#যদি_বলি_ভালোবাসি♥
#PART_38
#FABIYAH_MOMO🍁
ভারী বর্ষনমুখর দিন। কি বৃষ্টিই না হচ্ছে!! থামার কোনো অবকাশই দেখছিনা। মুগ্ধ আসার পর থেকে বৃষ্টির তান্ডব কোনো অংশেই কমছেনা। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে ঢাকাসহ পাশ্ববর্তী সকল শহর ভারী বর্ষনের কবলে পড়বে। হঠাৎ করে বৈরী আবহাওয়া মানুষের মনে বিষন্ন বাড়িয়ে দিচ্ছে। মুগ্ধ হসপিটালে। আজও উনার ছুটি নেই। পেশেন্টের ইর্মাজেন্সি আবহাওয়াকেও হার মানায়। তাতে আমার কোনো কষ্ট নেই। সেবা দেওয়া উনার পেশা। আর উনি যেকোনো খারাপ দূর্যোগপূর্ন পরিস্থিতিতেও ঘাপটি মারেননা। বিষয়টা প্রশংসনীয়। বিছানায় বসে পাঠ্যবই পড়ছি। মনিরা ওর রুম থেকে আমাদের বেডরুমে আসলো। আমার পাশে থাকা বালিশে ও গা ঢলে শুয়ে পড়লো।
–দোস্ত বৃষ্টিতে ভিজবি? চল ছাদে যাইয়া ভিজি!!
আমি বইটা নিয়ে একলাইন পড়ে তারপর উত্তর দেওয়ার জন্য মনুর দিকে তাকালাম। আর বললাম,
–ছাদে ভিজতে গেলে আশেপাশের বিল্ডিং থেকে পুরুষ মানুষ জুম করে আমাদের দেখবে।ছাদে যাওয়ার দরকার নেই। ওয়াশরুমে শাওয়ার ছেড়ে ভিজে নে।
মনিরা আমার বইটা নিয়ে টেবিলের উপর ছুড়ে মারলো। ঘটনাক্রমে বইটা শব্দ করে স্থান গ্রহন করলো। আমি বিরক্ত ভঙ্গি নিয়ে মনিরার দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে পাশ ফেরে গালে হাত দিয়ে ঘুরে বললো,
–তুই এমন খরখরা কেমনে হলি বইন? তুই যেই রোমান্টিক আছিলি!! বিয়ার পর জামাই পাইয়া কই গেছোস??
–খরখরা মানে? কি বুঝালি?
–এইযে তুই ভাইরে নিয়া রোমান্স করোস না। কেমন খরখরা রস কস ছাড়া পাতার মতো খাচ্চুনিটার মতো শুয়ে থাকোস। সাজবি গুজবি শাড়ি পড়বি। কপালে টিপ দিবি। লিপস্টিক দিবি। রূপবতী সাজবি। আর কই তুই কামের বেডী রহিমা সাইজা থাকোস!
“কামের বেডি রহিমা” –ওহ্ মাই গড! মনিরা আমাকে সাক্ষাৎ সাক্ষ্যে ইজ্জত মেরে প্লাস্টিক কোম্পানি বানিয়ে দিচ্ছে। ও খোদা আমার ইজ্জত নাই! শেষ! পুরা কুচিকুচি ফালুদা। আমি কি আসলেই খাচ্চর দেখতে? এই মনুকে কি করতে ইচ্ছা করে! আমি মনিরার ধারালো কেচির মতো জবান বন্ধ করার জন্য বললাম,
–তুই কি! শালী তুই নিজে বফ জুটায়া প্রেম চুটাইতে পারোস না!ছয়মাস না যাইতেই ব্রেকআপ ! এখন আসছোস আমার আর মুগ্ধের মাঝে লুতুপুতু ছুটাইতে! ফোট এখান থেকে! আমি যেমন আছি তেমনি বেস্ট। মুগ্ধ সেটাই পছন্দ করেন।
–দেখ! ওই হালার লগে প্রেম করছি ঠিকাছে। কিন্তু রিলেশনের ছয়মাস না যাইতেই হালার রুম ডেটে যাওয়ার লিগা চুলকানি উঠছিলো! আর তুই তো জানোস বিয়ার আগে আমি রুমডেট কি রুমমান্থেও যামু না! হালারে জুতা দিয়া চটকায়া কানসা ফাটায়া দিছি।
হাসতে হাসতে আমি বিছানায় যেন গড়াগড়ি খাই। ও মাবুদ! এই মেয়েকে রক্ষা করো!! কি চিজ রে বাবা! মনিরার সাথে কোনো ছেলে ঢপবাজি করে থাকতে পারবে? এ জীবনেও সম্ভব না!! মনিরা ঢপের উপর ঢপের গুল খাইয়ে উঠোন বাকিয়ে দিবে, তবুও নিজে মাথানত করবেনা!! বেচারা এক্স বফ! কানের পর্দা নাকি জুতার থাবড়ায় ফেটে গেছে!! বাহ্ রে বাহ্ ! কেয়া হে মাজা!!
