যাত্রাশেষে (পর্ব-১৫)

যাত্রাশেষে (পর্ব-১৫)
# হালিমা রহমান।

চারপাশে গুমোট আবহাওয়া।বৃষ্টি হবে হবে ভাব কিন্তু হচ্ছে না।বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই।মহুয়ার গলার কাছে ঘাম জমে।ঠোঁটের উপর, নাকের উপরেও মুক্তোদানার মতো ঘামবিন্দু স্থান করে নেয়।কালো শাড়ির কালো আঁচল দিয়ে তা মুছে নেয় মহুয়া।দূর থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।নাইট গার্ডের বাঁশির আওয়াজও বেশ স্পষ্ট। মহুয়ার পাশে তুষার দাঁড়ানো।সে এখনো নীরব।তুষারের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে কি না, তা জানে না মহুয়া।সে শুধু জানে,তুষারকে এখন সময় দিতে হবে।তুষারের সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে হবে,যাতে সে দুঃখের অতলে ডুবে না যায়।মহুয়া তুষারের দিকে দু-পা এগিয়ে যায়।অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে তুষারের ডান হাতের কনুই জড়িয়ে ধরে।

—” মিত্তির বাবা,চলুন একটু বসি।ওখানে বসার জায়গা আছে।”
—” চলো।”

তুষারের পকেটে ফোন ছিল।ফোনের লাইটের আলোতে বেঞ্চের কাছে যেয়ে পৌঁছায় তারা।বেঞ্চটা ছোট।দুজন বসলে একটু চাপাচাপি হয়।মহুয়া ও তুষার বসে পড়ে সেখানে।মহুয়া পা উঠিয়ে বসে।পা ঝুলিয়ে বসতে ওর অসহ্য লাগে।মানুষ আরামের জন্য বসে।কিন্তু বসার পর যদিই হাঁটুই এভাবে ঝুলিয়ে রাখতে হয়,তবে আরাম হলো কোথায়?

—” মিত্তির বাবা,মহিমাকে খুব বেশি মনে পড়ছে?”

—” চোখ বন্ধ করতে পারছি না আমি।চোখের উপর শুধু ভাসছে।কিন্তু এরকম হওয়ার কোনো কারণ ছিল না মহুয়া।মহিমাকে আমি নিজের চিন্তা থেকে দূর করে দিয়েছি অনেক আগেই।তাকে নিয়ে ভুলেও ভাবতাম না।কিন্তু,আজ দেখ।খবরটা শোনার পর এক মুহূর্তের জন্য ওকে মন থেকে সরাতে পারছি না।বারবার মনে হচ্ছে আল্লাহ ওকে এতো কঠিন শাস্তি কেন দিল?অথচ,মহিমার অপরাধ কিন্তু আমি জানি। তবুও এরকম যে কেন হচ্ছে!এ এক জঘন্য যন্ত্রণা। ”

—” পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী অনুভূতির নাম কি জানেন?”

—” না।”

—” মায়া।আপনি একসময় মহিমাকে ভালোবাসতেন।মহিমা চলে যাওয়ার পর হয়তো ভালোবাসা কর্পূরের মতো উবেও গেছে।কিন্তু মায়া থেকেই গেছে।এই কারণে এমন হচ্ছে।মহিমাকে আপনি জোর করে মন থেকে সরাতে চাইলেও পারবেন না।তার চেয়ে ওকে নিয়ে একটু গল্প করা যাক।আমার সব কথাই তো আপনি জানেন।কিন্তু আমি আপনাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না।একটু একটু করে বলুন তো আমায়।”

