যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
পর্ব ১৪
(লম্বা বিরতির পর দিলাম, আশা করি ভুলে জাননি)
সকালে রুমি দরজা খুলে যখন বের হয়, তার চোখেমুখে রাত জাগার ছাপ স্পষ্ট। ফজরের নামাজ শেষে বেশ খানিকটা সময় কান্না করেছে, এখন মনটা বেশ হালকা লাগছে । আসলে গত কয়েকমাসের জমানো কান্নাগুলো ঝরার অপেক্ষায় ছিল রুমি, আজ জায়নামাজে বসে সেই চোখের পানিই মুক্তো হয়ে যেন ঝরেছে।
এখন ভোর ছয়টা বাজে সবে, রুমি ভেবেছিল কেউ উঠেনি, এই সুযোগে পাউরুটিতে জেলী লাগিয়ে খেয়ে নিবে। কাল রাতে খাওয়া হয়নি। লম্বা সময় খুদা সহ্য হয় না রুমির। রাতে না খেয়ে থাকায় এখন দুনিয়া খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বাইরে বের হয়ে দেখে সানোয়ার সাহেব আর সাহেদা বেগম বসে আছেন। এত সকালে বাবা মাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয় রুমি। একটু লজ্জাও লাগে, গতকাল সন্ধ্যায় কতকিছু বলে ফেলেছে, এখন চাইলেও সেগুলো ফেরত আনা যাবে না। এই জন্যই বলে কথা তীরের মতো, একবার বের হলে আর ফেরানো সম্ভব নয়।
“রুমি, আয় চা খা আমাদের সাথে।”
“আব্বা, তোমরা খাও। আমার খিদা নাই। আর আমি ব্যাগ গুছিয়ে রাখছি, তিতলি উঠলে আমরা বের হয়ে যাব।”
সালেহা বেগমের মেজাজ খারাপ হয়, এতকিছুর পরও রুমের এত রাগ উনার ভালো লাগে না তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠেন, “রুমি যথেষ্ট হয়েছে, তোর বেয়াদবি আর নিতে পারছি না। এত দেমাগ ভালো না।”
“আম্মা, তুমি আমার কোন জিনিস টা নিতে পার? সমস্যা নেই আমার দেমাগ নিয়ে আমি চলে যাব, তোমার আর নিতে হবে না।”
“দেখছ, তোমার মেয়ের ব্যবহার দেখেছ? আর তুমি আমাকে বোঝাও ধৈর্য ধরতে। মেয়েকেও মায়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা বোঝাও। আর রুমি এত যে বড় বড় কথা বলিস, যাওয়ার জায়গা পেলে কাল রাতেই চলে যেতি, দিয়েছে কেউ জায়গা?”
সানোয়ার সাহেব, সাহেদা বেগমকে চোখের ইশারায় কথা বলতে না করেন। কিন্তু তারপরও সাহেদা বেগমের রাগ যায় না, তিনি আশায় ছিলেন রুমি সকালে উঠে বাবা মাকে স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখলে লজ্জিত হবে, হয়তো ক্ষমা চাইবে। কিন্তু রুমি এখনও তেজ দেখাচ্ছে দেখে উনারও আবার রাগ চাঁড়া দিয়ে ওঠে।
সানোয়ার সাহেব মা মেয়ের মাঝে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন, “রুমি, আম্মার সাথে এভাবে কথা বলা কী ঠিক? এত কষ্ট করে তিতলিকে বড় করছো তুমি। কাল যদি তিতলি এভাবে কথা বলে, তখন কেমন লাগবে? আর বসো এখানে, চা না খেলে না খাবে। কিন্তু মাথা ঠান্ডা করে কথা শোনো।”
এমনিতে সানেয়ার সাহেব ছেলেমেয়েকে তুই করেই বলেন, তবে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তুমি বলাই শ্রেয় ভাবেন।বাবার কথায় আদেশের পাশাপাশি আরও কিছু একটা ছিল, রুমি তাই চেয়ার টেনে বসে।
“রুমি, দেখ তোমার সাথে অন্যায় আচরণ হচ্ছে বলে যে অভিযোগ তুমি করেছ তা যেমন সত্যি, তেমনি তোমারও নিজের মাঝে পরিবর্তন আনা দরকার মা। আম্মার সাথে মিলেমিশে থাক। একা একা আমার নাতনিকে নিয়ে কোথায় যাওয়ার দরকার নেই। তুমি কী তিতলির জন্য কোন নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করতে পেরেছ? বলো? যদি পারতে আমি মানা করতাম না। যেহেতু পারনি সেহেতু কোন জিদ দেখাবে না। এইটুকু বাচ্চার কোন বিপদ হলে মা হিসেবে তুমি দায়ী থাকবে। আম্মার সাথে তর্ক না করে বড় মামা মামীকে ফোন দিয়ে মাফ চাও। বড়দের কাছে ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয় না।”
“এই তোমার সমাধান আব্বা?”
