যাত্রাশেষে (পর্ব-১৮) শেষ পর্ব

যাত্রাশেষে (পর্ব-১৮)
শেষ পর্ব
# হালিমা রহমান।

প্রচন্ডে গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। জ্বিভ শুকিয়ে কাঠ।কুকুরগুলো পর্যন্ত একটু পানি পেলেই তাতে গা ডুবিয়ে দিচ্ছে।সূর্যের তীব্র তাপে শরীর পুড়ে যাওয়ার জোগার।গাছের পাতার কোনো নড়নচড়ন নেই।এরকম অবস্থায় রাজপথে বিশাল জ্যাম।একদম সাপের মত সোজা হয়ে আছে গাড়িগুলো।এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা।আফজাল সাহেব জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলেন।গলার শেষ পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে।বুড়ো বয়সের এই এক সমস্যা।খুব বেশি ভ্রমণ করা যায় না।আফজাল সাহেব রিকশায় বসে গলা উঁচিয়ে দেখলেন।এখনো অনেক জ্যাম।এই জ্যাম কখন ছুটবে আল্লাহ মালুম।হাসপাতালেও তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে।তিনি পাশে নাতনীর দিকে তাকালেন।অধীর আগ্রহে সে এদিক-ওদিক দেখছে।আর কিছুক্ষণ পরপর নানার পাঞ্জাবী ধরে খুটছে।

—” নানাভাই,আর কতদূর?”
—” বেশি না বোন।আর একটু।”
—” উফ, তাড়াতাড়ি যাইতে বল।আমরা যাব না?”
—” যাব।আরেকটু সোনা।”

এনিয়ে পাঁচবার একই কথা বলল মৃত্তিকা।সে অধৈর্য হয়ে উঠেছে।সেই কখন বেড়িয়েছে ঘর থেকে।এখনো এতো সময় লাগবে কেন?না জানি কতকিছু হয়ে যাচ্ছে সেখানে!
আফজাল সাহেব মিনিট কয়েক কপাল কুঁচকে চিন্তা করলেন।এই জ্যাম ছাড়ার আশায় বসে থাকলে হবে না।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো মৃত্তিকা কান্নাকাটি শুরু করে দেবে।ওকে তখন সামাল দিবেন কি করে?তাই বেশ চিন্তিত সুরেই নাতনীকে বললেনঃ”মিত্তি,তুমি তাড়াতাড়ি যেতে চাও?”
—” হুম।”
—” এভাবে বসে থাকলে তো তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে না।তুমি কি হেঁটে যেতে পারবে?হাসপাতাল এখান থেকে মাত্র আধা ঘন্টার রাস্তা।”

আধা ঘন্টার রাস্তা কম নয়।মৃত্তিকা কয়েক সেকেন্ড ভাবে।এভাবে বসে থাকলে দেরি হবে।তার চেয়ে যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় ততোই ভালো।তাই মাথা নেড়ে বললঃ” পারব।চলো নানাভাই নেমে যাই।”
—” সত্যিই পারবে তো।নানাভাইয়ের কিন্তু কোমড়ে ব্যাথা। তোমাকে কোলে নিতে পারব না।মাঝ রাস্তায় কান্নাকাটি করতে পারবে না কিন্তু।ঠিক আছে?”
—” আচ্ছা।চলো নামি।”

আফজাল সাহেব নাতনীকে নিয়ে নেমে যান রিকশা থেকে।অর্ধেক রাস্তার ভাড়া দিয়ে দেন রিকশাওয়ালাকে।তারপর ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করেন।এখানে মানুষ,ওখানে মানুষ।একদম মানুষে গাদাগাদি।এত মানুষ এইটুকু শহরে কি করতে যে আসে!আফজাল সাহেব নাতনীর ডানহাত শক্ত হাতে ধরেন।নাতনীর আগে-পিছে সাবধানী দৃষ্টি রাখেন।তার সাধের নাতনীর গায়ে যেন কেউ হাতও দিতে না পারে,সেদিকে কঠোরভাবে নজর দেন।ফুটপাতের পাশেই একটা ফেরিওয়ালা দেখে হাঁটা থামিয়ে দেয় মৃত্তিকা।তার কাছে অনেকগুলো বেলুন আছে।তিনটা বেলুন কিনলে কেমন হয়!