তুষার আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।বলার মতো কোনো গল্প আছে?না, নেই।তিন বছরের সংসারের সবগুলো দিনেই হাসি ছিল, কান্না ছিল,অভিমান ছিল,রাগ ছিল আর ছিল একটু বোঝাপড়া। এ তো বলার মতো কোনো গল্প নয়।সব পরিবারেই তো এগুলো থাকে।তবে মৃত্তিকা আসার পরের তিনটা মাস খুব সুখী ছিল ওরা।ব্যবসায়ে ক্ষতি,মায়ের মৃত্যু, সংসারের টানাপোড়েন —এতো কিছুর মাঝেও মৃত্তিকা ছিল একমুঠো সুখ ও স্বস্তি।তাদের সংসারটাও রূপকথার মতো একটা সাজানো গল্প হতে পারতো।যেখানে রাজা থাকবে,রানী থাকবে আর থাকবে একটা ছোট্ট রাজকন্যা। মিষ্টি, আদুরে।কিন্তু এসব কিছুই হলো না।সুখ রাজ্যের গদ্য রচনা করার আগেই পাতা ফুরিয়ে গেল।মেয়েকে নিয়ে মুখ থুবড়ে পরে গেল তুষার।কারণ?আজ আর কারণ খুঁজতে ইচ্ছে করে না তুষারের।একজন মৃত মানুষকে দোষারোপ করতে ইচ্ছে করে না।ভাগ্যের দোহাই দেয় তুষার।এসব ভাগ্যেই ছিল।
তুষারের কাঁধে আলতোভাবে নিজের মাথা এলিয়ে দেয় মহুয়া।এ যেন অস্তিত্বের বার্তা।মহুয়ার এটুকু আত্নসমর্পণ তুষারকে নিজের বর্তমান মনে করিয়ে দেয়।তুষার একা নয়।তার বউ আছে,বাচ্চা আছে।আর আছে নতুন করে স্বপ্ন দেখার ইচ্ছা।অতীত নিয়ে চিন্তা করার সময় তার নেই।সুখ রাজ্যের গদ্যে রানী যদি মহুয়া হয়, তবে ক্ষতি কি?তুষার নাহয় আরেকবার চেষ্টা করবে।নতুন পাতা বুনবে।এতোক্ষণের জমিয়ে রাখা চিন্তাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয় তুষার।মহিমার জন্য মনের একাংশে খচখচ করছে।নিজের অবস্থা দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায়। এরকম হওয়ার কোনো কথা ছিল?নাকি তুষার সঠিকভাবে নিজের খোঁজ নিতে পারেনি?

—” মিত্তির বাবা,আপনি ভুলতে চাইলেও পারবেন না।একজন মানুষকে ভুলতে অনেক সময় লাগে।হোক সে ভালো অথবা মন্দ।মহিমার সাথে আপনার বিচ্ছেদের বয়স এক বছরও হয়নি।এই অল্প সময়ে মানুষের মায়া ছাড়ানো যায়?”

এ যেন তুষারের নিজস্ব চিন্তাগুলোর সমাধান।ঠিকই তো।মানুষ ভুলার জন্য এক বছর অনেক কম সময়।তাছাড়া,মহিমা তো যে সে ছিল না।তিনটে বছর সে তুষারের প্রেয়সী ছিল,স্বপ্ন ছিল,অর্ধাঙ্গিনী ছিল।এখন হয়তো নেই কিন্তু তখন তো ছিল।থাকুক তার স্মৃতি মনের এককোনে।তুষার পাত্তা না দিলেই তো হয়।মহুয়ার মাথা নিজের কাঁধ থেকে বুকের উপর রাখে তুষার।এক হাত দিয়ে মহুয়ার কাঁধের পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।অন্যহাতে সামনে জড়িয়ে ধরে।
তুষারের গন্ডি এটুকুই।মনের একাংশের স্মৃতি তার মতোই থাকুক।তুষার সেদিকে নজর দেবে না।মনে না করলে স্মৃতিও ফিকে হয়।আজ অনেকদিন পর খুব মনখোলা হতে ইচ্ছে করে তুষারের।ক্ষমা করতে ইচ্ছে করে।
” তোমার বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযোগ নেই, মহিমা।আল্লাহ তোমায় ক্ষমা করুক।শেষ বিচারের দিন, তিনি তোমায় অপরাধী হিসেবে না দাঁড় করাক”— নিজের মনেই আওড়ে নেয় তুষার।লক্ষ করে এতোক্ষণের মন খারাপ পালিয়ে গেছে।নিজের এই পরিবর্তনে নিজেই অবাক হয়ে যায় সে।ক্ষমার এতো ক্ষমতা!এরকম জানলে অনেক আগেই মহিমাকে ক্ষমা করে দিত।

—” আমি আপনাকে কি বললাম আর আপনি কি করছেন?গল্প শোনানোর জায়গায় জড়িয়ে ধরে বসে আছেন।এটা কি ঠিক?গরম লাগছে না আপনার?”