“আমি রশ্মি আর আদিলের সাথে কথা বলবো। রুমি একসাথে থাকলে গেলে অনেক কিছু মন মতো হয় না। কিন্তু রাগ করে বের হয়ে যাওয়া সমাধান না, বিশেষ করে তখন, যখন যাওয়ার জায়গা সীমিত।”
****
মরিয়মের রাতে ভালো ঘুম হয়নি। রুমিকে ফোনে নিষেধ করে দিলেও সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে। রুমি কতটা আশা নিয়ে ওর কাছে কয়েকটা দিন থাকার অনুরোধ করেছে, আর ও এভাবে মানা করে দিল, এই অপরাধবোধ মরিয়মকে শান্তি দিচ্ছিল না। আজ কলেজে আগে আগেই চলে এসেছে মরিয়ম, যদিও শাশুড়ি মা এখন ছুটি নিতে বলেছেন, কিন্তু মরিয়ম যতদিন শরীর ভালো থাকে ছুটি নষ্ট করতে চায় না। মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রেগন্যান্সির সময় নষ্ট করে ফেললে পরে সমস্যা হবে, বাচ্চাকে সময় দিতে পারবে না। শিহাব রাতের ঘটনা কিছু জানতো না, সকালে স্বাভাবিক ভাবেই মরিয়মকে বিদায় দিয়েছে। শিহাবের দিলে তাকিয়ে মরিয়ম একবার ভাবে তার শাশুড়ি বোধহয় ঠিকই বলেছেন, শিহাবকে মরিয়ম সময় দিতে পারে না, কলেজের বাইরের সময়টা ছেলে রুমনের পেছনে চলে যায়, আর এখন তো ও প্রেগন্যান্ট। আসলেই যদি অল্পবয়সী রুমিকে আাসায় জায়গা দিলে কোন কেলেঙ্কারি হতো!!! এই শিহাবই তো ওর ভালোবাসার জায়গা, ভরসার জায়গা।
আবার মনে হয় বিয়ের এতগুলো বছরেও যদি এই বিশ্বাসটুকু না হয়, তাহলে এই প্রেম এই বিয়ের কী মানে থাকে!
*****
রুমি কলেজ আসবে কী আসবে না তা নিয়ে মরিয়ম একটু চিন্তায় ছিল, লিফট থেকে তাই রুমিকে বের হতে দেখে মরিয়মের স্বস্তি লাগে। যদিও রুমির রাতজাগা মলিন চেহারা বলে দেয় কতটা ক্লান্ত রুমি।
“রুমি, তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল। সব ঠিক আছে?”
“আছে আপা।” সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় রুমি।
“কাল কী হয়েছিল রুমি?”
“জেনে কী করবেন আপা? বাদ দেন।”
“তুমি আমার উপর কষ্ট পেয়েছে জানি। রুমি তুমি তো জানো না আমিও একটা বড় চাপের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।”
“আমার জানার প্রয়োজন নেই আপা। যার যার জীবন তার তার সমস্যা আসলে।।কেউ কারও টা সমাধান করতে পারে না।”
“রুমি তুমি এভাবে বলছো। এখানে তোমার আমার সম্পর্ক কলিগ কম, বোনের মতো বেশি।”
“আমি আপন বোন হলে কাল রাতে একটা ম্যাসেজ দিয়ে না করে দিতে পারতেন আপা?” আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুমি ডিপার্ট্মেন্টের দিকে পা বাড়ায়।