা মনে উঠলে আমি নাই ভাই!! টা টা বায় বায় !! লিপস্টিক শব্দের শেষের দুই অক্ষর চাক্কু দিয়ে কেটে দেন তাহলেই বুঝবেন!! কি বুঝছেন?? বুঝলে বুইঝেন ডাক্তার সাহেব রোমান্সের দিক দিয়ে তেজপাতা না!! লাল, নীল সতেজ পাতা উনি!! আবার নামও দিছে “থেরাপি” ! ডাঃ রাদিফ মুগ্ধের ইনভেনশন করা “LIPSTICK THERAPY” ! আর ব্যাখ্যা না দেই!! দিলে…..(শেষ)
ভেতরে ঢুকে আমাদের ফ্ল্যাটে টাস্কি খেয়ে দাড়িয়ে আছি, উনার পছন্দসই বাসার ইনটেরিয়র ডিজাইন দেখেি। কতো রুচিশীল উনি!! প্রতি রুমের কোনায় কোনায় গাছের টব বসানো, দেয়ালে বিভিন্ন আর্টিস্টের গ্রামীন দৃশ্যের ছবি টাঙানো, ড্রয়িং রুমে খুব লম্বা প্রশ্বস্ত জানালা, বামদিকে সোফা সাজানো, ডানদিকে ফ্লোর বেড বিছানো, জানালা দিয়ে দখিনার শো শো ঠান্ডা করা বাতাস আসছে, গাঢ় নীল ও কালোর মিশ্রনে পর্দা ঝুলানো। উনি লাগেজ সব ভেতরে ঢুকিয়ে আমার কাধে উনার জ্যাকেটটা খুলে রাখলেন। মাথায় ঠোট ছুয়িয়ে বললেন,
–আমাদের “বিলাসমহল”!! কেমন হয়েছে?রাতে যখন মন খারাপ থাকবে জানালার কাছে ফ্লোরে পাতানো বিছানায় শুয়ে অন্ধকার বিলাস করবো!! আমার না অন্ধকার ভালো লাগে, সাথে আকাশের চাদঁ, ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া। বুকে থাকবি তুই!! তোকে নিয়ে এই জায়গাটায় ঘুমাবো!!
–আপনি এগুলো একদিনের মধ্যে করেছেন? একা?
–পরে কথা, আগে খাওয়া। আচ্ছা দেখি তো পায়ে একটু ভালোভাবে হেটে দেখা। আবার ইনফেকশন করলো নাকি!!
–এখন ঠিকআছি মুগ্ধ। আপনি জবাব দিননা !!
–একটুখানি প্রয়াস করলাম পাকনি। প্রমিস করেছিলাম নিজের সবটুকু দিয়ে দুনিয়া সাজাবো!! তোকে নিয়ে আলাদা থাকব!!তারই প্রতিফলন দেখে নে এখন!! চল, খাবি।
.
.
বিকেল পাচটা, আমাদের বেডরুমে বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছি। উনি হসপিটালে পেশেন্টের ক্রিটিক্যালি দেখথে জরুরি ভিত্তিতে গিয়েছেন। একা একা দিন কাটাতে ভালো লাগেনা, কেমন মনগড়া চিন্তা ভাবনা আসে। আবির ভাইকে একটা কল করলাম বহুদিন পর,
–হ্যা ভাইয়া কি অবস্থা? কেমন আছো?
–কি জানি কেমন আছি, কেমনে থাকতাছি জানিনা, তোকে দেখতে ইচ্ছা করতেছে সিনু।
–ভাইয়ু ভিডিও কল দেই? আমিও অনেক মিস করতেছি ভাই!!
–ভিডিও কল দিলেও সামনে দেখে ফাজলামি করার মতো হবে না সিনু। তুই বল, মুগ্ধ কোথায়? শালা আমারে মনের ভুলেও একটা কল দেয়না।
–হায়রে ভাই, তুমি “শালা” বলা বাদ দিলা না!! উনি ব্যস্ত ভাইয়া। সারাদিন হাসপাতালের কাজ নিয়ে রোগী দেখার উপরেই থাকে।ভাইয়া….
–কিরে থামলি কেন? কিছু বলবি? বল!!
–ভাইয়া আব্বু আম্মু ভালো আছে?
কলের ওদিকটায় ভাইয়া প্রশ্নের জবাব দিলেননা। ভুল প্রশ্ন করলাম? উনাদের কথা জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হয়নি? আমি এতোই আলাদা হয়ে গেলাম উনাদের ভালোমন্দ জানার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছি? জন্ম দিয়েছেন, তার টানেও জিজ্ঞেস কলার অধিকার নেই?
–ভাইয়া বলো না, তুমিও চুপ করে থাকলে আমি কার কাছে জানবো?মিরা আপুও সাথে থাকেননা। গ্রামে চলে গেছেন। আমার তো জানার মাধ্যম নেই….