দুপুরের সব রান্না করলো মনিরা বিবি। আমি খেয়ে দেয়ে ঘুম দিলাম বৈকি। যখন ঘুম থেকে উঠলাম, আবির ভাইয়াকে আরো একবার কল করলাম। “কাঙ্খিত নাম্বারটিতে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা অনুগ্রহ করে আবার ট্রায় করুন ধন্যবাদ” –এই একটি কথা ছাড়া অন্য কোনো কথার উন্মোচন করতে পারছিনা গত দুইদিন যাবৎ। ভাইয়ুর ফোন অফ। লাস্ট কথা দুইদিন আগে মুগ্ধের সাথে ঝগড়ার পূর্বে হয়েছিলো। সেই যে বলেছিল, “সময় কম! তুই ওরে বল বের হইতে! আমি অফিস থেকে রওনা দিতেছি!” এরপর থেকে নট রিচেবল। ভাইয়ার ফোন পাওয়া যাচ্ছেনা। মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করলেও জবাব জানেন না। হঠাৎ ভাইয়া লাপাত্তা গুম কিভাবে হয়ে গেল? ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ আমি কোনোভাবেই করতে পারছিনা! ভাইয়ু তুমি কোথায়? খোঁজ মেলবে কোথায়? রাফিয়াকে কল করেছিলাম। আবরার ভিলা থেকেও কোনো খবর আসেনি। আব্বু আমার নাম্বার ব্লক করে দিয়েছেন। আম্মু তো আমার “হ্যালো” বলার কন্ঠস্বর পেলেই ফোন কেটে বন্ধ করে দেন। কেউ কিচ্ছু জানায়না। কেন ভাই আমাকে বাসায় যেতে বললো আদৌ জানিনা।
মেইন দরজায় বেল পড়লো। আমি আগ বাড়িয়ে দরজা খুলতে গেলাম। আমাদের ফ্ল্যাটে লুকিং মিরর নেই। তাছাড়া সিকিউরিটি সিস্টেম থাকা সত্ত্বেও মুগ্ধ দরজার উপরে কাটাচামচ ঝুলিয়ে দিয়েছেন। স্কচট্যাপ দিয়ে সুন্দর করে দরজার একপাশে এটে দিয়েছেন যাতে সুবিধামতো খারাপ সিচুয়েশন দেখলে কাটাচামচ নিয়ে সামনে আসা ব্যক্তিকে আহত করা যায়। জিজ্ঞেস করলাম — “কে? কে এসেছেন? জবাব দিন প্লিজ!!”। হুহা কোনো শব্দ নেই। আকাশের মতো চুপ করে আছে। আমি কাটাচামচের উপর হাত রেখে দরজা খুলে একটু ফাক করে চোখ দিলাম। দেখি রাফিন! দেখার সাথে সাথেই আমি ধাম করে দরজা আটকিয়ে দেই। মনিরা দৌড়ে হুরহরিয়ে আমার কাছে আসলো। আমি দরজায় পিঠ লাগিয়ে মনিরার দিকে তাকিয়ে হাপাচ্ছি। হঠাৎই নিশ্বাস আমার তেজী হয়ে উঠেছে রাফিনকে দেখে। মুগ্ধ শতভাগ নিশ্চিত করেছেন রাফিন জীবনেও আমাদের ফ্ল্যাটের ঠিকানা পাবেনা। ও এখানে! মনিরা লাগাতার আমাকে “কে এসেছে” নিয়ে জিজ্ঞাসা করছে আমি জবাব দিতে পারছিনা। বাধ্য হয়ে মনিরা আমাকে দরজা থেকে ধাক্কা মেরে দরজা খুলে দেখলো। আমি মনিরার পিছনে যেয়ে ওর হাত চেপে দাড়াই, মনিরা আমার দিকে চোখ বন্ধ করে শান্ত থাকতে বলল। মনিরা ঝাঝালো করে বলল-
–কি দরকার তোর? কোন কাজের মারা দিতে এইখানে আসছোস!
