যেদিন তুমি এসেছিল পর্ব-১৩ ১৪

0
4818

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_১৩+১৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
গুমোট অন্ধকার আকাশ। সারি সারি কালো মেঘের ছড়াছড়িতে নীল-শুভ্র আকাশের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গেছে। ভারী বর্ষণের প্রস্তুতি বোঝা যাচ্ছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ায় একদিকে যেমন আনন্দ হচ্ছে অন্যদিকে কেমন যেন একটু কষ্টও লাগছে। কলেজ লাইফটাকে ভীষণ মিস করবে অর্ষা। মিস করবে তার প্রিয় গ্যাঞ্জাম পার্টিকে। ভার্সিটিতে কি সবাই একসাথেই পড়তে পারবে? হয়তো সেটা হবে না। কে যে কোথায় চলে যাবে কে জানে!

থাইগ্লাসে বিন্দু বিন্দু জল এসে জমা হয়েছে। আনমনে ব্যাগ গোছাচ্ছিল অর্ষা। দৃষ্টি জানালার দিকে যেতেই এক সাইড খুলে দেয়। বড়ো বড়ো ফোঁটায় গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ভেতর থেকে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। জানালাটা লাগিয়ে দিয়ে আবারও কাপড় গোছানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজই সে নিজেদের বাসায় চলে যাবে। রুহুল আমিন অর্ষাকে নিতে এসেছে মিনিট পাঁচেক হবে। বসার ঘরে বসে আমেনা বেগমের সাথে গল্প করছে এখন।

ব্যাগ গুছিয়ে অর্ষা নিজে রেডি হতে যায়। হিজাব বাঁধতে গিয়ে আয়নায় নিজেকে একবার পরখ করে নেয়। সময়গুলো কীভাবে যেন পানির স্রোতের মতো বয়ে গেল। সে একটু টেরও পেল না। ভালো সময়গুলো বোধ হয় এমনই হয়। বেশিক্ষণ থাকলেও মনে হয়, অনেক কম! আরেকটু সময় থাকলে ভালো হতো। এসব ভাবতে ভাবতেই তার ঠোঁট হালকা প্রসারিত হয়। আচমকা খেয়াল করে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আহিল।

অর্ষা মৃদু হেসে বলল,’ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়।’

‘বসার ঘরে তোর ভাইকে দেখলাম। তুইও রেডি হচ্ছিস। চলে যাবি নাকি আজই?’

হিজাবে পিন সেট করতে করতে অর্ষা প্রত্যুত্তর করল,’হুম।’

‘আশ্চর্য! মাত্র গতকাল পরীক্ষা শেষ হলো। আর আজই চলে যাচ্ছিস? কাল তো বললিও না আমায়।’

‘আরে আমিই তো জানতাম না। একটু আগে ভাইয়া এসে বলল রেডি হতে।’

‘এসেছে ভালো হয়েছে। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে চলে যাবে। তুই কোথাও যাবি না। আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলছি।’

‘মানে কী?’

‘মানে তুই আরো কয়েকটা দিন এই বাড়িতেই থাকবি। গ্যাঞ্জাম পার্টির সকলে মিলে আমরা ঘুরতে যাব।’

কথা শেষ করে আহিল বসার ঘরের দিকেই যাচ্ছিল; অর্ষা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পিছু ডেকে বলল,’শোন, শোন!’

আহিল দাঁড়ায়। পিছু ঘুরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

অর্ষা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে,’বাড়িতে ভাবির অনেক কষ্ট হয়ে যায়। তিয়াস তো ছোটো। ও’কে সামলানো আবার বাড়ির কাজ! বুঝিসই তো।’

আহিল বিরক্ত হয়ে বলে,’তুই বাড়ির কাজের লোক নাকি?’

‘এ কথা বলছিস কেন? ওটা আমারও তো বাড়ি।’

‘তোকে বাড়ির লোক বলে তো গণ্য করে না তারা।’

‘তুই এত ক্ষ্যাপা কেন আমার পরিবারের ওপর?’

‘উত্তরটাও তোর খুব ভালো করেই জানা আছে।’

‘যা হোক, তুই ভাইয়াকে কিছু বলিস না। অনেকদিনই তো থাকলাম। আর কত? তাছাড়া ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারেও কোনো সমস্যা নেই। কবে, কোথায় যাবি আমাকে জানিয়ে দিস তাহলেই তো হলো।’

‘তার মানে তুই যাবিই?’

অর্ষা অসহায় দৃষ্টিতে আহিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। আহিলও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্তকণ্ঠে বলল,’ঠিক আছে। সাবধানে যাস।’

অর্ষার ঠোঁট প্রসারিত হলো। আহিল যে রাগ করেনি এটাই অনেক! সে খুশি হয়ে বলল,’থ্যাঙ্কিউ দোস্ত।’

প্রত্যুত্তরে আহিল হালকা হেসে ড্রয়িংরুমে চলে যায়। অর্ষারও তৈরি হওয়া শেষ। তাই সে ব্যাগ নিয়ে বসার ঘরে যায়।

রুহুল আমিনের উদ্দেশ্যে বলে,’ভাইয়া চলো।’

রুহুল উত্তর দেওয়ার আগেই আমেনা বেগম বললেন,’চলো আবার কী? সকালে না খেয়েই যাবে নাকি?’