—” নানাভাই,বেলুন কিনে দেও।”
—” কোথায় বেলুন?”
—” ওই যে।”

মৃত্তিকার নজর অনুসরণ করে আফজাল সাহেব সেদিকে তাকান।তাদের থেকে অনেকটা দূরে একজন ফেরিওয়ালা।হরেক রকম বেলুন তার কাছে।আফজাল সাহেব নজর ঘুরিয়ে বলেনঃ” এখন না,মিত্তি।পরে কিনে দিব।লোকটা অনেক দূরে।”
—” দেও না, নানাভাই।তিনটা বেলুন লাগবে আমার।বেলুন না নিয়ে আমি যাব না।”

অগত্যা বেলুন কিনতে ছুটে যান আফজাল সাহেব।তিন বেলুনের হিসাব বুঝতে পেরেছেন।বেলুন কিনে আবারো রাস্তা ধরেন।ভালোয় ভালোয় হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলেই হয়।
আধ-ঘন্টার রাস্তা পাড়ি দিতে চল্লিশ মিনিট লাগলো।মৃত্তিকার পা ব্যাথায় টনটন করছে।সে বোধহয় জীবনে এতোটা হাঁটেনি।তবে তার মন খারাপ নয়।হাসপাতালের গেটে আসতেই মৃত্তিকার পায়ের শক্তি বেড়ে যায়।সে একছুটে নিচতলা পেড়িয়ে যায়।পিছন থেকে শোনা যায় আফজাল সাহেবের সাবধানী সুর।

—” নানু,আস্তে।”

মৃত্তিকার কি সেসব শোনার সময় আছে?সে কখন সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেছে!

—” আম্মু,আমি আসছি।”

মহুয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি।শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা। তবুও একটু উঠে বসার চেষ্টা করে।দু-হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কাছে ডাকে।মৃত্তিকা ঝাপিয়ে যেয়ে মায়ের বুকের উপর পড়ে।মা ছাড়া ঘুমনোর অভ্যাস নেই তার।অথচ,কালকে এই অপ্রিয় কাজটাই করতে হয়েছে।সে মায়ের উপর দিয়ে ওপাশে নজর দেয়।দুটো ঘুমন্ত পুতুল। কি সুন্দর মায়ের পাশে ঘুমিয়ে আছে। কখন এলো এরা? কাল রাতে?

—” আম্মু,এগুলা ভাইয়া বাবু?”
—” হুম।”
—” ওরা এত ছোট কেন?ওরা আমার মত বড় থাকতো।”
—” ওরাও বড় হবে।”
—” কবে?”
—“কয়েকদিনের মধ্যেই ইনশাআল্লাহ। তোর নানাভাই কোথায়?”
—” আসতেসে।আম্মু,ওরা কিভাবে আসলো?ওরা কোথায় ছিল?ওরা কি রাস্তা চিনে?”

মৃত্তিকা এখনো খুবই কৌতুহলী। যেকোনো জিনিস নিয়ে তার আগ্রহের শেষ নেই।পাখি কেন উড়ে,গাছ কেন হাঁটে না,আকাশ কেন শুধু নীল আর সাদা হয়,সূর্যের দিকে কেন তাকানো যায় না—এসব নিয়ে ওর প্রশ্নের শেষ নেই।মহুয়া মেয়ের মাথায় বিলি কেটে মৃদু হাসে।
—“ওদেরকে মার্কেট থেকে কিনে এনেছে তোর বাবা।”
—” কোন মার্কেট? ”
—” কি জানি।তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করিস।”
—” আব্বুর অনেক টাকা?এই দুইটা বাবু কিনতে অনেক টাকা লেগেছে না?”
—” হুম ”

আফজাল সাহেব বাইরে থেকে কেবিনের দরজায় নক করেন। এতোটা রাস্তা হাঁটার পর দুই তলার সিড়ি বাওয়া অনেক কষ্টের।দরজার আওয়াজ শুনে মহুয়া তাড়াতাড়ি করে শরীরে ওরনা টেনে দেয়।তারপর আস্তে করে বলেঃ” ভিতরে আসো, বাবা।”
আফজাল সাহেব ভিতরে ঢুকেন।চেয়ার টেনে মেয়ের বিছানার কাছে বসেন।মহুয়াও ততোক্ষণে উঠে বসার চেষ্টা করেছে।তা দেখে ধমক দেন আফজাল সাহেব।