–আমি তোমার সাথে কথা বলতে আসিনি মনিরা। স্টে এসাইড।
–ইংলিশে ফটরফটর কম করবি! ওর কাছে যাওয়ার আগে তুই আগে আমারে ওভারটেক কর! বুইঝা নিস আমি কি জিনিস!
–মনিরা প্লিজ কথা শুনো, আমি এখানে গন্ডগোল করতে আসেনি। ঠান্ডা মাথায় সব সল্ভ করতে এসেছি। আই ওয়ান্ট টু টক টু হার।
–তোরে ইংলিশে ফটফট করতে না করছিনা! তুই ওর সাথে কি নিয়া কথা বলবি?? যা বলবি আমারে বল আমি ওরে পাস করতাছি।
–বাইরে দাড়িয়ে কথা বলবো না। আমাকে ভেতরে আসার পারমিশন দেওয়ার হোক। রাদিফ জানে আমি এখানে এসেছি। ইনফ্যাক্ট! রাদিফ নিজেই বাসার এড্রেস দিয়েছে! সো ভেতরে আসতে দাও!
মনিরা দরজা ধরে দাড়িয়ে আছে। রাফিনের কথাতে আমিও যে বিশ্বাস করবো না মনিরা আমার দিকে চোখের ইশারায় “কি করবো” বলে জিজ্ঞেস করলো। আমি ওকে না সূচকে মাথা নাড়িয়ে বলে দিলাম এখনই ঢুকতে দিস না। ওয়েট!….রুমে যেয়ে ফোন নিয়ে মুগ্ধের নাম্বার ডায়াল করলাম। ঝটপট কল করে কোমরে হাত দিয়ে ছটফট করছি! ইশশ…মুগ্ধ তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করুন!! উনি ধরলেননা। আবার দিলাম! এবারও বাজছে রিসিভ করছেন না। আশ্চর্য ! আমার কল কেন ধরছেন না? দিতেই থাকলাম কল। একপর্যায়ে উনি রিসিভ করলেন-
–সরি সরি ফোন সাইলেন্ট করা ছিলো আমি শুনতে পাইনি!!
–আজব! আপনি ফোন কেন সাইলেন্ট রাখবেন! কত জরুরী বিষয়ক কল আসতে পারে জানেন না!
–আরে সরি তো পাকনি। আমি খেয়াল করিনি। ভুলবশত ভুল করে ফেলেছি। আচ্ছা কি হয়েছে? এতোগুলো কল?
–রাফিন বাসায় এসেছে! কি করবো?
–কি করবি মানে… ভেতরে ঢুকা। বাইরে দাড় করিয়ে রেখেছিস?
–আপনি সহজভাবে কেন বলছেন! কে এসেছে শুনেছেন! রাফিন এসেছে!
–হ্যা ভাই এসেছে।ভেতরে আসতে বল। চা নাস্তা খাওয়া ব্যস…ভয় কিসের?
–আপনার বিড়াল কান্নার ফল বোধহয় ঘনিয়ে এসেছে মুগ্ধ! আরেকটা বিয়ে করার জন্য রেডি থাকিয়েন। আমি গেলাম !আল্লাহ হাফেজ!
–ধুর ! পাগল নাকি! রাফিন ভাই তোকে মারতে আসবে? আমি থাকতে তোর উপর ওসব করার সাহস আছে? চটপট প্রিপ্রেয়ার হয়ে ভাইকে স্বাগত জানা। আমি তো তোকে ভালোবাসি। আরেক বিয়ে কোন দুঃখে করতে যাবো বোকা মেয়ে!
–রাফিনকে ঠিকানা আপনি দিয়েছেন? কেন দিয়েছেন? ও তো ভা…
–ভালো না জানি। তাই বলে ভালো হতে পারবেনা কোথায় বলা আছে? সুযোগ কি তোকে দেইনি? তুই তো ডিভোর্সের ভূত ঘাড়ে চেপেছিলি, তাই বলে শাস্তি দিয়েছি? পাগলামো বন্ধ কর। ভাইকে হাসিমুখে স্বাগত জানা। আমার প্রিয় শ্যালিকাকেও বলে দিস পাকনি। জল্লাদের মতো কান্ড না করতে। আমি জলদি আসার চেষ্টা করছি।
–যদি রাফিন কিছু করে?