‘এখন ক্ষুধা নেই আন্টি।’ বলল অর্ষা।

‘আমি সেসব শুনছি না। খেয়ে তারপরই যেতে হবে। রুহুল তুমিও আসো।’

অগত্যা অর্ষা ও রুহুলকে খেতে বসতে হলো। জহির চৌধুরী আরো আগেই অফিসে চলে গেছেন। আমেনা বেগমও তার সাথেই সকালের নাস্তা করে নিয়েছেন। এখন শুধু অর্ষা, আহিল আর রুহুল খাচ্ছে। রেণুও আরো সকালেই খেয়ে নিয়েছে। খেতে খেতে আমেনা বেগম আর রুহুল গল্প করছে। অর্ষা এবং আহিল নিশ্চুপ হয়ে খাচ্ছিল আর ওদের গল্প শুনছিল।

খাওয়ার পাট চুকিয়ে অর্ষা বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে রিকশায় উঠে বসে। অনেকদিন এখানে থাকায় মায়া জন্মে গেছে বিধায় এখন বেশ খারাপও লাগছে। বাড়িতে পৌঁছে ভেতরে যেতেই তিয়াস ‘ফুপি, ফুপি’ বলে দৌঁড়ে আসে।

অর্ষা হাত বাড়িয়ে তিয়াসকে কোলে তুলে নেয়। গালে, মুখে চুমু দিয়ে আদর করে। তিয়াসও অর্ষার গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখে। দেখে মনে হচ্ছে কত শান্তশিষ্ট! কিন্তু তিয়াস ভীষণ চঞ্চল প্রকৃতির ছেলে।

কুসুম বারান্দায় বসে সিলিন্ডারে গ্যাসের চুলায় রান্না করছিল। তিয়াসকে কোলে নিয়েই অর্ষা কুসুমের কাছে যায়। জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো ভাবি?’

কুসুমের মুখ অন্ধকার। সে চোখমুখ কালো করেই বলল,’ভালো।’

একটু থেমে ফের বললেন,’আসলি কেন? ওখানেই পার্মানেন্টলি থেকে যেতি। নবাব-নন্দিনী হয়ে গেছিস না তুই!’

অর্ষা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা। বাড়ি ফেরার যেই আনন্দটুকু সাথে করে নিয়ে এসেছিল, তা এখন কুসুমের তিরস্কারে নষ্ট হয়ে গেছে।

তিয়াস ওর মায়ের রাগের প্রতিবাদ করে বলল,’ফুপিলে বকবা না। মালব তোমালে।’

অর্ষার প্রতি ছেলের এত দরদও কুসুমের সহ্য হয় না। রুহুল এই পর্যায়ে কুসুমকে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,’থামবে তুমি?’

এরপর অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,’তিয়াসকে আমার কোলে দে। তুই ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হ।’

অর্ষা কোনো বাক্যব্যয় করল না। তিয়াসকে ভাইয়ের কাছে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে ভেতরে চলে গেল। কুসুম বেশ জোরে জোরেই অর্ষাকে শুনিয়ে রুহুলকে বলছিল,’এতদিন তো পরীক্ষা শেষ হোক, শেষ হোক বলে বোনকে আহ্লাদ দিয়ে রেখেছিলে। এখন তো পরীক্ষা শেষ। আর বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না বলে দিলাম। এবার নিজের রাস্তা নিজেকে দেখতে বলো। হয় চাকুরীবাকরি কিছু করতে বলো; নয়তো বিয়েশাদী দিয়ে দাও। অনেক করেছে আরাম-আয়েশ।’

রুহুল কিছু বলেছে কিনা অর্ষা শোনেনি। তবে কুসুমের কথা শুনেই তার চোখ ফেটে অশ্রু নির্গত হয়। ভাই-ভাবির সংসারে বুঝি সে এত বেশি হয়ে গেছে? হাতের উলটোপিঠে চোখ মুছে নেয় সে। কুসুম না বললেও সে চাকরী করত এবার। কারও গলগ্রহ হয়ে থাকার ইচ্ছে তারও নেই।

ফ্রেশ হয়ে অর্ষা বারান্দায় আসে ফের। কুসুমকে বলে,’তুমি ওঠো। আমি রান্না করছি।’

কুসুম কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। এরপর উঠে চলে যায় ঘরে। তিয়াসকে সাথে নিতে চেয়েছিল কিন্তু তিয়াস যায়নি। রান্না করতে করতে তিয়াসের সাথে দুষ্টুমি করছিল অর্ষা। তিয়াসের সুড়সুড়ি অনেক বেশি। একটু সুড়সুড়ি দিলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। অর্ধেক রান্না কুসুমই করে ফেলেছিল। তাই অর্ষার রান্না শেষ করতে বেশি সময় লাগল না। ভাত, তরকারি সব ঘরে রেখে এসে বারান্দা আর উঠান সুন্দর করে ঝাড়ু দিলো। এরপর তিয়াসকে গোসল করিয়ে, মাথায় তেল, শরীরে লোশন দিয়ে খাইয়ে দিয়েছিল। কুসুমের কাছে দিয়ে আসার পরও তিয়াস থাকবে না। আজ ছাড়ছেই না সে অর্ষাকে। কুসুম বিরক্তিকর দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ষার দৃষ্টি অসহায়।

কুসুম ছেলের রাগ অর্ষাকে দেখাল। জোরে ধমক দিয়ে বলল,’কাঁদাচ্ছিস কেন? দেখছিস থাকতে চাচ্ছে না এখানে, তবুও জোর করছিস। এখন ওর ঘুমানোর সময়। ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যাস।’

অর্ষা কিছু বলল না। তিয়াসকে কোলে করে বাইরে বেরিয়ে এলো। তিয়াসের মাথা ওর কাঁধে রেখে পিঠে হালকা চাপড় দিতে দিতে ছড়া বলছে অর্ষা। বারান্দায় আর উঠানে হাঁটাহাঁটি করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। সেই সময়ে লামিয়া আর জুঁই এসে বাড়িতে উপস্থিত হয়।

ওরা চেঁচাবেই তার আগেই অর্ষা ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে ইশারায় চুপ করতে বলল। ফিসফিস করে বলল,’তিয়াস ঘুমাচ্ছে।’

ওরা-ও সাবধান হয়ে যায়। ফিসফিস করেই বলল,’বাড়িতে যে চলে আসবি জানাসনি কেন?’