—” উঠছিস কেন?উঠিস না, শুয়ে থাক।নাতীরা কি করে?”
—” ঘুমায় বাবা।”
—” কালকে রাতেই আসতে চেয়েছিলাম আমি।কিন্তু জামাই নিষেধ করলো।আবার, আমার সাথে মিত্তি আছে তাই আসতে পারলাম না।”
—” ঠিক করেছ।আমাকে রাতে কেবিনে দিয়েছে।তুমি তো আর থাকতে পারতে না।মিত্তিকে নিয়ে আরেক ঝামেলা হতো তখন।মিত্তি বিরক্ত করেছে কাল?”
—” না।তোকে হাসপাতালে নিয়ে আসার কথা শুনে একটু কেঁদেছে।আবার ভাইদের খবর শুনে থেমে গেছে।সমস্যা হয়নি।জামাই কই?”
—” মাকে বাড়িতে দিয়ে আসতে গেছে।আসার সময় খাবার নিয়ে আসবে।”
—“তুই সকাল থেকে না খাওয়া?”
—” না। মাল্টা খেয়েছি একটু আগে।ওখানে মাল্টা আছে।তুমি কেটে খাও।”

মৃত্তিকা মায়ের ওপাশে বসে ভাইদের দেখছে।কি সুন্দর দুটো পুতুল।একসাথে দুটো পুতুল কিনলো বাবা?কত দাম নিয়েছে এদের? কোটি কোটি টাকা?
কাল রাতে দুটো ছেলে হয়েছে মহুয়ার।অসমকোষী জমজ।বিয়ের তিন বছরের মাথায় দুটো প্রাণ এসেছে মহুয়া-তুষারের ঘরে।মহুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ছেলে-মেয়েদের দেখে।ঠোঁটের কোনে তার হাসি ফুটে উঠে। একটা টুকুনের শখ ছিল।আল্লাহ,এখন তিনটা দিয়েছে।

প্রায় একঘন্টা পর হাসপাতালে আসে তুষার।হাতভর্তি খাবার।নিজেরটাও এখানে নিয়ে এসেছে।বউ-বাচ্চার সাথে একসাথে খাবার খাবে।কালরাতে একটা ঝড় গেছে তার উপর দিয়ে।মহুয়ার একটু স্বাস্থ্যগত জটিলতা ছিল।তারউপর একজোড়া সন্তান।চিন্তায় গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।কালরাতে কয়েক ঘন্টায় যেই পরিমাণ আল্লাহকে ডেকেছে,সেই পরিমাণ শ্বাসও বোধহয় নেয়নি।তারপর ছেলে দুটোকে যখন কোলে নিল,তখন কি যেন হলো তার। চুমু আর চোখের পানিতে ভরিয়ে ফেললো সন্তানের মুখ।বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা নতুন নয়। কিন্তু এই দুটো সন্তান তো নতুন! প্রতিবার সন্তান কোলে নেওয়ার পরে বোধহয় একই অনুভূতি সব বাবার হয়।রাতে কেবিনে থাকতে পারেনি।সাবিনা বেগম,রুবিনা বেগম,মহুয়া ও বাচ্চারা ছিল।তাই তুষারের জায়গা হয়েছে হাসপাতালের মসজিদে।কখন আবার কি প্রয়োজন হয়–এই চিন্তায় সারাটা রাত সে ঘুমাতেই পারলো না।
তুষার কেবিনে ঢুকলো একরাশ ক্লান্তি নিয়ে। দুটো বিছানা আছে এখানে।ভাত খেয়ে এখন সে ঘুমাবে।আনন্দ,পরিতৃপ্তি এসব অনুভূতি মনকে সতেজ করে শরীরকে নয়।একটু না ঘুমালে সে আর পারবেই না।
তুষারকে একবার চোখ তুলে দেখলো মহুয়া।সারা শরীর ফুটে যেন ক্লান্তি বেরোচ্ছে।সে আস্তে আস্তে বসার চেষ্টা করতেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল তুষার।সযত্নে, সাবধানে বউকে বসালো।আফজাল সাহেব নেই এখানে।এতোক্ষণ কথা-বার্তা বলে বাইরে গেছেন।

