যে শহরে এখনো ফুল ফোটে পর্ব-৩০ শেষ পর্ব

0
3297

#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
(সমাপ্তি পর্ব। প্রায় ৯ দিন পর পর্ব দিলাম। ধারাবাহিকটার শুরু থেকে নানা সমস্যায় অনিয়মিত ছিলাম। কোন বাহানা দিতে চাই না। কিন্তু সপ্তাহে একটার বেশি পর্ব চাইলেও দিতে পারিনি। তবে গল্প শেষ না করে গায়েব কিন্তু হইনি ❤️ যারা প্রায় ৪ মাস
ধরে পাশে ছিলেন অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ।)

“রুমি, আর কত কাঁদবে? চোখমুখ তো লাল করে ফেললে।”

“খালাম্মা এত আদর করে কথা বললেন, আমার যে কেমন লেগেছে বোঝাতে পারব না। আমি খুব অপরাধবোধে ভুগতাম জানেন। যতদিন পর্যন্ত রামিসা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে না যাচ্ছিল, ততদিন পর্যন্ত নিজের কাছে অপরাধী হয়ে ছিলাম। আজ যখন খালাম্মা আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে ক্ষমা চাইলেন, বুক থেকে একটা বোঝা নেমে গেল যেন।”

“খালাম্মাকে আজ আমারও অসাধারণ লেগেছেন। নিঃসন্দেহে ফাইটার মানুষ। অল্প বয়সে বিধবা হওয়ার পর শিহাব ভাই আর ওনার বোনকে একহাতে বড় করেছেন, যোগ্য করে বিয়েশাদি দিয়েছেন। মরিয়ম আপাকেও তিনি ভালোবাসেন। একমাত্র ছেলের বৌ বলে আপাকে ওনার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেননি। কিন্তু ওনার ভুল এটাই ছিল তিনি আর সবার মতো রুমনকে দুর্বল ভেবেছেন। অটিজম নিয়ে আমাদের সচেতনতা অভাব আর অজ্ঞতার কারণে অনেকেই এমনটা ভাবেন। সেজন্য মরিয়ম আপার দ্বিতীয় সন্তান নিয়ে খালাম্মার মাঝে একটা অবসেশন তৈরি হয়েছিল। যাই হোক সবার সামনে তিনি নিজের ভুল স্বীকার করেছেন এটা ওনার বয়সী একজন মানুষের জন্য কম কথা না।”

সত্যি আজ এই চমৎকার দৃশ্য মঞ্চায়ন হয়েছে মরিয়ম আপার বাসায়। সবার সামনেই শিহাবের আম্মা ওয়াদা করেছেন আর কখনো নাতি নাতনিকে তিনি আলাদা চোখে দেখবেন না। মরিয়মকে তিনি পথ দেখাবেন, তবে পদে পদে ভুল ধরবেন না।
রামিসাকে নিয়ে মরিয়ম যখন বাসায় প্রবেশ করে, এত চমৎকার করে শিহাবের বোন দুলাভাই তাদের বরণ করে নেন যে বাইরের মানুষ হয়েও রাকিন আর রুমি আবেগ আক্রান্ত হয়ে পরে। সবার মাথায় ছিল এই আয়োজনে রুমনকে বিন্দুমাত্র অবহেলা করা যাবে না, তাই তো ওয়েলকাম পোস্টারে রামিসাকে রুমনের কোলে রেখে ছবি সাজানো হয়েছে। এই কয়দিন মরিয়মের একটাই চেষ্টা ছিল তাদের জীবনে রামিসার ভূমিকাটা রুমনকে বোঝানো, যেন রুমনের জন্য রামিসাকে গ্রহণ করা সহজ হয়। রুমন এখনো রামিসাকে কোলে নেওয়ার সাহস না করলেও ছোট ছোট হাত পায়ের এই পুতুল বোনকে যে আপন করে নিয়েছে তা তার আচরণেই বোঝা যাচ্ছে। এইভাবে যদি পুরো পরিবার সাথে থাকে তাহলে নতুন এই পরীক্ষায় যে মরিয়ম সফল হবে তা সে আশাবাদী। বারবার করে সবাইকে বুঝিয়ে বলেছে দুষ্টুমির ছলেও কেউ যেন রামিসা রুমনকে মুখোমুখি না দাঁড় করায়। অর্থাৎ কেউ যেন এটা না বলে ‘বোন আসায় রুমনের আদর কমে যাবে, মা সময় দেবে না,বাবা বকবে’।
ছোট ছোট এই দুষ্টুমিগুলো যে একটা বাচ্চার মনে কী পরিমাণ ইনসিকিউরিটি সৃষ্টি করে তা বড়রা বোঝে না। মনের অজান্তেই তারা ভাইবোনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