‘আমিই জানতাম না।’

‘ছাই! আহিলও বাসায় নেই। ঐ বাড়িতে গিয়ে তোদের না পেয়ে ভাবলাম, পালিয়ে গেলি নাকি আবার! পরে রেণু আপু বলল তুই চলে এসেছিস। আর আহিল কোথায় গেছে জানে না। ফোন দিলাম কোনো রেসপন্স নাই।’ কথাগুলো বলল জুঁই।

অর্ষা মৃদু ধমকেরসুরে বলল,’থা’প্পড় খাবি। পালাব কেন আমরা? আমাদের মধ্যে অন্য কোনো সম্পর্ক নাই।’

‘আরে ভাই! মজা করছি। রাগ করিস না জানু।’

লামিয়া অর্ষার এক হাত ধরে বলল,’বাদ দে তো এসব। জরুরী একটা খবর দিতে এসেছি। কাল আমরা গ্যাঞ্জাম পার্টি মিলে ঘুরতে যাচ্ছি। সাথে নিহাল আর সুবাস ভাইয়াও যাবে।’

‘তোরা কাপলরা যাবি যা। মাঝখান থেকে আমাদের কেন কাবাব মে হাড্ডি বানাচ্ছিস?’

লামিয়া মুখটা একটুখানি করে বলল,’এটা কোনো কথা বললি বোকারানী? এর আগেও তো আমরা রেস্টুরেন্টে কত দেখা করেছি। আমি কি তোদের চেয়ে ও’কে বেশি সময় দিয়েছি বল? প্লিজ! তুই না করিস না। তুই বেঁকে গেলে গ্যাঞ্জাম পার্টির বাকি কেউই যাবে না।’

লামিয়ার সাথে জুঁইও অনুরোধ করে বলল,’প্লিজ! প্লিজ! সোনাপাখি না করিস না।’

ওদের বাচ্চামো দেখে অর্ষা হেসে ফেলে। বলে,’আচ্ছা ঠিক আছে যাব।’

ওরা খুশি হয়ে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে। তিয়াস নড়েচড়ে উঠতেই অর্ষাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,’তুই সকালে রেডি হয়ে থাকিস। আমরা দশটায় মাইক্রো নিয়ে আসব। তোকে বাড়ি থেকেই পিক করব।’

‘আচ্ছা।’

‘এখন তাহলে যাই। কাল দেখা হবে।’

‘বসবি না?’

‘না রে। নিহালের সাথে দেখা করতে হবে।’

অর্ষা হেসে বলল,’আচ্ছা। সাবধানে যাস।’
.
.
রাতে ঘুমানোর সময় কেয়াকে চাকরীর ব্যাপারে বলল অর্ষা। কেয়া কাৎ হয়ে শুয়ে বলল,’একটা শো-রুমে লোক নেবে একজন। কিন্তু সমস্যা হলো মালিকের বউ খুব দজ্জাল স্বভাবের।’

অর্ষা হেসে বলে,’তাতে কী? কাজ ঠিকঠাকভাবে করলেই তো হলো।’

‘পারবি তুই?’

‘পারতে হবে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তাহলে গিয়ে কথা বলব। এখন ঘুমা।’

‘আচ্ছা।’

সকালে ভোরের দিকেই অর্ষার ঘুম ভাঙে। ফজরের নামাজ পড়ে চুলায় ভাত বসিয়ে দেয়। তরকারি কেটে বারান্দা, উঠান সব ঝাড়ু দেয়। রান্নাবান্না শেষ করে থালাবাসন ধুয়ে ফেলে। এই বাড়িতে কেউ তেমন চা খায় না বলে, সকালে চা বানানোর বাড়তি ঝামেলাটা নেই। কেয়া আর রুহুল খেয়ে-দেয়ে কাজে চলে যায়। কুসুম নিজের ঘরেই খায়। অর্ষাও খেয়ে-দেয়ে সবকিছু গোছগাছ করে রাখে ঘুরতে যাবে বলে। যাওয়ার সময় তো বলে গেছিল দশটার দিকে আসবে। এখনো হাতে সময় আছে তাই ময়লা কিছু কাপড়-চোপড় সাবান দিয়ে ভিজিয়ে ধুয়ে শুকাতে দেয়। কাপড় ধুতে গিয়ে নিজেও অনেকটা ভিজে গেছে তাই গোসলটাও সেরে ফেলে। কখন ফিরবে আজ তারও তো ঠিক নেই।

বোরকা পরে হিজাব বাঁধছিল তখন তিয়াসকে কোলে নিয়ে কুসুম আসে ঘরে। জিজ্ঞেস করে,’রেডি হচ্ছিস যে? কোথাও যাচ্ছিস?’

‘তোমাকে কাল বললাম না? সবাই মিলে ঘুরতে যাব।’

কুসুম একটুখানি সময় চুপ করে থেকে বলল,’যাওয়া লাগবে না আজ ঘুরতে। কেয়া ফোন করেছিল। শো-রুমের মালিকের সাথে কথা বলেছে। তারা আজই যেতে বলেছে।’

অর্ষা আহত হয়। বিমর্ষ হয়ে বলে,’ভাবি কাল থেকে যাই প্লিজ? ওরা অনেক আশা নিয়ে আসবে। আমি না গেলে নিরাশ হবে।’

কুসুমের মেজাজ গরম হয়। সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে,’তোর মামার বাড়ি নাকি ঐটা যে যখন মন চায় তখন যাবি! চাকরী কি তোর চেহারা দেখে দেবে? আজ না গেলে যখন অন্য কাউকে নিয়ে নেবে তখন? আবার বসে থাকবি নতুন চাকরীর জন্য। বসে বসে গিলবি। ঐ আশা বাদ দে। আর তোর বন্ধুরা যে নিরাশ হবে বললি, ওদের নিরাশ হওয়ায় আমার কী? ওরা তোকে খাওয়ায়? নাকি পড়ায়?’

অর্ষার বলার মতো কিছুই নেই। আবার চাইলে হয়তো অনেক কিছুই বলতে পারে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ে থাকছে, খাচ্ছে তাদের মুখের ওপর বলবেই বা কী? এ কথাও তো সত্য, চাকরীটা তার খুবই প্রয়োজন!