—” মহুয়া,শরীর কেমন এখন?”
—” আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ঘুমিয়ে নিতেন একটু।পরে আসলেও তো চলতো।”
—” খাবারগুলো?”
—” আমি বাবাকে বলতাম একটু এনে দিতে।”
—” কাজ নেই আর।তোমার মনে হয়, তোমাকে হাসপাতালে রেখে আমি ঘরে ঘুমাব?”

মৃত্তিকা বাবাকে দেখে আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো।সে এখন কোনো শব্দ করছে না।যদি ভাইয়েরা উঠে যায়।আস্তে আস্তে তুষারের পিছনে যেয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো। বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললঃ”বাবা,ভাইদের দাম কত?কোন মার্কেট থেকে এনেছ ওদের?আমাকেও নিয়ে যেতে,আমি একটু দেখতাম।”

মেয়ের প্রশ্ন বুঝতে না পেরে স্ত্রীর দিকে তাকায় তুষার।তা দেখে হেসে ফেলে মহুয়া।গলায় কৌতুকের সুর ফুটিয়ে বললঃ” নিন বলুন।কোথা থেকে এনেছেন ওদের।আমি বলেছি,আপনি কিনে এনেছেন।”

মেয়েকে দুই হাতে কোলের কাছে নিয়ে আসে তুষার।দুই গালে চুমু দেয়।তারপর মেয়েকে কোলে বসিয়ে বলেঃ” ওদেরকে কিনতে টাকা লাগেনি,মা।আমি কাল রাতে হাসপাতালের দরজার কাছে যেয়ে দেখলাম, এই দুটো পুতুল মাটিতে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে।পরে ওদেরকে তুলে তোর মায়ের পাশে শুইয়ে দিয়েছি।ওদেরকে আল্লাহ পাঠিয়েছে।”
—” আম্মু যে বলল?”
—” তোর মা তো ঘুমিয়ে ছিল,জানবে কি করে?তুই ঘুমিয়ে থাকলে কিছু বুঝতে পারিস?”
—” উঁহু। ”
—” তোর মাও বুঝতে পারেনি।যা ভাইদের কাছে যেয়ে বসে থাক।নাস্তা খেয়েছিস সকালে?”
—” হ্যাঁ, নানাভাইয়ের সাথে খেয়েছি।আমি ভাইদের জন্য বেলুন এনেছি।ওরা খেলবে না?”
—” এখন না।ওরা ঘুম থেকে উঠলে খেলবে।”

মৃত্তিকা আবারো বাচ্চাদের কাছে যেয়ে বসে।কি সুন্দর মুখ হা করে ঘুমাচ্ছে দুজনে।ছোট্ট হাত,ছোট্ট পা,ছোট্ট পেট।ওরা খেলতে পারবে?এই ছোট্ট হাত দিয়ে বড় বেলুনগুলো ধরবে কি করে?
তুষার টিফিন বক্স থেকে মহুয়ার খাবার বের করে।নরম নরম ভাত সাথে কি একটা যেন ঝাল ছাড়া তরকারি। খাবার দেখেই মহুয়ার নাড়ী-ভুরি উল্টে আসে।এগুলো খেতে হবে?তুষার প্লেটে খাবার নিতেই সজোরে মাথা নাড়ায় মহুয়া।এগুলো কিছুতেই পেটে যেতে দেবে না।

—“মহুয়া,হা করো।”
—” অসম্ভব। এগুলো কিছুতেই খাব না।”
—” তাহলে সেই পাতলা পাতলা সাদা স্যুপ এনে দেই।ওগুলো খাবে?”
—” মোটেও না।আমি ঝাল তরকারি দিয়ে ভাত খাব।কাল রাত থেকে ভারী কিছু খাইনি। এগুলো পেটে গেলে নিশ্চিত বমি করে ভাসিয়ে ফেলব।”