–তুই কি করবি শিখিয়েছি না? ভুলে গেছিস? রান্নাঘরে হরেক রকম মশলা আছে, একটা কৌটা উঠিয়ে মেরে দিবি। আচ্ছা ভয় পাচ্ছিস কেন বলতো? শ্যালিকা নিজেই আস্তো একটা আগ্নেয়াস্ত্র, যে টোপ খাইয়ে দিবে, তোকে উদ্ধার করে আরো সাত বংশকে উদ্ধার করতে পারবে। কথা না। যা এখন ।
মুগ্ধ হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন রাফিনকে স্বাগতম জানিয়ে খাতিরযত্ন আপ্যয়ন করি!কি শখ! আহা!! মনিরার কাছে গিয়ে বললাম কানে কানে। মনিরা কথাটা কানে নিল সাবধানে। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে দরজা থেকে সরে দাড়ালো। রাফিন ঢুকলো ভেতরে। আমি রাফিনকে আঙুল দিয়ে সোফায় বসতে বলি, মনিরাকে পাঠাই চা আনতে। আমি ওড়না টেনে গা সহ মাথা ঢেকে বিপরীত সোফার আসনে বসি। শুরু করলো রাফিন তার জরুরী ব্যাপারে কথা….
–দেখ মম পাস্টে যা করেছি তা দয়াকরে ভুলে যাও। আমি সপ্তাহ ধরে রাদিফের সাথে কানেক্ট হওয়ার ট্রায় করছি কিন্তু বিশেষ কারনে সম্ভব হয়নি। আজ খুব জোড়তোড় তাড়া করে রাদিফের সাথে কথা বললাম। তুমি আমার মতো নরপশুকে বিশ্বাস করবেনা তাও জানি….কিন্তু তোমার সাথে কথাটা বলা বেশি জরুরী।
আমি রাফিনের দিকে চোখে চোখ রেখে তাকাইনি। চোখ নামিয়ে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। রাফিন জরুরি কথা বলতে এসেছে আমি বুঝলাম। কি কথা বলতে এসেছে তা জানা দরকার। সায় দিয়ে বললাম-
–জ্বি ভাই বলুন। আমি শুনছি।
–ফাস্ট এট অল তুমি আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। তোমাকে স্কুলজীবন থেকে লাইক করতাম, এখন তুমি অন্যকারো বউ। আমি বুঝতে পেরেছি আমার মোটেও উচিত হয়নি তোমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করা এবং কুদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। আমায় ক্ষমা করলে আমি ধন্য হবো। তুমি জানো হয়তো আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী পুষ্পিতা আমায় ছেড়ে চলে গেছে। তার অন্য জায়গায় ভাও ছিলো। তাকে নিয়ে পালিয়েছে। আমি হোস্টেলে থাকতাম এটাও তুমি জানো।
মনিরা চায়ের ট্রে এনে তিনকাপ টেবিলে রাখলো। রাফিন তার কথায় বিরতি টানলো। এক কাপ চা নিয়ে রাফিনের হাতে দিল মনিরা। আরেক কাপ চা আমার দিকে দিয়ে অপর কাপ নিয়ে আমার পাশে বসলো। রাফিন চায়ে চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করলো…
–কোথায় যেন ছিলাম…
মনিরা চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার পূর্বে বলল–
–তুমি হোস্টেলে থাকতা..