কুসুম কড়াকণ্ঠে বলল,’কোনো রকম কান্নাকাটি ছাড়া এখনই যাবি।’ বলে বিশ টাকার নোট গুঁজে দিলো হাতে।

অর্ষা তাই করল। হিজাব বাঁধা শেষ করে কেয়ার শো-রুমে চলে গেল। পথিমধ্যে হাতের উলটোপিঠে এতক্ষণ যাবৎ লুকিয়ে রাখা অশ্রু কণাগুলো মুছে নিল।
________
আহনাফ জগিং করে বাড়িতে ফিরে এসে ক্যাথিওনকে গার্ডেনে পায়। লেজ গুটিয়ে বসে ছিল। আহনাফকে দেখেই দৌঁড়ে কাছে চলে যায়। ক্যাথিকে কোলে তুলে মাথা চুলকে দেয় আহনাফ।

ভেতরে গিয়ে ক্যাথিকে ড্রয়িংরুমে রেখে গোসল করে রেডি হয়ে আসে। ডাইনিংরুমে গিয়ে ক্যাথিকে ওর খাবার দিয়ে নিজের খাবার খেয়ে নেয় আহনাফ। বাইরে যাওয়ার আগে ক্যাথিকে আদর করে বলে,’দুষ্টুমি করবি না। বাসার কোনো জিনিস কিন্তু এলোমেলো করবি না বলে দিলাম।’

ক্যাথি চোখ দুটো পিটপিট করে তাকাল। এর অর্থ হচ্ছে সে আহনাফের কথা রাখবে। আহনাফও হেসে দরজা বাইরে থেকে লক করে অফিসে চলে যায়। সুইজারল্যান্ড এসেছে অনেকদিন। কিন্তু মনটা মনে হয় সেই বাংলাদেশেই রেখেছে। এর আগে তো অনেকবার তাকে বাংলাদেশে যেতে হয়েছে; আবার দরকার শেষে সুইজারল্যান্ডে ফিরেও আসতে হয়েছে। কখনো তো এমন হয়নি।

অফিসে গিয়ে সে মাকে ফোন করে। বেশ কিছুক্ষণ মায়ের সাথে কথা বলে অফিসের কাজে মনোনিবেশ করে।
দুপুরের লাঞ্চ টাইমে বাংলাদেশ থেকে হোয়াটসএপে ভিডিয়ো কল করে ইমরান।

আহনাফ খেতে খেতেই বাম হাতে ফোন রিসিভ করে বলে,’কী অবস্থা? হঠাৎ কী মনে করে?’

ওপাশ থেকে ইমরান বলল,’খাচ্ছিস নাকি? পরে ফোন করব?’

‘আরে না। সমস্যা নাই বল।’

‘কেমন আছিস?’

‘আল্লাহ্ রেখেছে ভালো, আলহামদুলিল্লাহ। তোর কী খবর বল?’

‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো আছি। ফোন করেছি একটা দরকারে।’

‘তা আমি জানি। নয়তো গার্লফ্রেন্ডকে কল না দিয়ে কি ইমরান আমায় কল করে?’ কথা শেষ করে আহনাফ মুচকি হাসে।

ইমরানও হেসে বলে,’লজ্জা দিস না তো!’

‘আচ্ছা বল কী দরকার?’

‘আগামীকাল গার্লফ্রেন্ডের জন্মদিন। তো ও’কে ড্রেস থেকে শুরু করে কসমেটিক্স, জুতা সব গিফ্ট করতে চাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা হলো, এসবে মানে মেয়েদের জিনিস-পত্র কেনায় আমি খুব আনাড়ি। তুই তো আফরিন আর আন্টির জন্য সবসময় নিজেই পছন্দ করে সবকিছু কিনিস। তোর পছন্দও একদম চোখ ধাঁধানোর মতো। তাই ভাবলাম, তুই-ই পারবি আমায় সাহায্য করতে।’

আহনাফ হেসে বলল,’বাপ্রে! গার্লফ্রেন্ডের ড্রেস,কসমেটিক্স পছন্দ করে দেওয়ার জন্য সুদূর বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডে বন্ধুকে ফোন করছিস? ভাই তোর নাম তো গিনিস বুকে দেওয়া উচিত।’

‘পিঞ্চ মারিস না সবসময়? যখন নিজের কেউ আসবে তখন বুঝবি বুঝলি!’

‘অত বুঝে কাজ নেই। কী পছন্দ করতে হবে দেখা।’

‘ওয়েট। আমি শো-রুমেই আছি। দেখাচ্ছি।’ বলে ব্যাক ক্যামেরা অন করে ইমরান।

কাউন্টারে গিয়ে ওউনারকে বলে,’আমি জুয়েলারি, কসমেটিক্স এসব দেখতাম। এদিকের সেলসম্যান কোথায়?’

ওউনার ইমরানকে হাসিমুখে বলল,’ডেকে দিচ্ছি।’
এরপর সে ঘাড় ঘুরিয়ে একটা ছেলেকে ডেকে বলল,’নতুন মেয়েটা কোথায়? ও’কে ডাক।’

ছেলেটি এখান থেকেই নাম ধরে ডাকে,’অর্ষা, অর্ষা। ম্যাডাম তোমাকে ডাকছে।’

অর্ষা নামটি শুনে চকিতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায় আহনাফ। খাওয়া শেষ করে নিজের কেবিনের দিকে যাচ্ছিল বলে দৃষ্টি ছিল পথের দিকে। এবার সে স্ক্রিনেই দৃষ্টি রাখে। দেখতে পায় ঝাড়ু হাতেই অর্ষা তড়িঘড়ি করে এদিকে আসছিল। এবং এটা সেই অর্ষা, নাম শুনে যার কথা আহনাফের প্রথম মনে এসেছিল। কিন্তু মেয়েটা এখানে কেন? তাও ঝাড়ু দিচ্ছে!

সে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। ছেলেটি অর্ষার হাত থেকে ঝাড়ুটি রেখে ফিসফিস করে কিছু বলল। অর্ষাকে একটু ভীত-ই দেখাল। সে কাউন্টারে আসতেই ওউনার রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’উনি কী দেখবে দেখাও।’

অর্ষা হাসার চেষ্টা করে কসমেটিক্সের সাইডে গেল। ঘেমে চেহারার অবস্থা খারাপ। হাত দিয়ে বারবার ঘাম মুছেও কোনো লাভ হচ্ছে। অর্ষা যতটা সম্ভব হাসার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল,’কী লাগবে স্যার?’

