যেদিন তুমি এসেছিল পর্ব-৩৩

0
3170

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
ছোট্ট পেলব শরীরখানা কিছুক্ষণ বাদে বাদে ঈষৎ কেঁপে উঠছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে অর্ষার। আহনাফ নিরুপায় ভূমিকা পালন করছে। অনেকবার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি। তাই নিশ্চুপ থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কান্নার গতি কমলেও; একটু পরপর ফুঁপিয়ে উঠছে।

আহনাফ মৃদুস্বরে বলল,’অনেক রাত হয়েছে অর্ষা। এখন ঘুমাও।’

আহনাফকে ছেড়ে দিল অর্ষা। দু’হাতে চোখের পানি মুছে ওয়াশরুমে চলে গেল। আহনাফ কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে রইল। অর্ষা ফ্রেশ হয়ে আসার পর সেও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। এসে দেখে অর্ষা লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। ক্যাথিওন আর অ্যানিওনকে ডিম লাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে গুটিসুটি হয়ে অর্ষার পায়ের কাছে বসে আছে। আহনাফ আনমনেই হেসে ওঠে। ঘুণাক্ষরেও যদি অর্ষা একবার টের পায়, ওরা দুটোয় ওর এত নিকটে বসে আছে! তাহলে নির্ঘাত অর্ষা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবে। হঠাৎ-ই তার মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। অর্ষা এভাবে কাঁদল কেন? সারাটা দিন তো সব ভালোই ছিল।

বুকভরে শ্বাস নেয় সে। আবছা আলো-অন্ধকারে অর্ষার ঘুমন্ত মুখটির দিকে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে। তারপর ক্যাথি আর অ্যানিকে লিলিয়ার কাছে দিয়ে সেও নিঃশব্দে অর্ষার পাশে শুয়ে পড়ে। আনমনে ভাবতে থাকে,’মেয়েটি কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’
_________

সকাল, নিতু আর বিথী স্কুলের সামনে থাকা সেই রেস্টুরেন্টে এসে বসে আছে। আজকে আহিল ওর গার্লফ্রেন্ডকে কি সত্যিই নিয়ে আসবে? ভাবতেই তো বুকটা কেমন ধ্বক করে উঠছে।

সকালকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে নিতু জিজ্ঞেস করল,’মুখ পেঁচার মতো বানিয়ে রেখেছিস কেন?’

সকাল বিমর্ষ হয়ে বলল,’টেনশন হচ্ছে খুব। যদি সত্যিই উনার গার্লফ্রেন্ড থাকে?’

‘থাকলে থাকবে। দুনিয়াতে কি ছেলের অভাব আছে নাকি?’

‘উঁহু! কিন্তু তার বড্ড অভাব। সে তো এক পিস-ই।’

‘মাথা গেছে পুরা তোর!’ বিরক্ত হয়ে বলল বিথী।

সকাল গাল ফুলিয়ে বলল,’উনি যদি মিঙ্গেল হয়, তাহলে আমি আজ ক্লাসই করব না।’

‘আরে আজব! ক্লাস কেন করবি না?’

‘কারণ উনার গার্লফ্রেন্ড আছে এটা যদি সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে বিষয়টা আমার ভালো লাগবে না। কষ্ট পাব। আর কষ্ট পাওয়া মন নিয়ে ক্লাস করা যায় না।’

বিথী কিছু বলতে যাবে নিতু তখন কনুই দিয়ে দু’পাশে দুজনকে খোঁচা দেয়। চোখের ইশারায় সামনে তাকাতে বলে। ওর ইশারা অনুযায়ী সকাল এবং বিথী সামনে দৃষ্টিপাত করে। মুহূর্তেই সকালের মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আহিলের হাত ধরে আছে রেশমি। দুজনের মুখেই লেগে আছে অমায়িক হাসি।

আহিল রেশমিকে নিয়ে ওদের সামনের চেয়ারে বসল। ফোনের সময় দেখে বলল,’স্যরি তিন পিচ্চি। একটু দেরি হয়ে গেল।’

তিনজনেই নিরুত্তর হয়ে তাকিয়ে রয়েছে শুধু। রেশমি ওদেরকে পরখ করে একগাল হেসে বলল,’আসলে কী হয়েছে বলো তো, রেজাল্ট দেওয়ার আনন্দে দুজনে গতকাল রাত জেগে কথা বলেছি। ওর ঘুম সকালে তাড়াতাড়ি ভাঙলেও আমার ঘুম ভাঙেনি। একটু বেশি ঘুমাই কিনা তাই আরকি! কিন্তু আমার জান খুব ভালো জানো।’ বলে রেশমি আহিলের গাল টেনে দিলো।