–ওহ্ হ্যাঁ থ্যাংকস,
আমি মনিরা কর্মে অবাক হয়ে আছি কিন্তু মুখে প্রকাশ করছিনা।। খুব অদ্ভুত আচরন মনিরার। ও রান্নাঘরে ছিলো কিন্তু কান সজাগ ছিলো। সব কথা শুনেছে এই মেয়েটা। রাফিন পুনরায় বলল-
–রাদিফ যে তোমায় পছন্দ করতো এটা আমার ফ্যামিলি জানতো। কিন্তু মা তোমার জন্য আমায় চুজ করেছিলো এই কথায় তোমার পরিবারের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মা তোমাকে আলাদা করে দেখতো, বিশেষ করে আদর করতো। আই হোপ তুমি বুঝেছো, তোমার নাকের নিচ দিয়ে দুই পরিবার আগেই বিয়ে পাকাপাকি রেখেছিলো। একদিন রাদিফ কথাটা জেনে যায়, তখন রাফিয়া ছোট। আমি রাদিফকে প্রচুর মারধর করেছি। আব্বুও মেরেছে। নাক ফেটে রক্ত পড়ছিলো রাদিফের। তবুও ওর কঠোর গলায় কথা বেধেছে, তুমি নাকি ওর বউ। তুমি বড় হলে বিয়ে করে সংসার করবে। আব্বু রাদিফের সাথে রূপার বিয়েটা পারিবারিক সম্পর্কে আরো গভীর করার জন্য পাকা করেছিলো। ভেবেছিলো রূপাকে আবরার বাড়ির ছোট বউ করলে ফুপির সাথে ঘনিষ্ঠতা ঘন হবে, একমাত্র মেয়ে দেখে অঢেল সম্পত্তি ও বিলাসিতা পাবে। রাদিফ ওটা মানলো না। ও একগুঁয়ে শুরু করলো তোমাকেই বিয়ে করবে। যখন কেউ কিছু করতে পারছিলো না তখন বাধ্য হয়ে ওকে এব্রডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
চায়ের কাপ নিয়ে আমি স্থির হয়ে আছি। প্রতিক্রিয়া দিতে পারছিনা। রাফিনের কথায় পুরোনো সত্য জানছি, তাতে আমার একবুক খুশি হওয়া উচিত নাকি মুগ্ধের ভেতর ডেবে রাখা কথা শুনে শোকবিলাস করা উচিত? পরিস্থিতি কোনটাকে ইঙ্গিত করবে? খুশি না শোক? চায়ের কাপে আরেক চুমুক দিলো রাফিন। মনিরার চা খাওয়া শেষের দিকে। আমার গলা দিয়ে চায়ের পানীয় নামছেনা। থেমে আবার বলতে শুরু করলো-
–আমি হোস্টেলে চলে যাই নিজের ইচ্ছায়। তোমার কাছাকাছি থাকলে নিজেকে নিয়ে খুবই আবেগপ্রবন থাকবো। তাই হোস্টেলে থাকা শুরু করি। বছরে নানা ছুটিতে বাবা-মাকে দেখতে শহরে আসতাম। তোমাকেও ফলো করে দেখতাম তুমি জানতে না। জানতে দেইনি। রাদিফ বিদেশ যেয়ে বাকি পড়া কন্টিনিউ করলো। খুব সাফার করলো। তোমার সাথে সকল কানেকশন কাট করে দিলো। ওর ভেতরে জিদ বসে গেলো তোমাকে ও-ই বিয়ে করবে। রাদিফ যেদিন আসলো ত কিছুদিন পর আমি খবর পেয়ে চলে আসি। মাকে ওয়াদার কথা স্মরন করাই। বাবাকে রাদিফ ও রূপার বিয়ে দিতে মত বানাই। আমার ভুলটা কি ছিলো জানো?
আমি চুপ। চোখে পানি চলে আসলে খুব কষ্টকর হবে। এ পানিটা রাফিনের জন্য না উনার জন্য। একটা পাগল উন্মাদ ছেলের জন্য যে কিনা নিজের গোটানো কষ্টের দুনিয়া লুকিয়ে রেখেছেন খুব যত্নে। নিজেকে নিয়ে বিয়ে এত মাস পরেও টু আওয়াজ করেনি! কিচ্ছু বলেনি! “বিদেশ কেন গিয়েছিলেন”…. এই প্রশ্ন করতে করতে আমি পাগল হয়ে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু উনি জবাব দেননি। একদম দেননি। মনিরা রাফিনকে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল-
–কি ছিলো?