সেলসম্যানের প্রথম কাজটাই হচ্ছে হাসি-খুশি থাকা সর্বদা। যত কষ্টই হোক, খারাপ লাগুক না কেন কাস্টমারের সামনে একদম সেসব প্রকাশ করা যাবে না। সবসময় হাসির মুখোশ লাগিয়ে রাখতে হবে। কাস্টমারদের কথা বলে কনভেস করতে হবে।

ইমরান হেডফোন লাগিয়ে ছিল বিধায় আহনাফের কথা অর্ষা শুনতে পাবে না। ইমরান বলল,’সব ব্যান্ডের লিপস্টিক, মেকআপ করতে যা যা প্রয়োজন সেগুলো দেখান।’

অর্ষা একে একে সব বের করে সামনে ডেস্কের ওপর রাখছিল। আহনাফ তখনো নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ঘর্মাক্ত চেহারার অর্ষার শুকিয়ে যাওয়া মুখটি দেখছিল। মেয়েটার প্রতি একটা সফট্ কর্ণার বোধ হয় রয়েছে তার!

চলবে…

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_১৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
গ্যাঞ্জাম পার্টি এই প্রথম উপলব্ধি করল এই গ্যাং-এর কোনো একটি সদস্য ব্যতীত কতটা প্রাণহীন এই গ্যাঞ্জাম পার্টি। অর্ষার বাড়িতে গিয়ে অর্ষাকে পাওয়া যায়নি। কুসুম কাঠ কাঠ গলায় বলে দিয়েছিল, অর্ষার চাকরী হয়েছে। ওরা যেন আবার সেখানে গিয়ে কোনো তুলকালাম কাণ্ড না বাঁধায়। নিহাল এবং সুবাস না থাকলে গ্যাঞ্জাম পার্টির একজনও আজ কোত্থাও ঘুরতে যেত না। কিন্তু ওরা থাকায় অগত্যা সকলকেই যেতে হলো। তবে আড্ডা, ভ্রমণ কোনোটাই জমেনি। পুরো সময়টা ছিল নিষ্প্রাণ।

আহিলের মেজাজ ছিল তুঙ্গে। একটা দিনও রেস্ট নিতে দিলো না মেয়েটাকে! সে মনেপ্রাণে দোয়া করল এমন ভাই-ভাবি যেন আল্লাহ্ কোনো মেয়েকে না দেয়।
.
.
রাতে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফেরে অর্ষা। কেয়ার ছুটি ওর আগেই হয়েছিল। শরীরে যেন একটুও শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। সেলসম্যানের কাজ যতটা সহজ সে ভেবেছিল তার চেয়েও বেশি কষ্টের। সারাটাদিন দৌঁড়াদৌঁড়ি আর কাজের ওপর। একটুখানি রেস্ট করার সময় নেই। রাতে সে কোনো রকম দুটো খেয়ে শুয়ে পড়ে। বিছানায় শরীর রাখতেই প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ব্যথা অনুভব করে। হাত-পা টান করতেই আস্তে আস্তে আরাম অনুভব করে সে। যত তাড়াতাড়ি কাজটির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে ততই তার জন্য ভালো।

কাৎ হয়ে শুয়ে কেয়ার দিকে তাকায়। কেয়া ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। তার দু’চোখের পাতায়ও অজস্র ঘুম। চোখ খুলে রাখা দায়। হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় বন্ধুদের কথা। কাজের চাপে ওদের কথা মনে পড়ারও সুযোগ হয়নি। বাড়ি এসে যখন ও’কে পায়নি তখন নিশ্চয়ই ওরা কষ্ট পেয়েছে? রাগ করেছে কী? বন্ধুদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে করতেই ঘুম চলে আসে অর্ষার। শরীর এতটাই ক্লান্ত ছিল যে ফজরের সময়ও ঘুম ভাঙেনি।

কুসুম নিজেই উঠে এসে ডাকে। ভদ্রভাবে নয়। তার স্বভাবসুলভভাবেই ডেকে বলেছিল,’চাকরী নিয়েছিস বলে কি বাড়ির কাজকর্ম কিছু করা লাগবে না? সারাদিন সব কাজ তো আমাকেই করতে হবে। সকালে রান্নাটা তো অন্তত তুই করতে পারিস।’

ভাবির কথার উত্তর দেয়নি অর্ষা। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে অজু করে। নামাজ আদায় করে রান্না বসায়। উঠান ঝাড়ু দেয়। যা তার নিত্যকর্ম সব শেষ করে গোসল করে। খেয়ে-দেয়ে কেয়ার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ে।

রিকশায় বসে কেয়া জিজ্ঞেস করে,’রাতে কখন এসেছিস?’

‘সাড়ে দশটায়।’

‘দশটা পর্যন্ত জেগে ছিলাম। এরপর দেখি ঘুমে আর তাকিয়ে থাকতে পারছি না। তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’

উত্তরে অর্ষা মৃদু হাসল। কেয়া জিজ্ঞেস করল,’কাজ করতে কেমন লাগছে?’

‘ভালোই।’

‘প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবেই। পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু একটু সাবধানে থাকবি। মালিকের বউ যে দজ্জাল তা কিন্তু আগেই বলেছি।’

‘সব মালিকরাই কি এমন হয়?’