–তোর জানার দরকার নেই সিনু। যারা তোর নামে বেলায় বেলায় ‘বেশ্যা’ বলে ছিটকায় তুই খোজ নিবি কেন? রাখ। পরে কল করি। আমার ক্লায়েন্ট আসছে।
ভাইয়া ফোন কেটে দিলেন। কান থেকে ফোন সরিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছি, স্কিন অফ হয়ে গেছে। আমার চেহারাটা দেখা যাচ্ছে স্ক্রিনে, চোখ ভরে পানি আমার। “বেশ্যা বেশ্যা বেশ্যা”…….সবদিক থেকে বেশ্যা ছাড়া অন্য গুণকীর্তন শুনিনা। জোর করে বিয়ে করলেও বেশ্যা? ছেলেরা তাহলে রেপ করে বেড়ায়, আট দশটা প্রেম চুটিয়ে হোটেল রুম মানায়, শেষে সঙ্গী বানাতে পরিবারের কাছে আবদার করে সতী পবিত্র মেয়ে। আমি সবার ইচ্ছার বিপক্ষে বিয়ে করলেই ভুল? এ কেমন বিচার? কোন আদালতের কাঠগড়ায় দাড়ালে আমাকে নিন্দা করবে না? আমি “বেশ্যা”, “নষ্টা”, “পতিতা”, টাইপের কিছুই করিনি। আমার চরিত্র নিয়ে সবাই যেভাবে দস্তখত নিয়ে বসেছে… সবার পাপের ভান্ডার বোধহয় পূণ্য কর্মে ঢেকে গেছে। পাপী হিসেবে অবশিষ্ট খালি আমিই আছি।।
রাত দুইটা আমি ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে বিছানো বেডে শুয়ে আছি। মুগ্ধ পাশে নেই। উনি বেডরুমে টায়ার্ড হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। আমি কখন উঠে এসেছি উনি টের পাননি। “অন্ধকারবিলাস” করছি, মাথার নিচের বালিশ ভিজিয়ে কেদে। কান্না করতেও কষ্ট পোহাতে হচ্ছে আমি ফুপিয়ে শব্দ করে কাদতে পারছিনা। হালকার উপর হালকা যদি কান্নার আভাস মুগ্ধের কানে যায় উনি পাগল হয়ে পড়বেন নিজের ঘুম বাদ দিয়ে।
একাই শুয়ে শুয়ে মানুষের থুকের উপর কাদছি। এজন্যই মানুষ হয়তো আত্মহত্যা বেছে নেয়, “নিজেকে হত্যা”। আত্মহত্যা করলে সব সমস্যার সমাধান না ঘটলেও মৃত দেহের কানের ছিদ্রে গুন্জন গালি শোনা লাগেনা। মানুষের জিহবা পিস্তল, কামানের চেয়েও অদ্ভূত পদাংশ আমি প্রতিটি শিরা, উপশিরায়, রক্তবাহিকার ধমনির মধ্যেও টের পাচ্ছি। একপর্যায়ে এতোই কান্না পাচ্ছিলো আমি বাধ্য হয়েছি মুখে হাত চেপে কান্না করতে। মুখের চিৎকার আহাজারি উনাকে না শুনাতে দুইহাতে চেপে আছি। এবারও বিষ্ময়কর কিছু ঘটলো, মুগ্ধ ঘুম থেকে উঠে এসে আমার কান্নাকাটি দেখে তাড়া লাগিয়ে পাগলের মতো প্রশ্ন করতে লাগলেন,
–তুই….তুই কাদছিস ? তুই এখানে কেন? কে কি বললো তোকে??? আমার দিকে তাকা না প্লিজ, মম দেখ আমি….আমি আছি, তাকা না একবার, কাদছিস কেন???? প্লিজ প্লিজ প্লিজ….চুচুপ করে থাকবি না…..
উনি আমার মাথার কাছে বসে উনার কোলে আমার মাথা উঠিয়ে নিলেন। আমি মুখ ঢেকে ফুপাচ্ছি, উনি আমার হাতের উপর হাত বুলাচ্ছেন। আমার চেয়ে বেশি উনি চিল্লাহুল্লা শুরু করে দিয়েছেন। মুখ থেকে হাত সরিয়ে চোখের বদ্ধ পাতা মুছে তাকালাম। ইতিমধ্যে উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে নিয়ে শুয়ে আছেন। কি হয়েছে, কাদছি কেন প্রশ্নের পর প্রশ্নমালা। আমার মাথার চুল আকড়ে পাচ আঙ্গুলে উনার বুকে চেপে ধরে আছেন। “হৃদমাঝারে” নামক জায়গাটার প্রশ্বস্থ বেশি হলে উনি আমাকেই তন্মধ্যেই ঢুকিয়ে রাখতেন। কয়েক গুন বেশি ধকধক করছে উনার হৃৎপিন্ড। আমি কান্না থেকে অব্যহতি টানলে উনি আস্তে থেকেও আস্তে করে বলে উঠলেন,
–আমি কোনো ভুল করেছি প্লিজ? ভুল ত্রুটি থাকলে আমায় বল প্লিজ…..আমার আর কষ্ট নেওয়ার জায়গা নেই রে…..শূন্য আমি। নিরানব্বইয়ের কোঠার মতো জিতে জিততেও শূন্য….
কিছু সময়ব্যাপী থেমে বলে উঠলাম,
— “আমি কি বেশ্যা হয়ে গেছি? বাচার অধিকার কি নেই? মরে যাব ?”
-চলবে
-Fabiyah_Momo