—” উঁহু। ”

— ” কিন্তু আমার লাগছে।কাঁধ পর্যন্তই ঠিক ছিল।আবার এভাবে জড়িয়ে ধরার মানে কি?অস্থির লাগছিল বলে বাইরে এসে বসেছেন।নিজের অস্থিরতার সাথে সাথে আমাকেও অস্থির বানিয়ে ফেলছেন।দেখি,ছাড়ুন।আমার অস্বস্তি হয়।”

—” তুমি কি আমাকে সন্ন্যাসী ভাবো, মহুয়া?আমার সুন্দরী বউ পাশে বসে আছে অথচ আমি তাকে স্পর্শ করব না,এটা সম্ভব?আমি কোনো সংসারত্যাগী সন্নাসী নই।”

মহুয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। অবশেষে তুষার সহজ হয়েছে।কিন্তু কিছু কথা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।মহিমা হঠাৎ ঢাকায় কেন আসতে যাবে?আর মহিমার ভাই কেন তার বোনের প্রাক্তনের কাছে এসেছিল?মহিমার এক্সিডেন্ট হলে তার স্বামীর কি খবর?সেও কি স্পট ডেড?মহুয়া মুখ বাকিয়ে তুষারের টিশার্টের কাপড় খুটে।জিজ্ঞেস করবে?না থাক। আবার হয়তো তুষারের মনে পড়ে যাবে।কিন্তু, নিজের ভিতর কোনো কথা জমিয়ে রাখার গুণ মহুয়ার নেই।তাই জিজ্ঞেস করবে না করবে না ভেবেও করেই ফেললো।

—” মিত্তির বাবা,মহিমার ভাই কি বলল আপনাকে?মহিমা কেন ঢাকায় আসছিলো, সেগুলো কিছু বলেনি?”

—” মহিমা পালিয়ে যাওয়ার পর ওর বাবার বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ ছিল না।সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।মহিমা চট্টগ্রাম ছিল।সেও যোগাযোগের চেষ্টা করেনি।কিন্তু ওর বড়ভাই খুব দুর্বল ছিল ওর প্রতি।বুঝতেই পারছো একটা বোন।সে কিছুদিন আগে অনেক কষ্ট করে মহিমার সাথে যোগাযোগ করেছে।বোনকে ঢাকায় আসতে বলেছে।মহিমাও রাজি ছিল।অনেকদিন হয়তো বাড়ির সাথে যোগাযোগ নেই বলে হাঁপিয়ে গিয়েছিল।সম্পর্ক সহজ করার লোভেই স্বামীকে নিয়ে ঢাকার বাসে উঠেছিল।মাঝপথেই আরেক গাড়ির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ।আর সেখানেই স্পট ডেড। ”

—” ওর স্বামী?”

—” মরে না গেলেও মরার মতো বেঁচে আছে।সারা শরীরে ক্ষত আর দুটো পায়ের খুব খারাপ অবস্থা।খুব সম্ভবত হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হবে।সে এখনো চিকিৎসাধীন।”

—” মহিমার ভাই কেন এসেছিল?এই খবর দিতে?”
—“না।মহিমার নামে মিলাদ পড়িয়েছিল আজ।আমার সাথে করা অন্যায় তার মাথায় ছিল।তাই আমার কাছে এসেছিল ক্ষমা চাইতে।যাতে আমি ক্ষমা করে দেই তার বোনকে।”

—” দিয়েছেন?”