‘না। আমার মালিক তো অনেক ভালো। এখানে আপাতত কোনো লোক লাগবে না। যদি লাগে আমি তোকে এখানে নিয়ে আসব।’

‘আচ্ছা।’

কর্মস্থানে এসে রিকশা থেকে নামে দুজন। অর্ষার শো-রুমের তিনটা শো-রুম পরে কেয়ার শো-রুম। অর্ষা ভেতরে গিয়ে দেখে হাফিজ নামের ছেলেটা ফ্লোর ঝাড়ু দিচ্ছে।

জিসান নামের ছেলেটি জুতার ধুলাবালি পরিষ্কার করছে। অর্ষা কী করবে বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ বাদেই মালিকের বউ আসে। উনার নাম কামরুন নাহার। দেখতে বেশ মোটাসোটা, স্বাস্থবতী। গায়ের রং কালো। মুখে সবসময় রাগী রাগী ভাব থাকে একটা। দেখলেই ভয় লাগে।

কামরুন নাহার চেয়ারে বসে জিসানকে বললেন,’জিসান তুই সর। এই নতুন মেয়েটা জুতা পরিষ্কার করুক।’

জিসান একবার অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,’সমস্যা নাই ম্যাডাম। আমি পারব।’

‘এত কথা বলিস ক্যান? কাজ করতে আসছে। কাজ না করিয়ে কি বসিয়ে রাখব?’

জিসান এ কথার পিঠে আর কিছু বলল না। অর্ষা এগিয়ে গিয়ে বলল,’কী করতে হবে?’

জিসান একটা সুতি কাপড় দিয়ে বলল,’আপনি এই সাইডের জুতাগুলো পরিষ্কার করুন। আমি এই সাইডেরগুলো করছি।’

অর্ষা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। জুতা সব পরিষ্কার করা হলে অর্ষা পেছনের সাইডে গিয়ে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে কাস্টমার আসা শুরু করে। শো-রুমের মালিক এসে জিসানকে দায়িত্ব দেয় অর্ষাকে যেন সমস্ত কাজ শিখিয়ে দেয়।

অর্ষা কাপড়-চোপড় ভাঁজ করতে জানে। কিন্তু মার্কেটের কাপড়গুলো ভাঁজ করার নিয়ম বোধ হয় আলাদা। জর্জেট বোরকা, থ্রি-পিস ভাঁজ করতে গিয়ে তাকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। ওর অপারগতা দেখে জিসান হাসছে। জিসান এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও এবার বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। জিসানকে দেখে অর্ষার স্কুল লাইফের ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। তখন ক্লাস নাইনে পড়ত সে। তুষার নামে একটি ছেলে ছিল, যে একই স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ত। ছেলেটা অসম্ভব ভালোবাসত অর্ষাকে। অর্ষার যে তুষারকে ভালো লাগত না, এমনটা নয়। ওর’ও একটু একটু ভালো লাগত। কিন্তু এই ভালোলাগা ডাল-পালা গজানোর আগেই খবরটি অর্ষার ভাইয়ের কানে চলে যায়। সম্পর্ক না হওয়া সত্ত্বেও বিনা দোষে অনেক মার খেতে হয়েছিল অর্ষাকে। এরপর যদি তুষারের সাথে কোনো কথা বলে তাহলে তুষারকেও মারবে বলে হুমকি দেয়। তখন থেকে অর্ষা তুষারকে এড়িয়ে চলত। তুষার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর দেখা-সাক্ষাৎ’ও কমে গেছিল। আর এখন তো কোনো খোঁজ-খবরই নেই।

জিসানের কথা বলার স্টাইল, হাসি, দুষ্টুমি সব তুষারের মতো। এজন্যই অর্ষা আরো বেশি বিব্রত হয়। একই তো কাজ ঠিকঠাকভাবে শিখতে পারছে না, অন্যদিকে জিসানের দুষ্টুমি অর্ষাকে আরো বিচলিত করে তুলছে। লাঞ্চ টাইমে শো-রুমের এক আপুর সাথেই বাইরে খেতে গেল অর্ষা। মেয়েটা অর্ষার চেয়ে বেশ বড়ো। নাম সুস্মিতা।

খেতে খেতে সুস্মিতা বলল,’তোমায় একটা কথা বলি। জিসানের সাথে বেশি কথা বোলো না।’

অর্ষা ভ্রুঁ কুঞ্চন করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সুস্মিতা পানির বোতলে চুমুক দিয়ে বলল,’জারা নামের মেয়েটিকে দেখেছ না?’

‘হুম।’

‘জারার কিন্তু বেশ দাপট এই শো-রুমে। কামরুন ম্যামের বাড়িতেই থাকে। কাজে, কথায় এক্সপার্ট। তাই তো ম্যাম ও’কে নিজের বাসায় রেখেছে। তো জিসানের সাথে কিন্তু জারার সম্পর্ক রয়েছে। ও অনেকবার বাঁকাচোখে তাকিয়েছে। ঐ মেয়ের আচরণ তেমন ভালো নয়। ঝামেলা করতে পারে।’

অর্ষা হতাশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ‘কিন্তু আমি তো কারও সাথে সেধে কোনো কথা বলি না।’

‘জানি। আসলে জিসানটা একটু এরকমই। ও সবার সাথেই দুষ্টুমি করে। কিন্তু জারার এসব পছন্দ না।’

‘আচ্ছা, আমি আরো এড়িয়ে চলব তাকে।’

লাঞ্চের পর আবার কাজ শেখা শুরু অর্ষার। জিসান একটু পরপরই এসে কাজের তদারকি করছে আর দুষ্টুমি করছে। অর্ষা রাগ করার, গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে থাকে। কিন্তু জিসান এমন এমন কথা বলে যে, না হেসেও আর পারে না। সন্ধ্যার সময়ে দোকানে বেশ ভিড় হয়। এই সময়ে কাজ করতে হিমশিম খেতে হয় সকলকে। কয়েকটা দম্পতি ছোটো ছোটো বাচ্চা নিয়ে এসেছে। অর্ষা যেহেতু নতুন তাই বাচ্চা সামলানোর দায়িত্ব ও’কে দেওয়া হয়। যাতে করে বাচ্চাদের বাবা-মা শান্তিতে কেনাকাটা করতে পারে।

বাচ্চাগুলোর দূরন্তপনার সাথে অর্ষা পেরে ওঠে না। একটাকে সামলালে আরেকটা দৌঁড়ায়। শেষে হাফিজ এসে ও’কে সাহায্য করে। সন্ধ্যার পর ভিড় একটু কমে। মালিক বা তার বউ এখন কেউ নেই। একটু আরাম করে যে বসবে তারও উপায় নেই। সিসি ক্যামেরায় বাড়িতে বসেই তারা সব দেখে। অগত্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপড় ভাঁজ করা শেখে সে।

জারা অন্যপাশে ছিল। তার মাথার ওপর ফ্যান চলছে। শো-রুমে এসিও আছে। কিন্তু সবসময় ছাড়া হয় না। যখন অনেক কাস্টমার আসে তখন এসি ছাড়ে। জারা অর্ষাকে ডেকে পাশে বসায়। মনে মনে একটু ভয়ই পায় অর্ষা।

জারা অবশ্য কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। হেসেই জিজ্ঞেস করেছে,’তুমি শুধু জব-ই করো?’