রাফিন কাপটা টেবিলে রেখে বলল-
–মম যে সাধারণ মেয়ে না এটা বড় ভুল ছিলো। সব মেয়েদের মধ্যে এতো হিম্মত নেই বাবা মায়ের বিরোধ যেয়ে হবু স্বামীর ছোট ভাইকে বিয়ে করবে। সে তা দেখিয়েছে। চমৎকার এক্সিলেন্ট বাহাদুর একটা মেয়ে ও।…(আমারদিকে তাকিয়ে) সবাই যখন তোমার বিপক্ষে তখন তুমি একাই নিজের হাতের মুঠোয় ইচ্ছাপূর্বক এনে নিয়েছো। সমাজের মানুষ পাড়া পড়শি কত নানা কথা শুনাবে তুমি ভাবো নি। রাদিফ লাকি। তুমি ওর মতো ছেলের জীবনে এসেছো। তোমাদের দুজনের লাইফ খুব মিলে। স্ট্রাগল করা কেউ তোমাদের শিখুক। সত্যি বলতে কি….আমি আমার পাপের শাস্তি পেয়ে গেছি। পুষ্পিতা পালিয়ে যাবে কেউ কল্পনাতেও আনতে পারিনি। নম্র ভদ্র সুশীল মেয়ে ছিলো। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও। কম কথা শুনাইনি, খুব অশ্লীল কথা বলেছি। আরেকটা কথা, তোমার ফোনের ভিডিওটা আমি দিয়েছিলাম। প্র্যাঙ্ক ছিলো ওটা। মাইন্ড করো না ভুলে যাও। আমি আজ রাতে তিনটার ফ্লাইটে ইতালি চলে যাচ্ছি। দেশে ফিরবো কবে জানি না। এজন্য সবটা জানিয়ে দেখা করতে এসেছি।
আমি চোখের জল ছেড়ে নিশব্দে কেদেঁ দিয়েছি। মাথা যতটা সম্ভব ততটা নিচু করে ওড়নার কোনা দিয়ে চোখ ঢাকছি। চায়ের কাপটা বড্ড ভারী লাগছে হাতে। ওজন বেশি বেশি লাগছে। সর্তকতার সাথে নোনাজল মুছে মাথার ঘোমটা কপালের কাছে টেনে নিলাম। শান্ত করে বললাম-
–ধন্যবাদ ভাই। আমি আপনাকে কখনো নাম ধরে ডাকা থেকে “ভাই” বলেও ডাকতে পারবো আশা করিনি। উনার ব্যাপারে অনেক কিছুই আপনার মাধ্যমে জানলাম। হয়তো জানার জন্য আল্লাহ এভাবেই সবকিছু লিখে রেখেছেন। তাই জেনে গেলাম। আপনাকে নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি মাফ করে দিয়েছি। পুরোনো স্মৃতিতে মাটি ঢালুন। আপনার ইতালি সফর শুভ হোক দোয়া রইলো। তাকদিরে আবার দেখা হওয়া থাকলে অবশ্যই দেখা হবে।
রাফিন ভাই প্রশান্তমনার হাসি দিলো। সে হাসির অর্থ পুরোটা না বুঝলেও এটুকু বুঝেছি, ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন দিনের আশায় জীবনে পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। গর্বিত চিত্তের অনুভব হচ্ছিলো আমার। গর্ব ও অহংকার নিয়ে এক টুকরো সুখ। রাফিন চলে গেল। মনিরা দরজা আটকে দিতে আমি ফোন নিতে সোফা ছেড়ে উঠে দাড়াই। মনিরা পিছন থেকে কাধে হাত দিয়ে থামালো। আমি ঘুরে ওর দিকে তাকালে মনিরার মুখটা খুশীতে ভরে উঠলো। আমাকে জাপটে ধরে বলল-
–দোস্ত তোর রোমান্টিক হওয়ার দরকার নাই। তুই যেমন আছোস ওমনই ভালো। ভাই তোরে অনেক ভালোবাসে। তোরা দুইজনে দোয়া করিস, আমিও যেন ভাইয়ের মতো ভালো একটা পোলা পাই। বইন! ওরে পাইলে দেখিস! আমিও ওরে কিডন্যাপ কইরা বিয়া করমু! ওর ঠিকানা খালি পাই আমি!! পাতালতেও খুইজা আইনা বিয়া করুম!!নো ছাড়াছাড়ি! ডিরেক্ট বিয়া করি!!
দুষ্টু মেয়ের মাথায় হিরিক করে বুদ্ধি আসে কোথা থেকে!! আমার মতো মনু দ্যা বরিশাইল্লাও ছেলে ধরে বিয়ে করবে!! ওরে আল্লাহ্!! দুইজনের দেখি একই ইচ্ছার উপর তাবু গাড়লো!! হেসে দিলাম।পিঠে একটা কিল মেরে বললাম-
–যাও বাচ্চা দোয়া করলাম। মুগ্ধের চেয়েও ভালো উত্তম পুরুষ আসুক! তোর মতো শাকচুন্নিকে একেবারে টাইট করুক! চলবে??