আহিল প্রথমে গরম চোখে তাকালেও সকালের দিকে দৃষ্টি পড়ায় হাসার চেষ্টা করে।

সকাল নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে। তার চাহনী কাতর, অসহায়। নিঃসঙ্গ প্রায় ঠেকছে তার।

আহিল রেশমির হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,’পরিচয় করিয়ে দেই। ও হচ্ছে রেশমি, আমার গার্লফ্রেন্ড। আর রেশমি, ও হলো সকাল। আর এই দুজন সকালের বান্ধবী।’

রেশমিও হাসিমুখে বলল,’ওহ আচ্ছা আচ্ছা! সকাল তো ভোরের সকালের মতোই স্নিগ্ধ দেখছি। তো তোমাদের নাম কী?’

নিতু ও বিথীর উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা করে রেশমি আহিলের কাঁধে মাথা রাখল। আহিল একটু উশখুশ করলেও কিছু বলল না।

‘আমার নাম নিতু। আর ওর নাম বিথী।’ মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলল নিতু।

রেশমি এবারও হেসে বলল,’ও আচ্ছা আচ্ছা। খুব সুন্দর নাম।’

এরপর আহিলের দিকে তাকিয়ে বলল,’জান খাবার অর্ডার করবে না?’

রেশমির অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি অ্যাক্টিং দেখে আহিলের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। জান, প্রাণ, ফুসফুস আবার কী! রেশমি অবশ্য ওর রিয়াকশনে ভয় পেল না। বরং সে সকালদের উদ্দেশ্যে বলল,

‘তোমরা কী খাবে?’

সকাল এতটা সময় চুপ করেই ছিল। এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলল,’কিছু খাব না আপু। ক্লাসে দেরি হয়ে যাবে। যাচ্ছি এখন।’

রেশমি অস্থির হয়ে বলল,’সেকি! না খেয়েই কেন যাবে? এটলিস্ট চা-কফি তো কিছু খাও।’

‘না, আপু। ভাগ্যে থাকলে অন্য একদিন। ভালো থাকবেন আপনারা। আপনাদের দুজনের জন্যই অনেক শুভকামনা রইল।’

আহিল মুচকি হেসে বলল,’তোমার জন্যও দোয়া রইল পিচ্চি। বাই দ্য ওয়ে, তুমি এবার তোমার কথা রাখবে তো?’

রেশমি জানতে চাইল,’কীসের কথা আহিল?’

সকাল প্রত্যুত্তরে মেকি হাসি দিয়ে বলল,’নিশ্চিন্তে থাকুন। আর বিরক্ত করব না আপনাকে।’

এরপর সে নিতু এবং বিথীকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল আহিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘তোরে এত ওভার অ্যাক্টিং কে করতে বলছে হ্যাঁ?’

রেশমিও বা কম যায় কী! সেও ধমক দিয়ে বলল,’একশো বার করব। তোকে যে সাহায্য করেছি এটাই তো তোর ভাগ্য। তুই আবার আমায় ধমক দিচ্ছিস? এই দিলি তুই উপকারের প্রতিদান?’

‘একটু গার্লফ্রেন্ড সেজে না হয় কথাই বলেছিস, এতে এমন আর কী-ই বা উদ্ধার করে ফেলেছিস শুনি?’

‘আহিলের বাচ্চা! পল্টি খাইলি না তুই? দাঁড়া এক্ষুণী আমি মেয়েটাকে সব বলে দেবো।’ বলে উঠে দাঁড়ায় রেশমি।

অবস্থা বেগতিক দেখে আহিল দ্রুত রেশমির হাত চেপে ধরে। গলা নরম করে বলে,

‘স্যরি। প্লিজ রাগ করিস না! প্লিজ! আসলে আমরা বন্ধু তো এরকম রোমান্টিক অভিনয় করতে ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল। প্লিজ রাগ করিস না।’

রেশমি গাল ফুলিয়ে রাখল। আহিল আবার অনুনয় করে বলল,’প্লিজ!’

রেশমি শুনল না। হাত ছাড়িয়ে চলে যাওয়া ধরল। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসল। আহিলের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ঠিকাছে রাগ করব না। এখন আমি যা খাব তুই তাই খাওয়াবি। আর বাড়িতেও পার্সেল করে দিতে বলবি।’

আহিল হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,’তুইও তো পল্টিবাজ কম না।’

রেশমিও হেসে ফেলে। আহিলের পিঠে কিল বসিয়ে বলে,’তোরই তো ফ্রেন্ড!’