মহুয়ার কথায় কান দেয় না তুষার। ঝাল তরকারি খাবে বললেই হলো।অপারেশনের পরে নরম খাবার খেতে হয়।এই মেয়ের মাথায় বুদ্ধি নেই নাকি?
এক লোকমা,দুই লোকমা জোর করে দিল তুষার।না খেলে শরীর ঠিক হবে?দু’বার জোর করে গিললেও, তৃতীয়বারের বেলায় আর সহ্য করতে পারলো না মহুয়া।বমি করে নিজের শরীরসহ তুষারের শরীরের একাংশ ভাসিয়ে ফেললো।

***

বাচ্চা দুটোর নাম রাখা হলো সাত দিনের দিন।চুল ফেলে,আকিকা দিয়ে নাম রাখলো।একজনের নাম মৃন্ময় আরেকজনের নাম তমাল।ভাইদের চুল ফেলতে দেখে মৃত্তিকারও সাধ জাগলো,সেও চুল ফেলবে।রুবিনা বেগম ফেলে দিলেন মৃত্তিকার চুল।সবাই যখন বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত,মৃত্তিকা তখন দৌড়ে বারান্দায় চলে গেল।মায়ের মত তারও এই জায়গাটা খুব প্রিয়।মৃত্তিকা বারান্দার গ্রিলে হেলান দিয়ে সামনের বারান্দার দিকে নজর দিল।কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখতে পেল না।তাই হাঁসের মত গলা বাড়িয়ে ডাক দিল।

—” আংকেল,আংকেল।”

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো আবরার।সে যেন অপেক্ষাতেই ছিল।ঘর থেকে বারান্দায় এসে আবরারও হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।মৃত্তিকাকে দেখে হেসে ফেললো সে।

—” কি অবস্থা মা তোমার?চুল ফেলে দিয়েছো যে?”
—” ভাইয়েরা ফেলেছে, তাই।তুমি ভালো আছ?”
—” হুম।কবে এসেছ তুমি?”
—” কালকে রাতে।আমরা নানু বাড়ি ছিলাম এতোদিন।জানো আমাকে দুটো ভাই দিয়েছে আল্লাহ।ওরা এইটুকু।—” হাত দিয়ে ভাইদের আকার দেখায় মৃত্তিকা।
—” নাম কী ওদের?”
—” তমাল,মিনময়।”—মৃন্ময়ের নাম সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না মৃত্তিকা।
—” ওরা কার মতো হয়েছে?”
—” আম্মু বলেছে আমার মত।তুমি আমাদের বাসায় আসো। দেখে যাও ভাইদেরকে।”
—” অন্য একদিন আসব।”
—” তুমি থাকো আংকেল।আমি ভাইদের কাছে যাই।”