—” তোমার স্বামী পাষাণ নয়।তার দয়ার শরীর।”

—” তাহলে আমার দয়ালু স্বামীর কাছেই সবিনয় নিবেদন করছি,আপনার নিরাপত্তা বেষ্টনী সরান।আমাকে অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিন।”

কপাল কুঁচকে ফেলে তুষার।একটু জড়িয়ে ধরলেই ‘অস্বস্তি লাগছে,অস্বস্তি লাগছে ‘বলে পাগল হয়ে যায়।সমগ্র মেয়ে জাতির অস্বস্তি কি এই মেয়ের মধ্যেই দিয়ে দিয়েছে আল্লাহ?
মহুয়া নড়াচড়া করতেই হাতের বাধন শক্ত করে ফেলে তুষার।

—-” মহুয়া,আরেকবার দাপাদাপি করলে কঠিন শাস্তি দেব তোমায়।”

শান্ত হয়ে যায় মহুয়া।তুষারের শক্তির সাথে সে পারবে না।তাই গলায় খানিক বিরক্তি ফুটিয়ে বলেঃ”আপনার সাথে এখানে এসেই আমার ভুল হয়েছে।এর চেয়ে ঘরে ফ্যানের নিচে ঘুমিয়ে থাকতাম, সেটাই ভাল হতো।শয়তান লোক একটা।আপনার জন্য আমার চুলগুলোও শুকায়নি।ভিজা চুল বেঁধে রেখেছি।একদম গন্ধ হয়ে যাবে।”

—” বেঁধে রেখেছো কেন?আমি তোমাকে বলেছি বাঁধতে? খুলে দেও।”

—” আপনার যা বুদ্ধি।এতো রাতে এই খোলা মাঠে আমি চুল ছাড়ব! আশেপাশের যতো জ্বিন-ভূত সব আমার চুল বেয়ে উপরে উঠবে। ”

—” কেন?চুল ছাড়া তোমার শরীরে আর অঙ্গ-প্রতঙ্গ নেই?ওগুলো বেয়ে উঠতে পারবে না?যত্তসব আজাইরা কথা-বার্তা।চুল খোলো।”

মহুয়ার আগে তুষার নিজেই মহুয়ার চুলের কাঠি খুলে দেয়।মুহূর্তেই ঝর্ণার পানির মতো তুষারের হাতের উপর বেয়ে পড়ে মহুয়ার চুলের গোছা।মেয়েটার চুলগুলো কুচকুচে কালো নয়।গোছাও খুব বেশি ভারী নয়।হালকা লালচে রঙের পাতলা কয়েক গাছি চুল।তবে ছেড়ে রাখলে ভালোই মানায় চেহারার সাথে।তুষারের নাকে আসে মহুয়ার চুলের তীব্র ঘ্রাণ। কি শ্যাম্পু দেয় এই মেয়ে?সব মেয়ের চুল থেকেই কি এরকম ঘ্রাণ পাওয়া যায়?নাকি শুধু বউয়ের চুল থেকেই এরকম তীব্র ঘ্রাণ আসে?এই বিতর্কের উত্তর নেই তুষারের।কয়েকটা মেয়ের চুলে নাক ডুবিয়ে দেখলে ভালো হতো।তবেই এই ভয়াবহ বিতর্কের সমাধান পাওয়া যেত।
এসব দুর্দান্ত কথা মনে আসতে নিজেই অবাক হয়ে যায় তুষার।বউয়ের মাথা বুকে রেখে অন্য মেয়েদের চিন্তা করছে!
“আসতাগফিরুল্লাহ,আসতাগফিরুল্লাহ”—নিজের মনেই আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে সে।নিজের নৈতিক অধঃপতনে লজ্জিত হয়।ভাগ্যিস মনের কথা পৃথিবীর কেউ শুনতে পায় না।মহুয়া যদি এসব কথা জানতে পারত,তবে কি হতো এতোক্ষণে?জুতোপেটা করে এলাকা ছাড়া করতো।
অন্ধকারেই বউয়ের পায়ের দিকে তাকায় তুষার।পায়ে জুতো আছে নাকি বাড়িতে রেখে এসেছে???

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here