বিদায়ের আগে মরিয়ম রুমিকে তার রুমে ডেকে নেয়,
“রুমি, এতদিন নিজের সন্তানদের চিন্তায় তোমার দিকে নজরই দিতে পারিনি। ধন্যবাদ রুমি আমার পাশে এইভাবে পুরোটা সময় থাকার জন্য। আমাকে বোনের অভাব পর্যন্ত বুঝতে দাওনি।”

“আপু, আমার চরম খারাপ সময় তুমি আর ভাইয়া ছিলে পাশে। সত্যি বলতে এখনো ঐ রাতের জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হয়। এরপর এসব বলে লজ্জা দিও না।”

“রুমি, রাকিনের সাথে যে অদৃশ্য দেয়ালটা তুমি তৈরি করেছ, তা ভাঙতে দেরি করো না। অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না যে সহ্যের শেষ সীমাটুকু কোথায়। আজ আমার শাশুড়ি মা নিজের ভুল বুঝেছেন, আমিও বুঝেছি। কিন্তু আমাদের মান অভিমানের বলি কিন্তু রামিসা হতে পারতো। আর তা হলে শত ক্ষমা চেয়েও আমরা কী নিজেরা নিজেদের মাফ করতে পারতাম? তুমি বুদ্ধিমতি, এর বেশি কিছু বলা লাগবে না জানি। তিতলিকে নানুর বাসা থেকে না আনলে আজ। মাঝে মাঝে ও নানুর বাসায় বেড়াতে যেতেই পারে, তাই না?”

গাড়িতে বসে মরিয়মের কথাগুলো মনে পড়তেই একটা সিদ্ধান্ত নেয় রুমি, রাকিনকে বলে, “রাকিন, তিতলি অনেকদিন পর আমাদের বাসায় গিয়েছে, আম্মা বলছিলেন আজ তিতলিকে ওখানে রাখবেন।”

“তাহলে তোমাকে ঐ বাসায় নামিয়ে দেব? তুমিও থাকবে?”

“নাহ্ এই বৃষ্টির দিনে উল্টো দিকে জার্নি করে না যাই। ক্লান্ত লাগছে, বাসায় যাব। তিতলি নতুন মামীকে নিয়ে ব্যস্ত আছে, কথা হয়েছিল ফোনে।”

“হ্যাঁ, আমারও কথা হয়েছে। জেসমিনের পরিবার বিয়ের আগে যেমন শর্ত দিচ্ছিলেন তাতে সবাই ভয়ে ছিল যে কেমন হয়। কিন্তু মনে হচ্ছে জেসমিন মেয়ে হিসেবে খারাপ না।”

“বিয়ের আগে ওদের সমস্যা আমি আর তিতলি ছিলাম। শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে ওদের আপত্তি ছিল না, কিন্তু আমাকে আর তিতলিকে নিয়ে ছিল। যাক আমি এতটুকুই চাই এই বয়সে আব্বা আম্মা নিশ্চিন্তে থাকুক। অনেক তো ওদের টেনশন দিলাম।”

রাকিন আলতো করে রুমির হাতে হাত রাখে। বাসায় ফিরে দেখে রাকিনের বোন দুলাভাই সবাই বাসায়।

“আসসালামু আলাইকুল ভাইয়া। আসসালামু আলাইকুম আপু। কখন আসলেন আপনারা?”

“এই তো আসলাম। কেন আমরা আসায় খুশি হওনি রুমি?”

সিমি আপুর এই স্বভাবের সাথে এখন পরিচিত রুমি। আপু কোন কথার উত্তর সহজ ভাবে দেবে না। প্রশ্নের উত্তরেও প্রশ্নই করবে। একই গাছের সব ফল কী আর সমান হয়, তাই হয়তো রাকিন আর রাকিনের আম্মা এত চমৎকার মানুষ কিন্তু সিমি আপু বড় জটিল।

“আপু অনেক খুশি হয়েছি। বাচ্চারা কোথায়?”

“ওদের সামনে পরীক্ষা তাই আনিনি। তোমরা কই ছিলে এতক্ষণ? তোমার মেয়ে কই?”