মৃত্তিকা দৌড়ে চলে যায়।আবরার ওদিকে তাকিয়েই থাকে।ওই বাড়ির তুষার ও মৃত্তিকার সাথে ওর কথা হয়।মৃত্তিকার সাথে আবার তার খুব ভাব।নিজের বাড়ির সাথে ও বাড়ির তুলনা করে আবরার।এটা যেন পাতালপুরী।এক আবরার ছাড়া এখানে আর কেউ নেই।পুরো ঘরে নিস্তব্ধতায় মোড়ানো। আবরার বারান্দার ফ্লোরে বসে পড়ে।নিজের জীবনের জমা-খরচ তুলে ধরে সামনে।কি করলো জীবনে?কি পেল আর কি হারালো।অনন্যার সাথে বিচ্ছেদের বয়স বোধহয় এক বছর হয়ে গেছে।অনন্যা প্রথম প্রেম ছিল।আবরারের দুর্বলতা ছিল।অথচ,একদিনের বোঝাপড়ায় সব শেষ।অনন্যা যতই নিজের চারপাশে ব্যস্ততার শক্ত প্রাচীর গড়ে তুলতে লাগলো,আবরার ততোই হাঁপিয়ে উঠতে শুরু করলো।প্রায়ই নিজের মনে প্রশ্ন করতো সে।এভাবে কি সম্ভব? আদোও কি এভাবে দু-প্রান্তে দুটো মানুষ দূরে দূরে থাকা সম্ভব?আবরারের অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল যখন তার অন্তরঙ্গ বন্ধু রাফির একটা ছেলে হলো।রাফি কি সুন্দর করে সন্তানকে আদর করতো,চুমু দিত,কোলে নিত! এসব দেখে আবরারের ভিতরটা একদম পুড়ে যেত।তারপর বাড়িতেও আরেক জ্বালা।পাশাপাশি রুম হওয়ায় মৃত্তিকার কথা একদম স্পষ্ট শোনা যেত ঘর থেকে।মেয়েটা সুন্দর করে আধো আধো বুলিতে বাবাকে ডাকতো,মাকে ডাকতো।আবরার যেন আরো পাগল হয়ে গেল।মানুষের জীবনে বোধহয় একটা সময় আসে,যখন রমনীর রূপ-লাবন্যের চাইতে শিশুর কোমলতার প্রতি বেশি বেশি আকর্ষণ কাজ করে।রমনীর প্রনয়গাঁথার চাইতে শিশুর অর্থহীন কথার প্রতি বেশি ভালোলাগা কাজ করে।আবরারের ঠিক সেটাই হলো।পিতৃত্বের স্বাদ তার চাই।যেভাবেই হোক তার ঘরেও একটা নিষ্পাপ শিশু চাই।কিন্তু বেকে বসলো অনন্যা।বাচ্চা সামলালে ক্যারিয়ার?বাচ্চা পালতে সময়ের দরকার।এতো সময় তার কোথায়?বাচ্চা সামলাতে গেলে ক্যারিয়ারে সময় দিতে পারবে না।ফলস্বরূপ এতোদিনের অর্জন সব শেষ।তিলে তিলে গড়ে তোলা সব অর্জনকে গলা টিপে মেরে ফেলা অসম্ভব।এই মতবিরোধের ইতি টানলো আবরার।এ বোধহয় সেই গত বছরের কথা।আবরারের রাগের ছিলি খুলে গেল যেন।আবরার রাগারাগি করলো, মুক্তি চাইলো,অনন্যাও দিয়ে দিল।যেখানে সম্মান নেই, সেখানে ভালোবাসাও থাকতে পারে না।ভালোবাসার মানুষটাই যদি বদলে যায়,তবে সকল অনুভূতি সেখানে ফিকে হয়ে যায়। আবরার মুখ ঘুরিয়ে নিলো,অনন্যাও আড়ি নিয়ে চলে গেল।সেই থেকে আবরার নিঃস্ব।জীবন যাত্রায় হারানোর সূচনা মহুয়াকে দিয়ে।মহুয়াকে হারিয়ে অনুশোচনা হতো।খুব খারাপ লাগতো,যখন একা একা ওর কথা ভাবতো।মহুয়ার পরে গেল মা।আবরারের মা ভীষণ অভিমানী। যেদিন মহুয়ার সাথে আবরারের ডিভোর্স হয়ে গেল,সেদিন মাও এবাড়ি ছেড়ে চলে।আবরার কুলাঙ্গার। এই কুলাঙ্গারের সাথে এক বাড়িতে আর কিছুতেই না।এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর একমাসও পৃথিবীতে ছিলেন না বিলকিস বেগম।এককালের মা ভক্ত আবরারের ভাগ্যে মায়ের লাশের খাট ধরার সৌভাগ্য হয়নি।কারণ,সে তখন অনন্যাকে নিয়ে সিলেটে ছিল মধুচন্দ্রিমা উপলক্ষে।সবশেষে চলে গেল অনন্যা।এ নিয়ে আফসোস নেই আবরারের।কাপুরুষেরা অন্যের ঘাড়ে অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে শান্তি পায়।আবরার বোধহয় সেই শ্রেণির। নিজের করা কর্মের জন্য যখন তার অনুতাপ হয়,অনুশোচনায় ভিতরটা মরে যায়;তখন সে অনন্যার উপর দোষ চাপিয়ে শান্তি পায়।তার কি দোষ?সে তো তুলসি পাতা ছিল।মহুয়ার সাথে ভালো ছিল।সে কি কখনো মহুয়াকে ছাড়তো?সব সেই অনন্যার দোষ।বেহায়া মেয়ে! আবরার বিবাহিত জানার পরেও কত পাগলামি করেছে।সব সেই অনুরই দোষ।তবুও ভিতরে শান্তি পায় না আবরার।অনুশোচনা, অনুতাপ,আফসোস —এগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর নীরব শাস্তি।যে একবার এই শাস্তি পায়,সে আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।কত অদ্ভুত বিষয়! যেই বারান্দায় বসে মহুয়া একটা টুকুনের স্বপ্ন দেখতো,আজ সেই একই বারান্দায় বসে আবরার মহুয়ার সাজানো সংসারে উঁকি দিয়ে দেখে।তার সবটা জুড়েই একটানা বিষাদ সুর বাজে—” তিনটে টুকুন আজ আমারো থাকতে পারতো।কিন্তু থাকলো না,আর হয়তো থাকবেও না।”