অর্ষা মাথা নাড়িয়ে বলল,’না। পড়াশোনাও করি।’

‘কীসে পড়ো?’

‘ইন্টার দিয়েছি এবার। তুমি?’

জারা একটু চুপ করে থেকে বলল,’আমি ভার্সিটিতে পড়ি।’

‘ওহ। কোন ইয়ার? কোন সাবজেক্টে?’

জারা চুপ হয়ে যায়। অর্ষাও জানত জারা হয়তো কোনো উত্তর দিতে পারবে না। কারণ সে সুস্মিতার থেকে জারার সম্পর্কে প্রায় সবই জেনেছে। জারা সেভেন পর্যন্ত পড়েছিল। এরপর আর পড়াশোনা হয়নি। তাহলে সবাইকে মিথ্যে বলার দরকার কী?

জারাকে অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিতে অর্ষা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,’তোমার চুলগুলো অনেক সুন্দর। সিল্কি।’

জারা হাসল। বলল,’থ্যাঙ্কিউ। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?’

‘জি।’

‘তুমি কি রিলেশন করো?’

‘না।’

‘করবে?’

‘না।’

‘আরে একটা ভালো ছেলে আছে।’ বলে কসমেটিক্সের সাইডে বসে থাকা একটা ছেলেকে দেখায়। ছেলেটি কালো, দেখতেও তেমন নয়। আল্লাহর সকল সৃষ্টিই সুন্দর। তাই কাউকে নিন্দেমন্দ করতে নেই। তবে মানুষের দৃষ্টিতেই সৌন্দর্যের পার্থক্য রয়েছে। সেই দৃষ্টিতেই, এই ছেলে অর্ষার তুলনায় কিছুই নয়। কোনোদিক দিয়েই নয়। এরচেয়ে অনেক বেটার বেটার, সুন্দর, হ্যান্ডসাম ছেলের থেকে প্রপোজাল সে পেয়েছে। জারা কি তাকে এতটাই তুচ্ছ ভাবা শুরু করেছে?

অর্ষা নিরুত্তর রইল। জারা বলল,’ওর নাম রাকিব। দেখতে এত সুন্দর না হলেও মনটা কিন্তু খুব ভালো। পড়াশোনা না করলেও সমস্যা নেই। নিজেদের বাড়ি আছে। বাপ অনেক বড়ো লোক। এখানে চাকরী করে শখের বসে। তোমাকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ করেছে। চাইলে রিলেশন করতে পারো। বিয়ে করলেও সুখে থাকবে।’

অর্ষা এবার হেসে ফেলে। মৃদু হেসে বলে,’ওর বাপের অনেক টাকা, অনেক বড়ো লোক এসব দেখে আমি রিলেশনে যাব; আমার প্রতি এমন মনোভাব আনার কারণটা কি আপু?’

‘তেমন কিছু না। ও তোমাকে পছন্দ করে। তাই বললাম।’

‘তাকে বলে দেবেন, আমি তাকে পছন্দ করি না।’

‘ভেবে দেখতে পারতে।’

‘ভাবার কিছু নেই। রিলেশন করার মানসিকতা থাকলে অনেক সুন্দর এবং বড়ো লোক ছেলের সাথেই করতে পারতাম। অভাবের তাড়নায় চাকরী করতে এসেছি। এর মানে এই নয় লোভের বশবর্তী হয়ে কারও সাথে সম্পর্কে জড়াতে হবে।’

এতগুলো কথা অর্ষা কীভাবে বলে ফেলেছে সে নিজেও জানে না। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে কেন সবাই এমন তুচ্ছ ভাববে? সে তো তুচ্ছ নয়। হয়তো এজন্যই আজ এতগুলো কথা সে বলতে পেরেছে।

জারা একটুখানি সময় চুপ করে থেকে বলল,’আচ্ছা এটা বাদ দাও। আমার একটা কাজ করে দেবে?’

‘কী?’

‘জিসানকে পটাতে পারবে? সম্ভবত ও তোমাকে পছন্দ করে। ও’কে দিয়ে তোমায় ভালোবাসার কথা বলাতে হবে।’

‘এতে আমার লাভ?’

‘ও যদি তোমাকে ভালোবাসার কথা বলে তাহলে তোমার পড়াশোনার খরচ আমি চালাব।’

অর্ষা তাচ্ছিল্য করে বলল,’দরকার নেই আপু। সে যে আপনার বয়ফ্রেন্ড সেটা আমি জানি। এছাড়া আমার প্রতি তার অন্য কোনো মনোভাব নেই। যাকে ভালোবাসেন, তাকে বিশ্বাস করতে শেখেন। আমি যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে।’

অর্ষার কান্না পাচ্ছে। নতুন জায়গায় আসতে না আসতেই এমন প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হওয়ার কি খুব দরকার ছিল? সবসময় তার সাথেই কেন এমন হবে!কোথায় গেলে সে একটু শান্তি পাবে।স্বস্তি পাবে!

সেদিনের পর থেকে জিসানকে সে পুরোদমে এড়িয়ে চলা শুরু করে। প্রয়োজনেও কোনো কথা বলে না। তেমন সামনেও যায় না। কাজ শেখে অন্যদের কাছে। জিসানও হয়তো কারণ আঁচ করতে পেরে গুটিয়ে যায়।

শো-রুমের মালিক অর্ষাকে চুপচাপ কাপড় ভাঁজ করতে দেখে জিজ্ঞেস করেন,’মন খারাপ নাকি পিচ্চি?’