“আপু, আমাদের মেয়ের একটা নাম আছে, ‘তিতলি’। আর তিতলি ওর নানুর বাসায় আছে।”

এই সামান্য কথায় সিমি একটা হৈচৈ ফেলে দিলো। তবে এবার শক্ত হাতে মেয়েকে সামলালেন রাকিনের আম্মা, “সিমি, তুই জামাইবাবাজির সামনে যে এমন করিস, এতে তুই নিজে যেমন ছোট হোস তেমনি আমাদের ছোট করিস। এই বাসা আগে যেমন তোর ছিল, এখনো আছে। রুমি আর তিতলি এই বাসারই অংশ, সবার সাথে মিলেমিশে থাকলে ভালো থাকবি। আজ আমি আছি কাল নাই, তখন এই রুমি আর রাকিনই শুধু তোর আপন মানুষ থাকবে। তোর ভাবি হয়তো আজ নরম, কিন্তু তুই এমন ব্যবহার চালিয়ে গেলে একসময় ভাইয়ের সংসারে অনাহূত হয়ে যাবি। নিজের জায়গাটা নিজে নষ্ট করে পরে ভাবির দোষ দিবি যে বিয়ে করে ভাই আর বোন চেনে না।”

সিমি এই উপদেশেই বদলে গিয়েছে তা হয়তো নয়, তবে তখনকার মতো নিজেকে সামলে নিয়েছে। রাতে সবকিছু গুছিয়ে যখন রুমে আসে রুমি, রাকিন ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। রুমি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে শুয়ে পড়ে।

রাকিনের চোখটা একটু লেগে এসেছিল, হঠাৎ মনে হলো কে যেন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মনের ভুল ভেবে চোখ বন্ধ করতে চাইলেও নাক টানার শব্দ পায়। শব্দটা পরিচিত, দুপুরে এভাবেই কাঁদছিল রুমি। চকিতে পাশ ফেরে রাকিন। রুমির দুলে দুলে ওঠা শরীরই বলে দিচ্ছে, কাঁদছে রুমি। পিঠের উপর হাত রাখে রাকিন, “রুমি কী হয়েছে? আপুর কথায় এখনো মন খারাপ করে আছ? আম্মুতো আজ ভালো ভাবে বুঝিয়ে বলেছেন, দরকার হলে আমি আবার কথা বলবো। তুমি এত মন খারাপ করো না।”

রুমি উঠে বসে যায়। রুমিকে দেখে একটা কথা মনে পড়ে রাকিনের, হুমায়ুন আহমেদ বলতেন, কাঁদলে নাকি মেয়েদের সুন্দর লাগে। যদিও রাকিন এই কথার সত্যতা পায়নি। কাঁদলে চোখমুখ ফুলে সবাইকে কেমন অদ্ভুত লাগে। তবে যাকে আমরা ভালোবাসি, তাকে মনে হয় সর্বাবস্থায় সুন্দর লাগে। না হলে এই মুহূর্তে রুমিকে সাক্ষাৎ অপ্সরা কেন মনে হচ্ছে রাকিনের। মনে হচ্ছে কাছে টেনে নিয়ে রুমির দুচোখের সবটুকু জল শুষে নেয়।

“রাকিন, আমি আপুর কথায় কাঁদছি না। এরচেয়ে কঠিন কথা শোনার ও সহ্য করার ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু এই অবহেলা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”

“কে অবহেলা করলো?”

“তুমি। এই যে একই খাটে, একই সাথে শুয়েও মাঝে একটা কোলবালিশের দেয়াল তুলে রেখেছ। এটা অপমান অবহেলা নয়? তুমি কী বিয়ে করেও চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছ?”

রুমি তুমি করা বলা শুরু করেছে বলে খুশি হবে না, এমন অদ্ভুত অভিযোগ করছে বলে হাসবে, বুঝতে পারে না রাকিন।

“মনে না থাকলে বলি ম্যাডাম, এই দেয়াল আপনারই বানানো। তবে দেয়াল ভাঙার সক্ষমতার পরীক্ষা চাইলে তা এখনি হয়ে যাক।”

রাকিনের বুকে একটা আদুরে বিড়াল হয়ে মিশে যেতে যেতে রুমির মনে হয় জীবনটা ভীষণ সুন্দর, জীবনে সুখের মতো কষ্টও সাময়িক, নিশ্চয়ই কষ্টের পর সুখ আছে।

(সমাপ্তি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here