***

চুলের মাঝখানে সিঁথি করলো মহুয়া।ঘাড়ে ফালিয়ে একটা খোপা করলো।শাড়ির আঁচল টেনে সুন্দর করে কাঁধে ফেললো।বহুদিন পরে চোখে মোটা করে কাজলের রেখা টানলো।মাথার খোপায় গুজে দিল একটা কাঠগোলাপ।এটা তার গাছের ফুল।একটাই হয়েছে এই মাসে।মৃত্তিকার জন্য গাছে ফুল রাখা যায় না।সে দেখলেই ছিঁড়ে ফেলে।লিপস্টিক হাতে নিয়েও আবার রেখে দিল মহুয়া। এই একটা জিনিস তুষার পছন্দ করে না।তাই ঠোঁটে কিছুই দিল না সে।মহুয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে।আজ কতদিন পর শাড়ি পরলো।বাচ্চারা ছোট বলে এখন আর শাড়ি পরা হয় না।মহুয়ার স্বাস্থ্য একটু ভারী হয়েছে আগের থেকে।বয়স যে ত্রিশের কোঠায় পৌঁছে গেছে তা,এখন চেহারা দেখলেই বুঝা যায়।খাটের কাছে যেয়ে ছেলে-মেয়েদের দিকে নজর দেয়।তিনজন ঘুমাচ্ছে।ছেলেগুলোর বয়স দুই মাস।এই বয়সেই ভয়াবহ বিরক্ত করে মহুয়াকে।এটাকে ধরলে ওটা ছুটে যায়,ওটাকে ধরলে এটা ছুটে যায়।মহুয়া মশারী টাঙিয়ে ঘরের বাতি বন্ধ করে দেয়।নাহয় বাচ্চারা উঠে যাবে।অন্ধকার রাতে ঘরের বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ায় মহুয়া।তার বারান্দায় এখন অনেক গাছ।বাগান বিলাসী লতা,কাঠগোলাপ,হাসনাহেনা,টাইম ফুল,একটা মরিচ গাছ,ক্যাকটাস, পুঁই লতা আর এককোনে একটা নয়নতারা গাছ।একটা ময়না পাখির খালি খাচাও আছে একপাশে।মাস কয়েক আগে ময়না পাখিটা মরে গেছে।বাচ্চারা ছোট বলে আরেকটা আনা হয়নি।আশেপাশে বাতাস আছে তবে বোধহয় বৃষ্টি হবে না।মহুয়া শুনেছে আকাশে চাঁদ-তারা থাকলে নাকি বৃষ্টি হয় না।এর সত্যতা কতটুকু জানে না সে।মহুয়া প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়।আসার সময় ঘরিতে দেখেছে বারোটা দশ বাজে।আজ একটা বিশেষ দিন।আর মহুয়া এই রাতদুপুরে সুন্দর করে সেজে একটা জ্ঞানহীন মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে।
মহুয়ার অপেক্ষার পালাকে আরো দশমিনিট দীর্ঘ করলো তুষার।বারোটা বিশের দিকে সে বারান্দায় পা দেয়।আস্তে-ধীরে পা ফেলে মহুয়ার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়।মহুয়াকে নিজের দিকে ফিরিয়ে মৃদু হেসে বলেঃ”শুভ বিবাহ বার্ষিকী।চতুর্থ বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে আপনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।”
—“এতোক্ষণে?”
—” হ্যাঁ, দিন তো আর চলে যায়নি।”
—” সেটাই।”—মহুয়ার গলায় তীব্র অভিমানের সুর।