‘উফ! মাঝখান থেকে আমি কিল ফ্রি খেলাম।’

রেশমি খিলখিল করে হেসে ওঠে।
.
.
আহনাফের অফিসে যাওয়ার সময় অর্ষার ঘুম ভাঙে। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে আগে। আহনাফ তখন টাই বাঁধছিল। অর্ষার কেন জানি ইচ্ছে করছিল আহনাফের খুব কাছে গিয়ে সযত্নে টাই বেঁধে দিতে। তবে ইচ্ছেটা সে দমিয়ে নিল।

আহনাফ ও’কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃদু হাসি দিয়ে বলল,’গুড মর্নিং।’

‘মর্নিং।’

‘মন খারাপ?’

‘উঁহু!’

‘কী হয়েছে আমায় বলা যাবে?’

অর্ষা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কী বলবে এখন সে? কেয়া ফোন করেছিল এই কথা বললে কি সে রেগে যাবে? আবার আগের মতো ব্যবহার করবে? খারাপ ব্যবহার করলেও, কথাটা তো তাকে জানানো উচিত। তবে মন সায় দিচ্ছে না। আজ বড্ড স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করছে। লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে এই সত্যটি। জানা নেই কাজটা সঠিক হবে নাকি বেঠিক। সবসময় এত ঠিক-বেঠিক বিবেচনা করতে নেই। করতেও হয় না।

‘অর্ষা?’

আহনাফের ডাকে বুক থেকে ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অর্ষার। দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘কিছু হয়নি তো।’

‘সত্যি বলছ তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে কাঁদছিলে কেন?’

‘বাড়ির কথা মনে পড়ছিল। তিয়াসের কথা বেশি মনে পড়ছিল।’

আহনাফ এগিয়ে এলো অর্ষার কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’দেখা হবে আবার ইন-শা-আল্লাহ্। এখন খাবে এসো।’

এক চিলতে সুখ অনুভূত হলো যেন মনের কোণে। বিয়ের আগে তার শান্তির জায়গা ছিল বন্ধুরা। খুব খারাপ সময়ে আহিল এভাবে মাথায় হাত রেখে ভরসা দিত। আর আজ আহনাফ! মানুষটার মনে কি জায়গা করে নিতে পেরেছে অর্ষা?

‘এসো।’ বলে অর্ষাকে নিয়ে খেতে গেল। ক্যাথি আর অ্যানি ওদেরকে দেখে দৌঁড়ে আসে কাছে। অর্ষা ভয় পেয়ে আহনাফের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়।

আহনাফ হেসে বলে,’এতদিন ওদের সাথে থাকছ, এবার তো একটু সাহস সঞ্চয় করো মনে।’

‘পারব?’

‘পারবে।’

অর্ষা স্মিত হাসে। আজ সকাল থেকেই আহনাফ তার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। পরেও এভাবে কথা বলবে তো? নাকি আবার পরিবর্তন হয়ে যাবে? অর্ষা খায় আর আহনাফের দিকে তাকিয়ে আনমনে এসব ভাবে।

খাবার শেষ করে আহনাফ অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়। যাওয়ার পূর্বে অর্ষাকে বলে,’মন খারাপ কোরো না। সবসময় হাসি-খুশি থাকবে।’

দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছে অর্ষা। আহনাফ বেরিয়ে পড়েছে। সে এবার পিছু ডাকল,

‘শুনুন।’

আহনাফ দাঁড়িয়ে পড়ে। পিছু ফিরে বলে,’কিছু বলবে?’

‘একটা কথা বলব। রাগ করবেন না তো?’

‘সেটা তো বলার পর বলতে পারব।’

‘রাগ করলে বলব না।’

‘আচ্ছা রাগ করব না। বলো।’

অর্ষা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল,’যদি কেয়া আপু কখনো আপনার কাছে ফিরে আসে, তাহলে আপনি কি গ্রহণ করবেন?’

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।

বিঃদ্রঃ আজ গ্রামের বাড়িতে এসেছি। লেখার সময়, ফুরসত একদম নেই। ঈদের কয়েকটা দিন গল্প অনিয়মিত পাবেন আগেই বলে রাখলাম। পর্ব ছোটো নিয়েও অভিযোগ না করার অনুরোধ রইল। ইন-শা-আল্লাহ্ ঈদের পর বড়ো পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করব। হ্যাপি রিডিং।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here