মনিরা খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। আমাকে ছেড়ে দিয়ে দুগাল টেনে বলল, “চলবো না!! দৌড়ায়া বাসরও করবো!!”
.
.
কলমের ক্যাপ দাত দিয়ে কুটে চলছি। পা ফ্লোরে রেখে ধপাধপ করে উপরনিচ করছি। উফ! মুগ্ধ যে কখন আসবে! কখন থেকে অপেক্ষা করছি!! অপেক্ষা শেষ হওয়ার ইতি যেন করছেনা!! কি জ্বালা! মনিরা গালে হাত দিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। আমি দরজায় বেল পড়ার সময় গুনছি!! ইশশ…বেল পড়, বেল পড়!! মুগ্ধ আসেনা কেন! মনিরা বিরক্ত নিয়ে বলল,
–শালী এমনে কলমের মাথাডারে চাবায়া খাইতাছোস এইটার জায়গায় ভাত চাবায়া খাইলেও ভাই খুশি হইতো। কালকে আমারে যেই কথা শুনাইছে! তোর লিগা ঝারি মার্কা বেতাছিড়া কথার বকা খাইছি!তুই যে খাস না এইটা বলে আমার দোষ! ক এহন কেমনডা লাগে?
আমি মুগ্ধের অপেক্ষায় ঘড়ি দেখে বাচিনা!! বজ্জাত এটা…ফাও কথা শুনিয়ে মেজাজ খিটখিটে করছে! আমি এক ধমক দিয়ে বললাম-
–একটা ওয়ার্ড বের করবি তোর উত্তম পুরুষ নিয়া এমন অভিশাপ দিবো কাদতে কাদতে আচল ভিজাবি! চুপ ! চুপচাপ বস!
হঠাৎ কলিং বেল বাজলো। বাজতে দেরি ধপ করে দরজা খুলতে দেরি নেই। মুগ্ধ হা করে মিটিমিটি হাসছেন। আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “কি হয়েছে”। আমি ভেটকি দিলাম। ‘কিছুনা’!! মুগ্ধ ভেতরে এসে মনিরার দিকে তাকিয়ে আমার দিকে আপাদমস্তক দেখলো। আমার তাড়াহুড়ো বিহেব নিয়ে মুগ্ধ ইতস্তত করছেন। মাথা চুলকাতে মনিরাকে বলে উঠলেন-
–হেই শ্যালিকা? তোমার বান্ধুবী একটু তাড়াতাড়ি দরজা খুললো না? মনে হলো আমার অপেক্ষায় দরজা ধরে প্রহর কাটাচ্ছিলো!! ইজ ইট ট্রু শ্যালিকা?
মনিরা গম্ভীর ভীরু ভাব নিয়ে মুগ্ধের কাছে উঠে গেল। ফিসফিস করে বলল-
–ভাই ওরে পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে। দেইখেন একটু পরে জাপটায়া ধরবো। সাবধানে থাইকেন। চুম্মা কইলাম আমার সামনেও দিয়া ফালাইবো!
মুগ্ধ হুহু করে হেসে দিলেন। মনিরা সেরা লেভেলের বজ্জাত! কথাটার আর ব্যাখ্যা লাগলো না! মুগ্ধের কানে কি কি ফুসলিয়ে শুনিয়েছে উনি খিলখিল করে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছেন। আমি সিউর! আমার ব্যাপারে মনিরা আজাইরা কিছু শুনিয়েছে! তার বদৌলতে মুগ্ধ আমার উপর হাসছেন!
মুগ্ধের কাছে যেয়ে ভদ্র মেয়ের মতো দাড়ালাম। উনাকে আমার দিকে একটু ঝুকতে বলে বললাম-
–আপনি একটু নিচে ঝুকেন তো! আপনার চেহারা গগনচুম্বী হয়ে আছে!
উনি পিঠের পেছনে দুহাত মুঠ করে আমার দিকে মাথাটা ঝুকালেন। কপাল কুচকে মুচকি হেসে বললেন-
–কি বলবি পাকনি??
উনার গালে একটা চুমু একে বললাম-
–বড্ড উন্মাদ একটা নষ্টালজিক ছেলেকে ভালোবাসি!!!
উনি ফিট খেয়ে আমার দিকে তাকালেন একবার! আরেকবার মনিরার দিকে!
-চলবে