অর্ষা মাথা তুলে তাকায়। মৃদু হেসে বলে,’না, বস।’

‘তাহলে এত চুপচাপ কেন। এখানে সব সেলসম্যানের থেকে তুমি ছোটো। হৈচৈ না করে সবসময় নিরব থাকো। এত শান্তশিষ্ট হলে হয়?’

অর্ষা কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। বসের বউ অতিরিক্ত রাগী হলেও বস মানুষটা বেশ ভালোই। রাকিবকে প্রত্যাখান করায় বেশ কিছুদিন অর্ষার ওপর ক্ষেপে ছিল সে। সামনা-সামনি পড়লে কিংবা চোখাচোখি হলেই রাগী দৃষ্টিতে তাকাত। এখন অবশ্য তেমন করে না। স্বাভাবিক বন্ধুসুলভ আচরণই করে। অর্ষাও আস্তে আস্তে সবার সাথে, সবকিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। কাজে ভুল হলে কামরুন ম্যামের অজস্র ধমক, বকাও খেতে হয়। প্রথম প্রথম আড়ালে গিয়ে কাঁদত। এখন কান্না পেলেও কান্না আটকে রাখতে পারে। নিজের জন্য হলেও তাকে সবকিছু হজম করতে হবে।
_______
লামিয়া এবং জুঁইয়ের বিয়ে একদিনেই হবে। যেহেতু ওরা দুজন বান্ধবী এবং অপরদিকে নিহাল আর সুবাসও বন্ধু তাই একসাথে বিয়ে হওয়ায় দুই পরিবারের কারোরই কোনো আপত্তি নেই। অর্ষা বাদে বন্ধুমহলের সকলেই বিয়ের ডেট জানে। অর্ষার সাথে দুটো কথা বলারও সুযোগ নেই এখন। মেয়েটা এত বিজি থাকে! শুক্রবারে পর্যন্ত ডিউটি। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ অর্ষার শো-রুমে গিয়ে সারপ্রাইজ দেবে।

যেই ভাবা সেই কাজ। সকলে মিলে চলে যায় শো-রুমে। কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়েই অর্ষাকে দেখে। মেয়েটা আগে থেকে অনেকটা শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালিও পড়েছে মনে হচ্ছে। সামনে একগাদা কাপড়। সেগুলোই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাঁজ করছে সে।

লামিয়া কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে,’দোস্ত! ওর এই অবস্থা কেন?’

উত্তরে আশিক বলল,’কাজ করা এত সহজ কথা নয় রে। চল ভেতরে যাই।’

সবাই মিলে ভেতরে যায়। নিঃশব্দে গিয়ে অর্ষার সামনে দাঁড়ায়। অর্ষা কাজে এতটাই মগ্ন যে এতগুলো মানুষ তার সামনে দণ্ডায়মান সেটাও খেয়াল করেনি। পাশ থেকে যারা যখন ওদের বলল,’কী দেখবেন?’
তখন ভাবলেশহীন ভাবে সামনে তাকায় অর্ষা। আর তাকিয়েই অবাক হয়ে যায়। অজান্তেই খুশিতে চিৎকার করে ফেলে এবং পরক্ষণে দু’হাতে মুখ আবদ্ধ করে নেয়। দু’চোখে পানি টলমল করছে। আজ কতদিন পর ওদের সাথে দেখা? এক সপ্তাহ্? না এর-ও বেশি সময় হবে।

অর্ষা বেরিয়ে এসে ওদেরকে জড়িয়ে ধরে। আহিল, দিদার আর আশিক নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রয়েছে। ভেতরে ভেতরে আনন্দ ও কষ্ট অনুভব করতে পারলেও মেয়েদের মতো সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। ওরা কান্নাকাটি করতে করতেই গল্প জুড়ে দেয়।

পাশ থেকে জারা গম্ভীর হয়ে বলে,’এটা গল্প করার জায়গা নয়।’

লামিয়া ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ বাঁকা করে তাকায়। রাগীকণ্ঠে বলে,’এখানে আমরা গল্প করতে এসেছি আপনাকে কে বলেছে? আর কে আপনি হ্যাঁ? শো-রুমের মালিক?’

জারা থতমত খেয়ে যায়। আশিক লামিয়াকে থামতে বললে লামিয়া দ্বিগুণ রাগ দেখিয়ে বলে,’থামব কেন? মালিক হলে বলুক যে মালিক হয়। আর কর্মচারী হলে কাস্টমারদের সাথে এমন ব্যবহার করার সাহস কোথায় পায়? ম্যানার্সলেস মেয়ে! কই বস কোথায় আপনার?’

হৈচৈ শুনে কামরুন নাহার এগিয়ে আসেন। বিনীতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,’কী হয়েছে?’

এবার জুঁই বলল,’কেমন কর্মচারী দোকানে রেখেছেন আন্টি? সামান্য ম্যানার্সটুকু নেই। অর্ষা আমাদের কলেজ ফ্রেন্ড। ওর সুবাদেই এখানে এসেছি কেনাকাটা করতে। আর আপনার এই সেলসম্যান বলে কিনা এটা গল্প করার জায়গা নয়! এতদিন বাদে নিজের ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথা বলব না আমরা?’

‘অবশ্যই। ও বুঝতে পারেনি। তোমরা কিছু মনে কোরো না।’

এরপর তিনি জারার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,’স্যরি বলো ওদেরকে।’

জারা অনিচ্ছাকৃতভাবে বলল,’স্যরি।’

ওর স্যরিকে কেউ পাত্তা দিলো না। আর সত্যি সত্যিই শো-রুম থেকে সবাই মিলে অনেক কেনাকাটা করল। কামরুন নাহার নিজে সবাইকে কফি খাওয়ালেন। এমনকি অর্ষার সাথে ওদের কথা বলারও সময় দিলেন। ওরা চলে যাওয়ার পূর্বে কিছু ব্যাগ অর্ষাকে দিয়ে বলল,’এগুলো তোর জন্য।’

আহিল আস?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here