তুষার একবার মুখ বাকিয়ে কিছু একটা ভাবে।তারপর পকেট থেকে এক গুচ্ছ টকটকে লাল ফুল বের করে মহুয়ার সামনে ধরে।অন্ধকারেও ফুলগুলো চিনতে অসুবিধা হয় না মহুয়ার। তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। এই ফুলগুলো তার খুব পছন্দ।কিন্তু সচরাচর এর দেখা মিলে না।ফুলগুলো হাতে নিয়ে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠে সে।

—” বাহ,খুব সুন্দর তো! কোথায় পেলেন?”
—” গাছ থেকে এনেছি।অবশ্য আমি নিজে গাছে উঠিনি,আরেকজনকে উঠিয়েছি। আজব পছন্দ তোমার।শিমুল তুলা গাছের ফুল আবার কারো প্রিয় হয়?কোনো গন্ধ নেই শুধু সৌন্দর্য। ”
—” আপনি ফুলের রঙ দেখেছেন।কি দারুন!”

মহুয়ার নজর যায় তুষারের পাঞ্জাবির দিকে।সাদা পাঞ্জাবির বুকের কাছে কালো সুতার কাজ।কাজটুকু অসমাপ্ত। মহুয়া নিজেই বানিয়েছে এটা।প্রতিবছর বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে নিজের হাতে তুষারের জন্য একটা পাঞ্জাবি বানায়।এবার অর্ধেক করার পর আর সময় পায়নি।তাই বুকের কাছে কাজটুকু এখনো অসমাপ্ত।তুষার আরো একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় মহুয়ার সাথে।

—” এইভাবে তাকায় থাক কেন?নজর লাগবে তো?”
—” আমি আপনার পাঞ্জাবি দেখছিলাম।এটা না পরলেই পারতেন।শেষ হয়নি এখনো।”
—” না শেষ হোক।আমার এটাই ভালো লাগে।তোমার চুলে এইটা কি ফুল?কাঠগোলাপ?”
—” হুম।”
তুষার দু-হাতের আজলায় মহুয়ার মুখ তুলে নেয়।অন্ধকারেই খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে প্রেয়সীর মুখ।আগে যেমন লাগতো এখনো তেমনি লাগে।তুষার ফিসফিস করে বলেঃ” ভালোবাসি মহুয়া।কি চাও এবার?”
—” পাহাড়ে নিয়ে যাবেন।”
—” এবারেও?”
—” হুম।”
—” আচ্ছা মহুয়া,তুমি কি সুখী?”
—” জীবন একটা পথের মতো,মিত্তির বাবা।আমরা সবাই তার যাত্রী।যাত্রাপথে যে যেই বাধার সম্মুখীনই হোক না কেন,যাত্রাশেষে সবাই সুখী হয়।তবে একশ্রেণির মানুষ বাদে।যাদের ভাগ্যে কর্মফল অথবা রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার, এই দুটো ভারী শব্দ জুটে যায়।তাদের জীবনটাই চলে যায় অতীতের জমা-খরচ বিশ্লেষণ করতে করতে।বুঝলেন?”
—” সবার কথা বাদ দেও।শুধু নিজের কথা বলো।”
মহুয়া মৃদু শ্বাস ছাড়ে।
—” সাহিত্যের ছাত্ররা প্রেমিক হিসাবেও উপযুক্ত নয়, স্বামী হিসাবেও উপযুক্ত নয়।এদেরকে সব কথা কথা ভেঙে বলতে হয়।আপনি বুঝেন না আমি সুখী নাকি না?
তুষার কিছুই বলে না শুধু মুচকি হাসে।প্রেয়সীর কপালের মাঝ বরাবর উষ্ণ চুমু এঁকে দেয়।নিস্তব্ধ রাতের দূর আকাশের জ্বলজ্বলে নক্ষত্ররা এর নীরব সাক্ষী হয়ে রইলো।

(সমাপ্ত)

(অনভিজ্ঞ, অপটু হাতের লেখা।তবুও যারা সাথে ছিলেন, তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here